শিক্ষাপ্রশাসন জামায়াতিকরণ নয়

Daily Inqilab ইনকিলাব

২৭ জানুয়ারি ২০২৫, ১২:০২ এএম | আপডেট: ২৭ জানুয়ারি ২০২৫, ১২:০২ এএম

পতিত স্বৈরাচারের সাড়ে ১৫ বছরে অন্যান্য ক্ষেত্রের মতো শিক্ষা প্রশাসনও আওয়ামীকরণ করা হয়েছে। যে কোনো প্রতিষ্ঠানের অফিস সহকারী থেকে শুরু করে সর্বোচ্চ ব্যক্তি পর্যন্ত সবাই আওয়ামী লীগ নেতাকর্মী বা আওয়ামী লীগের সমর্থক হিসেবে নিয়োগের সুযোগ লাভ করেছে। যোগ্যতা, অভিজ্ঞতা, মেধা, সততার কোনো মূল্য দেয়া হয়নি। ফলে শিক্ষাপ্রশাসনে অনিয়ম, দুর্নীতি, লুটপাট বেপরোয়াভাবে চলেছে এবং গোটা শিক্ষাব্যবস্থা ভেঙ্গে পড়েছে। ইনকিলাবে প্রকাশিত এক খবরে বল হয়েছে, গত বছরের ৫ আগস্ট ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে স্বৈরাচার বিদায় নিলেও শিক্ষাপ্রশাসনে আওয়ামীপন্থীরা এখনো বহাল তবিয়াতে অবস্থান করছে। যে সব পদে পরিবর্তন হয়েছে বা হচ্ছে সেইসব পদে জামায়াত-অনুসারীরা নিয়োগ পেয়েছেন বা পাচ্ছেন। শিক্ষাপ্রশাসন আওয়ামীকরণ থেকে জামায়াতীকরণ হয়ে যাচ্ছে। আগের মতোই দক্ষ, অভিজ্ঞ ও মেধাবান এবং দলনিরপেক্ষ ব্যক্তিবর্গ বঞ্চিত থেকে যাচ্ছেন। এ নিয়ে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে এবং সংশ্লিষ্ট বিভিন্ন ক্ষেত্র ও পর্যায়ে ব্যাপক আলোচনা-সমালোচনা হচ্ছে। দলীয়করণ কোনো বিবেচনাতেই গ্রহণীয় নয়। আওয়ামীকরণ যদি অবাঞ্চিত ও ক্ষতিকর হয়, তবে জামায়াতীকরণও বাঞ্চিত ও সুফলদায়ী হতে পারে না। স্বাধীনতার পর থেকেই আমাদের শিক্ষা নিয়ে অহেতুক ও অপ্রয়োজনীয় পরীক্ষা-নিরীক্ষা চলছে। পতিত স্বৈরাচারের সময় এ পরীক্ষা-নিরীক্ষা বেশি করা হয়েছে। শিক্ষামন্ত্রী দীপুমনি ও নওফেলের সময় শিক্ষা আর জাতীয় নামাংকিত থাকেনি, তা পরিণত হয় ভারতীয় হিন্দুত্ববাদী শিক্ষার বর্ধিত অংশে। অন্তর্বর্তী সরকার ক্ষমতাসীন হওয়ার পর পাঠ্যক্রমে কিছু পরিবর্তন আনা হয়েছে বটে, তবে এখনো বহু বিতর্কিত বিষয় রয়ে গেছে। এ নিয়েও আলোচনা-সমালোচনা চলছে। যাহোক, শিক্ষাপ্রশাসন আওয়ামীকরণ যেমন দেশ ও জাতির জন্য কল্যাণকর হয়নি, তেমনি জামায়াতীকরণ হিতকর হতে পারে না। পর্যবেক্ষকরা মনে করেন, রাজনৈতিক দল হিসাবে জামায়াতের একটি রাজনৈতিক দর্শন আছে। তাদের শিক্ষাদর্শন রাজনৈতিক দর্শনের বাইরে নয়। রাজনৈতিক দল হিসেবে অনেকেই জামায়াতকে পছন্দ করে না, সমর্থন করে না। তার শিক্ষাদর্শনের ক্ষেত্রেও একথা প্রযোজ্য। শিক্ষাপ্রশাসনে জামায়াতপন্থীরা প্রাধান্য পেলে তারা জামায়াতের শিক্ষাদর্শন বাস্তবায়নের চেষ্টা করবেন, এটাই স্বাভাবিক। সেক্ষেত্রে একটা বড় ধরনের বিরোধ ও বিতর্ক সৃষ্টি হবে।

ইনকিলাবের খবরে উল্লেখ করা হয়েছে, ৫ আগস্টের পরে শিক্ষামন্ত্রণালয়ের শীর্ষ পদে নিয়োগ পান জামায়াতপন্থী এক কর্মকর্তা। তার মাধ্যমেই শিক্ষাপ্রশাসনের জামায়াতীকরণ শুরু হয়। তার হাত ধরেই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়, ইসলামী আরবী বিশ্ববিদ্যালয়সহ বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিসি, প্রোভিসি, ট্রেজারার ও অন্যান্য গুরুত্বপূর্ণ পদে নিয়োগ দেয়া হয় জামায়াতপন্থীদের। বাদ যায়নি শিক্ষাপ্রশাসনের অধিদফতর, মাদরাসা শিক্ষা বোর্ড, প্রাথমিক শিক্ষা অধিদফতর প্রভৃতি গুরুত্বপূর্ণ প্রতিষ্ঠানও। সর্বশেষ ২৩ জানুয়ারি মাদরাসা শিক্ষাবোর্ডের পরিচালনা পর্ষদ পুনর্গঠন করা হয়েছে। দেখা গেছে, যারা এ পর্ষদে সদস্য হিসাবে অন্তর্ভুক্ত হয়েছেন, তাদের অধিকাংশই জামায়াতপন্থী হিসেবে পরিচিত। অনুরূপভাবে ইসলামী আরবী বিশ্ববিদ্যালয়ের জন্য গঠিত সিন্ডিকেটেও প্রাধান্য পেয়েছেন জামায়াতপন্থীরা। ইসলামী আরবী বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিসি জানিয়েছেন, সিন্ডিকেট গঠনে দলীয় বিষয় দেখা হয়নি। গত সরকারের আমলে যারা বঞ্চিত ছিলেন, তাদেরই সুপারিশ করা হয়েছে। এখনো যারা সুযোগ পাওয়ার মতো আছেন, পরবর্তীতে তারাও সিন্ডিকেটে স্থান পাবেন। নিয়োগের ক্ষেত্রে শিক্ষা উপদেষ্টাকে জিজ্ঞাসা করা হলে তিনি ইনকিলাবকে জানিয়েছেন, আমরা বিভিন্ন পদে নিয়োগের ক্ষেত্রে সৎ মানুষ খুঁজছি। অনেক খোঁজাখুঁজির পর যখন নিয়োগ দিতে যাই তখন আবার নানা বিষয় চলে আসে। বলা বাহুল্য, প্রশাসনসহ বিভিন্ন ক্ষেত্রে নিয়োগ বা পদায়নের ক্ষেত্রে পতিত স্বৈরাচারের দোসরদের প্রভাব ছাড়াও বিভিন্ন পর্যায় থেকে চাপের কথা শোনা যায়। ছাত্রসমন্বয়কদের অনেকের বিরুদ্ধে এক্ষেত্রে হস্তক্ষেপ করার অভিযোগ রয়েছে। শিক্ষাপ্রশাসনে নিয়োগের ক্ষেত্রে তাদের ভূমিকা স্পষ্ট নয়। তবে পর্যবেক্ষকদের মতে, ছাত্রসমন্বয়কদের ৬০-৭০ শতাংশ ছাত্র শিবিরের নেতা-কর্মী বা সমর্থক। তাদের চাপ ও প্রভাব থাকা অসম্ভব নয়। এখানে বিশেষভাবে স্মরণ করা যেতে পারে, স্কুল, কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোতে ছাত্র শিবিরের সংগঠন এতদিন গোপন থাকলেও ৫ আগস্টের পর প্রকাশ্যে এসেছে। জামায়াত ও ছাত্র শিবিরকে মাওলানা মওদুদীর অনুসারী বা মওদুদীবাদী বলে উল্লেখ করা হয়। তাদের সঙ্গে অন্যান্য ইসলামীপন্থী দলের বিরোধ আছে। ইসলামপন্থী আরো যেসব ‘স্কুল’ আছে তাদের সঙ্গেও জামায়াত-শিবিরের বৈরিতা আছে। তারা কেউ চাইবে না শিক্ষায় মওদুদীবাদের বিস্তার ও বিকাশ সাধিত হোক।

আমাদের শিক্ষা ব্যবস্থায় মাদরাসা শিক্ষা প্রাচীনতম। বিভিন্ন পর্যায়ের লাখ লাখ মাদরাসা দেশে রয়েছে। মোটা দাগে আলিয়া ও কওমী ধারার মাদরাসার কথা উল্লেখ করা যায়। এসব মাদরাসায় লাখ লাখ শিক্ষক শিক্ষকতা করেছেন। দেশের মোট শিক্ষার্থীর অন্তত ১০ শতাংশ মাদরাসায় পড়াশোনা করে। আলিয়া ধারারই শিক্ষক সংখ্যা ৩ লাখের ওপর, শিক্ষার্থীদের সংখ্যা অন্তত ৭০ লাখ। কওমী ধারার শিক্ষক-শিক্ষার্থীদের সংখ্যা এরচেয়ে বেশি। এসব মাদরাসায় রাজনীতির চর্চা নেই। শিক্ষক যেমন রাজনীতির সম্পৃক্ততা থেকে মুক্ত থাকতে পছন্দ করেন, তেমনি শিক্ষর্থীরাও। শিক্ষাদান ও শিক্ষাগ্রহণেই তারা ব্যস্ত। মাদরাসাগুলোকে রাজনীতিমুক্ত রাখার ক্ষেত্রে প্রধান ও নিয়ামক ভূমিকা পালন করে আসছে মাদরাসা শিক্ষক-কর্মচারীদের বৃহত্তম অরাজনৈতিক সংগঠন জমিয়াতুল মোদার্রেছীন। স্বাধীনতার পর থেকে আজীবন এ সংগঠনের সভাপতির দায়িত্ব পালন করেন হযরত মাওলানা এম এ মান্নান (রহ.)। তিনি রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব হলেও সংগঠন ও মাদরাসাকে রাজনীতিতে টেনে আনেননি। বর্তমান সভাপতি ও ইনকিলাবের সম্পাদক এ এম এম বাহাউদ্দীনও তার পিতা হযরত মাওলানা এম এ মান্নান (রহ.) এর পদাংক অনুসরণ করে যাচ্ছেন। শিক্ষা প্রশাসন, মাদরাসা বোর্ড, ইসলামী আরবী বিশ্ববিদ্যালয়ে সিন্ডিকেট জামায়াতীকরণ হয়ে গেলে মাদরাসা শিক্ষার সুদীর্ঘ ঐতিহ্যের ব্যত্যয় ঘটবে, রাজনীতিকরণ শিক্ষাকে ব্যহত করেবে। সামগ্রিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হবে দেশ ও জাতি। এই বিবেচনা সামনে রেখে অন্তর্বর্তী সরকারের উচিত শিক্ষাপ্রশাসন ও মাদরাসাগুলোতে রাজনীতির অনুপ্রবেশ প্রতিরোধে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নেয়া। আমরা আশা করবো, শিক্ষাপ্রশাসনসহ সংশ্লিষ্ট ক্ষেত্রসমূহে রাজনীতিনিরপেক্ষ, সৎ, দক্ষ ও যোগ্য ব্যক্তিদের নিয়োগ নিশ্চিত করা হবে।


বিভাগ : সম্পাদকীয়


মন্তব্য করুন

HTML Comment Box is loading comments...

এই বিভাগের আরও

প্রসঙ্গ : অল্প সংস্কার ও দ্রুত নির্বাচন
সীমান্তে উত্তেজনা ও ঝুঁকি রোধে কার্যকর পদক্ষেপ নিতে হবে
গাজাকে বাসোপযোগী করতে হবে
ড. মুহাম্মদ ইউনূসেই জনগণের আস্থা
ঐক্যবদ্ধ মুসলিম উম্মাহই সময়ের দাবি
আরও

আরও পড়ুন

বৈষম্যহীন সমাজের তোমরাই হবে প্রধান চালিকা শক্তি

বৈষম্যহীন সমাজের তোমরাই হবে প্রধান চালিকা শক্তি

যারা ভাবছেন সংসদের কিছু চেয়ার দিয়ে ছাত্রদের কিনবেন, ভুল ভাবছেন: হাসনাত আবদুল্লাহ

যারা ভাবছেন সংসদের কিছু চেয়ার দিয়ে ছাত্রদের কিনবেন, ভুল ভাবছেন: হাসনাত আবদুল্লাহ

নওগাঁয় পর্দানশীল নারীদের মানববন্ধন

নওগাঁয় পর্দানশীল নারীদের মানববন্ধন

কাউকে ছেড়ে কথা বলব না, জামিন পেয়ে বললেন পরীমণি

কাউকে ছেড়ে কথা বলব না, জামিন পেয়ে বললেন পরীমণি

বিরল সীমান্তে বিজিবি ও বিএসএফ সেক্টর কমান্ডার পর্যায়ে সৌজন্য বৈঠক অনুষ্ঠিত

বিরল সীমান্তে বিজিবি ও বিএসএফ সেক্টর কমান্ডার পর্যায়ে সৌজন্য বৈঠক অনুষ্ঠিত

শেখ হা‌সিনা‌কে বি‌শ্বের ২৫৭‌টি রা‌ষ্ট্রের কেউ গ্রহণ করেনি  :  আমির হামজা

শেখ হা‌সিনা‌কে বি‌শ্বের ২৫৭‌টি রা‌ষ্ট্রের কেউ গ্রহণ করেনি : আমির হামজা

ফেব্রুয়া‌রির প্রথম সপ্তাহে আলজেরিয়া ও মিশর সফরে যাচ্ছেন পররাষ্ট্রস‌চিব

ফেব্রুয়া‌রির প্রথম সপ্তাহে আলজেরিয়া ও মিশর সফরে যাচ্ছেন পররাষ্ট্রস‌চিব

টানা সপ্তমবার বেলারুশের প্রেসিডেন্ট লুকাশেঙ্কো

টানা সপ্তমবার বেলারুশের প্রেসিডেন্ট লুকাশেঙ্কো

কোরআন শরিফ অবমাননার অভিযোগে আটক ১

কোরআন শরিফ অবমাননার অভিযোগে আটক ১

মোংলায় বিএনপির শীতবস্ত্র বিতরণ

মোংলায় বিএনপির শীতবস্ত্র বিতরণ

বিএনপি ক্ষমতায় আসলে সাধারন জনগন স্বাধীনতার সুফল ভোগ করবে: নুরুল ইসলাম নয়ন

বিএনপি ক্ষমতায় আসলে সাধারন জনগন স্বাধীনতার সুফল ভোগ করবে: নুরুল ইসলাম নয়ন

উত্তরায় ছিনতাইকারী-কিশোর গ্যাং গ্রেফতারে পুলিশের সাঁড়াশি অভিযান অব্যাহত

উত্তরায় ছিনতাইকারী-কিশোর গ্যাং গ্রেফতারে পুলিশের সাঁড়াশি অভিযান অব্যাহত

এবার নিউমার্কেট থানা ঘেরাওয়ের ঘোষণা ৭ কলেজ শিক্ষার্থীদের

এবার নিউমার্কেট থানা ঘেরাওয়ের ঘোষণা ৭ কলেজ শিক্ষার্থীদের

তথ্যের অবাধ প্রবাহ নিশ্চিতই দুর্নীতি প্রতিরোধ সম্ভব : জেলা প্রশাসক

তথ্যের অবাধ প্রবাহ নিশ্চিতই দুর্নীতি প্রতিরোধ সম্ভব : জেলা প্রশাসক

পঞ্চগড়ে প্রাইম ক্লিনিকের তৃতীয় তলা থেকে পড়ে শিশুর মৃত্যু

পঞ্চগড়ে প্রাইম ক্লিনিকের তৃতীয় তলা থেকে পড়ে শিশুর মৃত্যু

সকল ভেদাভেদ ভুলে গিয়ে ঐক্যবদ্ধ থাকতে হবে‌: হাসান সরকার

সকল ভেদাভেদ ভুলে গিয়ে ঐক্যবদ্ধ থাকতে হবে‌: হাসান সরকার

দৌলতপুরে রাস্তার দাবিতে মানববন্ধন

দৌলতপুরে রাস্তার দাবিতে মানববন্ধন

কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয়ের উন্নয়ন প্রকল্প : লালমাই পাহাড় ধ্বংসের বিষয়ে তদন্ত ও ব্যবস্থা গ্রহণের নির্দেশনা

কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয়ের উন্নয়ন প্রকল্প : লালমাই পাহাড় ধ্বংসের বিষয়ে তদন্ত ও ব্যবস্থা গ্রহণের নির্দেশনা

করিমগঞ্জে কৃষক সমাবেশ অনুষ্ঠিত

করিমগঞ্জে কৃষক সমাবেশ অনুষ্ঠিত

সন্দেহভাজন জাহাজ আটক করল সুইডেন

সন্দেহভাজন জাহাজ আটক করল সুইডেন