পিলখানা হত্যাকাণ্ডের বিচার নিয়ে বিভ্রান্তি কাম্য নয়

Daily Inqilab ইনকিলাব

৩১ জানুয়ারি ২০২৫, ১২:০৭ এএম | আপডেট: ৩১ জানুয়ারি ২০২৫, ১২:০৭ এএম

পিলখানায় বিডিআর বিদ্রোহের নামে মূলত একটি পরিকল্পিত গণহত্যা সংঘটিত করা হয়। নির্মম-নৃশংস সেই ঘটনায় সেনাবাহিনীর ৫৭ জন অফিসারকে হারিয়েছে জাতি। ভিকটিম ও প্রত্যক্ষদর্শীদের বর্ণনায় ম্যাসাকারের যে হৃদয়বিদারক ঘটনাবলী উঠে এসেছে, তাতে একে বিডিআর জওয়ানদের বিদ্রোহ বলে মেনে নেয়া যায় না। তবে কার্নেজ ও হত্যাকাণ্ডের সাথে বিপথগামী-বিভ্রান্ত বিডিআর জওয়ানদের প্রত্যক্ষ অংশগ্রহণের ঘটনাকে অস্বীকার করার কোনো উপায় নেই। পিলখানা হত্যাকাণ্ডের পর দেড় দশক পেরিয়ে গেলেও সেনা অফিসার হত্যার সাথে জড়িত নেপথ্যের মাস্টার মাইন্ড ও প্রকৃত দোষীরা এখনো শাস্তি বা ধরা-ছোঁয়ার বাইরেই রয়ে গেছে। উপরন্তু, পিলখানায় বিদ্রোহ ও কার্নেজের দায়ে অভিযুক্ত ও আটক শত শত বিডিআর জোয়ানকে নিরপরাধ আখ্যা দিয়ে মুক্তি দেয়া হচ্ছে। জুলাই বিপ্লবের পর চতুর্দিকে নানা রকম দাবি-দাওয়ার রব শুরু হয়েছে। এর মধ্যে পিলখানা হত্যায় আটক ও অভিযুক্তদের পরিবারও বাদ যায়নি। তাদের দাবির প্রেক্ষিতে ইতোমধ্যে ১৭৮ জন সাবেক বিডিআর সদস্য জামিন লাভ করেছে এবং অনেকে কারাগার থেকে মুক্তিও পেয়েছে। তবে পিলখানা ম্যাসাকারে শহীদ এবং প্রাণে বেঁচে যাওয়া সেনা অফিসার পরিবারের সদস্যরা পিলখানা হত্যাকাণ্ডে সাজাপ্রাপ্ত, অভিযুক্ত ও আটক ব্যক্তিদের ঢালাওভাবে মুক্তি দেয়ার বিষয়টিকে স্বাভাবিকভাবে মেনে নিতে পারছেন না। তারা এর প্রতিবাদে পাল্টা যুক্তি তুলে ধরে ঢাকায় সংবাদ সম্মেলন করেছেন।

 

গত বুধবার মহাখালীস্থ রাওয়া ক্লাবে আয়োজিত এক সংবাদ সম্মেলনে পিলখানা হত্যাকাণ্ডের ভিকটিম ও শহীদ পরিবারের সদস্যরা পিলখানা হত্যাকাণ্ডের বিচারে সাজাপ্রাপ্তদের ঢালাওভাবে নিরপরাধ বলা এবং মুক্তি দেয়ার চলমান প্রক্রিয়ায় গভীর উদ্বেগ ও ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন। বিডিআর কোর্টের সাজা নিয়ে প্রশ্ন তোলাকে তারা ৫৭ জন শহীদ সেনা অফিসারের আত্মার প্রতি অসম্মান করা এবং সেনাবাহিনীকে প্রশ্নবিদ্ধ করা বলে অভিহিত করেন। বিডিআর ম্যাসাকারের ঘটনার সাথে দেশি-বিদেশি ষড়যন্ত্র ও নেপথ্য ভূমিকার যেসব তথ্য-উপাত্ত বেরিয়ে এসেছে, তার আলোকে এই ঘটনার বিচার হয়নি। সে হিসেবে ইতোমধ্যে গৃহীত বিচার কার্যক্রমে প্রকৃত দোষী ও মাস্টারমাইন্ডদের আড়াল করার প্রয়াস লক্ষ করা গেছে। ২০০৯ সালের ২৫ ফেব্রুয়ারি পিলখানায় বিডিআরের দরবারের দিন সেখানে থাকা প্রায় ৫ হাজার বিডিআর সদস্যের অনেকে অস্ত্রাগারের তালা ভেঙ্গে প্রায় ৪ হাজার অস্ত্র ও বিপুল গোলাবারুদ লুটে নিয়ে সেনা অফিসার ও পরিবারের উপর তারা এলোপাথাড়ি গোলাগুলি করে হত্যা করেছে, নারী ও শিশুদের উপর নির্যাতন করেছে, বাসাবাড়িতে লুটপাট চালিয়েছে এবং মৃতদেহের চরম অবমাননা করেছে। সেসব ঘটনার ভিডিও ফুটেজ ও প্রত্যক্ষ সাক্ষী রয়েছে। ভিকটিম পরিবারের সদস্যদের কেউ কেউ কথিত বিদ্রোহী বিডিআর জওয়ানদের সাথে ভিন্ন ভাষা ও চেহারার লোকদের উপস্থিতির কথাও বিভিন্ন সময় তুলে ধরেছেন। যারা হত্যাকা-ে অংশগ্রহণ করেছে, যারা নেপথ্যে থেকে পরিকল্পনা বা প্লট সাজিয়েছে তাদের সবাইকে বিচারের আওতায় আনতে হবে। দেশি-বিদেশি সব কুশিলবের প্রকৃত ভূমিকা তুলে ধরার মাধ্যমে দেশের নিরাপত্তা ও স্বাধীনতা-সার্বভৌমত্বের বিরুদ্ধে গভীর ষড়যন্ত্রের ইতিহাস জাতির সামনে তুলে আনতে হবে।

পিলখানায় স্বজন হারানো সেনা পরিবারের সদস্যরা জাতির সূর্য সন্তানদের উত্তরাধিকারী। তাদের প্রতি জাতির অপূরণীয় দায় রয়েছে। সুষ্ঠু তদন্তের মধ্য দিয়ে পিলখানা হত্যাকাণ্ডের স্বচ্ছ বিচার নিশ্চিত করা জুলাই বিপ্লবত্তোর বাংলাদেশের নাগরিক সমাজের অন্যতম দাবি। সে বিষয়ে অন্তর্বর্তী সরকারের সুনির্দিষ্ট লক্ষ্য ও প্রতিশ্রুতি রয়েছে। তবে ইতোমধ্যে আটক ও সাজাপ্রাপ্ত বিডিআর সদস্যদের পরিবার গত ১৫ বছরে ভিকটিমদের নির্দোষ কিংবা মুক্তি দাবি না করলেও এখন তারা সে দাবি নিয়ে মাঠে নেমেছেন এবং তাদের দাবির প্রেক্ষিতেই ইতোমধ্যে শতাধিক বিডিআর সদস্য জামিনে মুক্তি লাভ করেছে। ভিকটিম সেনা অফিসারদের পরিবারের পক্ষ থেকে বিডিআর হত্যাকাণ্ডের সাথে পতিত স্বৈরাচারী সরকারের মন্ত্রী-এমপি এবং প্রধানমন্ত্রীর সংশ্লিষ্টতার জোরালো অভিযোগ রয়েছে। তাছাড়া প্রত্যক্ষ সাক্ষ্য-প্রমাণের ভিত্তিতে বিডিআর কোর্ট ও সিভিল কোর্টে যাদের শাস্তি হয়েছে তাদেরকে বেকসুর প্রমাণের সুযোগ নেই। পিলখানা হত্যাকাণ্ডের তদন্ত-বিচার প্রক্রিয়ায় কিছু ঘাটতিসহ নানা কারণে কিছু নিরপরাধ মানুষকে ফাঁসিয়ে দেয়াও অস্বাভাবিক নয়। তবে কার্নেজে অংশগ্রহণকারীদের ঢালাও জামিন ও মুক্তি দেয়া হলে তা ন্যায়বিচারের অন্তরায় হয়ে দাঁড়াতে পারে। নিরপরাধ কেউ সাজা পেয়ে থাকলে তাও উপযুক্ত প্রক্রিয়া অনুসরণ করে স্বচ্ছতার ভিত্তিতে তার ন্যায়সঙ্গত সমাধান নিশ্চিত করতে হবে। তার আগে কাউকে ঢালাও মুক্তি দেয়ার প্রক্রিয়া সমর্থনযোগ্য নয়। বিচার প্রক্রিয়া সম্পন্ন হওয়া পর্যন্ত ইতোমধ্যে জামিন ও মুক্তিপ্রাপ্তদের উপযুক্ত নজরদারির আওতায় রাখতে হবে। পিলখানায় বিডিআর বিদ্রোহ ও হত্যাকাণ্ড দেশ ও জাতির বিরুদ্ধে এক গভীর ষড়যন্ত্রের অংশ। বিগত সময়ের বিচারহীনতার সংস্কৃতি থেকে বেরিয়ে এসে শহীদ সেনা অফিসারদের হত্যাকাণ্ডের সাথে সরাসরি জড়িত, মাস্টারমাইন্ড ও নেপথ্যের কুশীলবদের বিচারের আওতায় এনে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দিতেই হবে। আগামী দিনে এ ধরনের ঘটনার পুনরাবৃত্তি রুখতেই পিলখানা হত্যাকা-ের সামগ্রিক বিচার নিশ্চিত করতে বিচার প্রক্রিয়াকে আরো গতিশীল করতে হবে।


বিভাগ : সম্পাদকীয়


মন্তব্য করুন

HTML Comment Box is loading comments...

এই বিভাগের আরও

বইমেলা দেশে দেশে
ভাষা আন্দোলনে ছাত্ররাই ছিল মূল ভূমিকায়
বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড কাম্য নয়
মাদকমুক্ত হোক ক্যাম্পাস
মাতৃভাষা বাংলা খোদার সেরা দান
আরও
X

আরও পড়ুন

স্থানীয় নির্বাচন বিতর্কে জাতীয় নির্বাচন পেছানো যাবে না -রিজভী

স্থানীয় নির্বাচন বিতর্কে জাতীয় নির্বাচন পেছানো যাবে না -রিজভী

ধর্ম নিয়ে ব্যবসা নয়,মানুষের সর্বশ্রেষ্ঠ জীবনবৃত্তান্ত হলো কোরআন- কাজী শিপন

ধর্ম নিয়ে ব্যবসা নয়,মানুষের সর্বশ্রেষ্ঠ জীবনবৃত্তান্ত হলো কোরআন- কাজী শিপন

অস্ত্রবাজির আতঙ্কে ঢাকার মানুষ

অস্ত্রবাজির আতঙ্কে ঢাকার মানুষ

ওয়াক আউট করল বাংলাদেশ

ওয়াক আউট করল বাংলাদেশ

রাষ্ট্রে ইসলাম বিজয়ী হলে সর্বস্তরের মানুষের অধিকার প্রতিষ্ঠিত হবে -পীর ছাহেব চরমোনাই

রাষ্ট্রে ইসলাম বিজয়ী হলে সর্বস্তরের মানুষের অধিকার প্রতিষ্ঠিত হবে -পীর ছাহেব চরমোনাই

আগে কখনো আমি এত অপমানিত বোধ করিনি -মাহমুদুর রহমান মান্না

আগে কখনো আমি এত অপমানিত বোধ করিনি -মাহমুদুর রহমান মান্না

রোজার ৯ পণ্যের আমদানি বেড়েছে

রোজার ৯ পণ্যের আমদানি বেড়েছে

সাবেক ইউপি সদস্য ও যুবদল নেতাকে প্রকাশ্যে কুপিয়ে হত্যা

সাবেক ইউপি সদস্য ও যুবদল নেতাকে প্রকাশ্যে কুপিয়ে হত্যা

মাতৃভাষা আল্লাহর বড় নেয়ামত

মাতৃভাষা আল্লাহর বড় নেয়ামত

লামায় অপহরণ কারী চক্রের ৪ জন গ্রেপ্তার

লামায় অপহরণ কারী চক্রের ৪ জন গ্রেপ্তার

একুশ সব ষড়যন্ত্রের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ানোর বীজমন্ত্র

একুশ সব ষড়যন্ত্রের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ানোর বীজমন্ত্র

মুক্ত বাতাসে শহীদদের স্মরণ

মুক্ত বাতাসে শহীদদের স্মরণ

দুর্নীতিবাজ সেই নির্বাহী প্রকৌশলী ছামিউলের ফিরে আসার খবরে জনমনে তীব্র অসন্তোষ

দুর্নীতিবাজ সেই নির্বাহী প্রকৌশলী ছামিউলের ফিরে আসার খবরে জনমনে তীব্র অসন্তোষ

হাব নির্বাচনকে কেন্দ্র করে তুমুল বাকবিতণ্ডা

হাব নির্বাচনকে কেন্দ্র করে তুমুল বাকবিতণ্ডা

কক্সবাজার টেকনাফ মেরিন ড্রাইভ সড়কে বিজিবির গাড়ির ধাক্কায় শিশু নিহত

কক্সবাজার টেকনাফ মেরিন ড্রাইভ সড়কে বিজিবির গাড়ির ধাক্কায় শিশু নিহত

ভার্চুয়ালি করা যাবে না বিমা কোম্পানির পরিষদ সভা

ভার্চুয়ালি করা যাবে না বিমা কোম্পানির পরিষদ সভা

দু’ঘণ্টার চেষ্টায় খিলগাঁওয়ের আগুন নিয়ন্ত্রণে

দু’ঘণ্টার চেষ্টায় খিলগাঁওয়ের আগুন নিয়ন্ত্রণে

নাস্তিক রাখাল রাহার সমুচিত বিচার নিশ্চিত করতে হবে

নাস্তিক রাখাল রাহার সমুচিত বিচার নিশ্চিত করতে হবে

ছাত্রদের মাঝে বিভেদ কাম্য নয় -খেলাফত মজলিসের আমির

ছাত্রদের মাঝে বিভেদ কাম্য নয় -খেলাফত মজলিসের আমির

ইত্তেফাকের সাবেক সাংবাদিক কাজী মোদাচ্ছের হোসেনের মৃত্যুবার্ষিকী আজ

ইত্তেফাকের সাবেক সাংবাদিক কাজী মোদাচ্ছের হোসেনের মৃত্যুবার্ষিকী আজ