ভারত এখনো অপতথ্য ছড়াচ্ছে
০৬ ফেব্রুয়ারি ২০২৫, ১২:০৯ এএম | আপডেট: ০৬ ফেব্রুয়ারি ২০২৫, ১২:০৯ এএম

মিথ্যা বলা, কম বলা কিংবা বেশি বলা তথা অপতথ্য প্রকাশ, গুজব ছড়ানো ইত্যাদি মারাত্মক ক্ষতিকর। এতে মানুষের মধ্যে মনোমালিন্য সৃষ্টি হয়, ঝগড়া-ফ্যাসাদ বাঁধে, মারামারি-হানাহানি-মামলা ইত্যাদি হয়। তাই এসবকে ধর্মীয় এবং দেশ-বিদেশের আইন অনুযায়ী অপরাধ এবং দ-নীয় অপরাধ। এই অপরাধে আইনত ও সামাজিক বিচারে শাস্তি হয়েছে অনেকের। তবুও মিথ্যা বলা, গুজব ছড়ানো, অপতথ্য প্রকাশ করা বন্ধ হয়নি! এসব ক্রমান্বয়ে বেড়েই চলেছে। নারী-পুরুষ নির্বিশেষে সব ধরনের ও সব বয়সের মানুষ কম-বেশি অপতথ্য প্রকাশ করে। অনেক ব্যবসায়ী, রাজনীতিবিদ, সামাজিক হর্তা-কর্তাও এ ক্ষেত্রে পিছিয়ে নেই। তবে, বাংলাদেশে গত জুলাই-আগস্ট গণঅভ্যুত্থানে ফ্যাসিস্ট আওয়ামী লীগ সরকারের পতন এবং তার প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা দেশ থেকে পালিয়ে ভারতে আশ্রয় গ্রহণের পর থেকে দেশে গুজব অতীতের সব রেকর্ড ভঙ্গ করেছে। এ ক্ষেত্রে অগ্রনী ভূমিকা পালন করছে দলটির গুজব বাহিনী! তারা অনবরত একের পর এক মিথ্যা, বানোয়াট কল্পকাহিনী ছড়াচ্ছে! এই অপকর্মে তারা মূল মিডিয়ার চেয়ে ফেসবুকসহ সব ধরনের সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ব্যবহার করছে। তাদের লক্ষ্য হারানো ক্ষমতা পুনরুদ্ধার এবং লুটপাট করে সম্পদশালী হওয়া। অনেক সাধারণ মানুষ তাদের এ অপকৌশল ধরতে পারছে না। ফলে, তারা চরম বিভ্রান্ত হচ্ছে। গুজব সম্প্রতি সর্বাধিক আলোচ্য বিষয়ে পরিণত হয়েছে। এই চরম ঘৃণ্য কাজে তথা মিথ্যাচারে ভারতও সংশ্লিষ্ট হয়েছে। দেশটির রাজনৈতিক, সামাজিক, সাংস্কৃতিক তথা সব স্তরের মানুষ এবং মিডিয়া ফ্যাসিস্ট আওয়ামী লীগ এবং শেখ হাসিনার পতনকে নিজেদের পতন মনে করে খাওয়া-নাওয়া ছেড়ে দিয়ে সার্বক্ষণিক চরম মিথ্যাচার করে যাচ্ছে। তারা মনে করে, আওয়ামী লীগই বাংলাদেশ। আর আওয়ামী লীগ তাদের টেস্টেড এন্ড ট্রাস্টেড অনুগত। অন্যরা শত্রু। তাই নট এলাউড। তারা আওয়ামী লীগের পক্ষে আর বাংলাদেশের বিরুদ্ধে অনবরত তথ্যবোমা ছুড়ছে। রিউমার স্কানার কিছুদিন আগে তথ্য যাচাই করে বলেছে, ভারত থেকে বাংলাদেশকে নিয়ে যা বলা হচ্ছে, তার অধিকাংশ মিথ্যা-বানোয়াট। তবুও ভারত বাংলাদেশ নিয়ে মিথ্যাচার বন্ধ করেনি! গুজব, মিথ্যা প্রচারণা প্রকাশ অব্যাহত রেখেছে। এতে বিশ্বে বাংলাদেশের ভাবমূর্তি ক্ষুণœ হচ্ছে। বাংলাদেশে ভারত বিরোধী মনোভাব বৃদ্ধি পাচ্ছে। ভারত ও বাংলাদেশের সম্পর্কের অবনতি হচ্ছে। সর্বোপরি, বাংলাদেশের বেশিরভাগ মানুষ ভারতমুখিতা ত্যাগ করে পূর্বমুখী যাত্রা শুরু করেছে। এতে ভারতের ব্যবসা-পর্যটনসহ নানাবিধ ক্ষতি হচ্ছে। দিল্লিস্থ ‘ইন্টারন্যাশনাল কাউন্সিল ফর রিসার্চ অন ইন্টারন্যাশনাল ইকনমিক রিলেশনস’-এর সমীক্ষা অনুযায়ী, ভারতের চিকিৎসা-পর্যটন শিল্পে সব থেকে বড় অংশীদার ছিল বাংলাদেশ। গত বছরের আগস্টে শেখ হাসিনা ক্ষমতাচ্যুত হওয়ার পরে ভারতের চিকিৎসা-পর্যটন ক্ষেত্র ধাক্কা খেয়েছে। চিকিৎসা-পর্যটক কমেছে। হাসপাতাল ও তার সঙ্গে যুক্ত বিভিন্ন ক্ষেত্রে যার প্রভাব দেখা যাচ্ছে। তবুও ভারতের আওয়ামী লীগপ্রীতি কমছে না! এর প্রধান কারণ, আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় থাকাকালে ভারত যা চেয়েছে, তার সবই পেয়েছে, বিনিময়ে কিছুই দিতে হয়নি। শেখ হাসিনা নিজেই বলেছেন, ভারতকে যা দিয়েছি, তা তারা কোনদিনই ভুলতে পারবে না। শেখ হাসিনার সঙ্গে ভারতেরও পরাজয় ঘটেছে। ফলে ভারত বাংলাদেশবিরোধী মিথ্যাচার অব্যাহত রেখেছে! গুজব বাহিনীর গুজবও বহাল রয়েছে। এ ক্ষেত্রে তারা ব্যাপক অর্থ ব্যয় করছে।
অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস গত ৩ জানুয়ারি বলেছেন, ক্ষমতাচ্যুত স্বৈরশাসক শেখ হাসিনার ঘনিষ্ঠরা বিশৃঙ্খলা সৃষ্টির জন্য বিশাল অঙ্কের অর্থ ব্যয় করছে এবং মিথ্যা ও অপতথ্য ছড়াচ্ছে। দেশবাসীকে এই অপপ্রচারের বিরুদ্ধে লড়াই করতে হবে। কাউকে বিশৃঙ্খলা ও অরাজকতা সৃষ্টির সুযোগ দেওয়া যাবে না। যুদ্ধ পরিস্থিতির মতো সতর্ক থাকতে হবে। প্রধান উপদেষ্টার প্রেস সচিব শফিকুল আলম গত ২৬ জানুয়ারি বলেছেন, যারা পালিয়েছে, তারাই গুজব ছড়াচ্ছে, যার বিরাট অংশ মিডিয়ায় প্রকাশিত হচ্ছে। রিউমর স্ক্যানার জানিয়েছে, গত জানুয়ারি মাসে ইন্টারনেটে ছড়িয়ে পড়া ২৭১টি ভুল তথ্য শনাক্ত করা হয়েছে। তন্মধ্যে তথ্যভিত্তিক ১১৫টি, ছবিকেন্দ্রিক ৫৪টি, ভিডিওকেন্দ্রিক ১০২টি। এছাড়া, মিথ্যা হিসেবে ১৭৫টি, বিভ্রান্তিকর হিসেবে ৬৫টি এবং বিকৃত হিসেবে ৩১টি ঘটনাকে সাব্যস্ত করা হয়েছে। এসব ফেসবুকে ২২৫টি, এক্সে ৫৬টি, টিকটকে ৪৪টি, ইউটিউবে ৪২টি, ইন্সটাগ্রামে ১৯টি, থ্রেডসে প্রচারিত হয়েছে। ভুল তথ্য প্রচারের তালিকা থেকে বাদ যায়নি দেশের গণমাধ্যমও। উপরন্তু ১৬টি ঘটনা দেশের একাধিক গণমাধ্যমে প্রচারিত হয়েছে। একই সময়ে ভারতে প্রকাশিত বাংলাদেশ সম্পর্কে সাতটি অপতথ্য প্রচার করা হয়েছে। ডিসমিস ল্যাব গত জানুয়ারি মাসে প্রকাশিত এক প্রতিবেদনে বলেছে, বাংলাদেশে কাজ করা আটটি তথ্য যাচাইকারী সংস্থা ২০২৪ সালে ৪ হাজার ৫০০ এর বেশি ভুয়া তথ্যের সত্যতা যাচাই করেছে, ২০২৩ সালের চেয়ে যা ৫৮ শতাংশ বেশি। সিজিএস’র নির্বাহী পরিচালক জিল্লুর রহমান গত ২৬ জানুযারি বলেছেন, তথ্য যাচাইয়ের দক্ষতা আধুনিক সাংবাদিকতার গুরুত্বপূর্ণ অংশ। ৫ জুলাই পরবর্তী সময়ে ভুল তথ্য ও গুজবের ব্যাপক বিস্তার জনসচেতনতা ও সামাজিক স্থিতিশীলতার জন্য হুমকি সৃষ্টি করছে। সঠিক সাংবাদিকতা নিশ্চিতে ফ্যাক্ট-চেকিং অপরিহার্য। তিনি সিজিএস’র নতুন মিস ইনফরমেশন ট্র্যাকিং প্ল্যাটফর্ম ‘ফ্যাক্ট-চেকিং হাব’ সম্পর্কে সাংবাদিকদের অবহিত করেন।
অপতথ্য প্রকাশে দেশের সরকারি প্রতিষ্ঠান-বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো বা বিবিএসও পিছিয়ে নেই। এই প্রতিষ্ঠানের তথ্য দেশ-বিদেশের কেউ তেমন বিশ্বাস করে না। বিশ্বে সংস্থাটির ভাবমূর্তির অবস্থান তলানিতে। বিশ্ব ব্যাংকের ২০২০ সালের স্ট্যাটিস্টিক্যাল ক্যাপাসিটি ইন্ডিকেটর অনুযায়ী, বিবিএস’র পদ্ধতিগত স্কোর ৩০ (১০০-এর মধ্যে)! যা’হোক, বিবিএস›র বেশিরভাগ তথ্যের সাথে আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলোর সাথে, বিশেষ করে বিশ্ব ব্যাংক, আইএমএফ ইত্যাদির তথ্যের সাথে ভিন্নতা থাকে অনেক। তবুও সংস্থাটির মানোন্নয়ন হয়নি। বরং অনেক অবনতি হয়েছে গত পতিত আওয়ামী লীগ সরকারের সময়ে। কিছুদিন আগে দাখিলকৃত দেশের শ্বেতপত্র কমিটি তাদের প্রতিবেদনে বলেছে, গত ফ্যাসিস্ট সরকারের অর্থমন্ত্রীর নির্দেশে বিবিএস বেশিরভাগ বিষয়ে তিলকে তাল আর তালকে তিল বানিয়েছে। আর সেটাকে মূলধন করে তৎকালীন সরকারি মন্ত্রী-এমপি-নেতারা বাংলাদেশকে বিশ্বের উন্নয়ন মডেল বলে জাহির করেছে। কিন্তু প্রকৃত ঘটনা হচ্ছে, পতিত আওয়ামী লীগ সরকারের সময়ে বাংলাদেশ উন্নয়নের নামে ঋণের ফাঁদে পড়েছে এবং লুটপাটের মডেলে পরিণত হয়েছে। শেখ পরিবার বিশ্বের মধ্যে শ্রেষ্ঠ বাটপার পরিবার বলে পরিচিতি পেয়েছে। এই পরিবারের লোকরা দেশ-বিদেশের যেখানেই রয়েছে, সেখানেই ব্যাপক লুটপাট করেছে। যার কিয়দাংশ ইতোমধ্যেই প্রকাশিত হয়েছে। যার সুষ্ঠু তদন্ত হচ্ছে দেশ-বিদেশে।
যা’হোক, গুজব বা অপতথ্যে দেশের ঐক্য, শান্তি ও উন্নতির চরম ক্ষতি হচ্ছে। তাই গুজব ও মিথ্যাচার বা অপতথ্য প্রকাশ বন্ধ করা জরুরি। কিন্তু সেটা প্রচারণা বন্ধ করে নয়। কারণ, সেটা স্বাধীন মত প্রকাশের অধিকারের পরিপন্থী। তাই বলে চুপচাপ বসে থাকলেও চলবে না। কারণ, একটি মিথ্যাকে কয়েকবার কয়েকভাবে প্রচার করলে সেটা বিশ্বাসযোগ্য হয়ে উঠে অনেকের কাছে। তাতে নানাবিধ ক্ষতি হয়। তাই বেআইনী কর্মকে আইনগতভাবে মোকাবেলা করতে হবে। আর সব মিথ্যাকে সত্য দিয়ে মোকাবেলা করতে হবে। এ দায়িত্ব সরকারের। সরকারের কর্তাব্যক্তিদের সব কথা হতে হবে সঠিক তথ্য ভিত্তিক। পাশাপাশি বিবিএসের প্রকাশিত সব তথ্যকে নির্ভুল, নিয়মিত ও ত্রৈমাসিক করতে হবে। তাহলে, মানুষ প্রকৃত তথ্য জানতে পারবে। অপরদিকে, রাজনৈতিক, সামাজিক ও ধর্মীয় নেতা-কর্মীদের উচিত মিথ্যা বা অতিরঞ্জিত কিছু না বলে সদা সত্য কথা বলা। সঠিক তথ্য প্রকাশের ক্ষেত্রে মিডিয়ার অগ্রনী ভূমিকা পালন করা দরকার। সন্দেহজনক কিছু হলেই তা বিধান অনুযায়ী দেখে কিংবা ফ্যাক্ট চেকিংয়ে যাচাই করে সঠিকটি প্রকাশ করতে হবে। এসব হলে গুজব বা মিথ্যাচার স্বল্প দিনের মধ্যে বন্ধ হয়ে যাবে। মানুষ অপতথ্যের কবল থেকে রক্ষা পাবে।
লেখক: সাংবাদিক ও কলামিস্ট।
sardarsiraj1955@gmail.com
বিভাগ : সম্পাদকীয়
মন্তব্য করুন
আরও পড়ুন

রাশিয়ার পক্ষে যুদ্ধে গেছে শত বাংলাদেশি

ইন্দুরকানীতে ডায়রিয়া রোগীর প্রকোপ হাসপাতালে কলেরা স্যালাইন সংকট

গাজায় মানবিক বিপর্যয় নিয়ে জাতিসংঘের উদ্বেগ, অবরোধ তুলে নেওয়ার আহ্বান

এসএসসি পরীক্ষাকেন্দ্রে ১৪৪ ধারা, কোচিং-ফটোকপি বন্ধসহ একগুচ্ছ নির্দেশনা

এশিয়ার শেয়ারবাজারে বড় ধস, তেলের দামেও পতন

গাজা ইস্যুতে সিসি ও ম্যাখোঁর সঙ্গে জর্দানের রাজার বৈঠক আজ

ঐকমত্য কমিশনের সংলাপ ফের শুরু আজ

সকালে ব্রিদিং এক্সারসাইজের উপকারিতা

মতলব দক্ষিণ থানার এসআই জীবন চৌধুরীর বেতন বন্ধের নির্দেশ

সাবেক এমপি কেরামত আলী গ্রেফতার

নীলফামারীর উত্তরা ইপিজেডে মেশিন বিস্ফোরণে ২জন শ্রমিক দগ্ধ

ট্রাম্পের সাথে বৈঠক করতে যুক্তরাষ্ট্রে ছুটলেন নেতানিয়াহু

বিক্ষোভে উত্তাল মণিপুর, নেতার বাড়িতে আগুন দিলো জনতা

ঢাকায় ৪ দিনব্যাপী বিনিয়োগ সম্মেলন আজ শুরু

ইয়েমেনে সর্বশেষ মার্কিন বিমান হামলায় নিহত ৪

মধ্যপ্রাচ্যের ৬ দেশকে হুমকি ইরানের, যুদ্ধের শঙ্কা

রাজধানীর বংশালে আগুন, নিহত ১, আহত ৭

গাজায় ইসরায়েলি বর্বরতার প্রতিবাদে বিশ্বজুড়ে আজ ধর্মঘট

দুর্ঘটনার কবলে জামায়াত নেতাকর্মীদের বহনকারী বাস, নিহত ৩

ঈদকে কেন্দ্র করে কৃষি নির্ভর বরিশাল অঞ্চলের অর্থনীতিতে নতুন প্রাণের সঞ্চার