তিস্তা মহাপরিকল্পনা দ্রুত বাস্তবায়ন করতে হবে

Daily Inqilab ইনকিলাব

১১ ফেব্রুয়ারি ২০২৫, ১২:০১ এএম | আপডেট: ১১ ফেব্রুয়ারি ২০২৫, ১২:০১ এএম

তিস্তা মহাপরিকল্পনা চলতি বছর ডিসেম্বরের মধ্যে চূড়ান্ত হবে বলে জানিয়েছেন পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তন এবং পানিসম্পদ উপদেষ্টা সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান। গত রোববার বিকালে রংপুর কাউনিয়া উপজেলার তিস্তা রেলব্রিজ প্রাঙ্গনে ‘তিস্তা বিষয়ক করণীয়’ শীর্ষক গণশুনানি অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথির বক্তব্যে তিনি একথা বলেন। অনুষ্ঠানে বিশেষ অতিথি ছিলেন স্থানীয় সরকার, পল্লীউন্নয়ন ও সমবায় উপদেষ্টা আসিফ মাহমুদ সজীব ভূঁইয়া। ওয়াবিকহাল মহলের অজানা নেই, ভারতীয় বাধা ও পতিত স্বৈরাচারের অনীহার কারণে তিস্তা মহাপরিকল্পনা বাস্তবায়নের আশা প্রায় শেষ হয়ে গিয়েছিল। অন্তর্বর্তী সরকার ক্ষমতায় আসার পর এ মহাপরিকল্পনা বাস্তবায়নে আশার আলো দেখা দিয়েছে। অন্তর্বর্তী সরকার ইতোমধ্যে এ নিয়ে চীনের সঙ্গে কথাবার্তা শুরু করেছে। পররাষ্ট্র উপদেষ্টার চীন সফরের সময় এ মহাপরিকল্পনা বিষয়ে কথাবার্তা হয়েছে এবং চীন ইতিবাচক সাড়া দিয়েছে। এই প্রেক্ষাপটে উপদেষ্টা সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান ও আসিফ মাহমুদ সজীব ভূঁইয়া সরেজমিনে তিস্তা বিষয়ক গণশুনানি অনুষ্ঠানে হাজির হয়ে তিস্তাপাড়ের মানুষের অভিমত শুনেছেন ও নিজেদের মতামত ব্যাক্ত করেছে। সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান তিস্তা মহাপরিকল্পনা সম্পর্কে সংক্ষেপে বলেছেন, ২০১৬ সালে তিস্তা মহাপরিকল্পনা বিষয়ে একটি চুক্তি হয়। চুক্তি অনুযায়ী চীন একটি পরিকল্পনা দেয়। পরিকল্পনাটি ফের যখন চীনের কাছে পাঠানো হয়, তখন চীন অভিমত দেয়, যেভাবে পরিকল্পনা সাজানো হয়েছে, তাতে তা স্থায়ী হবে না। এখন চীন আবার দু’বছরের সময় চেয়েছে এবং বর্তমান সরকার সেটা দিতে সম্মত হয়েছে। উপদেষ্টা আরো জানিয়েছেন, সরকার নতুন করে দুটি শর্ত আরোপ করেছে। তার একটি হলো, মহাপরিকল্পনায় যে বিষয়গুলো থাকবে বা থাকবে না, তা নিয়ে তিস্তাপাড়ের মানুষের মতামত নিতে হবে। অপর শর্তটি হলো, ২০২৫ সালের ডিসেম্বরের মধ্যে মহাপরিকল্পনা চূড়ান্ত করতে হবে। আসিফ মাহমুদ সজীব ভূঁইয়া তার বক্তব্যে বলেছেন, তিস্তা মহাপরিকল্পনার একটি খসড়া ঘুরে বেড়াচ্ছে। আওয়ামী সরকার ভারতে গিয়ে সে দেশের প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে শুধু ছবি তুলেছে, তিস্তা নিয়ে কোনো কথা বলার সাহস পায়নি। তিস্তার পানির ন্যায্য হিস্যা আদায় করতে পারেনি। উল্লেখ করা যেতে পারে, তিস্তার পানি বণ্টন সংক্রান্ত একটি চুক্তি সম্পাদনের চূড়ান্ত মুহূর্তে ভারতের অনীহায় পরিত্যক্ত হয়। এরপর বছরের পর বছর অতিবাহিত হলেও আর চুক্তি হয়নি। চুক্তি নিয়ে আলাপ পর্যন্ত বন্ধ হয়ে গেছে। তিস্তা উত্তরাঞ্চলের দুঃখ হিসাবে পরিগণিত। শুকনো মওসুমে পানির অভাবে আবাদ-উৎপাদন, প্রকৃতি-পরিবেশে, জীববৈচিত্র্য ব্যাপকভাবে ক্ষতির সম্মুখীন হয়। বর্ষায় বন্যা ও নদী ভাঙ্গনে মানুষ পথে বসতে বাধ্য হয়। বিপুল সম্ভাবনা থাকলেও উত্তরাঞ্চলের মানুষ চরম দারিদ্রের শিকার। বাংলাদেশের উজানে ভারতের সিকিম ও পশ্চিমবঙ্গে তিস্তার ওপর বাঁধ ও বিদ্যুৎকেন্দ্র স্থাপনা করে পানি প্রত্যাহার করার কারণে উত্তরাঞ্চলের দুঃখের অবসান ঘটছে না।

চীন বাংলাদেশের অনুরোধেই তিস্তা মহাপরিকল্পনার সম্ভাব্যতা সমীক্ষা, প্রকল্প গ্রহণ ও বাস্তবায়নে সম্মত হয়। প্রকল্পের যাবতীয় ব্যয় বহন ও অন্যান্য সহযোগিতা করতেও রাজি হয়। সে মোতাবেক সমীক্ষা ও প্রকল্প তৈরি হয়। কিন্তু তা আর বাস্তবায়নের মুখ দেখেনি। মহাপরিকল্পনা সম্পর্কে যতটুকু জানা যায়, তাহলো, তিস্তার ১১৫ কিলোমিটারে ব্যাপক খনন করে গভীরতা ১০ মিটারে বাড়ানো হবে। একই সঙ্গে এর প্রশস্ততা কমিয়ে আনা হবে। নদীশাসনে বিপুল ভূমি উদ্ধার করে সেখানে চাষাবাদ করা হবে। নদীর দুই পাড়ে চার লেনের সড়ক হবে। উপযুক্তস্থানে কয়েকটি ব্যারাজ-কাম রোড নির্মাণ করে জলাধারে পরিণত করা হবে। এর পানিতে উভয় তীরে সেচ বিস্তার করা হবে। উভয় তীরে শিল্পায়ন ও নগরায়ন হবে। দারিদ্র্যপীড়িত উত্তরাঞ্চলের উন্নয়ন ও অর্থনৈতিক বিকাশে তিস্তা মহাপরিকল্পনা কী বিরাট ভূমিকা পালন করতে পারে, তা বিশদ ব্যাখ্যার অপেক্ষা রাখে না। এতদিনেও কেনো প্রকল্পটি আলোর মুখ দেখেনি তা আগেই উল্লেখ করেছি। ভারত বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছে এবং তার দাস্যদাস হাসিনা সরকার অনাগ্রহ প্রদর্শন করেছে। চীনের দ্বারা প্রকল্প বাস্তাবায়নে ভারতের নিরাপত্তা বিঘিœত হতে পারে বলে ভারত দাবি করেছে। এ দাবি সম্পূর্ণ অবান্তর হলেও হাসিনা সরকার তা মেনে নিয়েছে। অতঃপর ভারত নিজেই তিস্তা মহাপরিকল্পনা বাস্তবায়নের পাল্টা প্রস্তাব দিয়েছে এবং সরকার তাতে সম্মতি জানিয়েছে। এভাবে চীনা মহাপরিকল্পনা বাস্তবায়ন অনিশ্চিত হয়ে গিয়েছে। ভারতের গোলাম সরকার বিদায় নিয়েছে। এখন অনুকূল সময় এসেছে। উত্তরাঞ্চলের মানুষসহ গোটা দেশের মানুষ অবিলম্বে তিস্তা মহাপরিকল্পনার বাস্তবায়ন চায়। তাদের এই চাওয়াকে অন্তর্বর্তী সরকারের সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার দিতে হবে। তিস্তা মহাপরিকল্পনা চূড়ান্ত করার যে সময়রেখা সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান দিয়েছেন, তার যেন অন্যথা না হয়। স্মরণ রাখতে হবে, এ সরকার থাকতে থাকতেই তিস্তা মহাপরিকল্পনার কাজ শুরু করতে হবে। কাজ শুরু হলে, বলা যায়, অর্ধেক কাজ হয়ে গেলো।

দুঃখজনক হলেও বলতে হচ্ছে, নদীমাতৃক এই দেশে সবচেয়ে বিপন্ন হয়ে পড়েছে নদী। ভারতের পানি আগ্রাসন এবং দখল ও দূষণে নদীগুলোর অধিকাংশই বিপন্ন হয়ে পড়েছে বড় নদী বড় খালে পরিণত হয়েছে। ছোট নদী অধিকাংশই হারিয়ে গেছে। উত্তরাঞ্চলের নদীগুলোর বেশিরভাগই পদ্মা ও তিস্তার পানির ওপর নির্ভরশীল। এ দুটি নদী ভারতের পানি আগ্রাসনের ভয়াবহ শিকার। অন্যদিকে উত্তরাঞ্চলসহ গোটা দেশেই নদী দখল হয়ে যাচ্ছে। দূষণেরও শেষ নেই। রাজধানীর চারপাশের নদী, দখল-দূষণে নদীর চরিত্রই হারাতে বসেছে। বুড়িগঙ্গা ময়লা আবর্জনার ভাগাড়, শীতলক্ষা, তুরাগ, ধলেশ্বরীও ব্যতিক্রম নয়। এসব নদীর পানি এতটাই দূষিত যে, মাছ বা অন্য কোনো জলজ প্রাণী বাঁচতে পারে না। দখল নিরোধ, দূষণ প্রতিরোধে অতীতে অনেক অঙ্গীকার, অনেক পরিকল্পনা নেয়ার কথা বলা হয়েছে। কাজের কাজ কিছু হয়নি। মাঝখান থেকে বিপুল অংকের অর্থ বিনষ্ট হয়েছে। বলা হয়, নদী বাঁচলে বাংলাদেশ বাঁচবে। কথাটা মিথ্যে নয়। প্রশ্ন উঠতে পারে, নদী বাঁচানোর পরিকল্পিত উদ্যোগ কই? নদীকে জীবন্ত সত্তা হিসেবে ঘোষণা করা হয়েছে। অথচ, অবহেলায়-উপেক্ষায় নদীর অকাল মৃত্যু সাধারণ বিষয়ে পরিণত হয়েছে। পরিবেশ, বন ও জলবায়ু উপদেষ্টা সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান একইসঙ্গে পানিসম্পদ উপদেষ্টাও বটে। তার দায়িত্বের পরিধি বিশাল। দূষণ সর্বত্র। পানি, বায়ু, শব্দ, পরিবেশ কোথায় দূষণ নেই? দখলে-দূষণে নদী হারাচ্ছে। নদী রক্ষণও তার দায়িত্ব। এ ব্যাপারে কিছু কাজ চলছে। রাজধানীর খাল উদ্ধারের উদ্যোগ নেয়া হয়েছে। চিহ্নিত ২১টি খালের মধ্যে ৬টির সংস্কারের কাজ হাতে নেয়া হয়েছে। রাজধানীর বায়ু দূষণ ও শব্দ দূষণ রোধে এখনো তেমন কোনো অগ্রগতি হয়নি। এখনো ঢাকা বায়ু দূষণে বিশ্বসেরা। সার্বিক পরিবেশের উন্নতির সঙ্গে জনস্বাস্থ্য, অর্থনীতি, জীবনযাপন, জীববৈচিত্র্য ইত্যাদির সম্পর্ক ওতপ্রোত।


বিভাগ : সম্পাদকীয়


মন্তব্য করুন

HTML Comment Box is loading comments...

এই বিভাগের আরও

মিয়ানমারে ভূমিকম্প এবং আমাদের ভয়
ড. মুহাম্মদ ইউনূসের উচিৎ কথা
আইএমএফ’র ঋণের প্রশ্নে সরকারকে কঠোর অবস্থান নিতে হবে
মুক্তিযুদ্ধ থেকে ছাত্র-জনতার অভ্যুদয়
শিক্ষাব্যবস্থার ব্ল্যাকবক্স খোলার এখনই সময়
আরও
X

আরও পড়ুন

রাশিয়ার পক্ষে যুদ্ধে গেছে শত বাংলাদেশি

রাশিয়ার পক্ষে যুদ্ধে গেছে শত বাংলাদেশি

ইন্দুরকানীতে ডায়রিয়া রোগীর প্রকোপ হাসপাতালে কলেরা স্যালাইন সংকট

ইন্দুরকানীতে ডায়রিয়া রোগীর প্রকোপ হাসপাতালে কলেরা স্যালাইন সংকট

গাজায় মানবিক বিপর্যয় নিয়ে জাতিসংঘের উদ্বেগ, অবরোধ তুলে নেওয়ার আহ্বান

গাজায় মানবিক বিপর্যয় নিয়ে জাতিসংঘের উদ্বেগ, অবরোধ তুলে নেওয়ার আহ্বান

এসএসসি পরীক্ষাকেন্দ্রে ১৪৪ ধারা, কোচিং-ফটোকপি বন্ধসহ একগুচ্ছ নির্দেশনা

এসএসসি পরীক্ষাকেন্দ্রে ১৪৪ ধারা, কোচিং-ফটোকপি বন্ধসহ একগুচ্ছ নির্দেশনা

এশিয়ার শেয়ারবাজারে বড় ধস, তেলের দামেও পতন

এশিয়ার শেয়ারবাজারে বড় ধস, তেলের দামেও পতন

গাজা ইস্যুতে সিসি ও ম্যাখোঁর সঙ্গে জর্দানের রাজার বৈঠক আজ

গাজা ইস্যুতে সিসি ও ম্যাখোঁর সঙ্গে জর্দানের রাজার বৈঠক আজ

ঐকমত্য কমিশনের সংলাপ ফের শুরু আজ

ঐকমত্য কমিশনের সংলাপ ফের শুরু আজ

সকালে ব্রিদিং এক্সারসাইজের উপকারিতা

সকালে ব্রিদিং এক্সারসাইজের উপকারিতা

মতলব দক্ষিণ থানার এসআই জীবন চৌধুরীর বেতন বন্ধের নির্দেশ

মতলব দক্ষিণ থানার এসআই জীবন চৌধুরীর বেতন বন্ধের নির্দেশ

সাবেক এমপি কেরামত আলী গ্রেফতার

সাবেক এমপি কেরামত আলী গ্রেফতার

নীলফামারীর উত্তরা ইপিজেডে মেশিন বিস্ফোরণে ২জন শ্রমিক দগ্ধ

নীলফামারীর উত্তরা ইপিজেডে মেশিন বিস্ফোরণে ২জন শ্রমিক দগ্ধ

ট্রাম্পের সাথে বৈঠক করতে যুক্তরাষ্ট্রে ছুটলেন নেতানিয়াহু

ট্রাম্পের সাথে বৈঠক করতে যুক্তরাষ্ট্রে ছুটলেন নেতানিয়াহু

বিক্ষোভে উত্তাল মণিপুর, নেতার বাড়িতে আগুন দিলো জনতা

বিক্ষোভে উত্তাল মণিপুর, নেতার বাড়িতে আগুন দিলো জনতা

ঢাকায় ৪ দিনব্যাপী বিনিয়োগ সম্মেলন আজ শুরু

ঢাকায় ৪ দিনব্যাপী বিনিয়োগ সম্মেলন আজ শুরু

ইয়েমেনে সর্বশেষ মার্কিন বিমান হামলায় নিহত ৪

ইয়েমেনে সর্বশেষ মার্কিন বিমান হামলায় নিহত ৪

মধ্যপ্রাচ্যের ৬ দেশকে হুমকি ইরানের, যুদ্ধের শঙ্কা

মধ্যপ্রাচ্যের ৬ দেশকে হুমকি ইরানের, যুদ্ধের শঙ্কা

রাজধানীর বংশালে আগুন, নিহত ১, আহত ৭

রাজধানীর বংশালে আগুন, নিহত ১, আহত ৭

গাজায় ইসরায়েলি বর্বরতার প্রতিবাদে বিশ্বজুড়ে আজ ধর্মঘট

গাজায় ইসরায়েলি বর্বরতার প্রতিবাদে বিশ্বজুড়ে আজ ধর্মঘট

দুর্ঘটনার কবলে জামায়াত নেতাকর্মীদের বহনকারী বাস, নিহত ৩

দুর্ঘটনার কবলে জামায়াত নেতাকর্মীদের বহনকারী বাস, নিহত ৩

ঈদকে কেন্দ্র করে কৃষি নির্ভর বরিশাল অঞ্চলের অর্থনীতিতে নতুন প্রাণের সঞ্চার

ঈদকে কেন্দ্র করে কৃষি নির্ভর বরিশাল অঞ্চলের অর্থনীতিতে নতুন প্রাণের সঞ্চার