ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে আওয়ামী লীগের কবর রচিত হয়েছে

Daily Inqilab জামালউদ্দিন বারী

১২ ফেব্রুয়ারি ২০২৫, ১২:০১ এএম | আপডেট: ১২ ফেব্রুয়ারি ২০২৫, ১২:০১ এএম

ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানের ৬ মাসের মাথায় পতিত স্বৈরাচারের উস্কানিমূলক বক্তব্য ও নিষিদ্ধ ঘোষিত সংগঠন ছাত্রলীগকে রাজনৈতিক কর্মসূচি পালনের নির্দেশনা ঘিরে বিপ্লবী ছাত্র-জনতা আবারো রাজপথে নেমে আসতে বাধ্য হয়। গত ৫ ফেব্রুয়ারি গণঅভ্যুত্থানে হাসিনার পলায়নের ৬ মাসের মাথায় হাসিনা দিল্লি থেকে নিষিদ্ধ ঘোষিত ছাত্রলীগের সাথে একটি ভার্চুয়াল সভায় ভাষণ দেয়ার আনুষ্ঠানিক ঘোষণা দেয়ায় ছাত্র-জনতার প্রতিরোধের অগ্নিস্ফূলিঙ্গ দাবানলের মতো ছড়িয়ে পড়ে। ১ ফেব্রুয়ারি থেকে ছাত্রলীগ-আওয়ামী লীগের অন্তর্বর্তী সরকারবিরোধী লিফলেট বিতরণ, গণসংযোগ, হরতাল ইত্যাদি মাসব্যাপী রাজনৈতিক কর্মসূচি ঘোষণা অনেকটা ঝিমিয়ে পড়া বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনে যেন নতুন শক্তিতে জেগে উঠার মন্ত্র খুঁজে পেল। ৫ আগস্ট গণঅভুত্থান সফল হলেও ১৬ বছরে স্বৈরাচারের হাতে গড়া সামরিক-বেসামরিক প্রশাসন, পুলিশ ও আমলাতন্ত্র অক্ষত থাকায় স্বৈরতন্ত্রের লেসপেন্সার, দুর্নীতিবাজ, দখলবাজ, অর্থপাচারকারি মন্ত্রী-এমপি, গুম-খুনের জন্য দায়ী ব্যক্তি, ছাত্র-জনতার উপর গুলি চালানো ও নির্দেশদাতা কর্মকর্তাদের প্রায় সবাই নিরাপদে আত্মগোপনে চলে যায়। পরবর্তীতে সেনাবাহিনী সুত্রে জানা যায়, শেখ হাসিনা ও শেখ রেহানাকে ভারতে পাঠিয়ে দেয়ার পাশাপাশি আওয়ামী লীগ ও হাসিনা সরকারের সংশ্লিষ্ট ৬ শতাধিক ব্যক্তিকে কয়েক সপ্তাহ ধরে সেনানিবাসের অভ্যন্তরে নিরাপত্তা হেফাজতে রেখে পালিয়ে যাওয়ার সেইফ এক্সিট দেয়া হয়েছে। যেখানে স্বৈরাচার শেখ হাসিনা ক্ষমতায় আঁকড়ে থাকতে মাত্র দুই সপ্তাহের মধ্যে ২ হাজারের বেশি ছাত্র-জনতাকে গুলি করে হত্যা করেছে, ৩০ হাজারের বেশি মানুষকে চিরতরে আহত, পঙ্গু ও অন্ধ করে দিয়েছে, সেখানে হাসিনা পালিয়ে যাওয়ার পর ৬ মাসেও গুম-খুন, গণহত্যার সাথে জড়িত স্বৈরাচারের দোসর কয়েক হাজার নেতাকর্মীকেও গ্রেফতার ও বিচারের সম্মুখীন করা যায়নি। সরকারের এই ব্যর্থতা ছাত্র-জনতার মনে বিরূপ প্রভাব সৃষ্টি করেছে। মাঠের বাস্তবতায় এ সংক্ষোভ ক্রমে বেড়েই চলেছে। দিল্লিতে বসে শেখ হাসিনার সীমাহীন আস্ফালন এবং দেশকে অস্থিতিশীল করার উস্কানি সেই সংক্ষোভের আগুনে যেন ঘৃত সংযোগ ঘটিয়েছে। পাঁচ ফেব্রুয়ারি রাতে শেখ হাসিনার ভার্চুয়াল ভাষণের জবাবে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন ও নাগরিক কমিটির পক্ষ থেকে পাল্টা কর্মসূচি হিসেবে একই সময়ে দেশের গণমাধ্যম ও ভার্চুয়াল প্ল্যাটফর্মে জুলাই বিপ্লবের গণহত্যার ডকুমেন্টারি ও বিশেষ বুলেটিন প্রকাশের কর্মসূচি ঘোষণা করা হয়। হাজারো মানুষ হত্যা করে দেশ ছেড়ে পালিয়ে যাওয়ার ৬ মাস পরও স্বৈরাচার হাসিনা ও তার দোসররা ন্যুনতম আত্মসমালোচনা, অনুশোচনা কিংবা জাতির কাছে ক্ষমা চাওয়ার প্রয়োজন বোধ করছে না। উপরন্তু নিষিদ্ধ ঘোষিত ছাত্রলীগকে আবারো সন্ত্রাসের পথ বেছে নেয়ার নির্দেশনা দিয়ে বিক্ষুব্ধ জনতার ক্ষোভ ও উত্তেজনা বাড়িয়ে শেখ পরিবারের স্বৈরশাসনের আইকন শেখ মুজিব ও ধানমন্ডির ৩২ নম্বরের বাড়ি গুঁড়িয়ে দেয়ার মতো কঠোর কর্মসূচি বাস্তবায়নের দিকে ধাবিত করে। ফ্রান্সের প্যারিস থেকে মিডিয়া অ্যাক্টিভিস্ট পিনাকী ভট্টাচার্য বত্রিশ নম্বরের বাড়ি গুঁড়িয়ে দিতে বুলডোজার মার্চ কর্মসূচির ডাক দিলে শত শত মানুষ বাড়িটি গুঁড়িয়ে দিতে এগিয়ে আসে। সেনাবাহিনী সেই জন¯্রােতকে আটকানোর চেষ্টা করেও ব্যর্থ হয়ে ফিরে যেতে বাধ্য হয়েছে। ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানের ৬ মাসের মাথায় এ যেন ৬ আগস্ট বিপ্লবের দ্বিতীয় দিনের উন্মাদনা। আওয়ামী ফ্যাসিবাদের কুশীলবরা আত্মগোপনে কিংবা দেশছেড়ে পালিয়ে গেলেও তাদের বাড়ি-ঘর, মুজিবের অনেক মূর্তি, ম্যুরাল, নামাঙ্কিত প্রতিষ্ঠান অক্ষত ছিল। এবারের প্রত্যাঘাতে ফ্যাসিবাদের সেসব অবশিষ্ট স্মৃতিফলক ও স্থাপনাগুলো গুঁড়িয়ে দিয়ে নতুন বাংলাদেশের সূচনাপর্বের দ্বিতীয় ধাপে পদার্পণ করেছে।

সরকার পরিবর্তন যেভাবেই হোক, দেশে একটি বিপুল জনসমর্থিত সরকার রয়েছে। দেশকে অস্থিতিশীল করার নানামুখী ষড়যন্ত্রও অব্যাহত রয়েছে। এহেন বাস্তবতায় আবারো বিক্ষুব্ধ ছাত্র-জনতার ভাঙ্গচুরের ভূমিকা কাম্য ছিল না। পতিত স্বৈরাচারের রেখে যাওয়া পুলিশ, সামরিক বাহিনী, আমলাতন্ত্র এবং অন্তর্বর্তী সরকারের ভেতরে থাকা মুখোশধারি এজেন্টরা ছাত্র-জনতার আকাক্সক্ষার সাথে বিশ্বাসঘাতকতা করে পতিত স্বৈরাচারকে রাজনৈতিকভাবে পুর্নবাসিত করার দ্বারপ্রান্তে টেনে আনার অপপ্রয়াস থেকেই বিপ্লবের অতন্দ্র প্রহরী ছাত্র-জনতা নতুনভাবে মাঠে নামতে বাধ্য হয়েছে। যদিও এটি রাষ্ট্রের স্থিতিশীলতার জন্য সুখকর বিষয় নয়। ধানমন্ডি ৩২ নম্বরের ঐতিহাসিক বাড়িটি বুলডোজার দিয়ে ভাঙ্গার পর অনেক অপ্রকাশিত ইতিহাস ও নতুন নতুন তথ্য জাতির সামনে উঠে আসছে। এসব তথ্য নতুন প্রজন্মের কাছে অজানা অপ্রকাশিত ছিল। ধানমন্ডি ৩২ নম্বরের বাড়িটির সাথে জড়িয়ে আছে মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস, শেখ মুজিবের শাসনামলের ইতিহাস এবং স্বদেশ প্রত্যাবর্তনের পর বাড়িটিকে মুজিবীয় কাল্টের সিম্বলে পরিনত করতে শেখ হাসিনা ও ভারতীয় সফ্ট পাওয়ার অপারেশনের সুচতুর পরিকল্পনার সবকিছুই এখন জাতির সামনে খোলাসা হতে শুরু করেছে। মত প্রকাশের স্বাধীনতা হরণ ও কণ্ঠরোধের স্বৈরতান্ত্রিক নিয়ন্ত্রণব্যবস্থায় যেসব তথ্য এতদিন জাতী জানতে পারেনি, তার সবটা ধামাচাপা দেয়া সম্ভব হয়নি। বাণিজ্য ও তথ্যপ্রযুক্তির বিশ্বায়ন এবং বিশ্ববিস্তৃত ডায়াসপোরার কারণে রাজনৈতিকভাবে স্পর্শকাতর কোনো তথ্য আর ধামাচাপা দেয়া সম্ভব নয়। একাত্তরের ২৫ মার্চ পাক বাহিনীর অপারেশন সার্চলাইট বা ক্র্যাকডাউন শুরুর প্রাকমুহূর্তে স্বাধীনতার ঘোষণা দিতে শেখ মুজিবের আপত্তি ও অনাগ্রহ সম্পর্কে শীর্ষ আওয়ামী লীগ নেতা ও প্রথম প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দিন আহমেদের মেয়ে শারমিন আহমেদের লেখা ‘তাজউদ্দিন আহমেদ: নেতা ও পিতা’ গ্রন্থে সেদিনের চরম মুহূর্তের বর্ণনা উঠে এসেছে। শেখ মুজিবের স্বাধীনতার ঘোষণার দাবিটি যে ভুয়া ও ভিত্তিহীন, তা নতুন করে বলার প্রয়োজন নেই। শেখ হাসিনার জোটসঙ্গী নেতারাও সংসদে দাঁড়িয়ে চট্টগ্রাম থেকে মেজর জিয়াউর রহমানের স্বাধীনতার ঘোষণা এবং নিজেকে প্রথম রাষ্ট্রপ্রধান হিসেবে দাবির পক্ষে সাক্ষ্য দিয়েছিলেন। শেখ মুজিব সাতচল্লিশোত্তর পূর্ব পাকিস্তানের গণতান্ত্রিক আন্দোলনে আওয়ামী লীগের নেতৃত্ব দিয়েছিলেন, আগরতলা ষড়যন্ত্রের মধ্য দিয়ে পাকিস্তান থেকে পূর্ব বাংলাদেশে স্বাধীন করার পরিকল্পনা ছিল ভারতীয় গোয়েন্দা সংস্থা ‘র’-এর ডিজাইন করা। দল ও দেশকে পাকবাহিনীর আগ্রাসনের মুখে ঠেলে দিয়ে তাদের সহযোগিতায় পেছনের দরজা দিয়ে পাকিস্তানে চলে যাওয়ার আগে শেখ মুজিব মুক্তিযুদ্ধ কিংবা স্বাধীনতার ঘোষণা দেননি। এ ক্ষেত্রে আওয়ামী লীগ ৭ মার্চে দেয়া রেসর্কোস ময়দানের রাজনৈতিক বক্তব্যকে স্বাধীনতার ঘোষণা বলে দাবি করলেও সত্তুরের নির্বাচনের ফলাফল মেনে নিতে পশ্চিম পাকিস্তানের রাজনৈতিক নেতৃত্ব ও সামরিক নেতাদের সাথে ধারাবাহিক আলোচনা এবং পরবর্তীতে অস্বচ্ছ রাজনৈতিক ভূমিকার কারণে তা ধোপে টেকে না। ৩২ নম্বরের বাড়ি ধ্বংসের পর শেখ হাসিনা ও ভারতীয় প্রতিক্রিয়ার পর রাজনৈতিক নেতা এবং রাষ্ট্রের প্রধান হিসেবে বাড়িটিতে থাকা শেখ মুজিবের ভূমিকার ঐতিহাসিক পটভূমি নিয়ে নতুন করে যে আলোচনা হচ্ছে, তাতে নতুন প্রজন্মের মধ্যে ইতিহাসের নির্মোহ চর্চার একটি সুযোগ সৃষ্টি হয়েছে। আধিপত্যবাদী শক্তির সফ্ট পাওয়ারের অধীনে মেকি দেশপ্রেমের মিথ্যা ন্যারেটিভ ছুঁড়ে ফেলে দিয়ে নতুন বাংলাদেশের অগ্রযাত্রা ও মুক্তবুদ্ধির চর্চা শুরু হবে, এটা চব্বিশের গণঅভ্যুত্থানের অন্যতম লক্ষ্য।

গণঅভ্যুত্থানের ৬ মাস পরও দেশের আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে সুসংহত করতে পারেনি অর্ন্তবর্তী সরকার। এখানে পতিত শেখ হাসিনার ইভিল ডিজাইন অনেকটা সফল। ভারতীয় নির্দেশনায় দেশের পুলিশ ও বিজিবিকে নিজের মতো করে সাজিয়েছিলেন শেখ হাসিনা। সেখানে গুরুত্বপূর্ণ পদে নিরপেক্ষ পেশাদার ব্যক্তিদের কোনো স্থান ছিল না। গুম-খুন, মিথ্যা মামলা ও বিরোধীদের উপর ক্র্যাকডাউনে হাত-পাকানো, সিদ্ধহস্ত এমন একটি দানবীয় পুলিশ বাহিনীর পরিচয় ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে পাওয়া যায়। হাসিনার ক্ষমতা টিকিয়ে রাখতে ছাত্র-জনতার উপর গুলি চালাতে সেনাবাহিনী অপারগতা প্রকাশ করে তাকে পদত্যাগের আহ্বান জানানোর পরও পুলিশ বাহিনী ঢাকার গুরুত্বপূর্ণ পয়েন্টগুলোতে পাখির মত গুলি করে হাজার হাজার মানুষ হত্যা করেছে। দেশত্যাগের আগে নাকি শেখ হাসিনা চলে যাওয়ার পর দেশকে অচল করে দিতে পুলিশের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের নির্দেশ দিয়েছিলেন। তিনি হয়তো মনে করেছিলেন, আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর অনুপস্থিতিতে তার নেতাকর্মী এবং ভারতের নির্দেশে সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের একটি অংশের অংশগ্রহণে দেশে একটি অরাজক পরিস্থিতি তৈরী হবে এবং ভারতের হস্তক্ষেপে হাসিনার প্রত্যাবর্তনের সাথে সাথে অর্ন্তবর্তী সরকারের পতন কিংবা রাজনৈতিক পুর্নবাসনে বাধ্য করা সম্ভব হবে। ৫ আগস্টের পর থেকে একের পর এক হাসিনার উস্কানিমূলক ভার্চুয়াল নির্দেশনার পাশাপাশি নানা দাবিদাওয়া নিয়ে বিভিন্ন সেক্টরের হাজার হাজার মানুষের ঢাকার রাজপথে, শাহবাগ-সচিবালয় ঘেরাও করা, মোদির সমর্থক ভারতীয় গোদি মিডিয়া, ইসকনসহ সনাতন ধর্মাবলম্বিদের কয়েকটা প্ল্যাটফর্ম, ইসকনের বহিষ্কৃত নেতা চিন্ময়কৃষ্ণ দাসের উস্কানিমূলক বক্তব্য ও গ্রেফতারের পর চট্টগ্রামের আদালত পাড়ায় আইনজীবীকে নির্মমভাবে হত্যার মধ্য দিয়ে বাংলাদেশে একটি গৃহযুদ্ধ পরিস্থিতি সৃষ্টির অপচেষ্টা হয়েছিল। সেসব অপচেষ্টা ব্যর্থ হওয়ার সাথে সাথে অর্থনৈতিক খাতের সংকট দূর করা, পাচার হওয়া টাকা ফেরত আনা, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রসহ আর্ন্তজাতিক সম্প্রদায়ের অভাবনীয় সমর্থন আদায়ে অর্ন্তবর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা প্রফেসর ইউনূসের অভাবনীয় সাফল্যে ভারত ও পতিত স্বৈরাচারের ডিস্ট্যাবিলাইজেশনের ইভিল ডিজাইন যখন মাঠে মারা যাচ্ছে, তখনই শেখ হাসিনা তার পলাতক নেতাকর্মীদের সামনে নতুন বার্তা নিয়ে হাজির হয়েছেন। ১৬ বছরের দুঃশাসন, হাজার হাজার মানুষ হত্যা, লাখ লাখ কোটি টাকার দুর্নীতি ও পাচার, রাষ্ট্রের প্রতিটি প্রতিষ্ঠান ধ্বংসের জন্য তার মধ্যে সামান্যতম অনুশোচনা, স্বীকারোক্তি কিংবা ক্ষমা প্রার্থণার চিহ্নও তিনি দেখাননি। উপরন্তু তিনি এখনো জানেননা, কী দোষ ছিল তার! অবৈধ ক্ষমতা টিকিয়ে রাখতে নির্বিচারে হাজার হাজার মানুষ হত্যার পর দেশ থেকে পালিয়ে যাওয়ার পর পতিত স্বৈরাচার যখন প্রশ্ন তোলেন, কি দোষ ছিল তার? তা থেকে সবাই বুঝতে পারেন, তিনি স্বাভাবিক মানসিকতার নন, একজন সাইকোপ্যাথ। অনেক আগে দেশের সর্বোচ্চ আদালত তাকে ‘রং হেডেড’ আখ্যা দিয়েছিল। রং হেডেড বা সাইকোপ্যাথ না হলে কেউ দেশের বিরুদ্ধে এমন ভূমিকায় থাকতে পারেন না।

স্বাধীনতার ৫৪ বছর পরও আমাদের মুক্তি সংগ্রামের লক্ষ্য অর্জিত হয়নি। লাখো শহীদের রক্তের বিনিময়ে অর্জিত স্বাধীন রাষ্ট্রের সার্বভৌমত্ব নিয়ে আঞ্চলিক-আন্তর্জাতিক আধিপত্যবাদীদের ক্রীড়ণক কোনো দল বা গোষ্ঠীকে আর কখনো এ দেশের মানুষ রাজনীতিতে দেখতে চায় না। স্বাধীনতাত্তোর আওয়ামী লীগ কোনো রাজনৈতিক দল নয়, এটি একটি ভারতীয় ‘ভেন্ডেটা’ নেটওয়ার্ক মাত্র। এটি শুরু হয়েছিল ষাটের দশক থেকেই। মাওলানা আব্দুল হামিদ খান ভাসানী, হোসেন শহীদ সহরাওয়ার্দী, খন্দকার মোশতাক, তাজউদ্দিনদের মত নেতাদের গৌণ করে ভারতীয় এজেন্টরা শেখ মুজিবকে দিয়ে এই ভেন্ডেটা গড়ে তুলেছিল, এ দেশের সব সামাজিক-রাজনৈতিক প্রতিরোধ শক্তিকে ধ্বংস করে দিয়ে লেন্দুপ দর্জির মতো নেতা সৃষ্টি করে কোনো এক সময় দেশটাকে কাশমির-হায়দারাবাদ বা সিকিমের মতো গ্রাস করে নেয়ার এজেন্ডা সামনে রেখে। শেখ হাসিনা ছিল সেই লেন্দুপ দর্জির সংষ্করণ।

পতন ও পালিয়ে যাওয়ার পর শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে শতাধিক হত্যা মামলা দায়ের হয়েছে। রাজপথে পিটিয়ে মানুষ হত্যার পৈশাচিক লগিবৈঠার তা-বের নির্দেশদাতা শেখ হাসিনা। এরপর পাতানো নির্বাচনে ক্ষমতায় এসে পিলখানায় সেনাহত্যা, শাপলা চত্ত্বর ম্যাসাকার থেকে শুরু করে ১৬ বছরের গুম-খুন-গণহত্যার ধারাবাহিকতায় ২০১৮ সালে শিক্ষার্থীদের নিরাপদ সড়ক আন্দোলন, বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষার্থীদের কোটোবিরোধী আন্দোলন এবং বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনের পথ ধরে চব্বিশের গণঅভ্যুত্থান দমনে হাজার হাজার মানুষ হত্যার বিভীষিকাময় পরিস্থিতির জন্য দায়ী শেখ হাসিনার বিচার নিশ্চিত করার মধ্য দিয়ে জাতি পুরনো রাজনৈতিক বন্দোবস্তের কবর রচনা করতে চায়। হাসিনা দেশে না থাকলেও তার অলিগার্করা গা ঢাকা দিলেও বিভিন্ন রাজনৈতিক দলে, সেনাবাহিনীতে, আমলাতন্ত্রের অভ্যন্তরে, গণমাধ্যমে, সাংস্কৃতিক জোট, বিভিন্ন পেশাজীবী সংগঠনে শেখ হাসিনা ও ভারতের অনুগত এজেন্ট ও মগজধোলাই প্রাপ্ত সফ্ট পাওয়ার সক্রিয় রয়েছে। তারা কোটি মানুষের শ্রমের অর্থ পাচারকারির শাস্তির চেয়ে রাজনৈতিক সমঝোতাকে বড় করে দেখাতে চায়। তাদের কাছে হাজার হাজার ছাত্র-জনতার জীবনের চেয়ে মেট্রোরেলে ভাঙ্গচুরের ক্ষতি, শেখ মুজিবের মূর্তি, মূর‌্যাল কিংবা ৩২ নাম্বার ধানমন্ডির বাড়ির ঐতিহাসিক মূল্য বেশি গুরুত্বপূর্ণ। ছাত্র-জনতার উপর গুলি চালিয়ে এক ভয়ঙ্কর পরিস্থিতি সৃষ্টির পর চব্বিশের গণআন্দোলনের শেষ প্রান্তে এসে এক শ্রেণীর মানুষকে বলতে শোনা গেছে, তারা বৈষম্যবিরোধী আন্দোলন সমর্থন করলেও তারা এক দফা ও লংমার্চ টু ঢাকা সমর্থন করেন না। ঠিক একইভাবে ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানের পর আরেক শ্রেণীর মানুষের পরিচয় পাওয়া যাচ্ছে, যারা দেশে স্বৈরতন্ত্রের প্রত্যাবর্তন চান না, ভারতীয় আধিপত্য চান না, কিন্তু গণহত্যা ও লুটপাটের বিচারের আগেই আওয়ামী লীগের রাজনৈতিক পুর্নবাসন চান, শেখ মুজিবের মূর্তি ভাঙ্গার কষ্টে আবেগাপ্লুত হন, হাসিনার মতোই অন্তর্বর্তী সরকারের উপর চাপ সৃষ্টির জন্য রাজনৈতিক কর্মসূচি দেয়ার হুমকি দিতেও ছাড়েননা। অন্যদিকে, এসব দেখে-শুনে ছাত্র-জনতার একটি অংশ মব জাস্টিসের দিকে ঝুঁকে পড়ছেন। রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের কেউ কেউ মনে করছেন, ডোনাল্ড ট্রাম্পের সাথে নরেন্দ্র মোদির বৈঠকের আগে শেখ হাসিনাকে দিয়ে উস্কানিমূলক ভার্চুয়াল বক্তব্য প্রচার করিয়ে ছাত্র-জনতাকে উত্তেজিত করে বাংলাদেশে ‘বিশৃঙ্খলা ও মব জাস্টিসের’ সংবাদ ও ভিডিও ক্লিপিং সংগ্রহ করে দেখাতে চান।

শেখ হাসিনার ভার্চুয়াল বক্তৃতায় হুমকি ও উস্কানির জবাবে ৩২ নম্বরের বাড়ি গুঁড়িয়ে দিয়েছে ছাত্র-জনতা। এরপর গাজীপুরের সাবেক মেয়র জাহাঙ্গীর আলমের গোপণ ফোনালাপে ঢাকাবাসিকে ঘুমাতে না দেয়ার নির্দেশনা, পুলিশ সদস্যদের প্রতি পালিয়ে যাওয়া সাবেক আইজিপি বেনজিরের উস্কানিমূলক নির্দেশনা, গাজীপুরে ছাত্র-জনতার উপর মোজাম্মেল হক ও জাহাঙ্গীরের লোকদের হামলা ও হত্যাকা-ের পর পতিত স্বৈরাচারের দোসরদের অবস্থান অনেকটা স্পষ্ট হয়ে গেছে। গত ৫০ বছরেও আওয়ামী লীগের রাজনৈতিক দুর্বৃত্তায়ণ বদলায়নি। আ ক ম মোজাম্মেলরা কিভাবে নববধূকে ধর্ষণ করে হত্যার অভিযোগে সেনাবাহিনীর হাতে আটক হওয়ার পর শেখ মুজিবের নির্দেশে ছাড়া পেয়ে প্রভাবশালী আওয়ামী লীগ নেতায় পরিনত হয়েছিল, এই কাহিনী জনপ্রিয় লেখক হুমায়ন আহমেদ তার ‘দেয়াল’ উপন্যাসে তুলে ধরেছিলেন। বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের সময় ঢাকায় দায়িত্ব পালন করা পশ্চিমা সাংবাদিকদের অন্যতম অ্যান্থনি মাসকারেনহাস তার ‘লিগ্যাসি অফ ব্লাড’ বইতেও কথিত মোজাম্মেলের ধর্ষণকা-ের বিবরণ রয়েছে। সেই মোজাম্মেলকে শেখ হাসিনা মুক্তিযোদ্ধা মন্ত্রনালয়ের মন্ত্রী হিসেবে নিয়োগ দেয়ার পর শত শত কোটি টাকার বিনিময়ে হাজার হাজার ভুয়া মুক্তিযোদ্ধার সনদ বিক্রি করে জাতির গর্বিত সন্তান প্রকৃত মুক্তিযুদ্ধের গৌরবজনক ইতিহাসের উপর কলঙ্ক লেপন করেছেন। আওয়ামী লীগের পরিচয়ে, শেখ হাসিনার মোসাহেবিতে যে যত বড় দুর্বৃত্ত, খুনি, ধর্ষক, দুর্নীতিবাজ, দখলবাজ, সন্ত্রাসী শেখ হাসিনার শাসনে সে তত বেশি রাষ্ট্রের আনুকূল্য প্রাপ্ত নেতা হয়েছিলেন। ধর্ষণের সেঞ্চুরি উৎসব পালন করা ছাত্রলীগ নেতা মানিক, ধর্ষক আওয়ামী লীগ নেতা মোজাম্মেল, শত শত ক্রসফায়ার ও নারী ধর্ষণের হোতা ওসি প্রদীপ, ক্যাঙ্গারু কোর্টে গণভবনের নির্দেশে ফাঁসির রায় দেয়া হাইকোর্টের বিচারক মানিক কিংবা আন্ডার ওয়ার্ল্ডের সিরিয়াল কিলারদের মৃত্যুদ-াদেশ রাষ্ট্রপতিকে দিয়ে মওকুফ করিয়ে অপরাধ জগতে পুর্নবহালের মতো অসংখ্য নজির স্থাপন করেছেন শেখ হাসিনা। দলের সাধারণ নেতাকর্মীদের আবেগ ও সমর্থনকে পুঁজি করে শেখ হাসিনা, শেখ রেহানা, নাতিপুতিসহ পুরো মুজিব ডায়নেস্টি এবং আওয়ামী গ্যাং স্টারদের এমন ধারাবাহিক রাষ্ট্রবিরোধী, মানবতাবিরোধী অপরাধচিত্র আওয়ামী লীগের রাজনৈতিক অস্তিত্ব শত সহশ্র শহীদের কবরের মাটির নিচে দাফন হয়ে গেছে। এসব অপরাধের বিচার শেষ হওয়ার আগে আওয়ামী লীগের রাজনীতি করার অধিকার স্বজন হারানো ছাত্র-জনতা মেনে নেবে না। তাদেরকে বিচারের আওতায় আনতে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে পুনর্গঠিত করার আগেই নির্বাচনের জিগির তুললে তা পতিত স্বৈরাচারের পক্ষে যায়। পতিত স্বৈরাচারের এজেন্টদের বিরুদ্ধে রাষ্ট্র যথাযথ পদক্ষেপ নিতে না পারলে ছাত্র-জনতার বিক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়া পুরনো বন্দোবস্তের যেকোনো আইডল কিংবা আইকন বাস্তিল দূর্গ ও বার্লিন প্রাচীরের মতো পতনের সম্মুখীন হবে। তবে যৌথবাহিনীর ‘অপারেশন ডেভিল হান্ট’ অভিযানে পতিত স্বৈরাচারের দোসরদের ডিস্ট্যাবিলাইজেশন এজেন্ডা ব্যর্থ করে দিয়ে বিচারহীনতার সংস্কৃতির কবর রচনা করে মানবাধিকার ও আইনের শাসন নিশ্চিত করার বিকল্প নেই।

bari_zamal@yahoo.com


বিভাগ : সম্পাদকীয়


মন্তব্য করুন

HTML Comment Box is loading comments...

এই বিভাগের আরও

মিয়ানমারে ভূমিকম্প এবং আমাদের ভয়
ড. মুহাম্মদ ইউনূসের উচিৎ কথা
আইএমএফ’র ঋণের প্রশ্নে সরকারকে কঠোর অবস্থান নিতে হবে
মুক্তিযুদ্ধ থেকে ছাত্র-জনতার অভ্যুদয়
শিক্ষাব্যবস্থার ব্ল্যাকবক্স খোলার এখনই সময়
আরও
X

আরও পড়ুন

পরীক্ষাকেন্দ্রে ১৪৪ ধারা, কোচিং-ফটোকপি বন্ধসহ একগুচ্ছ নির্দেশনা

পরীক্ষাকেন্দ্রে ১৪৪ ধারা, কোচিং-ফটোকপি বন্ধসহ একগুচ্ছ নির্দেশনা

এশিয়ার শেয়ারবাজারে বড় ধস, তেলের দামেও পতন

এশিয়ার শেয়ারবাজারে বড় ধস, তেলের দামেও পতন

গাজা ইস্যুতে সিসি ও ম্যাখোঁর সঙ্গে জর্দানের রাজার বৈঠক আজ

গাজা ইস্যুতে সিসি ও ম্যাখোঁর সঙ্গে জর্দানের রাজার বৈঠক আজ

ঐকমত্য কমিশনের সংলাপ ফের শুরু আজ

ঐকমত্য কমিশনের সংলাপ ফের শুরু আজ

সকালে ব্রিদিং এক্সারসাইজের উপকারিতা

সকালে ব্রিদিং এক্সারসাইজের উপকারিতা

মতলব দক্ষিণ থানার এসআই জীবন চৌধুরীর বেতন বন্ধের নির্দেশ

মতলব দক্ষিণ থানার এসআই জীবন চৌধুরীর বেতন বন্ধের নির্দেশ

সাবেক এমপি কেরামত আলী গ্রেফতার

সাবেক এমপি কেরামত আলী গ্রেফতার

নীলফামারীর উত্তরা ইপিজেডে মেশিন বিস্ফোরণে ২জন শ্রমিক দগ্ধ

নীলফামারীর উত্তরা ইপিজেডে মেশিন বিস্ফোরণে ২জন শ্রমিক দগ্ধ

ট্রাম্পের সাথে বৈঠক করতে যুক্তরাষ্ট্রে ছুটলেন নেতানিয়াহু

ট্রাম্পের সাথে বৈঠক করতে যুক্তরাষ্ট্রে ছুটলেন নেতানিয়াহু

বিক্ষোভে উত্তাল মণিপুর, নেতার বাড়িতে আগুন দিলো জনতা

বিক্ষোভে উত্তাল মণিপুর, নেতার বাড়িতে আগুন দিলো জনতা

ঢাকায় ৪ দিনব্যাপী বিনিয়োগ সম্মেলন আজ শুরু

ঢাকায় ৪ দিনব্যাপী বিনিয়োগ সম্মেলন আজ শুরু

ইয়েমেনে সর্বশেষ মার্কিন বিমান হামলায় নিহত ৪

ইয়েমেনে সর্বশেষ মার্কিন বিমান হামলায় নিহত ৪

মধ্যপ্রাচ্যের ৬ দেশকে হুমকি ইরানের, যুদ্ধের শঙ্কা

মধ্যপ্রাচ্যের ৬ দেশকে হুমকি ইরানের, যুদ্ধের শঙ্কা

রাজধানীর বংশালে আগুন, নিহত ১, আহত ৭

রাজধানীর বংশালে আগুন, নিহত ১, আহত ৭

গাজায় ইসরায়েলি বর্বরতার প্রতিবাদে বিশ্বজুড়ে আজ ধর্মঘট

গাজায় ইসরায়েলি বর্বরতার প্রতিবাদে বিশ্বজুড়ে আজ ধর্মঘট

দুর্ঘটনার কবলে জামায়াত নেতাকর্মীদের বহনকারী বাস, নিহত ৩

দুর্ঘটনার কবলে জামায়াত নেতাকর্মীদের বহনকারী বাস, নিহত ৩

ঈদকে কেন্দ্র করে কৃষি নির্ভর বরিশাল অঞ্চলের অর্থনীতিতে নতুন প্রাণের সঞ্চার

ঈদকে কেন্দ্র করে কৃষি নির্ভর বরিশাল অঞ্চলের অর্থনীতিতে নতুন প্রাণের সঞ্চার

ঝড়ো বাতাসে যমুনা নদীতে আটকে ছিল ফেরি

ঝড়ো বাতাসে যমুনা নদীতে আটকে ছিল ফেরি

হিজবুল্লাহকে নিরস্ত্র করতে লেবাননের শীর্ষ নেতাদের সঙ্গে মার্কিন দূতের বৈঠক

হিজবুল্লাহকে নিরস্ত্র করতে লেবাননের শীর্ষ নেতাদের সঙ্গে মার্কিন দূতের বৈঠক

ফিলিস্তিনিদের সমর্থনে বৈশ্বিক কর্মসূচিতে সংহতি, দেশব্যাপী ধর্মঘট আজ

ফিলিস্তিনিদের সমর্থনে বৈশ্বিক কর্মসূচিতে সংহতি, দেশব্যাপী ধর্মঘট আজ