অপারেশন ডেভিল হান্টের প্রয়োজনীয়তা স্বীকার্য
১৩ ফেব্রুয়ারি ২০২৫, ১২:০২ এএম | আপডেট: ১৩ ফেব্রুয়ারি ২০২৫, ১২:২০ এএম

গণঅভ্যুত্থানের মাধ্যমে বিশ্বের নিকৃষ্টতম ফ্যাসিস্টকে বিদায় করে বর্তমান অন্তর্বর্তীকালীন সরকার রাষ্ট্রীয় ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হয়েছে, যার নেতৃত্বে রয়েছেন বর্তমান বিশ্বের বরেণ্য ব্যক্তিত্ব ড. মুহাম্মদ ইউনূস। তাই দেশবাসীসহ বিশ্ববাসী এবং সব আন্তর্জাতিক সংস্থা এই সরকারকে সমর্থন করেছে এবং সহায়তা করার আশ্বাস দিয়েছে। এই সরকারের কাছে গণপ্রত্যাশা অনেক। সরকার অরাজনৈতিক ও দুর্বল হওয়া সত্ত্বেও অবাধ গণতন্ত্র চালু করেছে। তাই বিভিন্ন ব্যক্তি, গোষ্ঠি ও সংস্থার লোকদের বিভিন্ন যৌক্তিক ও অযৌক্তিক দাবির সুনামি সৃষ্টি হয়েছে সরকার গঠনের পরপরই। তবে অস্বীকার করা যাবে না যে, সরকারের মেয়াদ ৬ মাস অতিবাহিত হলেও মানুষের আশা সেভাবেপূরণ হয়নি। অবশ্য, চরম ভঙ্গুর অর্থনীতি, সব খাত ধ্বংস, টালবাহানার প্রশাসন বিদ্যমান। উপরন্তু ফ্যাসিস্টদের সহায়তা করার কারণে পুলিশের উপর গণঅসন্তোষ সৃষ্টি হওয়ায় গণঅভ্যুত্থানের সময় পুলিশ ব্যাপক আক্রমণের শিকার হয়েছে এবং বহু অস্ত্র লুট হয়েছে। অনেক পুলিশ নিহত-আহত হয়েছে। ফলে পুলিশের অনেক সদস্য প্রাণভয়ে চাকরি ছেড়ে পালিয়ে গেছে। পালিয়ে যাওয়া পুলিশের বেশিরভাগ কাজে যোগদান করলেও সৃষ্ট ভীতিকরভাব দূর হয়নি এখনো। এছাড়া পুলিশে রয়েছে ব্যাপক আওয়ামীকরণ। এসব নানা অবস্থায় বর্তমান সরকারের যাত্রা শুরু হয়েছে। এর মধ্যে ব্যাংক খাতে স্থিতাবস্থা ফিরে এসেছে ৬ হাজার কোটি টাকা ছাপিয়ে বিশেষ ঋণ দেওয়ায়। অনেক বেসরকারি ব্যাংক বন্ধ হয়ে যাওয়ার উপক্রম থেকে রক্ষা পেয়েছে। অবশ্য, খেলাপি ঋণ কমেনি, বরং বেড়েছে! দুর্ঘটনা ও যানজটও কমেনি। তবে, ভঙ্গুর অর্থনৈতিক অবস্থায়ও বৈদেশিক বিশাল ঋণের ৫ বিলিয়ন ডলারের কিস্তি পরিশোধ করা হয়েছে। বৈদেশিক মুদ্রা মজুদের সংকটজনক পরিস্থিতি থেকে উত্তরণ ঘটেছে। রেমিটেন্স এবং রফতানি বেড়েছে। কৃষির উৎপাদন ভালো হয়েছে। কিন্তু মূল্যস্ফীতি কমেনি, এখনো প্রায় ১০% চলছে। বেকারত্ব কমেনি। বিনিয়োগ বাড়েনি। পরিবেশের উন্নতি হয়নি। মাদকের ব্যবহার ও চোরাচালান কমেনি। দুর্নীতিও কমেনি। টিআই’র দুর্নীতির ধারণা সূচক-২০২৪ মতে, বিশ্বের ১৮০টি দেশের মধ্যে ‘সবচেয়ে দুর্নীতিগ্রস্ত’ দেশের তালিকায় বাংলাদেশ ১৪তম, স্কোর ২৩। বিদ্যুৎ খাতের উন্নতি হয়নি। তাই ভারতের আদানির কাছ থেকে মাসিক ১৬০০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ আমদানি করার সিদ্ধান্ত জানিয়ে দেওয়া হয়েছে। সেনাবাহিনী মাঠে থাকা এবং মাজেস্ট্রেসি ক্ষমতা দেওয়া সত্ত্বেও আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির উন্নতি হয়নি। লোমহর্ষক কিছু কর্মকা- সংঘটিত হয়েছে। সর্বোপরি পতিত ফ্যাসিস্টরা ভারতের সহায়তায় সারাদেশে ব্যাপক নৈরাজ্য সৃষ্টি করার প্রক্রিয়া শুরু করেছে।
এমতাবস্থায় আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির উন্নতি ঘটিয়ে স্বাভাবিক করার লক্ষ্যে গত ৮ ফেব্রুয়ারি রাত থেকে শুরু হয়েছে যৌথ বাহিনীর ‘অপারেশন ডেভিল হান্ট’ অভিযান। শয়তান ধরার এই অভিযান স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় থেকে মনিটরিং করা হচ্ছে। বিএনপিসহ অনেক রাজনৈতিক দল ও মানবাধিকার সংগঠন এবং সাধারণ মানুষ অভিযান সমর্থন করেছে। স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা লেফটেন্যান্ট জেনারেল (অব.) মো. জাহাঙ্গীর আলম চৌধুরী গত ১০ ফেব্রুয়ারি রাজশাহীতে সাংবাদিকদের বলেছেন, ‘এই অপারেশনটা চলবে ততদিন পর্যন্ত, যতদিন পর্যন্ত ডেভিল এখান থেকে মুক্ত না হবে।’ যারা শয়তান, তাদেরই ধরা হবে। এখন ছোট শয়তান নাকি বড় শয়তান, সেটা দেখব না। যারা মিথ্যা মামলা করেছে, আইনের ভেতর থেকেও তাদের বিরুদ্ধে অ্যাকশন নিতে হবে।’ আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর কর্মকর্তাদেরও ছাড় দেওয়া হয়নি। প্রথম দিনই পাঁচজনকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সিনিয়র সচিব ড. নাসিমুল গনি গত ৯ ফেব্রুয়ারি বলেছেন, ‘ডেভিল হান্ট শুরু হয়েছে। এর উদ্দেশ্য ও কাজ হচ্ছে- যেসব পকেট থেকে দেশকে আনস্টেবল করা হচ্ছে, সেগুলোকে নিউট্রালাইজ করা। আইনানুগভাবে ব্যবস্থা নেয়ার জন্য সকল বাহিনীকে প্রস্তুত করা হয়েছে, ব্রিফ করা হয়েছে এবং কাজ চলমান আছে। দেখা যাচ্ছে, হঠাৎ করে দেশকে অস্থিতিশীল করার চেষ্টা হচ্ছে। মানুষের মন যাতে উদ্বেলিত না হয়, সেজন্য এই ডেভিল হান্ট পরিচালনা করার সিদ্ধান্ত হয়েছে। এটির নেতৃত্ব দিচ্ছে পুলিশ। যতক্ষণ প্রয়োজন হয় ততক্ষণ এই ডেভিল হান্ট চলবে।’ উপদেষ্টা মাহফুজ আলম বলেছেন, ‘রাষ্ট্রকে অকার্যকর এবং ব্যর্থ প্রমাণের চেষ্টা করা হলে একবিন্দু ছাড় দেয়া হবে না।’
অপারেশন ডেভিল হান্ট অভিযান কতদিন চলবে তা নির্ধারণ করা হয়নি। তবে, অনুমেয়, দীর্ঘদিন চলবে। দ্বিতীয়ত, অপারেশন শেষে দেশ ডেভিল মুক্ত হবে কি-না বলা কঠিন। যা’হোক, এই অভিযানকালে কোনো অন্যায় তথা নিরপরাধ লোক গ্রেফতার না হয়, নির্যাতন-হয়রানির শিকার না হয় সেদিকে লক্ষ রাখতে হবে। অর্থাৎ অভিযানে ন্যায্যতা রক্ষা করতে হবে। অভিযানে যদি কোনো কারণে একটিও অন্যায্য ঘটনা ঘটে, তাহলে সমগ্র অভিযান প্রশ্নের মুখে পড়বে। যৌথবাহিনী কঠোর সমালোচনার সন্মুখীন হবে। ভালো একটি উদ্যোগ সমালোচিত হবে। সরকারেরও ভাবমূর্তি ক্ষুণœ হবে। তাই প্রধান উপদেষ্টা ড. ইউনূসও আইন প্রয়োগকারী সংস্থাগুলোকে অভিযানের সময় যেকোনো মূল্যে মানবাধিকার বজায় রাখার নির্দেশ দিয়েছেন বলে তিনি যুক্তরাষ্ট্রের চার্জ দ্য অ্যাফেয়ার্সকে জানিয়েছেন, তাই ডেভিল হান্ট অভিযান অত্যন্ত ন্যায্যভাবে নিরপেক্ষতার সঙ্গে। সর্বোপরি প্রতিদিন গ্রেফতারকৃতদের সংখ্যা ও কারণ প্রকাশ করা করতে হবে, যাতে পরিচয় ও অপরাধ সম্পর্কে মানুষ জানতে পারে। উল্লেখ্য যে, পুলিশ সদর দফতরের ১১ ফেব্রুয়ারির বিজ্ঞপ্তি মতে, গত শনিবার রাত থেকে মঙ্গলবার বিকেল পর্যন্ত সারাদেশে ‘অপারেশন ডেভিল হান্ট’ ও নিয়মিত যৌথ অভিযানে আটক হয়েছে ৪ হাজার ৬০৪ জন এবং অনেক অবৈধ অস্ত্র উদ্ধার হয়েছে বলে খবরে প্রকাশ। গ্রেফতারকৃতদের বেশিরভাগ আওয়ামী লীগের নেতা-কর্মী। বলা বাহুল্য, ডেভিল হান্ট অভিযান চিরদিন চলবে না। একদিন না একদিন বন্ধ হবেই। কিন্তু অপারেশন বন্ধ হওয়ার পর আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি যেন পুনরায় খারাপ না হয় সেটিই কামনা। আর সে জন্য অবিলম্বে নিয়োগের মাধ্যমে পুলিশের সদস্য সংখ্যা প্রয়োজনানুগ করা, নিয়োগে শতভাগ সততা ও নিরপেক্ষতা বজায় রাখা, পুলিশের সব সদস্যকে উপযুক্ত প্রশিক্ষণ এবং সময়োপযোগী অস্ত্র প্রদান করা দরকার। সকলেই আশা করে, পুলিশের কাজকর্ম গণপত্যাশা পূরণে সক্ষম হবে। তার ভাবমর্যাদা পুনরুদ্ধার হবে। দেশের শান্তি ও নিরাপত্তা ত্বরান্বিত হবে।
দেশে বহু দিন থেকে অনেক অনাকাক্সিক্ষত ঘটনা ঘটেছে। কিন্তু তা প্রতিহত করা যায়নি। বিষয়টি সরকারের নজরে সঠিক সময়ে না আসার কারণেই সেসব সংঘটিত হয়েছে বলে পন্ডিত ব্যক্তিদের অভিমত। আর সে জন্য মূলত গোয়েন্দা সংস্থাগুলো দায়ী বলেও তাদের অভিমত। কারণ, দেশের সব ধরনের অপরাধ সম্পর্কে সজাগ থাকার জন্য অনেক ধরনের গোয়েন্দা সংস্থা এবং তার লোকবল রয়েছে। তবুও দেশবিরোধী এবং শান্তি-শৃঙ্খলা বিরোধী কাজের আগাম তথ্য না পাওয়া কিংবা তথ্য পেলেও সে অনুযায়ী কাজ করে অপকর্ম বন্ধ করতে না পারা অত্যন্ত দুঃখজনক ও অনাকাক্সিক্ষত। তাই দেশের সব গোয়েন্দা বাহিনীকে পূর্ণভাবে কার্যকর করা এবং তাদের তথ্যের ভিত্তিতে দ্রুত কাজ করা জরুরি। দ্বিতীয়ত, পুলিশের তদন্তের কাজ নির্ধারিত সময়ের মধ্যে হওয়া অত্যন্ত আবশ্যক। কারণ, পুলিশের তদন্ত কাজ শেষ না হওয়ার কারণে বহু মামলার নিষ্পত্তি বিলম্বিত হয়। তাতে মানুষের ভোগান্তি ও আর্থিক ব্যয় অনেক বেড়ে যায়। অপরদিকে, সাধারণ মানুষের উচিত আইন নিজের হাতে তুলে নেওয়া বন্ধ করা। আইন নিজের হাতে তুলে নেওয়ার কারণে দেশে বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি হচ্ছে। বড় ধরনের সংকটও সৃষ্টি হচ্ছে। তাই আইন নিজের হাতে তুলে নেওয়ার প্রবণতা পরিহার করে সব সংকটের নিষ্পত্তির দায়িত্ব আইন-আদালতের ওপর ন্যাস্ত করাই উত্তম।
লেখক: সাংবাদিক ও কলামিস্ট।
sardarsiraj1955@gmail.com
বিভাগ : সম্পাদকীয়
মন্তব্য করুন
আরও পড়ুন

পরীক্ষাকেন্দ্রে ১৪৪ ধারা, কোচিং-ফটোকপি বন্ধসহ একগুচ্ছ নির্দেশনা

এশিয়ার শেয়ারবাজারে বড় ধস, তেলের দামেও পতন

গাজা ইস্যুতে সিসি ও ম্যাখোঁর সঙ্গে জর্দানের রাজার বৈঠক আজ

ঐকমত্য কমিশনের সংলাপ ফের শুরু আজ

সকালে ব্রিদিং এক্সারসাইজের উপকারিতা

মতলব দক্ষিণ থানার এসআই জীবন চৌধুরীর বেতন বন্ধের নির্দেশ

সাবেক এমপি কেরামত আলী গ্রেফতার

নীলফামারীর উত্তরা ইপিজেডে মেশিন বিস্ফোরণে ২জন শ্রমিক দগ্ধ

ট্রাম্পের সাথে বৈঠক করতে যুক্তরাষ্ট্রে ছুটলেন নেতানিয়াহু

বিক্ষোভে উত্তাল মণিপুর, নেতার বাড়িতে আগুন দিলো জনতা

ঢাকায় ৪ দিনব্যাপী বিনিয়োগ সম্মেলন আজ শুরু

ইয়েমেনে সর্বশেষ মার্কিন বিমান হামলায় নিহত ৪

মধ্যপ্রাচ্যের ৬ দেশকে হুমকি ইরানের, যুদ্ধের শঙ্কা

রাজধানীর বংশালে আগুন, নিহত ১, আহত ৭

গাজায় ইসরায়েলি বর্বরতার প্রতিবাদে বিশ্বজুড়ে আজ ধর্মঘট

দুর্ঘটনার কবলে জামায়াত নেতাকর্মীদের বহনকারী বাস, নিহত ৩

ঈদকে কেন্দ্র করে কৃষি নির্ভর বরিশাল অঞ্চলের অর্থনীতিতে নতুন প্রাণের সঞ্চার

ঝড়ো বাতাসে যমুনা নদীতে আটকে ছিল ফেরি

হিজবুল্লাহকে নিরস্ত্র করতে লেবাননের শীর্ষ নেতাদের সঙ্গে মার্কিন দূতের বৈঠক

ফিলিস্তিনিদের সমর্থনে বৈশ্বিক কর্মসূচিতে সংহতি, দেশব্যাপী ধর্মঘট আজ