পতিত স্বৈরাচার ও ভারতের পাতা ফাঁদে পা দেয়া যাবে না

Daily Inqilab ইনকিলাব

১৩ ফেব্রুয়ারি ২০২৫, ১২:০২ এএম | আপডেট: ১৩ ফেব্রুয়ারি ২০২৫, ১২:০২ এএম

ভারতে নির্বাসিত লেখিকা তাসলিমা নাসরিনের ইসলাম ও রাষ্ট্রবিদ্বেষ সর্বজনবিদিত। দেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষের সামাজিক-ধর্মীয় মূল্যবোধের উপর আঘাতের কারণেই তাঁকে দেশ ছাড়তে হয়েছিল। বিগত দেড় দশক ধরে ভারতপন্থী সরকার ক্ষমতায় থাকা সত্ত্বেও সঙ্গতকারণেই তসলিমাকে দেশে ফিরিয়ে আনার কোনো চেষ্টা করা হয়নি। একুশের বইমেলায়ও তাসলিমার বই কার্যত নিষিদ্ধ ছিল। অন্যদিকে ইসলাম বিদ্বেষী ন্যারেটিভের কারণে একুশের বইমেলায় বেশিরভাগ ইসলামি বইপত্র ও প্রকাশনাও কার্যত নিষিদ্ধ ছিল। সেখানে এক ব্যক্তি ও তার পরিবারের বন্দনা ও স্তুতিগাঁথার প্রচার ছিল মূখ্য বিষয়। ছাত্র-জনতার রক্তাক্ত গণঅভ্যুত্থানে পতিত স্বৈরাচার দেশ ছেড়ে ভারতে পালিয়ে যাওয়ার পর দেশের মানুষ এক নতুন বাংলাদেশ পেয়েছে। এখন ছাত্র-জনতা স্বৈরাচার ফ্যাসিবাদের আইকন ও সিম্বলগুলো উপড়ে ফেলতে চাইবে, এটাই স্বাভাবিক। ৫ আগস্টের পর ৬ মাস পেরিয়ে যাওয়ার পরও অনেক কিছুই অপরিবর্তিত রয়েছে। অর্ন্তবর্তী সরকারের অনেকটা ধীরগতি ও আপসকামী মনোভাব দ্বারা পরিচালিত হওয়ার সুযোগে ঘাপটি মেরে থাকা পতিত স্বৈরাচারের দোসররা আবার মাথাচাড়া দিয়ে উঠতে চাইছে। একুশের বইমেলায় আওয়ামী সাংস্কৃতিক লেসপেন্সার শতাব্দী ভবের সব্যসাচী স্টলে তসলিমা নাসরিনের বই ‘চুম্বন’র প্রদর্শন নিয়ে সাধারণ দর্শকদের ক্ষোভ থাকা অস্বাভাবিক নয়। প্রতিবাদের স্বাভাবিক বহি:প্রকাশের মধ্যে জনৈক প্রতিবাদী মাদরাসা ছাত্রকে মারধর এবং জয়বাংলা শ্লোগান ছিল আসলে একটি বিশৃঙ্খলা সৃষ্টির অপপ্রয়াস তথা সাবোটাজ। সেখানে উপস্থিত প্রতিবাদী মানুষজনকে তৌহিদী জনতা, মৌলবাদী আখ্যা দিয়ে ভারতীয় গণমাধ্যমে ফুলিয়ে-ফাপিয়ে সংবাদ পরিবেশন থেকেই বোঝা যায়, এর পেছনে আওয়ামী ও ভারতীয় স্বার্থান্বেষী মহলের ইন্ধন ও যোগসাজশ আছে।

একযুগ আগে ঢাকার শ্হাবাগে নাস্তিক-ব্লগারদের মাধ্যমে যে গণজাগরণ মঞ্চের উত্থান ঘটেছিল তার নেপথ্যে ভারতীয় গোয়েন্দা সংস্থার যোগসাজশের বিষয়টি এখন আর গোপন নেই। সেখান থেকেই বিচারের নামে জুডিসিয়াল কিলিং ও আওয়ামী ফ্যাসিবাদ ভয়ঙ্কর রূপে আবির্ভুত হয়েছিল। কথিত লেখক-গায়ক ও সংস্কৃতিকর্মী শতাব্দী ভব গণজাগরণ মঞ্চের একজন সক্রিয় কর্মী ছিলেন। স্বাধীনতার ৫০ বর্ষপূর্তির সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে আমন্ত্রণ না পাওয়ায় ভব আত্মহত্যার ইচ্ছা ব্যক্ত করে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে আলোচিত হয়েছিলেন। সেই শতাব্দী ভব জাতির এক স্পর্শকাতর সময়ে একুশে বইমেলায় নিজের স্টলে তসলিমার বই প্রর্দশন, মাদরাসা শিক্ষার্থীকে নিজ হাতে মারধর এবং জয়বাংলা শ্লোগান দিয়ে হট্টগোল পাকিয়ে বিষয়টিকে একটি সাম্প্রদায়িক রং চড়ানোর চেষ্টা করেছেন। গণঅভ্যুত্থান পরবর্তী বাংলাদেশে একুশের বইমেলায় ইসলামপন্থী মৌলবাদীদের ঊগ্রতার একটি চিত্র তুলে ধরতেই পরিকল্পিতভাবে এ পরিস্থিতি তৈরী করা হয়েছিল বলে সংশ্লিষ্ট অনেকে মনে করেন। এ তসলিমার বই নিয়ে মব যে তৈরী হচ্ছে, আগের রাতেই তা স্পষ্ট হয়েছিল। কিন্তু তা প্রতিরোধের জন্য সরকার বা গোয়েন্দা সংস্থা কোনো পদক্ষেপ নেয়নি। এ ব্যর্থতাই ঘটনার জন্ম দিয়েছে। দোষ পড়েছে কথিত তৌহিদী জনতার। আসলে পতিত স্বৈরাচার ও ভারতের পাতা ফাঁদে পা দিয়েছে কিছু মানুষ। অর্ন্তবতী সরকারের উপদেষ্টা মাহফুজ আলম নিজের ফেইজবুক পোষ্টে তৌহিদী জনতার ছদ্মবেশে মব জাস্টিসের ব্যাপারে সংশ্লিষ্টদের সতর্ক করে বলেছেন, ‘কথিত মব আর আন্দোলনের মহড়া এখন থেকে আমরা কঠোর হাতে মোকাবেলা করব’। তিনি মব ও স্বত:ষ্ফুর্ত আন্দোলনের প্রকৃতি নির্ণয় করে বক্তব্য দিয়েছেন। তার বক্তব্যের যৌক্তিকতা নিয়ে প্রশ্ন তোলার কোনো অবকাশ নেই।

গুম-খুন, গণতন্ত্র ও মানবাধিকার লঙ্ঘনের মাধ্যমে হাসিনার স্বৈরাচারি ক্ষমতা টিকিয়ে রাখতে জঙ্গিবাদ-ইসলামিক মৌলবাদ, মুক্তিযুদ্ধের চেতনা, স্বাধীনতা বিরোধীতা ইত্যাদি ন্যারেটিভ ব্যবহার করা হয়েছিল। এ ক্ষেত্রে আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীদের চেয়ে কথিত অলিগার্ক, গণমাধ্যম এবং একশ্রেণীর বুদ্ধিজীবী, সাংস্কৃতিক কর্মীদের ভূমিকা ছিল প্রকট। ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে অনেকে পালিয়ে কিংবা আত্মগোপণে থাকলেও গিরগিটির মত রং বদল করে অনেকেই ছাত্র-জনতা ও অর্ন্তবর্তী সরকারের বিরুদ্ধে ক্যামোফ্লেজ-সাবোটাজ করার অপচেষ্টা করছে। এর মূল লক্ষ্য হচ্ছে, ভারতীয় গণমাধ্যমের হাতে অস্ত্র তুলে দেয়া, যাতে অভ্যুত্থান পরবর্তী বাংলাদেশকে ইসলামি চরমপন্থার উত্থান হিসেবে দেখানো যায়। পতিত স্বৈরাচার ও দোসরদের উস্কানির ফাঁদে পা দিয়ে তাদেরকে সে সুযোগ করে দেয়া হচ্ছে বলে অনেকে মনে করেন। এ ব্যাপারে সকলের সতর্ক ও সাবধান হওয়া জরুরি। বিষয়গুলো নিয়ে আনন্দবাজার পত্রিকাসহ ভারতীয় গণমাধ্যমের প্রচারণা এবং শতাব্দী ভব ও তার স্ত্রীর নানা কর্মকান্ডের সাথে ভারত ও আওয়ামী প্রীতির যোগসুত্র থেকে বোঝা যায়, এর সাথে পতিত স্বৈরাচারের দোরসদের উদ্দেশ্যমূলক তৎপরতার যোগসুত্র রয়েছে। তারা এসব করে অর্ন্তবর্তী সরকারের ভাবমর্যাদা ক্ষুন্ন করতে চাইবে, এটাই স্বাভাবিক। সেদিন বইমেলায় যা ঘটেছে তা যে সুপরিকল্পিত ষড়যন্ত্রের অংশ তাতে সন্দেহের অবকাশ নেই। এ রকম ষড়যন্ত্র শুরু থেকেই অব্যাহত আছে। সনাতন ধর্মাবলম্বিদের হিন্দু নির্যাতনের মিথ্যা অভিযোগ থেকে শুরু করে গত ৬ মাসে অনেক কিছূই হয়েছে। ছাত্র-জনতা এবং অর্ন্তবর্তী সরকারের সময়োপযোগী পদক্ষেপে সব ষড়যন্ত্রই ব্যর্থ হয়েছে। পতিত স্বৈরাচার ও ভারতীয় কুশীলবরা একাট্টা হয়ে বাংলাদেশ মৌলবাদী, ইসলামি জঙ্গিবাদীদের দখলে চলে গেছে, এ রকম একটি ন্যারেটিভ খাড়া করার চেষ্টা করছে। বাস্তবে এ ন্যারেটিভ প্রমাণ করতে তারা নানাবিধ ষড়যন্ত্রে লিপ্ত রয়েছে। ছাত্র-জনতা তাদের পাতা ফাঁদে পা দিবে কেন? হাজারো ছাত্র-জনতার রক্তের বিনিময়ে অর্জিত নতুন বাংলাদেশের সব অংশীজনকে এ বিষয়ে আরো সতর্ক থাকতে হবে। অতি আবেগ কিংবা মতলবি প্রচারণায় বিভ্রান্ত হয়ে মাজার ভাঙ্গা, নিরপরাধ মানুষের ঘরবাড়ি ভাঙ্গা, নারী ফুটবলে বাঁধা প্রদান করার মত ঘটনাগুলো পরিবর্তিত বাংলাদেশ সম্পর্কে বিশ্বের কাছে ভুল মেসেজ তুলে দেয়ার সুযোগ সৃষ্টি করেছে। কৃতকর্মের বিচারের আগে পতিত স্বৈরাচারের সাথে আপসের যেমন সুযোগ নেই, তেমনি আইন নিজের হাতে তুলে নিয়ে মব জাস্টিসের ধারণাকে এস্টাবলিশ করার যে কোনো অপপ্রয়াসকে কঠোরভাবে নিয়ন্ত্রণ করা সরকারের দায়িত্ব।


বিভাগ : সম্পাদকীয়


মন্তব্য করুন

HTML Comment Box is loading comments...

এই বিভাগের আরও

মিয়ানমারে ভূমিকম্প এবং আমাদের ভয়
ড. মুহাম্মদ ইউনূসের উচিৎ কথা
আইএমএফ’র ঋণের প্রশ্নে সরকারকে কঠোর অবস্থান নিতে হবে
মুক্তিযুদ্ধ থেকে ছাত্র-জনতার অভ্যুদয়
শিক্ষাব্যবস্থার ব্ল্যাকবক্স খোলার এখনই সময়
আরও
X

আরও পড়ুন

পরীক্ষাকেন্দ্রে ১৪৪ ধারা, কোচিং-ফটোকপি বন্ধসহ একগুচ্ছ নির্দেশনা

পরীক্ষাকেন্দ্রে ১৪৪ ধারা, কোচিং-ফটোকপি বন্ধসহ একগুচ্ছ নির্দেশনা

এশিয়ার শেয়ারবাজারে বড় ধস, তেলের দামেও পতন

এশিয়ার শেয়ারবাজারে বড় ধস, তেলের দামেও পতন

গাজা ইস্যুতে সিসি ও ম্যাখোঁর সঙ্গে জর্দানের রাজার বৈঠক আজ

গাজা ইস্যুতে সিসি ও ম্যাখোঁর সঙ্গে জর্দানের রাজার বৈঠক আজ

ঐকমত্য কমিশনের সংলাপ ফের শুরু আজ

ঐকমত্য কমিশনের সংলাপ ফের শুরু আজ

সকালে ব্রিদিং এক্সারসাইজের উপকারিতা

সকালে ব্রিদিং এক্সারসাইজের উপকারিতা

মতলব দক্ষিণ থানার এসআই জীবন চৌধুরীর বেতন বন্ধের নির্দেশ

মতলব দক্ষিণ থানার এসআই জীবন চৌধুরীর বেতন বন্ধের নির্দেশ

সাবেক এমপি কেরামত আলী গ্রেফতার

সাবেক এমপি কেরামত আলী গ্রেফতার

নীলফামারীর উত্তরা ইপিজেডে মেশিন বিস্ফোরণে ২জন শ্রমিক দগ্ধ

নীলফামারীর উত্তরা ইপিজেডে মেশিন বিস্ফোরণে ২জন শ্রমিক দগ্ধ

ট্রাম্পের সাথে বৈঠক করতে যুক্তরাষ্ট্রে ছুটলেন নেতানিয়াহু

ট্রাম্পের সাথে বৈঠক করতে যুক্তরাষ্ট্রে ছুটলেন নেতানিয়াহু

বিক্ষোভে উত্তাল মণিপুর, নেতার বাড়িতে আগুন দিলো জনতা

বিক্ষোভে উত্তাল মণিপুর, নেতার বাড়িতে আগুন দিলো জনতা

ঢাকায় ৪ দিনব্যাপী বিনিয়োগ সম্মেলন আজ শুরু

ঢাকায় ৪ দিনব্যাপী বিনিয়োগ সম্মেলন আজ শুরু

ইয়েমেনে সর্বশেষ মার্কিন বিমান হামলায় নিহত ৪

ইয়েমেনে সর্বশেষ মার্কিন বিমান হামলায় নিহত ৪

মধ্যপ্রাচ্যের ৬ দেশকে হুমকি ইরানের, যুদ্ধের শঙ্কা

মধ্যপ্রাচ্যের ৬ দেশকে হুমকি ইরানের, যুদ্ধের শঙ্কা

রাজধানীর বংশালে আগুন, নিহত ১, আহত ৭

রাজধানীর বংশালে আগুন, নিহত ১, আহত ৭

গাজায় ইসরায়েলি বর্বরতার প্রতিবাদে বিশ্বজুড়ে আজ ধর্মঘট

গাজায় ইসরায়েলি বর্বরতার প্রতিবাদে বিশ্বজুড়ে আজ ধর্মঘট

দুর্ঘটনার কবলে জামায়াত নেতাকর্মীদের বহনকারী বাস, নিহত ৩

দুর্ঘটনার কবলে জামায়াত নেতাকর্মীদের বহনকারী বাস, নিহত ৩

ঈদকে কেন্দ্র করে কৃষি নির্ভর বরিশাল অঞ্চলের অর্থনীতিতে নতুন প্রাণের সঞ্চার

ঈদকে কেন্দ্র করে কৃষি নির্ভর বরিশাল অঞ্চলের অর্থনীতিতে নতুন প্রাণের সঞ্চার

ঝড়ো বাতাসে যমুনা নদীতে আটকে ছিল ফেরি

ঝড়ো বাতাসে যমুনা নদীতে আটকে ছিল ফেরি

হিজবুল্লাহকে নিরস্ত্র করতে লেবাননের শীর্ষ নেতাদের সঙ্গে মার্কিন দূতের বৈঠক

হিজবুল্লাহকে নিরস্ত্র করতে লেবাননের শীর্ষ নেতাদের সঙ্গে মার্কিন দূতের বৈঠক

ফিলিস্তিনিদের সমর্থনে বৈশ্বিক কর্মসূচিতে সংহতি, দেশব্যাপী ধর্মঘট আজ

ফিলিস্তিনিদের সমর্থনে বৈশ্বিক কর্মসূচিতে সংহতি, দেশব্যাপী ধর্মঘট আজ