সরকারের দ্বিতীয় ইনিংস শুরু
১৭ ফেব্রুয়ারি ২০২৫, ১২:০৫ এএম | আপডেট: ১৭ ফেব্রুয়ারি ২০২৫, ১২:০৫ এএম

প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বাধীন ‘জাতীয় ঐকমত্য কমিশন’ ও বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের মধ্যে বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়েছে গত শনিবার। ওই বৈঠকে ছয় সংস্কার কমিশনের প্রধানরা উপস্থিত ছিলেন। বৈঠকে বিএনপি, জামায়াত, নাগরিক কমিটি, এলডিপি, ইসলামী আন্দোলন, নাগরিক ঐক্যসহ ২৭টি দল ও জোটের প্রায় ১০০ জনপ্রতিনিধি অংশ নেন। অন্তর্বর্তী সরকার বিভিন্ন বিষয়ে ১১টি সংস্কার কমিশন গঠন করে, যার মধ্যে প্রথম দফায় গঠিত ছয়টি সংস্কার কমিশনের রিপোর্ট নিয়ে এই বৈঠক হয়েছে। সংস্কার বিষয়ে আশার কথা এই যে, বৈঠকে অংশগ্রহণকারী দল ও জোটের নেতৃবৃন্দের কেউই সংস্কারে দ্বিমত প্রকাশ করেননি। সংস্কার বিষয়ে এই রাজনৈতিক ঐকমত্যের তাৎপর্য বিশদ ব্যাখ্যার অবকাশ রাখে না। বৈঠকে প্রধান উপদেষ্টা বলেছেন, অন্তর্বর্তী সরকারের ছয় মাসে প্রথম ইনিংস বা প্রথম অধ্যায় শেষ হয়েছে। প্রথম অধ্যায় ছিল প্রস্তুতি পর্ব। শনিবারের রাজনৈতিক সংলাপের মাধ্যমে দ্বিতীয় অধ্যায় শুরু হলো। সিদ্ধান্ত ছিল, সংস্কার কমিশনগুলোর সংস্কার প্রস্তাব নিয়ে রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে আলোচনা হবে এবং তার ভিত্তিতে সিদ্ধান্ত গৃহীত হবে। সেই প্রক্রিয়া শুরু হলো। অতঃপর রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে পৃথক পৃথক আলোচনা হবে। সে আলোচনার ভিত্তিতে সিদ্ধান্ত চূড়ান্ত হবে। বলার অপেক্ষা রাখে না, সংস্কার, তা যে কোনো বিষয়ে, চলমান ব্যাপার। এতে ইতি বা ছেদ টানার সুযোগ নেই। স্বীকার করতেই হবে, পতিত স্বৈরাচার সংবিধান, প্রশাসন, পুলিশ, বিচার বিভাগ, নির্বাচন কমিশন, দুর্নীতি দমন কমিশন ইত্যাদিÑ কোনো কিছুই আস্ত রেখে যায়নি। সব কিছু ভেঙ্গেচুরে প্রায় অকার্যকর করে দিয়ে গেছে। এগুলোর সংস্কার ও পুনর্গঠন ছাড়া বিকল্প নেই। জাতীয় প্রয়োজনেই এই সংস্কার অত্যাবশক। গণতন্ত্র, ভোটাধিকার, সুশাসন, মানবাধিকার, ন্যায়বিচার, জবাবদিহিতা ইত্যাদি যখন লক্ষ্য, তখন এসবের নিশ্চিয়তাদানকারী সংস্কার এড়িয়ে যাওয়ার উপায় নেই। অন্তর্বর্তী সরকার প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে আইন ও গণসমর্থন ভিত্তি হিসেবে কাজ করলেও মানতে হবে, এ সরকার নির্বাচিত সরকার নয়। এ সরকারের সবচেয়ে বড় কাজ হলো, একটি অবাধ, সুষ্ঠু, নিরপেক্ষ নির্বাচন অনুষ্ঠানের মাধ্যমে নির্বাচিত সরকারের কাছে ক্ষমতা হস্তান্তর। এটা যথাযথভাবে করতে হলে বিভিন্ন ক্ষেত্রে প্রয়োজনীয় সংস্কার করতে হবে। প্রশ্ন উঠেছে, এই ‘প্রয়োজনীয় সংস্কার’ কতটা? উত্তর হতে পারে, নির্বাচনের জন্য যতটা দরকার। বিভিন্ন ক্ষেত্রে সংস্কার বিষয়ে যে সম্মিলিত সিদ্ধান্ত হবে, জরুরি সংস্কার বাদে সেগুলোর বাস্তাবায়ন নির্বাচিত সরকার করবে।
সংস্কার ও নির্বাচনের মধ্যে এক ধরনের বিরোধাভাস লক্ষ করা যাচ্ছে। আগে সংস্কার, পরে নির্বাচন বলার চেষ্টা করছে কেউ কেউ। কেউ কেউ আগে নির্বাচন চাইছে, সংস্কারের বিষয়টি তেমন আমলে আনছে না, আসলে এ রকম মতভেদের অবকাশ খুবই কম। মনে রাখতে হবে, সংস্কার পর্ব দীর্ঘ হলে নির্বাচন বিলম্বিত হবে। এতে নানা সংকট-সমস্যা দেখা দেবে। আবার জরুরি সংস্কার বাদ রেখে তাড়াহুড়া করে নির্বাচন দিলে নির্বাচনের গ্রহণযোগ্যতা প্রশ্নের সম্মুখীন হবে। না, আগে পরে নয়, সংস্কার নির্বাচন দুই-ই হতে হবে। এটাই বাস্তবের চাহিদা। বিএনপি নির্বাচনের ব্যাপারে সোচ্চার হলেও সংস্কারকে বাতিল করেনি। জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের সঙ্গে বৈঠকে বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বলেছেন, খুব দ্রুত সংস্কারের ঐক্যমতের ভিত্তিতে অতি দ্রুত নির্বাচন হতে হবে। জামায়াতে ইসলামীর পক্ষ থেকে বলা হয়েছে, সংস্কারের বিষয়ে ঐকমত্যের পর নির্বাচন হতে হবে। প্রধান দুই দলের বক্তব্যের মধ্যে তেমন একটা ফারাক নেই। অন্যান্য দল ও জোট সংস্কার এবং নির্বাচনের পক্ষেই অভিমত দিয়েছে। কিছু কিছু বিষয়ে রাজনৈতিক দল ও জোটের মধ্যে মত পার্থক্য পরিলক্ষিত হয়েছে। জাতীয় ও স্থানীয় সরকার নির্বাচন নিয়ে কথা উঠেছে। বিএনপির পক্ষে বলা হয়েছে, আগে জাতীয় নির্বাচন, পরে স্থানীয় সরকার নির্বাচন। জামায়াতে ইসলামীর পক্ষে বলা হয়েছে, আগে স্থানীয় সরকার নির্বাচন, পরে জাতীয় নির্বাচন। বর্তমান পদ্ধতিতে ভোট ও আনুপাতিক পদ্ধতিতে ভোটÑ এনিয়ে এই দুই দলের মধ্যে পার্থক্য দেখা দিয়েছে। বিএনপি বর্তমান পদ্ধতির পক্ষে আর জামায়াত আনুপাতিক পদ্ধতির পক্ষে। পর্যবেক্ষক মহলের মতে, সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার জাতীয় নির্বাচন। একে পেছনে ফেলে স্থানীয় সরকার নির্বাচন আগে করার মানে হয় না। এতে গ্রাম-গঞ্জে আইনশৃঙ্খলার অবনতি ঘটতে পারে, যা জাতীয় নির্বাচনে প্রভাব ফেলতে পারে। জাতীয় নির্বাচন সরকার গঠনের নির্বাচন, স্থানীয় সরকার নির্বাচন তা নয়। তাদের মতে, বিদ্যমান বাস্তবতায় বর্তমান পদ্ধতিতেই ভোট হওয়া উচিত। আনুপাতিক পদ্ধতিতে ভোট হলে পতিত স্বৈরাচারের অনুসারী-অনুগামীরা সংসদে কিছু আসন পেয়ে যেতে পারে, যা জুলাই বিপ্লবের চেতনার সঙ্গে যায় না। তাই এমন কিছু করা উচিত হবে না, যাতে যে দলটি মানবতার বিরুদ্ধে অপরাধ করেছে তার কেউ নির্বাচিত হোক, এত সহজে পুনর্বাসিত হোক। মাফিয়া সংগঠন আওয়ামী লীগকে নিষিদ্ধ করার দাবি ইতোমধ্যে আরো জোরদার হয়েছে। রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের বৈঠকে এ নিয়েও কথাবার্তা হয়েছে। বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের আহ্বায়ক হাসনাত আব্দুল্লাহ জানিয়েছেন, আওয়ামী লীগের নিবন্ধন বাতিলের ব্যাপারে সব দল মৌখিকভাবে একমত হয়েছে। এটা অবশ্যই একটি ইতিবাচক দিক।
সংস্কার ও নির্বাচনের বিষয়ে রাজনৈতিক ঐকমত্য আগে ছিল, আলোচ্য বৈঠকে তা পুনর্ব্যক্ত হয়েছে। সংস্কারের পরিধি ও নির্বাচনের সময় নিয়ে যে মত পার্থক্য রয়েছে, তার সমাধান আলোচনার মাধ্যমেই সম্ভব হবে। অন্যান্য ক্ষেত্রে যেসব মতভিন্নতা দৃশ্যমান হয়েছে, খোলাখুলি আলোচনায় তারও সমাধান হবে বলে আমাদের বিশ্বাস। যেসব ক্ষেত্রে ঐকমত্য রয়েছে তা তো আছেই। সংস্কার কমিশনগুলোর প্রতিবেদন পাওয়ার পর রাজনৈতিক দলগুলোর প্রত্যেকের সঙ্গে পৃথক পৃথক আলোচনা যখন হবে, তখন আরও অভিন্ন ও ভিন্ন অভিমত সামনে আসবে। বিভিন্ন মতামত একমতে রূপান্তর হবে, এটা ধারণা করার কারণ নেই। বিতর্কিত বিষয়গুলো ভবিষ্যতের জন্য রেখে দিতে হবে। যেসব বিষয়ে ঐকমত্য হবে, সেসব বাস্তবায়ন রাজনৈতিক অঙ্গীকার হিসাবে গণ্য হবে। আমরা লক্ষ করছি, অন্তর্বর্তী সরকারের সময়কাল ছয় মাস পেরিয়ে গেলেও প্রশাসন, পুলিশ, অর্থনৈতিক সেক্টর ইত্যাদিতে তার পূর্ণ নিয়ন্ত্রণ এখনো প্রতিষ্ঠিত হয়নি। প্রশাসন-পুলিশে পতিত স্বৈরাচারের দোসরদের অনেকে বহাল তবিয়তে আছে। অর্থনীতি নিয়ন্ত্রণ করছে পতিত স্বৈরাচারের অলিগার্ক ব্যবসায়ীরা। পণ্যমূল্য নিয়ন্ত্রণহীন। সিন্ডিকেট এখনো সক্রিয়। মানুষের নিরাপত্তা, সুশাসন ও জীবনযাপনে স্বস্তি ক্রমাগত কমছে। সরকার ব্যর্থ প্রতিপন্ন হচ্ছে, জনপ্রিয়তা হারাচ্ছে। এমতাবস্থায়, সর্বক্ষেত্রে সরকারের শাসন ও নিয়ন্ত্রণ যেমন বাড়াতে হবে, তেমনি যতটুকু সংস্কার করে নির্বাচন সম্ভব, ততটুকু সংস্কার করে নির্বাচন অনুষ্ঠানের ব্যবস্থা করতে হবে। প্রধান উপদেষ্টা আবারও বলেছেন, এবছর ডিসেম্বরের মধ্যে নির্বাচন হতে পারে। সে অনুযায়ী সরকার ও নির্বাচন কমিশনের প্রস্তুতি আছে কি? এর মধ্যেই সবকিছুকে নির্বাচনমুখী করা যাবে কি? সরকারের দ্বিতীয় ইনিংস শুরু হলো বটে, তবে সে ইনিংস সাফল্যের সঙ্গে শেষ করার চ্যালেঞ্জ আছে। আমরা আশা করি, সরকার সে চ্যালেঞ্জে উত্তীর্ণ হবে। রাজনৈতিক দলগুলো সরকারকে প্রয়োজনীয় সহযোগিতা দেবে, সেটাই কাম্য।
বিভাগ : সম্পাদকীয়
মন্তব্য করুন
আরও পড়ুন

রাশিয়ার পক্ষে যুদ্ধে গেছে শত বাংলাদেশি

ইন্দুরকানীতে ডায়রিয়া রোগীর প্রকোপ হাসপাতালে কলেরা স্যালাইন সংকট

গাজায় মানবিক বিপর্যয় নিয়ে জাতিসংঘের উদ্বেগ, অবরোধ তুলে নেওয়ার আহ্বান

এসএসসি পরীক্ষাকেন্দ্রে ১৪৪ ধারা, কোচিং-ফটোকপি বন্ধসহ একগুচ্ছ নির্দেশনা

এশিয়ার শেয়ারবাজারে বড় ধস, তেলের দামেও পতন

গাজা ইস্যুতে সিসি ও ম্যাখোঁর সঙ্গে জর্দানের রাজার বৈঠক আজ

ঐকমত্য কমিশনের সংলাপ ফের শুরু আজ

সকালে ব্রিদিং এক্সারসাইজের উপকারিতা

মতলব দক্ষিণ থানার এসআই জীবন চৌধুরীর বেতন বন্ধের নির্দেশ

সাবেক এমপি কেরামত আলী গ্রেফতার

নীলফামারীর উত্তরা ইপিজেডে মেশিন বিস্ফোরণে ২জন শ্রমিক দগ্ধ

ট্রাম্পের সাথে বৈঠক করতে যুক্তরাষ্ট্রে ছুটলেন নেতানিয়াহু

বিক্ষোভে উত্তাল মণিপুর, নেতার বাড়িতে আগুন দিলো জনতা

ঢাকায় ৪ দিনব্যাপী বিনিয়োগ সম্মেলন আজ শুরু

ইয়েমেনে সর্বশেষ মার্কিন বিমান হামলায় নিহত ৪

মধ্যপ্রাচ্যের ৬ দেশকে হুমকি ইরানের, যুদ্ধের শঙ্কা

রাজধানীর বংশালে আগুন, নিহত ১, আহত ৭

গাজায় ইসরায়েলি বর্বরতার প্রতিবাদে বিশ্বজুড়ে আজ ধর্মঘট

দুর্ঘটনার কবলে জামায়াত নেতাকর্মীদের বহনকারী বাস, নিহত ৩

ঈদকে কেন্দ্র করে কৃষি নির্ভর বরিশাল অঞ্চলের অর্থনীতিতে নতুন প্রাণের সঞ্চার