বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড কাম্য নয়

Daily Inqilab ইনকিলাব

২২ ফেব্রুয়ারি ২০২৫, ১২:০৬ এএম | আপডেট: ২২ ফেব্রুয়ারি ২০২৫, ১২:০৬ এএম

গত বুধবার মধ্যরাতে মোহাম্মদপুরের চাঁদ উদ্যানে যৌথ বাহিনীর সঙ্গে গোলাগুলির সময় দুই ব্যক্তি নিহত হয়েছেন। এ সময় অস্ত্র-গুলিসহ পাঁচজনকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। পুলিশ ও যৌথ বাহিনী বলেছে, নিহত ব্যক্তিরা ছিনতাইয়ের প্রস্তুতি নিচ্ছিলেন। তাদের বিরুদ্ধে মোহাম্মদপুর থানায় ছিনতাই, ডাকাতিসহ একাধিক মামলা রয়েছে। গত বৃহস্পতিবার যৌথ অভিযান নিয়ে আন্তঃবাহিনী জনসংযোগ পরিদপ্তরের (আইএসপিআর) এক বিবৃতিতে বলা হয়, চাঁদ উদ্যান এলাকায় ছিনতাইয়ের প্রস্তুতি নিচ্ছে, এমন তথ্যের ভিত্তিতে বুধবার দিবাগত রাত সাড়ে ১২টার দিকে যৌথ বাহিনীর একটি দল সেখানে অভিযান চালায়। অভিযানের সময় যৌথ বাহিনীর সদস্যরা একটি গলির দুই পাশ ঘিরে ফেলেন। তখন সন্ত্রাসীরা একটি একতলা ভবনের ছাদ থেকে আভিযানিক দলটির ওপর অতর্কিত গুলি চালায়। আভিযানিক দলটি আত্মরক্ষার্থে তৎক্ষণাৎ পাল্টা ব্যবস্থা গ্রহণ করে এবং পাঁচ সন্ত্রাসীকে অস্ত্রসহ আটক করে। পরে বাড়িটিতে তল্লাশি চালিয়ে ছাদের ওপর থেকে দুজনের মরদেহ উদ্ধার করা হয। আটক ব্যক্তিদের কাছ থেকে একটি পিস্তল, চারটি গুলি ও একটি চাপাতি উদ্ধার করা হয়েছে। জনগণের জানমালের নিরাপত্তা রক্ষার্থে এ ধরনের অভিযান অব্যাহত থাকবে বলে বিবৃতিতে উল্লেখ করা হয়। যৌথ বাহিনীর অভিযান এবং আইএসপিআর-এর বিবৃতি থেকে মনে হচ্ছে, এ যেন অনেকটা ফ্যাসিস্ট শেখ হাসিনার শাসনামলে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর কথিত ক্রস ফায়ারের বয়ানেরই অনুরূপ। আমরা দেখেছি, সে সময় পুলিশ বা র‌্যাবের অভিযানকালে সন্ত্রাসীরা আক্রমণ করলে অত্মরক্ষার্থে পুলিশ বা র‌্যাব গুলি ছোঁড়ে এবং তাতে সন্ত্রাসী নিহত হয়। সে সময় বিভিন্ন মানবাধিকার সংস্থা ও সচেতন মহলের কাছে তা বিশ্বাসযোগ্য হয়নি। তারা একে বিচারবর্হিভূত হত্যাকা- হিসেবে অভিহিত করেছেন। তারা বারবার বলেছেন, যেকোনো মানুষ, সে যত বড় অপরাধী হোক না কেন, তাকে বিচারের মুখোমুখি করে শাস্তি নিশ্চিত করতে হবে। তার বিচার পাওয়ার অধিকার রয়েছে। এসবের কোনো কিছুর তোয়াক্কা না করেই হাসিনার আইনশঙ্খলা বাহিনী তথাকথিত ক্রসফায়ার ও বিচারবর্হিভূত হত্যাকা- অব্যাহত রেখেছিল।

ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে ফ্যাসিস্ট হাসিনার পতনের পর বিপুল জনসমর্থন নিয়ে অন্তর্বর্তী সরকার দায়িত্ব গ্রহণ করেছে। জনগণের প্রত্যাশা, এ সরকার দেশের অর্থনীতি ও আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির দ্রুত উন্নয়ন ঘটাবে। পরিতাপের বিষয়, সরকারের মেয়াদ ছয় মাস পার হয়ে গেলেও সে প্রত্যাশা পূরণ হয়নি। মানুষ একদিকে যেমন অর্থনৈতিক দুর্দশার মধ্যে রয়েছে, অন্যদিকে আইনশৃঙ্খলার অবনতিতে নিরাপত্তাহীনতার মধ্যে রয়েছে। তারা একধরনের ভয় ও উৎকণ্ঠার মধ্যে জীবনযাপন করছে। আমরা দেখেছি, এ সরকারের শুরুর দিকে রাজধানীতে কীভাবে ডাকাতের আতঙ্ক বেড়ে গিয়েছিল। পাড়া-মহল্লার লোকজন রাত জেগে বাড়িঘর পাহারা দিয়েছে। সে সময় পুলিশ বাহিনী অত্যন্ত নাজুক অবস্থায় ছিল। তারা ট্রমা কাটিয়ে উঠতে পারছিল না। থানাগুলো প্রায় অকার্যকর অবস্থায় ছিল। সে পরিস্থিতির কিছুটা হলেও উন্নতি ঘটেছে। আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে সেনাবাহিনী, পুলিশ, র‌্যাবসহ অন্যান্য বাহিনীর সমন্বয়ে ‘ডেভিল হান্ট’ নামে যৌথ অভিযান শুরু চলছে। জানুয়ারির শেষের দিকে যৌথ বাহিনীর কিছু সদস্য কুমিল্লা সদর উপজেলার পাঁচথুরি ইউনিয়নের যুবদলের আহ্বায়ক তৌহিদুল ইসলামকে রাতে তুলে নিয়ে যায়। পরদিন তাকে থানায় যখন সোপর্দ করা হয়, তখন সে অচেতন ছিল এবং হাসপাতালে নেয়ার পর চিকিৎসক তাকে মৃত ঘোষণা করে। তার শরীরের বিভিন্ন জায়গায় আঘাতের চিহ্ন ছিল। এ ঘটনাকে যৌথবাহিনীর হেফাজতে থাকাবস্থায় মৃত্যু হিসেবে তার পরিবার অভিহিত করে। শুধু এ ঘটনা নয়, অন্তর্বর্তী সরকারের সাড়ে ছয় মাসে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর হেফাজতে ১৭ জনের মৃত্যু হয়েছে বলে বেসরকারি সংস্থা আইন ও সালিশ কেন্দ্রের বরাত দিয়ে জার্মান সংবাদ সংস্থা ডয়েচে ভেলের এক প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে। এ পরিসংখ্যান নিশ্চিতভাবেই উদ্বেগ ও দুঃখজনক। কীভাবে এ ধরনের ঘটনা ঘটে? জনসমর্থিত সরকারের সময় হাসিনার শাসনামলের মতো আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর হেফাজতে মৃত্যুর ঘটনা ঘটবে, এটা কল্পনাও করা যায় না। তাহলে, ফ্যাসিস্ট শেখ হাসিনার সরকার এবং এ সরকারের মধ্যে পার্থক্য থাকল কোথায়? গত বুধবার মোহাম্মদপুরের ঘটনাটি হাসিনার শাসনামলে তথাকথিত ক্রসফায়ারের ঘটনার পুনরাবৃত্তি। সে সময় এ ধরনের ঘটনার পর যে ধরনের ব্যাখ্যা দেয়া হতো, তার সাথে এ সময়ের ব্যাখ্যার মিল খুঁজে পাওয়া যায়। পার্থক্য শুধু সে সময় আসামীকে নিয়ে অস্ত্রের সন্ধানে অভিযানে বের হলে বলা হতো, তার সহযোগীরা হামলা করায় আত্মরক্ষার্থে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী পাল্টা গুলি করায় মৃত্যু হয়েছে। এক্ষেত্রে তা না ঘটলেও আত্মরক্ষায় গুলি ছোঁড়ার কথা বলা হয়েছে। উল্লেখের অপেক্ষা রাখে না, যেকোনো অভিযানের আগে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীগুলোর কাছে আগাম তথ্য থাকে এবং সে অনুযায়ী ব্যবস্থা গ্রহণ করা স্বাভাবিক। এক্ষেত্রে অভিযুক্তদের কীভাবে গ্রেফতার করা যায়, সে ব্যাপারে নিশ্চয় অভিযানকারিদের কৌশল ও প্রশিক্ষণ থাকে। বিপজ্জনক সন্ত্রাসীরা কী করতে পারে এবং তা কীভাবে মোকাবেলা করে গ্রেফতার করা যায়, সে কৌশল নিতে হয়। তারা যদি টেরই পেয়ে যায়, তাহলে সে অভিযান সফল হওয়ার সম্ভাবনা কম থাকে এবং পাল্টাপাল্টি গুলির ঘটনা ঘটে।

দেশের আইনশৃঙ্খলা নিয়ন্ত্রণে অভিযান অবশ্যই চলবে। তবে এক্ষেত্রে যাতে ক্রসফায়ারের নামে বিচারবর্হিভূত হত্যাকা-ের ঘটনা না ঘটে, এ ব্যাপারে সতর্ক থাকা বাঞ্চনীয়। ইতোমধ্যে মানবতাবিরোধী অপরাধে র‌্যাবকে দেশ ও বিদেশ থেকে নিষিদ্ধ করার কথা বলা হয়েছে। তারপর যদি সরকারের হুঁশ না হয়, তাহলে তা দুঃখজনক। দেখা যাচ্ছে, আইনশৃঙ্খলা নিয়ন্ত্রণ করতে গিয়ে পরিস্থিতির অবনতি ঘটছে। চুরি, ডাকাতি বেড়ে গেছে। গত সোমবার ঢাকা থেকে গাজীপুর হয়ে রাজশাহী যাওয়া এক নৈশবাসে যাত্রীরা ডাকাতের কবলে পড়ে। ডাকাতদল শুধু পুরুষ যাত্রীদের নির্যাতন করেনি, মহিলা যাত্রীদের যৌন নিপীড়ন ও ধর্ষণ করেছে। ভয়াবহ এ ঘটনায় যৌথ বাহিনীর কোনো তৎপরতা এখন পর্যন্ত পরিলক্ষিত হয়নি। গতকাল ইনকিলাবের এক প্রতিবেদন থেকে জানা যায়, অন্যকে ফাঁসাতে এক বালু শ্রমিকের স্বাভাবিক মৃত্যুকে পুলিশ হত্যাকা- হিসেবে চালিয়ে দিয়েছে। পুলিশের এ ধরনের অপকর্ম যদি এখনো চলে, তবে তা দুর্ভাগ্য ছাড়া কিছু নয়। এসব ঘটনা জনমনে আতঙ্ক ও অনিরাপত্তা জন্ম দিয়েছে। অবস্থাদৃষ্টে প্রতীয়মান হচ্ছে, আইনশৃঙ্খলা বাহিনী ও যৌথ অভিযানে সমন্বয়ের অভাব রয়েছে। ডিসি সম্মেলনে ডিসিরা বর্তমানে দেশের আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি ও দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতি প্রধান সমস্যা চিহ্নিত করে তা মোকাবেলার ওপর গুরুত্ব দেয়ার আহ্বান জানিয়েছেন। উল্লেখ করে যথাযথ পদক্ষেপ নেয়ার কথা বলেছেন। বলা বাহুল্য, আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি যদি নাজুক থাকে, তাহলে মানুষের নিরাপত্তা বলে কিছু থাকে না। আইনশৃঙ্খলা নিয়ন্ত্রণে নিয়োজিত বাহিনীই যদি হন্তারকের ভূমিকায় অবর্তীণ হয়, আইনের শাসনের তোয়াক্কা না করে, তাহলে মানুষ যাবে কোথায়? পর্যবেক্ষকদের মতে, অপরাধী যত বড় হোক, কোন প্রেক্ষাপট বা পরিস্থিতিতে নিহত হয়েছে, এ ব্যাখ্যা না দিয়ে কীভাবে তাকে গ্রেফতার করে আইনের মুখোমুখি করা যায়, এ পদক্ষেপ নিতে হবে। কেউ যাতে বিচারবর্হিভূত হত্যার শিকার না হয়, তা নিশ্চিত করতে হবে। মোহাম্মদপুরের ঘটনার যত দ্রুত সম্ভব তদন্ত করে কার্যকর পদক্ষেপ নিতে হবে। নতুন বাংলাদেশে মানুষ হাসিনার শাসনামলের মতো তুলে নিয়ে যাওয়া, আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর হেফাজতে মৃত্যু, অত্মরক্ষার নামে তথাকথিত ক্রসফায়ারের ঘটনার পুনরাবৃত্তি দেখতে চায় না।


বিভাগ : সম্পাদকীয়


মন্তব্য করুন

HTML Comment Box is loading comments...

এই বিভাগের আরও

মিয়ানমারে ভূমিকম্প এবং আমাদের ভয়
ড. মুহাম্মদ ইউনূসের উচিৎ কথা
আইএমএফ’র ঋণের প্রশ্নে সরকারকে কঠোর অবস্থান নিতে হবে
মুক্তিযুদ্ধ থেকে ছাত্র-জনতার অভ্যুদয়
শিক্ষাব্যবস্থার ব্ল্যাকবক্স খোলার এখনই সময়
আরও
X

আরও পড়ুন

সাবেক এমপি আফজাল ৭ দিনের রিমান্ডে

সাবেক এমপি আফজাল ৭ দিনের রিমান্ডে

ক্ষমা চাইলেন ড্যাফোডিলের সেই শিক্ষিকা

ক্ষমা চাইলেন ড্যাফোডিলের সেই শিক্ষিকা

সারাদেশে চলছে ‘নো ওয়ার্ক নো ক্লাস’ কর্মসূচি

সারাদেশে চলছে ‘নো ওয়ার্ক নো ক্লাস’ কর্মসূচি

ইসরায়েলি বর্বর হামলায় গাজায় ২০ দিনে ৪৯০ শিশু নিহত

ইসরায়েলি বর্বর হামলায় গাজায় ২০ দিনে ৪৯০ শিশু নিহত

চট্টগ্রামে কোরিয়ান ইপিজেড পরিদর্শনে ৪০ দেশের প্রতিনিধি

চট্টগ্রামে কোরিয়ান ইপিজেড পরিদর্শনে ৪০ দেশের প্রতিনিধি

রাশিয়ার পক্ষে যুদ্ধে গেছে শত বাংলাদেশি

রাশিয়ার পক্ষে যুদ্ধে গেছে শত বাংলাদেশি

ইন্দুরকানীতে ডায়রিয়া রোগীর প্রকোপ হাসপাতালে কলেরা স্যালাইন সংকট

ইন্দুরকানীতে ডায়রিয়া রোগীর প্রকোপ হাসপাতালে কলেরা স্যালাইন সংকট

গাজায় মানবিক বিপর্যয় নিয়ে জাতিসংঘের উদ্বেগ, অবরোধ তুলে নেওয়ার আহ্বান

গাজায় মানবিক বিপর্যয় নিয়ে জাতিসংঘের উদ্বেগ, অবরোধ তুলে নেওয়ার আহ্বান

এসএসসি পরীক্ষাকেন্দ্রে ১৪৪ ধারা, কোচিং-ফটোকপি বন্ধসহ একগুচ্ছ নির্দেশনা

এসএসসি পরীক্ষাকেন্দ্রে ১৪৪ ধারা, কোচিং-ফটোকপি বন্ধসহ একগুচ্ছ নির্দেশনা

এশিয়ার শেয়ারবাজারে বড় ধস, তেলের দামেও পতন

এশিয়ার শেয়ারবাজারে বড় ধস, তেলের দামেও পতন

গাজা ইস্যুতে সিসি ও ম্যাখোঁর সঙ্গে জর্দানের রাজার বৈঠক আজ

গাজা ইস্যুতে সিসি ও ম্যাখোঁর সঙ্গে জর্দানের রাজার বৈঠক আজ

ঐকমত্য কমিশনের সংলাপ ফের শুরু আজ

ঐকমত্য কমিশনের সংলাপ ফের শুরু আজ

সকালে ব্রিদিং এক্সারসাইজের উপকারিতা

সকালে ব্রিদিং এক্সারসাইজের উপকারিতা

মতলব দক্ষিণ থানার এসআই জীবন চৌধুরীর বেতন বন্ধের নির্দেশ

মতলব দক্ষিণ থানার এসআই জীবন চৌধুরীর বেতন বন্ধের নির্দেশ

সাবেক এমপি কেরামত আলী গ্রেফতার

সাবেক এমপি কেরামত আলী গ্রেফতার

নীলফামারীর উত্তরা ইপিজেডে মেশিন বিস্ফোরণে ২জন শ্রমিক দগ্ধ

নীলফামারীর উত্তরা ইপিজেডে মেশিন বিস্ফোরণে ২জন শ্রমিক দগ্ধ

ট্রাম্পের সাথে বৈঠক করতে যুক্তরাষ্ট্রে ছুটলেন নেতানিয়াহু

ট্রাম্পের সাথে বৈঠক করতে যুক্তরাষ্ট্রে ছুটলেন নেতানিয়াহু

বিক্ষোভে উত্তাল মণিপুর, নেতার বাড়িতে আগুন দিলো জনতা

বিক্ষোভে উত্তাল মণিপুর, নেতার বাড়িতে আগুন দিলো জনতা

ঢাকায় ৪ দিনব্যাপী বিনিয়োগ সম্মেলন আজ শুরু

ঢাকায় ৪ দিনব্যাপী বিনিয়োগ সম্মেলন আজ শুরু

ইয়েমেনে সর্বশেষ মার্কিন বিমান হামলায় নিহত ৪

ইয়েমেনে সর্বশেষ মার্কিন বিমান হামলায় নিহত ৪