কীভাবে শিশুদের বই পড়ার অভ্যাস গড়ে তোলা যায়
২৫ ফেব্রুয়ারি ২০২৫, ১২:০১ এএম | আপডেট: ২৫ ফেব্রুয়ারি ২০২৫, ১২:০১ এএম

একবিংশ শতাব্দিতে প্রযুক্তির উন্নয়ন হয়েছে ঠিক, কিন্তু শিক্ষার্থীদের মধ্যে বই পড়ার অভ্যাস প্রতিনিয়ত কমতে শুরু করেছে। ডিজিটাল উপকরণ বৃদ্ধি পাওয়াতে শিশুরা মুদ্রিত বই পড়া থেকে সরে পড়ছে। অথচ, একটি স্বাস্থ্যকর পড়ার অভ্যাস থাকা আমাদের শিশুদের সুস্থ বিকাশের জন্য অপরিহার্য। শিশুকাল থেকে বইয়ের প্রতি শিশুদের আগ্রহ এবং বই পড়ার প্রতি ভালোবাসা সৃষ্টি করতে পিতামাতা ও স্কুলের গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রয়েছে। অল্প বয়স থেকেই শিশুদেরকে পড়ার উপকরণগুলির সাথে পরিচয় করিয়ে দিতে পারলে তাদের মধ্যে বই পড়ার অভ্যাস তৈরি হতে পারে।
সেথ গডিন বলেছেন, ‘সফল ব্যক্তিরা বেশি বই পড়েন এটা কোন দুর্ঘটনা নয়’। বিশ্বের দুই ধনী ব্যক্তি জেফ বেজোস এবং বিল গেটস বই পড়েন। বিল গেটস সম্পর্কে বছরে ৫০টি বই পড়ার গল্পও রয়েছে। সফল ব্যক্তিদের মধ্যে বাণিজ্যিক কৌশলগত ভিন্নতা থাকলেও তাদের সকলের মধ্যে বই পড়ার বিষয়ে অনেক মিল লক্ষ করা যায়। শিশুকাল থেকে বই পড়ার অভ্যাস তৈরি করতে পারলে শিশুদের জ্ঞান, শব্দভা-ার, সৃজনশীলতা এবং সমালোচনামূলক চিন্তাভাবনার দক্ষতা বৃদ্ধি পায়।
প্রতিটা পরিবারে বই সংগ্রহ করার একটি সংস্কৃতি গড়ে তুললে শিশুরা বইয়ের প্রতি আকৃষ্ট হতে পারে। এজন্য পিতামাতা অক্ষরজ্ঞানহীন বা স্বল্পশিক্ষিত হলেও তাদের সন্তানদের নিয়মিত বইয়ের লাইব্রেরিতে নিয়ে যাওয়া উচিত। প্রতি বছর দেশব্যাপী বই মেলা বা গ্রন্থাগার দিবস উদযাপিত হলে শিশুদের সেখানে নিয়ে গিয়ে তাদের জন্য মজার মজার বই কিনে দিলে শিশুদের মধ্যে বই পড়ার অভ্যাস তৈরি হবে। এছাড়া, প্রত্যেক পরিবারের কোনো ঘরের কোণে শিশুদের জন্য একটি বইয়ের শেল্ফ থাকা আবশ্যক, যা দেখে তাদের মধ্যে বই পড়ার আগ্রহ সৃষ্টি হতে পারে।
প্রতিটি শ্রেণিকক্ষে একটি পড়ার কর্নার থাকা উচিত, যেখানে আকর্ষণীয় এবং অনুপ্রেরণামূলক বই ও পড়ার উপকরণ থাকতে পারে, যা একটি বন্ধুত্বপূর্ণ শিক্ষার পরিবেশ তৈরি করে। এটি শিশুদের জন্য বিনামূল্যে বই পড়ার সুযোগ তৈরি করে এবং তাদের মধ্যে বই সংগ্রহ করার ইচ্ছা জেগে ওঠে।
স্কুল কর্তৃপক্ষকে এটি নিশ্চিত করতে হবে যে, স্কুলের লাইব্রেরিতে ভালো বই রয়েছে এবং বই পড়ার জন্য একটি মজাদার ও আরামদায়ক জায়গাও বরাদ্দ রাখা হয়েছে। বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি চর্চা, সুস্থ্য জীবনযাপন প্রণালী ও চরিত্র উন্নয়নধর্মী বইপুস্তকের ব্যাপক সংগ্রহ থাকা আবশ্যক, যাতে শিক্ষার্থীরা তাদের উন্নত জীবন গঠনের শিক্ষা গ্রহণ করতে পারে এবং ভালো বই পড়ার অভ্যাস তৈরি করতে পারে।
আমাদের সমাজের সকল ধরনের সভা-সমাবেশ এবং সেমিনার-সিম্পোজিয়ামে শিশুদের বই পড়ার প্রতি আগ্রহী হওয়ার জন্য অনুপ্রেরণা জোগানো উচিত। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে আবশ্যকীয়ভাবে শিক্ষার্থীদের কবিতা আবৃত্তি, উক্তি চয়ন, বইয়ের একটি অংশ পাঠ, সংবাদপত্রের শিরোনাম পড়া, তাদের প্রিয় বইয়ের পছন্দের অংশটি পড়তে শেখানোর সংস্কৃতি গড়ে তোলা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। এটি শিক্ষার্থীদের মধ্যে ব্যাপকভাবে পড়ার অনুভূতি তৈরি করে এবং শব্দের খেলা উপভোগ করার তৃপ্তি দেয়।
প্রতিটি ক্লাসে এমন একটি সময় বরাদ্দ করা উচিত, যখন শিশুরা তাদের পছন্দের বইটি স্বাধীনভাবে পড়ার জন্য বেছে নেয় অথবা ক্লাসের সামনে জোরে জোরে পড়ে শোনায় অথবা বইটি কী নিয়ে আলোচনা করে তা পড়ার জন্য একটি বৃত্ত তৈরি করে অথবা প্রতিটি বইয়ের উপর একটি কুইজ আয়োজন করে। প্রতিদিন বই পড়ার জন্য প্রত্যেক পরিবারেও শিশুদের জন্য একটি সময় নির্দিষ্ট করা যেতে পারে।
প্রতিটি শিক্ষার্থীর জন্য একটি লক্ষ্য নির্ধারণ করতে হবে, যাতে তারা তাদের পছন্দমত নির্দিষ্ট সংখ্যক বই পড়তে পারে। যে ক্লাসে সর্বাধিক সংখ্যক বই থাকবে এবং শিক্ষার্থীরা বেশি পড়ার অভ্যাস দেখাতে পারবে, সে ক্লাসের সকলকে বা ভালো পারফর্মারদের একটি উপহার দেয়া যেতে পারে। এটি শিশুদের মধ্যে সাহিত্যের বিকাশ ঘটায় এবং তাদের বই পড়ার জন্য উৎসাহিত করে। স্কুলের প্রতি শিক্ষাবর্ষে শিক্ষার্থীদের মাঝে বুকরিডিং কম্পিটিশন বা বই পঠন প্রতিযোগিতার আয়োজন করা উচিত।
প্রত্যেক স্কুলে সহপাঠ্যক্রমিক শিক্ষার অংশ হিসেবে অন্যান্য ক্লাবের ন্যায় বুক রিডিং ক্লাব নামেও একটি ক্লাব কার্যক্রম চালু রাখা আবশ্যক। এ ক্লাব গঠন বই এবং পড়ার সাথে সংযোগ স্থাপনের একটি নিখুঁত উপায়। বই ক্লাবগুলি স্কুলের সময়, স্কুলের পরে, অথবা সুবিধামত নির্ধারিত সপ্তাহান্তে আয়োজন করা হতে পারে।
মাঝেমধ্যে স্কুলের সকল ছাত্রছাত্রীদের নিয়ে বই লেখকদের সাথে একটি বই আসর বসানো যেতে পারে। লেখকদের, বিশেষ করে শিশুদের বই লেখকদের আসর বসিয়ে শিশুদের বইয়ের একটি অংশ পড়তে বললে শিশুদের মধ্যে বই কেনা ও পড়ার আগ্রহ জেগে ওঠে। এ ধরনের আয়োজন শিশুদের জন্য লেখকদের সাথে দেখা করার এবং তাদের বই পড়ার অভ্যাস তৈরি করার জন্য একটি শক্তিশালী অনুশীলন।
স্কুলের বড় শিক্ষার্থীদের সাথে ছোট শিক্ষার্থীদের বই পঠনের অভ্যাস তৈরি করা যেতে পারে। এটি শিশুদের মধ্যে পড়ার প্রতি আরো ভালোবাসা বৃদ্ধি করে এবং উৎসাহিত করে। বই-বন্ধুদের একত্রিত করে শিক্ষার্থীদের মধ্যে ব্যাপক বই প্রীতি বৃদ্ধি করা সম্ভব।
স্কুলের কারিকুলামের মধ্যে মজাদার বা আনন্দ তৈরি করতে পারে এমন কিছু পাঠক্রম যোগ করা যেতে পারে। যেমন, ধাঁধার আকারে অ্যাক্টিভিটি বই ব্যবহার করা এবং শব্দ অনুসন্ধানও শিশুদের মধ্যে পড়ার প্রবণতা বৃদ্ধির একটি মজাদার উপায়। একটি শিশু সবেমাত্র পড়তে শিখছে কিনা বা তারা সাবলীল কিনা তা নির্বিশেষে, তাদের বইয়ের প্রতি আগ্রহী করে তুলতে শিক্ষকরা বিভিন্ন পঠন কুইজ চর্চার মাধ্যমে শিশুদের পড়ার অভ্যাস তৈরি করতে পারে। শিশুদের আগ্রহের বিষয়গুলি খুঁজে বের করতে এবং আকর্ষণীয় ও মজাদার বই খুঁজে পেতে তাদেরকে সাহায্য করার জন্য শিক্ষক ও পরিবারকে দায়িত্বশীল আচরণ করতে হবে।
শিশুদের প্রথমবারের মতো কোন বই পড়াতে প্রত্যেক পিতামাতা বা শিক্ষক প্রায়শই কিছুটা দুশ্চিন্তায় পড়তে পারেন। শিশুরা কোন বইটি পছন্দ করবে বা আদৌও বই পড়তে চায় কিনা সেটি নির্ধারণ করা কষ্টসাধ্য হতে পারে। তাই, শিশুর অভিজ্ঞতাকে আরও আকর্ষক করতে আমরা টোনাল বৈচিত্র্য, হাতের অঙ্গভঙ্গি, আবেগপূর্ণ পাঠ, সময়মত বিরতি ইত্যাদি পদ্ধতি ব্যবহার করা যেতে পারে। অ্যানিমেটেড বই বা কার্টুন সমৃদ্ধ বইয়ের প্রতি শিশু শিক্ষার্থীদের আগ্রহ বরাবরই বেশি থাকে।
শিশুদের পড়ার বিষয়ে কৌতূহলী করে তোলার একটি গোপন উপায় হল একসাথে সম্পূর্ণ গল্প না পড়তে দেয়া, এটিকে ‘ক্লিফহ্যাঙ্গার্স গ্যালোর’ বলা হয়ে থাকে। এটি হলো শিক্ষক বা অভিভাবককে বরাবরই ভান করতে হয় যে তারা পুরো বইটি পড়তে খুব ক্লান্ত বোধ করছেন বা তাদের অনেক ব্যস্ততা রয়েছে। পরে বইটি পড়ে তাদের গল্প শোনাবেন। এতে শিশুরা অপেক্ষার প্রহর গুনতে থাকে যে, কখন আবার তারা গল্পটি শুনতে পারবে বা পড়তে পারবে। এ কৌশলটি শিশুদের জানার কৌতূহলকে জাগিয়ে তোলে এবং পরবর্তীতে কী ঘটবে তা পড়তে সে আগ্রহী হবে।
সুতরাং, এটি স্পষ্ট যে শিশুদের বই পড়ার প্রতি আগ্রহ সৃষ্টি করা খুব সহজ কোনো বিষয় নয়। যখন কোনো শিশু সবেমাত্র পড়তে শুরু করে, তখন তাদের সংশোধন করার জন্য খুব বেশি স্থির থাকা ঠিক নয়। তাদের দ্রুত পড়ার জন্য চাপ না দেয়া, তাদের তাড়াহুড়ো না করে ধৈর্য ধরা গুরুত্বপূর্ণ। তাদের পড়তে দিতে হবে, পর্যাপ্ত সময় দিতে হবে এবং সঠিক উপায়ে পড়ার বিষয়ে চিন্তা না করেই সবকিছু করতে দিতে হবে। একবার তারা পড়ার মজা পেতে শুরু করলে, শিক্ষক ও অভিভাবকগণ ধীরে ধীরে তাদের সঠিক উচ্চারণ এবং আরও অনেক কিছু সম্পর্কে বলা শুরু করতে পারেন। যাহোক, যথেষ্ট ধৈর্য, অধ্যবসায়, টিমওয়ার্ক এবং অনুপ্রেরণাসহ পড়ার অভ্যাস গড়ে তোলা শিশুদের জন্য একটি ফলপ্রসূ বিনিয়োগ হতে পারে!
লেখক: প্রিন্সিপাল, কলামিস্ট এবং প্রেসিডেন্ট, বাংলাদেশ স্মার্ট এডুকেশন নেটওয়ার্ক (বিডিসেন)।
বিভাগ : সম্পাদকীয়
মন্তব্য করুন
আরও পড়ুন

ইসরায়েলি বর্বর হামলায় গাজায় ২০ দিনে ৪৯০ শিশু নিহত

চট্টগ্রামে কোরিয়ান ইপিজেড পরিদর্শনে ৪০ দেশের প্রতিনিধি

রাশিয়ার পক্ষে যুদ্ধে গেছে শত বাংলাদেশি

ইন্দুরকানীতে ডায়রিয়া রোগীর প্রকোপ হাসপাতালে কলেরা স্যালাইন সংকট

গাজায় মানবিক বিপর্যয় নিয়ে জাতিসংঘের উদ্বেগ, অবরোধ তুলে নেওয়ার আহ্বান

এসএসসি পরীক্ষাকেন্দ্রে ১৪৪ ধারা, কোচিং-ফটোকপি বন্ধসহ একগুচ্ছ নির্দেশনা

এশিয়ার শেয়ারবাজারে বড় ধস, তেলের দামেও পতন

গাজা ইস্যুতে সিসি ও ম্যাখোঁর সঙ্গে জর্দানের রাজার বৈঠক আজ

ঐকমত্য কমিশনের সংলাপ ফের শুরু আজ

সকালে ব্রিদিং এক্সারসাইজের উপকারিতা

মতলব দক্ষিণ থানার এসআই জীবন চৌধুরীর বেতন বন্ধের নির্দেশ

সাবেক এমপি কেরামত আলী গ্রেফতার

নীলফামারীর উত্তরা ইপিজেডে মেশিন বিস্ফোরণে ২জন শ্রমিক দগ্ধ

ট্রাম্পের সাথে বৈঠক করতে যুক্তরাষ্ট্রে ছুটলেন নেতানিয়াহু

বিক্ষোভে উত্তাল মণিপুর, নেতার বাড়িতে আগুন দিলো জনতা

ঢাকায় ৪ দিনব্যাপী বিনিয়োগ সম্মেলন আজ শুরু

ইয়েমেনে সর্বশেষ মার্কিন বিমান হামলায় নিহত ৪

মধ্যপ্রাচ্যের ৬ দেশকে হুমকি ইরানের, যুদ্ধের শঙ্কা

রাজধানীর বংশালে আগুন, নিহত ১, আহত ৭

গাজায় ইসরায়েলি বর্বরতার প্রতিবাদে বিশ্বজুড়ে আজ ধর্মঘট