দেশপ্রেমিক শক্তিগুলোকে ঐক্যবদ্ধ থাকতে হবে

Daily Inqilab জালাল উদ্দিন ওমর

২৮ ফেব্রুয়ারি ২০২৫, ১২:০২ এএম | আপডেট: ২৮ ফেব্রুয়ারি ২০২৫, ১২:০২ এএম

ছাত্র-জনতার অসীম আত্মত্যাগে বাংলাদেশ স্বৈরাচার এবং ফ্যাসিবাদ থেকে মুক্তি পেয়েছে। আন্দোলন দমাতে সরকারি ও আওয়ামী লীগের দলীয় বাহিনী নির্বিচারে গুলি চালিয়েছে। প্রায় দেড় হাজার মানুষ জীবন দিয়েছে এবং বিশ হাজার মানুষ আহত হয়েছে। অনেকে বিভিন্ন অঙ্গ হারিয়ে চিরতরে পঙ্গু হয়েছে। আন্দোলনে অনেক তরুণ-তরুণী জীবন দিয়েছে। আওয়ামী লীগবিরোধী সবাই ঐক্যবদ্ধভাবে আন্দোলনে শামিল হওয়ায় আন্দোলন গণঅভ্যুত্থানে পরিণত হয় এবং সরকার তা দমাতে ব্যর্থ হয়। ফলে শেখ হাসিনা পালিয়ে যান এবং তার সরকারের পতন হয়। অতীতের অনেক আন্দোলন সরকার হামলা-মামলা চালিয়ে দমন করতে সক্ষম হলেও এবার পারেনি। কারণ, এবারের আন্দোলন অনেক বেশি সুদৃঢ় এবং আন্দোলনকারীরা খুবই ঐক্যবদ্ধ ছিল। কোনো কিছু অর্জনের চেয়ে রক্ষা করা অনেক বেশি কঠিন। স্বাধীনতা অর্জনের চেয়ে স্বাধীনতা রক্ষা করা যেমন কঠিন, তেমনি বিপ্লবকে অর্জনের চেয়ে অর্জিত বিপ্লবকে রক্ষা করা অনেক বেশি কঠিন। কারণ, পরাজিত শক্তি কখনো বসে থাকে না। তারা ঐক্যবদ্ধ হয়, ষড়যন্ত্র করে এবং বিপ্লবকে ব্যর্থ করে ক্ষমতায় ফিরতে সর্বাত্বক চেষ্টা চালায়। প্রতিবিপ্লব ঘটাতে তারা বরাবরই সক্রিয় থাকে। বিপ্লববিরোধী দেশি-বিদেশি শক্তি এ কাজে সমর্থন ও সহযোগিতা করে। বিপ্লব পরবর্তী সময়ে বিপ্লবীদের তাই আরো বেশি ঐক্যবদ্ধ, তৎপর ও সচেতন থাকতে হয়। না হলে প্রতিবিপ্লবে বিপ্লব ছিনতাই হয়ে যায় এবং বিপ্লবীদের জীবনে নেমে আসে ভয়াবহ বিপর্যয়। বিপ্লবের স্বপ্ন তখন অনন্তকালের জন্য হারিয়ে যায়।

ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থান দেশের বৃহত্তর জনগোষ্ঠীর ঐতিহাসিক অর্জন, যা সচারাচর ঘটে না। গণঅভ্যুত্থান সহজে অর্জনের বিষয় নয়। হাজারো জীবনের বিনিময়ে দীর্ঘ ১৬ বছরের আন্দোলন-সংগ্রামে আওয়ামী লীগের শাসনের বিরুদ্ধে অর্জিত বিপ্লবকে যে কোনো মূল্যে রক্ষা, সুসংহত এবং শক্তিশালী করতে হবে। বিপ্লবকে ধারণ করেই দেশকে এগিয়ে নিতে হবে। এজন্য সকল দেশপ্রেমিক শক্তির ইস্পাত কঠিন ঐক্য প্রয়োজন। ঐক্য সব সময়ে বজায় রাখতে হবে। না হলে সর্বনাশ হয়ে যাবে, বিপ্লব ব্যর্থ হবে। বিএনপি, জামায়াতে ইসলামী, জাতীয় পার্টি (পার্থ এবং জাফর), হেফাজতে ইসলাম, খেলাফত মজলিশ, ইসলামী শাসনতন্ত্র আন্দোলন, এলডিপি, এবি পার্টি, এনডিএম, লেবার পার্টি, গণ অধিকার পরিষদ, গণ সংহতি আন্দোলন, নাগরিক ঐক্য, জাগপা, মুসলিম লীগ, গণফোরাম, বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন, জাতীয় নাগরিক কমিটিসহ দেশপ্রেমিক সকলকে ঐক্যবদ্ধ থাকতে হবে। ছাত্রদল, ছাত্র শিবির, ছাত্র অধিকার পরিষদ, ইসলামী ছাত্র সমাজ, ছাত্র শক্তি, ইসলামী ছাত্র মজলিশ, ইসলামী শাসনতন্ত্র ছাত্র আন্দোলনসহ সকল ছাত্র সংগঠনকে এক থাকতে হবে। ডাক্তার, ইঞ্জিনিয়ার, আইনজীবী, শিক্ষক, সাংবাদিক, অবসর প্রাপ্ত সামরিক বেসামরিক কর্মকর্তা, লেখক, বুদ্ধিজীবী, কবি সাহিত্যিক, আলেম সমাজ, অভিনয় শিল্পী, সংগীত শিল্পীসহ সকল পেশাজীবী মানুষকেও ঐক্যবদ্ধ থাকতে হবে। ফ্যাসিবাদ বিরোধী আন্দোলনে অংশগ্রহণ এবং সমর্থনকারীদের সবাইকে এক হতে হবে এবং এক থাকতে হবে। সবাই ঐক্যবদ্ধ হয়েছিল বলেই কিন্তু আন্দোলন সফল হয়েছে এবং স্বৈরাচারের পতন হয়েছে। সবচেয়ে বড় রাজনৈতিক দল হিসাবে বিএনপিকেই এক্ষেত্রে মূল ভূমিকা পালন করতে হবে। দ্বিতীয় বৃহত্তম দল হিসাবে জামায়াতের ভূমিকাও অপরিসীম। আশা করি, বিএনপি এবং জামায়াতের নেতাকর্মীরা বাস্তবতা অনুধাবন করে সর্বাবস্থায় ঐক্য বজায় রাখবেন।

সব রাজনৈতিক দলের লক্ষ্য, উদ্দেশ্য এবং কর্মসূচি এক নয়। কিন্তু মৌলিক ইস্যুতে এক হতে হবে। দেশের স্বাধীনতা সার্বভৌমত্ব রক্ষা, গণতন্ত্র-মানবাধিকার-আইনের শাসন প্রতিষ্ঠা এবং অগ্রগতিÑ এই তিন ইস্যু সবার কাছেই কমন। এই তিন মৌলিক ইস্যুতে সবাইকে ঐক্যবদ্ধ হতে হবে। যার রাজনীতি সে করবে, কিন্তু মৌলিক ইস্যুতে ঐক্যবদ্ধ থাকবে। সকল পক্ষকে ঐক্যবদ্ধ রাখার স্বার্থে কিছু মৌলিক কাজ করতে হবে। সবাইকে সবার প্রতি সম্মান জানাতে হবে। তুচ্ছ তাচ্ছিল্য বক্তব্য এবং কাদা ছোড়াছুড়ি বন্ধ করতে হবে। সকল পক্ষের লোকজন নিয়ে একটি লিয়াজো কমিটি গঠন করতে হবে, যা সকল দলের মাঝে ঐক্য বজায় রাখতে সমন্বয়ক হিসেবে কাজ করবে। তারা নিয়মিত বৈঠক করবে এবং আন্তঃদলের ঐক্য বজায় রাখবে। কেন্দ্র হতে তৃণমূল পর্যন্ত সবখানেই লিয়াজো কমিটি গঠন করে ঐক্য বজায় রাখতে হবে। ঐক্যেই শক্তি, ঐক্যেই শান্তি। বিভেদে কখনো মিলে না মুক্তি। যেখানে ঐক্য সেখানে অর্জন। যেখানে অনৈক্য সেখানে ধ্বংস। ইউরোপের ২৭টি দেশ সব সময় ঐক্যবদ্ধ থেকে ইউরোপীয় ইউনিয়ন গড়ে নিজেদের সমস্যা নিজেরাই সমাধান করেছে। তাই তারা উন্নত এবং তাদের স্বাধীনতা সার্বভৌমত্ব সব সময় সুরক্ষিত থেকেছে। মুসলিম দেশসমূহ বিভিন্ন গ্রুপে বিভক্ত হয়েছে। ফলে তারা দুর্বল হয়েছে, পিছিয়ে পড়েছে এবং স্বাধীনতা সার্বভৌমত্ব বিপন্ন হয়েছে। ঐক্য করতে হলে ক্ষুদ্র স্বার্থকে বিসর্জন দিতে হয়। প্রত্যেকেই নিজের ক্ষুদ্র স্বার্থকে জাতির বৃহত্তর স্বার্থে ত্যাগ করলে অটোমেটিক্যালি বৃহত্তর ঐক্য গড়ে উঠবে, যা কেউ ভাঙ্গতে পারবে না। দেশপ্রেমিক শক্তিরা ঐক্যবদ্ধ থাকলে ষড়যন্ত্রকারীরা কখনোই সফল হবে না। দেশপ্রেমিক শক্তি বিভক্ত হলে, বিভক্তির ফাঁক দিয়ে শত্রু পক্ষ ঢুকে পড়বে। তারা বিপ্লব এবং দেশপ্রেমিক শক্তিকে ধ্বংস করবে। ঐক্য প্রতিষ্ঠায় রাজনৈতিক দলগুলোকেই মূল ভূমিকা পালন করতে হবে। রাজনীতিবিদরা এক হলে সবাই এক এবং বিভক্ত হলে সবাই বিভক্ত হয়।

দেশটা সবার। জাতি-ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে সকলের মাঝে একতা, সাম্য এবং সমতা বজায় রাখতে হবে। কোনো অবস্থাতেই ধর্মীয় বিভাজন সৃষ্টি করা যাবে না। যার ধর্ম সে পালন করবে, কিন্তু সবাই মিলে শান্তিতে বসবাস করবে। সংখ্যালঘু এবং সংখ্যাগুরু বলতে কিছুই নাই। ধর্ম যার যার, কিন্তু দেশটা সবার। সবাইকে বাংলাদেশি পরিচয়ে পরিচিত হতে হবে। কোনো অবস্থাতেই সাম্প্রদায়িক সংঘাত সৃষ্টি করা যাবে না। সর্বাবস্থায় সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি রক্ষা করতে হবে। এজন্য সবাইকে মিলে মিশে এক হয়ে কাজ করতে হবে। পরাজিত শক্তি এবং তাদের বিদেশি সহযোগীরা কিন্তু বসে নাই। তারা যে কোন মূল্যে প্রতিবিপ্লব ঘটাতে এবং বিপ্লবকে ধ্বংস করতে প্রস্তুত। দেশপ্রেমিক শক্তির সুদৃঢ় ঐক্যই কেবল পরাজিত শক্তির সকল ষড়যন্ত্রকে নস্যাত করতে সক্ষম। ঐক্যই কেবল বিপ্লব এবং দেশের স্বাধীনতা সার্বভৌমত্বকে রক্ষা করবে। দেশের স্বাধীনতা সার্বভৌমত্ব সুরক্ষা, অর্জিত বিপ্লবকে সুসংহত এবং দেশকে এগিয়ে নিতে দেশ প্রেমিক শক্তিরা ঐক্যবদ্ধ থাকা অপরিহার্য।

লেখক : প্রকৌশলী ও উন্নয়ন গবেষক।
omar_ctg123@yahoo.com


বিভাগ : সম্পাদকীয়


মন্তব্য করুন

HTML Comment Box is loading comments...

এই বিভাগের আরও

মিয়ানমারে ভূমিকম্প এবং আমাদের ভয়
ড. মুহাম্মদ ইউনূসের উচিৎ কথা
আইএমএফ’র ঋণের প্রশ্নে সরকারকে কঠোর অবস্থান নিতে হবে
মুক্তিযুদ্ধ থেকে ছাত্র-জনতার অভ্যুদয়
শিক্ষাব্যবস্থার ব্ল্যাকবক্স খোলার এখনই সময়
আরও
X

আরও পড়ুন

ইসরায়েলি বর্বর হামলায় গাজায় ২০ দিনে ৪৯০ শিশু নিহত

ইসরায়েলি বর্বর হামলায় গাজায় ২০ দিনে ৪৯০ শিশু নিহত

চট্টগ্রামে কোরিয়ান ইপিজেড পরিদর্শনে ৪০ দেশের প্রতিনিধি

চট্টগ্রামে কোরিয়ান ইপিজেড পরিদর্শনে ৪০ দেশের প্রতিনিধি

রাশিয়ার পক্ষে যুদ্ধে গেছে শত বাংলাদেশি

রাশিয়ার পক্ষে যুদ্ধে গেছে শত বাংলাদেশি

ইন্দুরকানীতে ডায়রিয়া রোগীর প্রকোপ হাসপাতালে কলেরা স্যালাইন সংকট

ইন্দুরকানীতে ডায়রিয়া রোগীর প্রকোপ হাসপাতালে কলেরা স্যালাইন সংকট

গাজায় মানবিক বিপর্যয় নিয়ে জাতিসংঘের উদ্বেগ, অবরোধ তুলে নেওয়ার আহ্বান

গাজায় মানবিক বিপর্যয় নিয়ে জাতিসংঘের উদ্বেগ, অবরোধ তুলে নেওয়ার আহ্বান

এসএসসি পরীক্ষাকেন্দ্রে ১৪৪ ধারা, কোচিং-ফটোকপি বন্ধসহ একগুচ্ছ নির্দেশনা

এসএসসি পরীক্ষাকেন্দ্রে ১৪৪ ধারা, কোচিং-ফটোকপি বন্ধসহ একগুচ্ছ নির্দেশনা

এশিয়ার শেয়ারবাজারে বড় ধস, তেলের দামেও পতন

এশিয়ার শেয়ারবাজারে বড় ধস, তেলের দামেও পতন

গাজা ইস্যুতে সিসি ও ম্যাখোঁর সঙ্গে জর্দানের রাজার বৈঠক আজ

গাজা ইস্যুতে সিসি ও ম্যাখোঁর সঙ্গে জর্দানের রাজার বৈঠক আজ

ঐকমত্য কমিশনের সংলাপ ফের শুরু আজ

ঐকমত্য কমিশনের সংলাপ ফের শুরু আজ

সকালে ব্রিদিং এক্সারসাইজের উপকারিতা

সকালে ব্রিদিং এক্সারসাইজের উপকারিতা

মতলব দক্ষিণ থানার এসআই জীবন চৌধুরীর বেতন বন্ধের নির্দেশ

মতলব দক্ষিণ থানার এসআই জীবন চৌধুরীর বেতন বন্ধের নির্দেশ

সাবেক এমপি কেরামত আলী গ্রেফতার

সাবেক এমপি কেরামত আলী গ্রেফতার

নীলফামারীর উত্তরা ইপিজেডে মেশিন বিস্ফোরণে ২জন শ্রমিক দগ্ধ

নীলফামারীর উত্তরা ইপিজেডে মেশিন বিস্ফোরণে ২জন শ্রমিক দগ্ধ

ট্রাম্পের সাথে বৈঠক করতে যুক্তরাষ্ট্রে ছুটলেন নেতানিয়াহু

ট্রাম্পের সাথে বৈঠক করতে যুক্তরাষ্ট্রে ছুটলেন নেতানিয়াহু

বিক্ষোভে উত্তাল মণিপুর, নেতার বাড়িতে আগুন দিলো জনতা

বিক্ষোভে উত্তাল মণিপুর, নেতার বাড়িতে আগুন দিলো জনতা

ঢাকায় ৪ দিনব্যাপী বিনিয়োগ সম্মেলন আজ শুরু

ঢাকায় ৪ দিনব্যাপী বিনিয়োগ সম্মেলন আজ শুরু

ইয়েমেনে সর্বশেষ মার্কিন বিমান হামলায় নিহত ৪

ইয়েমেনে সর্বশেষ মার্কিন বিমান হামলায় নিহত ৪

মধ্যপ্রাচ্যের ৬ দেশকে হুমকি ইরানের, যুদ্ধের শঙ্কা

মধ্যপ্রাচ্যের ৬ দেশকে হুমকি ইরানের, যুদ্ধের শঙ্কা

রাজধানীর বংশালে আগুন, নিহত ১, আহত ৭

রাজধানীর বংশালে আগুন, নিহত ১, আহত ৭

গাজায় ইসরায়েলি বর্বরতার প্রতিবাদে বিশ্বজুড়ে আজ ধর্মঘট

গাজায় ইসরায়েলি বর্বরতার প্রতিবাদে বিশ্বজুড়ে আজ ধর্মঘট