মিছিল-সমাবেশ প্রসঙ্গে হাইকোর্টের নির্দেশনা

Daily Inqilab ইনকিলাব

১৭ মার্চ ২০২৫, ১২:১০ এএম | আপডেট: ১৭ মার্চ ২০২৫, ১২:১০ এএম

মিছিল, সমাবেশ ও জনসভার ক্ষেত্রে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী কী করতে পারবে বা পারবে না, সে সম্পর্কে সাত দফার একটি নির্দেশনা দিয়েছেন হাইকোর্ট। এ বিষয়ক রায়টি সম্প্রতি প্রকাশিত হয়েছে সুপ্রিম কোর্টের ওয়েবসাইটে। স্মরণ করা যেতে পারে, গত জুলাই-আগস্ট বৈষম্য বিরোধী ছাত্র আন্দোলন চলাকালে আইন প্রয়োগকারী সংস্থার হেফাজতে থাকা ছয় ছাত্র সমন্বয়কের মুক্তির দাবিতে মিছিল, সমাবেশ ও জনসভায় তাজা গুলির ব্যবহার বন্ধের নির্দেশনা চেয়ে একটি রিট করা হয়। সেই রিটের প্রেক্ষিতে হাইকোর্ট এই নির্দেশনা দেন। নির্দেশনাগুলোর মূল কথা: বাংলাদেশের সংবিধান অনুযায়ী শান্তিপূর্ণ মিছিল, সমাবেশ ও জনসভায় অংশগ্রহণের অধিকার প্রত্যেক নাগরিকের থাকবে। জীবন সবচেয়ে মূল্যবান হওয়ায় আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী মানুষের জীবন ও জীবনের মর্যাদা সমুন্নত রাখাকে সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার দেবে। দায়িত্ব পালনকালে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী সংস্থাগুলো যখন কঠোরতার প্রয়োজন, তখন প্রয়োজনীয় পরিমাণ বল প্রয়োগ করতে পারে। দায়িত্ব পালনকালে আইন প্রয়োগকারী সংস্থাগুলোকে মানুষকে সম্মান করতে, মর্যাদা দিতে ও মানবাধিকার সমুন্নত রাখতে হবে। আইন প্রয়োগকারী সংস্থাগুলোকে আইন প্রয়োগের ক্ষেত্রে ক্ষমতা আইনগত বাধ্যবাধকতা মেনে চলতে হবে। এ ক্ষেত্রে যে কোনো ব্যর্থতার দায় তাদের বহন করতে হবে। এছাড়া বেআইনী সমাবেশ, দাঙ্গা ও জনস্বস্থ্যের বিরুদ্ধে অন্যন্য অপরাধ দমানোর ক্ষেত্রে সংবিধানের সংশ্লিষ্ট অনুচ্ছেদ, দ-বিধি ও প্রচলিত আইনের অনুসরণ করতে হবে। হাইকোর্ট তার পর্যবেক্ষণে উল্লেখ করছেন, কেউ আইন লংঘন করলে পুলিশ বা আইনপ্রয়োগকারী সংস্থা রাবার বুলেট, টিয়ার শেল ব্যবহারের পর তাজা গুলি ব্যবহার করতে পারে। যদি কোনো আইন লংঘন না হয় বা কোনো দাঙ্গা না হয় তাহলে কোনো তাজা বুলেট ব্যবহার করা যাবে না। শেষ কথা: একটি গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রে আইনের সব দিক, নাগরিকেদের সংবিধানিক অধিকারের প্রতি শ্রদ্ধা রেখে ভিন্নমত ও গণতন্ত্র যেন হাতে-কলমে চলে এবং আইনের শাসন প্রাধান্য পায় সেদিকে খেয়াল রেখে পুলিশের কাজ করা আবশ্যক।

হাইকোর্টের বর্ণিত নির্দেশনা সম্পর্কে আইনশৃঙ্খলারক্ষাকারী সংস্থাগুলো সম্যক অবহিত। মিছিল, সমাবেশ ও জনসভা আহ্বান বা আয়োজনকারীদেরও তা একেবারে অজানা নয়। কিন্তু যখনই আইনবিধি এই সীমানার কোনো তরফে লংঘন হয়, তখনই অঘটন ঘটে। গত জুলাই-আগস্ট ছাত্র-জনতার শান্তিপূর্ণ মিছিল-সমাবেশে পুলিশসহ বিভিন্ন আইনশৃঙ্খলারক্ষাকারী সংস্থা যে চন্ড আচরণ করে, তার কোনো তুলনা নেই। মানবিক, সাংবিধানিক ও আইনগত অধিকার লংঘন করে আন্দোলনকারীদের ওপর লাঠিচার্জ, কাঁদানে গ্যাস নিক্ষেপ, নির্বিচার গুলি, গ্রেফতার, জোরপূর্বক উঠিয়ে নেয়া ইত্যাদি এমন কোনো অপরাধ বা অপকর্ম নেই যে আইনপ্রয়োগকারী সংস্থাগুলো করেনি। ছাত্রদের আন্দোলন শুরু অহিংস, অরাজনৈতিক অবস্থান থেকে। ফ্যাসিস্ট শাসকরা এই ‘নিরিহ’ আন্দোলন দমনে হিং¯্রতার পথ বেছে নেয়। আন্দোলন শেষ পর্যন্ত গণঅভ্যুত্থানে রূপ পরিগ্রহ করে। একদফার আন্দোলন-অভ্যুত্থানে ফ্যাসিবাদী শাসনের অবসান ঘটে। গণরোষ থেকে আত্মরক্ষার জন্য ফ্যাসিস্টরা পালিয়ে যেতে বাধ্য হয়। পতিত স্বৈরাচার ও ফ্যাসিস্টরা আন্দোলন-অভ্যুত্থান দমনে অন্তত দেড় হাজার মানুষকে হত্যা করেছে। ২০ হাজারের অধিক মানুষকে পঙ্গু ও অঙ্গহানি করেছে। বিশ্বের সাম্প্রতিক ইতিহাসে এটা নজিরবিহীন। ফ্যাসিস্ট হাসিনা এই দমনপীড়ন ও হত্যা-নির্যাতনে পুলিশকে বিশেষভাবে ব্যবহার করেন। ফলে অভ্যুত্থানের পর পুলিশ গণ-হিংসার শিকার হয়েছে। গোটা বাহিনী এমন অবস্থায় পতিত হয়েছে যে, গত সাত-আট মাসেও সোজা হয়ে দাঁড়াতে পারেনি। তার নৈতিক মনোবল এখনো ফিরে আসেনি। পুলিশ যদি মানুষের জীবনকে সবচেয়ে মূল্যবান সম্পদ হিসাবে গণ্য করতো, মর্যাদা দিতো এবং সংবিধান ও প্রচলিত আইন অনুযায়ী দায়িত্ব পালন করতো তাহলে তার এই করুণ পরিণতি হতো না। এত মানুষ হতাহত হতো না। বলাই বাহুল্য, পুলিশ ছাড়া দেশ চলতে পারে না, পুলিশের ভগ্নদশায় সেনাবাহিনীকে ম্যাজিস্ট্র্রেসি ক্ষমতা দিয়েও আইনশৃংখলা সুরক্ষা সম্ভবপর হচ্ছিল না। এদিকে অন্তর্বর্তী সরকারের ক্ষমতা নেয়ার পর থেকে দেশ জুড়ে আন্দোলন, মিছিল, সমাবেশ ইত্যাদির প্রতিযোগিতা চলছে। সেই সংখ্যালঘুদের আন্দোলন থেকে শুরু করে আনসারদের আন্দোলন, পল্লী বিদু্যুৎ কর্মীদের আন্দোলন, গার্মেন্ট শ্রমিক-কর্মীদের আন্দোলন, সরকারি কর্মচারীদের আন্দোলন, শিক্ষকদের আন্দোলন ইত্যাদি চলছেই। এই সাত-আট মাসে সরকারকে অন্তত দু’শ আন্দোলন মোকাবিলা করতে হয়েছে। পর্যবেক্ষকদের মতে, এসব আন্দোলনের বেশির ভাগের পেছনে পতিত স্বৈরাচার ও তার দলবলের হাত রয়েছে, মদদ রয়েছে ভারতের মোদি সরকারের। পরিস্থিতি এমন যে, সচিবালয়, প্রধান উপদেষ্টার কার্যালয়, শাহবাগ প্রভৃতি গুরুত্বপূর্ণ স্থানে মিছিল, সমাবেশ, অবস্থান নিষিদ্ধ করতে হয়েছে। অন্তর্বতী সরকার মানুষের অধিকার ও দাবি-দাওয়ার প্রশ্নে অত্যন্ত সহানুভূতিশীল ও সহৃদয়। এর সুযোগ নিচ্ছে মতলববাজরা। সর্বশেষ নব্য শাহাবাগীরা ধর্ষণকে কেন্দ্র করে মাথা চাড়া দিতে শুরু করেছে। এদের রুখতে সেদিন মৃদু শক্তি প্রয়োগ করেছে পুলিশ। ক’দিন আগে গার্মেন্ট শ্রমিকদের রাস্তা-অবরোধের অবসান ঘটিয়েছি সেনাবাহিনী ৭ মিনিটের আলটিমেটাম দিয়ে। এটা ইতিবাচক। অনেকের মতে, আইনশৃংখলা রক্ষায় সরকার কঠোর অবস্থানে চলে যেতে বাধ্য হয়েছে। তারা মনে করেন, আরো আগে সরকারের কঠোর হওয়া উচিত ছিল।

দাবি-দাওয়ার নামে, আন্দোলনের নামে রাস্তা অবরোধ, যানবাহন ভাঙচুর ইত্যাদি অপকর্ম ঘটেই চলেছে। এমনিতেই রাজধানী থেকে শুরু করে বড় বড় শহর ও বিভিন্ন সড়ক-মহাসড়কে যানজট নিত্যদিনের ঘটনায় পরিণত হয়েছে। কোথাও রাস্তাদখল ও অবরোধের ঘটনা ঘটলে মানুষের দুর্ভোগ-বিড়ম্বনার কোনো শেষ থাকে না। দেশকে যারা অস্থির-অস্থিতিশীল করার এজেন্ডা নিয়ে ময়দানে সক্রিয় রয়েছে, তারা চায় জননিরাপত্তা, আইনশৃংখলা ও জনচলাচল ব্যাহত হলে গণমানুষ সরকারের প্রতি ক্ষুব্ধ হবে, অসন্তুষ্ট হবে। সরকারের যে কোনো ব্যর্থতা তাদের জন্য লাভ। ফলে তারা এসব ক্ষেত্রে মদদ দিচ্ছে। রাস্তা চলাচলের জন্য, তা ২৪ ঘণ্টা উন্মুক্ত থাকবে। সরকারকে এটা নিশ্চিত করতে হবে। যানবাহন রাখা ও চলাচলের ক্ষেত্রেও শৃংখলার শোচনীয় অভাব রয়েছে। অনেক সময়ই রাস্তাঘাটে যানবাহন এলোপাথাড়িভাবে রাখা হয়। এতে যাতায়াত ব্যাহত হয়। রাস্তায় রাখা যানবাহন সরিয়ে দিতে হবে। এ ব্যাপারে কঠোরতার বিকল্প নেই। মোট কথা: আইনশৃংখলা, জননিরাপত্তা ও মানুষের অবাধ যাতায়াত নিশ্চিত করতে হবে। পুলিশসহ আইন শৃংখলারক্ষারকারী সংস্থাগুলোকে আইনবিধির আওতায় থেকে যতটা সম্ভব কঠোর অবস্থান গ্রহণ করতে হবে। হাইকোর্টের নির্দেশনা অনুসরণ করলে আইনশৃংখলার যেমন উন্নতি হবে, তেমনি আইনশৃংখলা রক্ষকারীসংস্থাগুলোর ভাবমর্যাদাও বৃদ্ধি পাবে।


বিভাগ : সম্পাদকীয়


মন্তব্য করুন

HTML Comment Box is loading comments...

এই বিভাগের আরও

নানা ইস্যু সামনে এনে মাঠ গরমের চেষ্টা
বদর যুদ্ধের তাৎপর্য ও শিক্ষা
জুসের নামে আমরা কী খাচ্ছি?
দ্বৈত নাগরিকত্বের সুযোগে অর্থপাচার
দক্ষ জনশক্তি রফতানিতে অগ্রাধিকার দিতে হবে
আরও
X

আরও পড়ুন

সুনামগঞ্জে বিজিবি’র অভিযানে ৪১ লাখ টাকার অবৈধ মালামাল জব্দ

সুনামগঞ্জে বিজিবি’র অভিযানে ৪১ লাখ টাকার অবৈধ মালামাল জব্দ

ইসরায়েলি গণহত্যায় মার্কিন সমর্থন বন্ধের আহ্বান ইরানের

ইসরায়েলি গণহত্যায় মার্কিন সমর্থন বন্ধের আহ্বান ইরানের

ভারতকে কোনোক্রমে সভ্য রাষ্ট্র বলা চলে না : শায়খ আহমদুল্লাহ

ভারতকে কোনোক্রমে সভ্য রাষ্ট্র বলা চলে না : শায়খ আহমদুল্লাহ

সরকার পতনের যে নীলনকশা প্রমাণসহ ফাঁস করলেন পিনাকী

সরকার পতনের যে নীলনকশা প্রমাণসহ ফাঁস করলেন পিনাকী

ঢাকা উত্তর বিএনপির ৭ নেতা বহিষ্কার, মিরপুরে বিক্ষোভ

ঢাকা উত্তর বিএনপির ৭ নেতা বহিষ্কার, মিরপুরে বিক্ষোভ

নেতানিয়াহুর সিদ্ধান্তে উত্তাল ইসরায়েল, অভ্যন্তরীণ নিরাপত্তা প্রধান বরখাস্তের উদ্যোগ

নেতানিয়াহুর সিদ্ধান্তে উত্তাল ইসরায়েল, অভ্যন্তরীণ নিরাপত্তা প্রধান বরখাস্তের উদ্যোগ

মেসির দুর্দান্ত গোল, মায়ামির হ্যাটট্রিক

মেসির দুর্দান্ত গোল, মায়ামির হ্যাটট্রিক

আছিয়া হত্যার বিচারের দাবিতে সাতক্ষীরায় মহিলা জামায়াতের মানববন্ধন

আছিয়া হত্যার বিচারের দাবিতে সাতক্ষীরায় মহিলা জামায়াতের মানববন্ধন

অপরাধে জড়িয়ে পড়লে কাউকে ছাড় নয়-মাহবুব আলমগীর আলো

অপরাধে জড়িয়ে পড়লে কাউকে ছাড় নয়-মাহবুব আলমগীর আলো

কত হাজার কোটি টাকার মালিক শেখ সেলিম? জানা গেলো চাঞ্চল্যকর তথ্য!

কত হাজার কোটি টাকার মালিক শেখ সেলিম? জানা গেলো চাঞ্চল্যকর তথ্য!

ফরিদপুরে শিশুকে যৌন হয়রানির অভিযোগে ব্যবসায়ীকে গণপিটুনি

ফরিদপুরে শিশুকে যৌন হয়রানির অভিযোগে ব্যবসায়ীকে গণপিটুনি

ঢাকায় হিজবুত তাহরীরের সক্রিয় সদস্য গ্রেপ্তার

ঢাকায় হিজবুত তাহরীরের সক্রিয় সদস্য গ্রেপ্তার

১৯ দেশের মিশন প্রধানদের সঙ্গে বৈঠকে বসছে ইসি

১৯ দেশের মিশন প্রধানদের সঙ্গে বৈঠকে বসছে ইসি

ডিএমপি কমিশনারের বক্তব্যে প্রধান উপদেষ্টার কার্যালয়ের তীব্র নিন্দা

ডিএমপি কমিশনারের বক্তব্যে প্রধান উপদেষ্টার কার্যালয়ের তীব্র নিন্দা

নর্থ মেসিডোনিয়ার নাইটক্লাবে ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ড: নিহত ৫৯, আটক ১০

নর্থ মেসিডোনিয়ার নাইটক্লাবে ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ড: নিহত ৫৯, আটক ১০

ট্রেনে ঈদযাত্রা: ২৭ মার্চের টিকিট বিক্রি শুরু

ট্রেনে ঈদযাত্রা: ২৭ মার্চের টিকিট বিক্রি শুরু

কর্মবিরতি প্রত্যাহার, মেট্রোরেলে টিকিট ব্যবস্থা চালু

কর্মবিরতি প্রত্যাহার, মেট্রোরেলে টিকিট ব্যবস্থা চালু

নাটোরে সাবেক উপজেলা চেয়ারম্যান আটক

নাটোরে সাবেক উপজেলা চেয়ারম্যান আটক

ঢাকাসহ ৩ বিভাগে বৃষ্টি ও বজ্রপাতের পূর্বাভাস

ঢাকাসহ ৩ বিভাগে বৃষ্টি ও বজ্রপাতের পূর্বাভাস

ইউক্রেনে যুদ্ধবিরতি নিয়ে পুতিনের সঙ্গে আলোচনায় বসছেন ট্রাম্প

ইউক্রেনে যুদ্ধবিরতি নিয়ে পুতিনের সঙ্গে আলোচনায় বসছেন ট্রাম্প