ক্ষুদ্র ও মাঝারি খাতের বিকাশে জোর দিতে হবে
১০ এপ্রিল ২০২৫, ১২:০২ এএম | আপডেট: ১০ এপ্রিল ২০২৫, ১২:০২ এএম

সময়ের সাথে খেলাপী ঋণ কেবলই বাড়ছে। যত আইন করি না কেন, খেলাপী ঋণ বাড়ছেই। ২০২৪ সালের সেপ্টেম্বরে ছিল ২,৮৪,৯৭৭ কোটি টাকা, যা ডিসেম্বরে হয়েছে ৩,৪৫,৭৬৫ কোটি টাকা। তিন মাসে বেড়েছে ৬০,৭৮৮ কোটি টাকা। ২০২৪ সালের ডিসেম্বরে বিতরণকৃত মোট ঋণ ১৭,১১,৪০২ কোটি টাকা, যার ২০.২০ শতাংশ খেলাপী। ২০০৯ সালে আওয়ামী লীগের ক্ষমতা গ্রহনের সময় খেলাপী ঋণ ২২,৪৮২ কোটি এবং ২০২৪ সালে ক্ষমতাচ্যুত হবার সময় ২,১১,৩৯১ কোটি টাকা ছিল। খেলাপী ঋণের আসল পরিমাণ আরো বেশি। ব্যাংক এবং আর্থিক প্রতিষ্ঠানসমূহ ঋণের বিরাট অংশ রিশিডিউল করেছে, যা প্রকাশিত খেলাপী ঋণের অংশ নয়। এর বড় অংশ বড় ঋণ গ্রহীতারাই করেছে। খেলাপী ঋণের ক্রমাগত বৃদ্ধি ব্যাংকসহ দেশের পুরো আর্থিক খাতকে বিপন্ন করে তুলেছে। এ অবস্থায় খেলাপী ঋণের পরিমাণ কমিয়ে আনতেই হবে। তার জন্য ক্ষুদ্র এবং মাঝারি খাতের উন্নয়ন এবং বিকাশ অপরিহার্য।
ব্যাংক একটি প্রতিষ্ঠানকে কত টাকা ঋণ প্রদান করতে পারবে সে নীতিমালা বাংলাদেশ ব্যাংক প্রণয়ন করেছে। ব্যাংকের ক্যাপিটালের ওপর ঋণ প্রদানের সীমা নির্ভর করে। ব্যাংক নন-এক্সপোর্ট প্রতিষ্ঠানকে ক্যাপিটালের ৩৫% (ফান্ডেড ১৫% + ননফান্ডেড ২০%) এবং এক্সপোর্ট প্রতিষ্ঠানকে ৫০% (ফান্ডেড ১৫% + ননফান্ডেড ৩৫%) ঋণ প্রদান করতে পারে। ব্যাংকের ক্যাপিটাল ১,০০০ কোটি টাকা হলে নন-এক্সপোর্ট প্রতিষ্ঠানকে ৩৫০ কোটি এবং এক্সপোর্ট প্রতিষ্ঠানকে ৫০০ কোটি টাকা পর্যন্ত ঋণ প্রদান করতে পারবে। ক্যাপিটাল বাড়লে ঋণ প্রদানের পরিমাণও বাড়ে।
অধিকাংশ ব্যাংক ঋণ গুটি কয়েক ব্যক্তির হাতে পুঞ্জিভূত। কিছু শিল্পপতির ব্যাংক ঋণের পরিমাণ পাঁচ, দশ এমনকি বিশ হাজার কোটি টাকারও বেশি। অধিকাংশ ব্যাংক এবং আর্থিক প্রতিষ্ঠান হতেই এরা ঋণ নিয়েছে। অনেক ধরনের ব্যবসাই এরা করতে চায়। ট্রেডিং, শিল্প প্রতিষ্ঠান এবং সেবা খাতেও ব্যবসা করে। যোগ্যতা না থাকলেও তারা অনেক ব্যবসা প্রতিষ্ঠান গড়ে তুলছেন। গার্মেন্ট, ডাইয়িং ফিনিশিং, নিটিং, ¯িপনিং এবং এক্সেসরিস কারখানাও করে। ইটের ভাটা, সিমেন্ট ফ্যাক্টরি, রডের কারখানা, জমির ব্যবসা, স্টিল কারখানা, ভোজ্য তেলের কারখানা এবং শিপিং ব্যবসাও করে। চিনি কারখানা, ঠিকাদারি, পরিবহন, ডেভেলাপার, স্টক একচেঞ্জের ব্যবসা, ঔষধ, রঙের ফ্যাক্টরি এবং হাসপাতালও প্রতিষ্ঠা করে। কো¤পানিসমূহ প্রাইভেট লিমিটেড হলেও তা নামে মাত্র। পরিচালকরা হচ্ছে পারিবারিক মানুষ। স্বামী-স্ত্রী, ছেলে-মেয়ে, ভাই-বোনই প্রতিষ্ঠানের চেয়ারম্যান, ব্যবস্থাপনা পরিচালক এবং পরিচালক। দুয়েকজন ব্যক্তির সিদ্ধান্তে প্রতিষ্ঠান পরিচালিত হয়। খাবার টেবিলেই বোর্ড মিটিং হয়। বেশি পরিমাণে ঋণ নেয়ায় প্রতিষ্ঠানের মালিকেরা স¤পদশালী ও প্রভাবশালী হয়ে ওঠে। রাজনীতি, অর্থনীতি এবং ব্যাংকের পরিষদকেও তারা নিয়ন্ত্রণ করে। ব্যবসা সম্প্রসারণের নামে প্রতিবছর ব্যাংক থেকে ঋণের পরিমাণ বাড়িয়ে নেয়। অনেকে ঋণের একটা অংশ বিদেশে পাচারও করে। অনেকগুলি ব্যবসা প্রতিষ্ঠান গড়ে নিজেকে গ্রুপ অব ইন্ডাস্ট্রিজের মালিক পরিচয় দেয়। অভিজাত এলাকায় বসবাস করে, বিলাসী জীবন যাপন করে, বিভিন্ন ক্লাব, সামাজিক ও শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের প্রতিষ্ঠাতা এবং দাতা হয়। কিন্তু এর সবই ঋণের টাকায় করা। একটা সময় পরে অনেকের ব্যবসা ভালো চলে না বা চালাতে পারে না। ব্যাংকের টাকা পরিশোধ করতে পারে না এবং ঋণটা খেলাপী হয়ে যায়। ব্যাংকে বিরাট পরিমাণে মন্দ ঋণের সৃষ্টি হয় এবং ঋণ গ্রহীতারা প্রভাবশালী হওয়ায় এদের ঋণ আদায় করা কঠিনই বটে। এসব কারখানা বন্ধ হলে একসাথে হাজারো মানুষ বেকার হয়ে যায়।
ক্ষুদ্র ও মাঝারি খাতের উন্নয়ন ছাড়া খেলাপী ঋণ কমবে না। ব্যাংক একজন ব্যক্তিকে বড় কারখানা প্রতিষ্ঠায় হাজার কোটি টাকা ঋণ না দিয়ে, দশ কোটি টাকা করে একশ’ ব্যক্তিকে ঋণ দিলে মাঝারি আকারের একশ’ কারখানা প্রতিষ্ঠা হবে। ফলে একশ’ জন উদ্যোক্তা সৃষ্টি হবে। পাঁচ কোটি টাকা করে দুইশত ব্যক্তিকে ঋণ দিলে মাঝারি আকারের দুইশ কারখানা প্রতিষ্ঠা হবে। ফলে দুইশ’ জন উদ্যোক্তা সৃষ্টি হবে। এসব ব্যক্তি অতিরিক্ত ধনী হতে পারবে না। ফলে তারা রাজনীতি, অর্থনীতি এবং ব্যাংকের পরিষদকে প্রভাবিত করতে পারবে না। এসব প্রতিষ্ঠানের ব্যবসা মন্দ হলে ৫/১০ কোটি টাকা খেলাপী হবে, যা আদায় করা ব্যাংকের পক্ষে সহজ। কারণ ঋণ গ্রহীতারা কম প্রভাবশালী হওয়ায় এদের ওপর ব্যাংকের নিয়ন্ত্রণ থাকে। দেশে ব্যাপক সংখ্যক মানুষ বেকার। ক্ষুদ্র উদ্যোক্তাদেরকে পরিবহন, ট্রেডিং, কৃষি, নার্সারি, পোল্ট্রি, মৎস্য এবং ডেইরীসহ বিভিন্ন খাতে ৫/২০/৫০ লাখ টাকা ঋণ প্রদান করলে গ্রামে গ্রামে হাজারো ব্যবসা প্রতিষ্ঠান গড়ে ওঠবে এবং অসংখ্য উদ্যোক্তা সৃষ্টি হবে। গ্রামে কর্মসংস্থান হবে, গ্রামীণ অর্থনীতি শক্তিশালী হবে এবং অর্থনীতি টেকসই হবে। সুষম জনসংখ্যার জন্য শিশু, যুবক এবং বৃদ্ধ যেমন সমানুপাতে প্রয়োজন তেমনি টেকসই উন্নয়নে ছোট, মাঝারি, বৃহৎÑ সকল পর্যায়ের ব্যবসা প্রতিষ্ঠান এবং ইন্ডাস্ট্রি প্রয়োজন। তাহলে অর্থনীতিতে সমতা সৃষ্টি হবে এবং অর্থনীতি টেকসই হবে। ধনী গরিবের ব্যবধান কমবে, বেকারত্ব কমবে এবং দেশ সুষম উন্নয়নের পথে এগিয়ে যাবে। কোনো কারখানা প্রতিষ্ঠা এবং পরিচালনায় হাজার কোটি টাকা দরকার হলে সিন্ডিকেট ঋণের আওতায় করতে হবে। বিদ্যুৎ, সার, চিনি, টায়ার টিউব, গাড়ি উৎপাদন, ¯িপনিং, পেপার, স্টিল, সিরামিক এবং সিমেন্ট মিলসহ বৃহৎ কারখানা প্রতিষ্ঠা ও পরিচালনা বিভিন্ন পরিবার এবং ব্যবসায়ী গ্রুপ থেকে আগত একাধিক ব্যক্তির সমন্বয়ে পরিচালনা বোর্ডের মাধ্যমে করতে হবে। বৃহত শিল্প প্রতিষ্ঠানের মালিক একক ব্যক্তি বা পরিবার হতে পারবে না। সিন্ডিকেট ঋণের মাধ্যমে বৃহৎ শিল্প প্রতিষ্ঠান প্রতিষ্ঠা ও পরিচালিত হলে তা ভালো চলবে এবং খেলাপী ঋণও সৃষ্টি হবে না। অতিরিক্ত অর্থ প্রয়োজন হলে শেয়ার বাজার এবং জনগণের কাছ থেকে কালেকশান করবে।
বাংলাদেশ ব্যাংক সকল ব্যাংকের নিয়ন্ত্রক সংস্থা। ক্ষুদ্র ও মাঝারি খাতের উন্নয়নে বাংলাদেশ ব্যাংককেই নীতিমালা প্রণয়ন করতে হবে। ঋণ প্রাপ্তি নাগরিক অধিকার হতে হবে। নীতিমালা প্রণয়ন করতে হবে যাতে যে কেউ ব্যবসা করতে ব্যাংক থেকে সহজে ঋণ পায়। ব্যাংক থেকে অনেকের জন্য হাজার কোটি টাকা ঋণ পাওয়া সহজ হলেও, কয়েকটি গরু কিনতে এক/দুই লক্ষ টাকা ঋণ পাওয়া একজন কৃষকের জন্য সহজ হয় না। ঋণ পাওয়া নিয়ে কৃষকের জানাশোনা অথবা সহায়ক জামানত নাই। ব্যাংক একজন কৃষককে সহজেই জামানত ছাড়া ১/২/৩ লাখ টাকা ঋণ দিতে পারে। ব্যাংকের টাকা পরিশোধ না করার কোনো চিন্তাই এদের নাই। এরা ঋণের টাকা তছরূপ এবং বিদেশে পাচারও করবে না। ঋণ পরিশোধ করতে না পারলেও ব্যাংকের ক্ষতি হবে কয়েক লাখ টাকা, হাজার কোটি টাকা নয়। একজন ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠানের অনুকূলে হাজার কোটি টাকা ঋণ প্রদানের বিদ্যমান নিয়ম বন্ধ করতে হবে। ক্ষুদ্র ও মাঝারি সাইজের ব্যবসা প্রতিষ্ঠান এবং কলকারখানা প্রতিষ্ঠার জন্য দেশের জনগণের মাঝে ছোট ছোট ঋণ প্রদান করতে হবে। সব ব্যবসা একজনকেই করতে হবে এমন তো কথা নাই। একজন মানুষের কত টাকা প্রয়োজন? তারও সীমা থাকা দরকার। ক্ষুদ্র ও মাঝারি খাতের উন্নয়নের মাধ্যমে খেলাপী ঋণের পরিমাণ বহুলাংশে কমিয়ে আনতে এবং অর্থনীতিকে টেকসই করতে পারি।
লেখক : প্রকৌশলী ও রাষ্ট্র চিন্তক।
omar_ctg123@yahoo.com
বিভাগ : সম্পাদকীয়
মন্তব্য করুন
আরও পড়ুন

শেরপুরে আওয়ামী লীগ নিষিদ্ধের দাবিতে এনসিপির বিক্ষোভ মিছিল

যুক্তরাষ্ট্রে ছড়িয়ে পড়ছে মহামারি! আতঙ্কে ট্রাম্প প্রশাসন

গণমাধ্যমের স্বাধীনতায় ভারত-পাকিস্তানের চেয়ে এগিয়ে বাংলাদেশ

লক্ষ্মীপুরে পূর্ব শক্রতার জেরে বসতঘরে হামলা-ভাঙচুর, আহত ৪

হজযাত্রীদের ভোগান্তি লাঘবে থার্ড ক্যারিয়ার চালু করতে হবে হজ প্রশিক্ষণ কর্মশালায় নেতৃবৃন্দ

খেলোয়ার গন দেশ ও জাতি গঠনে অগ্রণী ভূমিকা পালন করতে পারে -স্থানীয় সরকার সচিব রেজাউল মাকসুদ জাহেদী

মোদির 'ফলস ফ্লাগ নাটক' সুপার ফ্লপ: ব্যর্থ বৈশ্বিক সমর্থন আদায়ে

চীনের সঙ্গে লড়বে ভারত! দাপুটে সেনার ভূমিকায় সালমান!

সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে ইসলামী গণজাগরণের বহিঃপ্রকাশ ঘটবে কাল হেফাজতে ইসলাম বাংলাদেশ

বেনাপোল সীমান্তে পিস্তল-গুলি উদ্ধার

ভারতীয় মদসহ সিলেটে এক ব্যক্তিকে আটক করলো জৈন্তাপুর থানা পুলিশ

ছোট ভাইয়ের খুনি বড় ভাইকে ধরলো পুলিশ !

মতলবে দুটি পৃথক মোটরসাইকেল দূর্ঘটনায় দুই শিক্ষার্থী মৃত্যু

শেরপুরে আওয়ামীলীগ নিষিদ্ধের দাবীতে এনসিপির বিক্ষোভ

কুষ্টিয়ার দৌলতপুরে ডেভিল হান্ট অপারেশনে ইউপি সদস্যসহ ৭ জন গ্রেপ্তার

কাল বিএনপি নেতা নাসির উদ্দিন পিন্টুর ১০ম শাহাদতবার্ষিকী

বীমা খাতে ব্যতিক্রম কাজিম উদ্দিন, ন্যাশনাল লাইফের নানা অর্জন

ফিলিস্তিন সহ মুসলিম বিশে^র শান্তি কামনায় আখেরী মোনাজাতের মাধ্যমে বিশ্ব জাকের মঞ্জিলে ফাতেহা শরিফ সম্পন্ন

ইবিতে ইসরায়েলি বর্বরতার মর্মস্পর্শী চিত্র

দক্ষিণ সুদানে ত্রাণ সহায়তা দিল চীন