ধর্মীয় কারণে কোনো হিন্দু নিপীড়নের শিকার হচ্ছে না
১২ এপ্রিল ২০২৫, ১২:০২ এএম | আপডেট: ১২ এপ্রিল ২০২৫, ১২:০২ এএম

কিছুদিন আগে মার্কিন জাতীয় গোয়েন্দা প্রধান তুলসী গ্যাবার্ড বাংলাদেশ সম্পর্কে কিছু বিভ্রান্তিকর ও অতিরঞ্জিত অভিযোগ করেছেন। তিনি বলেছেন, বাংলাদেশে ধর্মীয় সংখ্যালঘুরা নিপীড়নের শিকার এবং ইসলামপন্থী সন্ত্রাসীরা খিলাফত প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে সক্রিয়। এই বক্তব্য বাস্তবতার সঙ্গে অসামঞ্জস্যপূর্ণ, বাংলাদেশের সার্বভৌমত্বের প্রতি অশ্রদ্ধাসূচক এবং আন্তর্জাতিক পরিম-লে দেশের ভাবমর্যাদা ক্ষুণœ করার অপচেষ্টার নামান্তর।
বাংলাদেশের সমাজ বরাবরই শান্তিপূর্ণ, সহনশীল ও সহমর্মিতার আদর্শে গড়ে উঠেছে। ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে অর্জিত এ দেশের সংবিধানে ধর্মীয় সহাবস্থান ও সাম্যের নীতি সুস্পষ্টভাবে উল্লেখ করা হয়েছে। সকল ধর্মের মানুষের সমান অধিকারের কথা বলা হয়েছে। মুসলমান, হিন্দু, বৌদ্ধ, খ্রিস্টানসহ সকল সম্প্রদায় যুগ যুগ ধরে এখানে শান্তিপূর্ণভাবে বসবাস করে আসছে।
বাংলাদেশ সরকার সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের উন্নয়নের জন্য নানাবিধ কার্যক্রম পরিচালনা করছে। সরকারি অর্থায়নে মন্দির, গির্জা ও অন্যান্য উপাসনালয় সংরক্ষণ, ধর্মীয় উৎসব উদযাপনের জন্য অনুদান, শিক্ষাবৃত্তি ও কর্মসংস্থানে সংখ্যালঘুদের জন্য সংরক্ষিত কোটার ব্যবস্থা করা হয়েছে। অতীতের যেকোনো সময়ের তুলনায় এখন সংখ্যালঘুদের সামাজিক ও অর্থনৈতিক অবস্থার উন্নতি হয়েছে। বাংলাদেশে ধর্মীয় সম্প্রীতি আমাদের সংস্কৃতির অবিচ্ছেদ্য অংশ, যা কোনো রাজনৈতিক বা কূটনৈতিক স্বার্থে বিকৃত করা উচিত নয়।
বাংলাদেশে কখনো কখনো সংখ্যালঘুদের ওপর হামলার ঘটনা ঘটেছে। তবে এটি ধর্মীয় কারণে নয়, বরং রাজনৈতিক কারণে। ইতিহাস পর্যালোচনা করলে দেখা যায়, প্রতিটি সহিংসতার পেছনে রাজনৈতিক কারণ বিদ্যমান। ২০০১ সালের নির্বাচন-পরবর্তী সহিংসতা, ২০১২ সালে রামুর বৌদ্ধ মন্দিরে হামলা, ২০২১ সালে কুমিল্লায় দুর্গাপূজা ম-পে হামলাÑ এ ধরনের ঘটনা রাজনৈতিক ফায়দা লুটতে উসকে দেওয়া হয়েছে। দোষীদের চিহ্নিত করে শাস্তির আওতায় আনার জন্য সরকার কঠোর পদক্ষেপ নিয়েছে, যা প্রমাণ করে যে, বাংলাদেশ রাষ্ট্র হিসেবে সংখ্যালঘুদের নিরাপত্তা ও অধিকার রক্ষায় প্রতিশ্রুতিবদ্ধ।
তুলসী গ্যাবার্ডের বক্তব্য বাস্তবতা বিবর্জিত ও উদ্দেশ্যপ্রণোদিত। তিনি অতীতে ভারতের উগ্র হিন্দুত্ববাদী সংগঠনগুলোর সঙ্গে সংশ্লিষ্ট ছিলেন এবং বিজেপি-আরএসএসের ঘনিষ্ঠ হিসেবে পরিচিত। তার বাংলাদেশ বিরোধী মন্তব্যও একই ধরনের একটি রাজনৈতিক প্রোপাগান্ডার অংশ, যা মূলত ভারতের হিন্দুত্ববাদী বিজেপির বাংলাদেশবিরোধী প্রচারণার সঙ্গে সংযুক্ত। তিনি একপাক্ষিক তথ্যের ওপর নির্ভর করে বাংলাদেশের সার্বভৌমত্বকে অগ্রাহ্য করেছেন এবং ভুল তথ্য প্রচারের মাধ্যমে আন্তর্জাতিক মহলে বিভ্রান্তি ছড়ানোর চেষ্টা করেছেন।
বাংলাদেশের বিরুদ্ধে এই ধরনের অপপ্রচার রুখতে সঠিক তথ্য প্রচার করা জরুরি। আন্তর্জাতিক পর্যায়ে বাংলাদেশ সরকারের নীতিমালা ও সংখ্যালঘুদের উন্নয়নের বাস্তব চিত্র তুলে ধরতে হবে। বিভ্রান্তিকর প্রচারণার বিরুদ্ধে কূটনৈতিকভাবে ব্যবস্থা নিতে হবে এবং গণমাধ্যমকে বাংলাদেশের প্রকৃত অবস্থা তুলে ধরতে কার্যকর ভূমিকা রাখতে হবে। বাংলাদেশ সব ধর্ম ও সংস্কৃতির মানুষের দেশ এবং এর শান্তিপূর্ণ সহাবস্থানকে প্রশ্নবিদ্ধ করার যেকোনো প্রচেষ্টা রুখে দাঁড়ানো জরুরি। বিদেশি রাজনীতিকদের দায়িত্বশীলতার সঙ্গে নিরপেক্ষ ও তথ্যভিত্তিক বক্তব্য দেওয়া উচিত, যা একটি সার্বভৌম রাষ্ট্রের প্রতি সম্মান প্রদর্শন করবে।
বাংলাদেশ সরকার চরমপন্থা ও সন্ত্রাসবাদের বিরুদ্ধে অত্যন্ত কঠোর অবস্থান গ্রহণ করেছে। চরমপন্থার বিরুদ্ধে সরকার যে ‘শূন্য সহনশীলতা’ নীতি অনুসরণ করছে, তা শুধুমাত্র একটি রাজনৈতিক বক্তব্য নয়, বরং বাস্তবিক পদক্ষেপের দ্বারা প্রমাণিত। ২০০৫ সালে জেএমবি (Jamaatul Mujahideen Bangladesh) ও আনসারুল্লাহ বাংলা টিম (ABT)-এর মতো উগ্রবাদী সংগঠনের কার্যক্রম নিষিদ্ধ করার পর, আইনশৃঙ্খলা বাহিনী তাদের নেটওয়ার্ক ধ্বংসে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছে। কেবল নিষিদ্ধ করাই নয়, এই সংগঠনগুলোর নেতাদের গ্রেফতার, বিচার ও শাস্তি নিশ্চিত করার মধ্য দিয়ে বাংলাদেশ তার প্রতিশ্রুতি বাস্তবায়ন করেছে।
২০১৬ সালে গুলশানের হলি আর্টিজান ক্যাফেতে সন্ত্রাসী হামলার পর সরকার কঠোর নীতি গ্রহণ করে। এরপর থেকে নিরাপত্তা সংস্থাগুলোর ধারাবাহিক অভিযানের ফলে বাংলাদেশে বড় ধরনের কোনো জঙ্গি হামলা ঘটেনি। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী বিভিন্ন গোয়েন্দা সংস্থার সমন্বয়ে জঙ্গি বিরোধী অভিযান পরিচালনা করছে, যার ফলে নব্য জেএমবি, হিজবুত তাহরির এবং অন্যান্য উগ্রবাদী সংগঠনগুলোর কার্যক্রম নিষ্ক্রিয় হয়ে পড়েছে। শুধু তাই নয়, জঙ্গি অর্থায়ন বন্ধ, চরমপন্থী মতাদর্শ প্রচার রোধ এবং সমাজের বিভিন্ন স্তরে গণসচেতনতা বৃদ্ধির মাধ্যমে সরকার উগ্রবাদের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তুলেছে।
বাংলাদেশ শুধু অভ্যন্তরীণভাবে নয়, আন্তর্জাতিক সহযোগিতার মাধ্যমেও চরমপন্থা দমনে গুরুত্বপূর্ণ অগ্রগতি অর্জন করেছে। জাতিসংঘ, ইন্টারপোল, যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্যসহ বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সংস্থার সঙ্গে সমন্বয় করে বাংলাদেশ জঙ্গি বিরোধী কার্যক্রম পরিচালনা করছে। সন্ত্রাসী কার্যক্রম রোধে আর্থিক লেনদেনের উপর কঠোর নজরদারি চালানো হয়েছে, যার ফলে উগ্রপন্থী সংগঠনগুলোর অর্থায়নের পথ সংকুচিত হয়েছে।
এমন পরিস্থিতিতে তুলসী গ্যাবার্ডের মন্তব্য অত্যন্ত দুঃখজনক। তার বক্তব্য কেবল বাংলাদেশের ভাবমর্যাদা নষ্ট করার প্রচেষ্টা নয়, বরং এটি একটি বৃহত্তর ভূরাজনৈতিক ষড়যন্ত্রের অংশ হতে পারে। কিছু আন্তর্জাতিক মহল বাংলাদেশকে চরমপন্থার সঙ্গে জড়িত দেখানোর চেষ্টা করে, যাতে দেশটির রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা বিনষ্ট করা যায় এবং অভ্যন্তরীণ বিভেদ সৃষ্টি করা যায়। বাংলাদেশের সংখ্যালঘুদের বিরুদ্ধে সহিংসতার অভিযোগকে অতিরঞ্জিত করে উপস্থাপন করা হচ্ছে। বাস্তবতা হলো, সংখ্যালঘুরা বাংলাদেশে তাদের ধর্মীয় কার্যক্রম স্বাধীনভাবে পরিচালনা করতে পারে এবং রাষ্ট্র তাদের সুরক্ষা নিশ্চিত করে। বাংলাদেশ সরকার সংখ্যালঘুদের ধর্মীয় অধিকার রক্ষার জন্য প্রতিনিয়ত বিভিন্ন পদক্ষেপ নিচ্ছে। দুর্গাপূজা, বড়দিন, বুদ্ধপূর্ণিমা, ঈস্টার সানডেÑ এমন ধর্মীয় উৎসবগুলোতে সরকার আর্থিক অনুদান প্রদান করে এবং নিরাপত্তা নিশ্চিত করে। সংখ্যালঘুদের জন্য সরকারি চাকরি ও শিক্ষায় সংরক্ষিত কোটার ব্যবস্থা রয়েছে, যা তাদের অর্থনৈতিক ও সামাজিক অবস্থানকে আরও শক্তিশালী করেছে।
তুলনা করলে দেখা যায়, দক্ষিণ এশিয়ার অন্যান্য দেশের তুলনায় বাংলাদেশ সংখ্যালঘুদের জন্য অপেক্ষাকৃত নিরাপদ। প্রতিবেশী দেশগুলোতে সংখ্যালঘুদের প্রতি বিদ্বেষমূলক সহিংসতা ও বৈষম্যের হার অনেক বেশি, যা আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংস্থাগুলোর প্রতিবেদনে উঠে এসেছে। বাংলাদেশে সংখ্যালঘুরা সরকারি পৃষ্ঠপোষকতা ও সামাজিক সমর্থন পায়, যা তাদের ধর্মীয় ও সাংস্কৃতিক বিকাশে সহায়ক ভূমিকা রাখে।
বাংলাদেশের বিরুদ্ধে ভিত্তিহীন অভিযোগ ছড়ানোর পেছনে কিছু বিশেষ উদ্দেশ্য রয়েছে। কিছু আন্তর্জাতিক স্বার্থান্বেষী গোষ্ঠী বাংলাদেশকে একটি অস্থিতিশীল রাষ্ট্র হিসেবে উপস্থাপন করতে চায়, যাতে দেশের উন্নয়ন ব্যাহত হয় এবং আন্তর্জাতিক মহলে বাংলাদেশকে বিচ্ছিন্ন করা যায়। তাই, এই ধরনের অপপ্রচারের বিরুদ্ধে যথাযথ পদক্ষেপ নেওয়া প্রয়োজন। বাংলাদেশ সরকারের উচিত কূটনৈতিকভাবে আন্তর্জাতিক মহলে প্রকৃত তথ্য তুলে ধরা, যাতে বিভ্রান্তিকর প্রচারণার বিরুদ্ধে কার্যকরভাবে জবাব দেওয়া যায়। গণমাধ্যম, গবেষণা প্রতিষ্ঠান ও প্রবাসী বাংলাদেশিদেরও এ বিষয়ে সচেতন হতে হবে এবং বিশ্বব্যাপী বাংলাদেশের ইতিবাচক ভাবমর্যাদা বজায় রাখতে ভূমিকা রাখতে হবে।
বাংলাদেশ শান্তিপূর্ণ ও সহনশীল সমাজ গঠনের প্রতিশ্রুতিবদ্ধ এবং ধর্মীয় সম্প্রীতি বজায় রাখতে সর্বদা সচেষ্ট। অতএব, বাংলাদেশের উন্নয়ন ও অগ্রগতিকে ব্যাহত করার যে কোনো অপপ্রয়াস কঠোরভাবে প্রত্যাখ্যান করতে হবে। আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের উচিত সত্য তথ্যের ভিত্তিতে বাংলাদেশ সম্পর্কে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা এবং ভুল তথ্যের প্রচার থেকে বিরত থাকা।
লেখক: নিরাপত্তা বিশ্লেষক।
বিভাগ : সম্পাদকীয়
মন্তব্য করুন
আরও পড়ুন

রাজধানীতে আইবিডব্লিউএফ’র দ্বি-বার্ষিক সম্মেলন অনুষ্ঠিত

ফেনীতে ইনকিলাব সাংবাদিককে নির্যাতন মামলার প্রধান আসামি জামাই ফারুক গ্রেপ্তার

গাজীপুরে বলাৎকারের অভিযোগে এনে ইমামকে গণপিটুনি, কারাগারে মৃত্যু

স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের স্টিকার ছাড়া সচিবালয়ে যানবাহন প্রবেশ বন্ধের সিদ্ধান্ত

ইফার প্রকাশিত নিয়োগ বিজ্ঞপ্তি নিয়ে ভুল বোঝাবুঝির অবকাশ নেই

ইউআইইউ বন্ধের ঘটনায় বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় সমিতির উদ্বেগ

অবৈধ গ্যাস সংযোগ উচ্ছেদে তিতাসের অভিযান : জরিমানা আদায়

হামদর্দের গাজার জনগণের প্রতি মানবিক সহায়তা

অভিনেতা সিদ্দিককে মারধরের পর পুলিশে সোপর্দ

বনশ্রীর মেরাদিয়ায় কোরবানির পশুর হাট বসানো যাবে না

দিল্লি আর আওয়ামী দোসরদের দৌরাত্ম্য চলবে না : রাশেদ প্রধান

নুসরাত ফারিয়া, অপু বিশ্বাস, ভাবনাসহ ১৭ অভিনয়শিল্পীর বিরুদ্ধে হত্যাচেষ্টা মামলার আবেদন

মিয়ানমার সীমান্ত সংক্রান্ত পররাষ্ট্র উপদেষ্টার বক্তব্য বিকৃতভাবে উপস্থাপন : বাংলাফ্যাক্ট

দেশের আর্থিক পরিস্থিতির উন্নতি হচ্ছে ঋণমান সংস্থা ফিচকে জানাল কেন্দ্রীয় ব্যাংক

গ্যাস সিলিন্ডার বিস্ফোরণ দগ্ধ অন্তঃসত্ত্বা গৃহবধূর মৃত্যু

দীপ্ত টিভির সংবাদ বন্ধ করতে বলেনি সরকার : তথ্য উপদেষ্টা

সউদী নুসুকে কাঙ্খিত হজ ভিসা হচ্ছে না

কোম্পানির মুনাফার জায়গা গো-খাদ্য হতে পারে না : মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ উপদেষ্টা

এনসিপির সঙ্গে আমার কোনো সম্পর্ক নেই : উমামা ফাতেমা

শেখ রেহানার স্বামী-দেবরসহ ৮ জনের দেশত্যাগে নিষেধাজ্ঞা