দেশে আওয়ামী লীগের রাজনীতি অপ্রাসঙ্গিক

Daily Inqilab জামালউদ্দিন বারী

২৩ এপ্রিল ২০২৫, ১২:০৪ এএম | আপডেট: ২৩ এপ্রিল ২০২৫, ১২:০৪ এএম

তারা বিশ্বাস করুণ আর নাই করুন, রাজনীতির নেতাকর্মীদের মুখে শোনা যায়, ‘ব্যক্তির চেয়ে দল বড়, দলের চেয়ে দেশ বড়’। আওয়ামী লীগের ক্ষেত্রে এটি বরাবরই উল্টো। গণতান্ত্রিক ব্যবস্থাকে ম্যানিপুলেট করেই ফ্যাসিবাদের উত্থান ঘটে থাকে। ব্যক্তির হাত ধরেই দলের বির্বতন ও ক্ষমতায়ণ ঘটে আর ক্ষমতাসীন দল ভালো করলেই দেশ ও সমাজ সমৃদ্ধির পথে এগিয়ে যায়। বহু শতাব্দী আগে দার্শনিক প্লেটো বলেছিলেন, ‘শাসক যদি মহৎগুণসম্পন্ন হয়, তাহলে আইন নিষ্প্রয়োজন, আর শাসক যদি অযোগ্য বা মহৎগুণসম্পন্ন না হন, তাহলে আইন অকার্যকর।’ গত শতাব্দী থেকে থেকে চলমান সময় পর্যন্ত আমাদের দেশের রাজনৈতিক বিবর্তনের পটভূমিকায় অনেক রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব, নেতৃত্বের সাক্ষাৎ মিললেও খুব কম সংখ্যক রাষ্ট্র দার্শনিকের আবির্ভাব ঘটেছে। অবিভক্ত ভারতের প্রথম রাজনৈতিক দল জাতীয় কংগ্রেস প্রতিষ্ঠার পেছনে ভারতে পশ্চিমা ধাঁচের গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা ও ভারতীয়দের গণতান্ত্রিক রাজনীতির চর্চায় শামিল করতে ইংরেজেদের প্রথম পদক্ষেপ। এর আগে ইংরেজরা এদেশে ইংরেজি শিক্ষা ও শিক্ষাব্যবস্থাকে ইংরেজী মাধ্যমে রূপান্তরিত করার পেছনের দূরভিসন্ধি তাদের পার্লামেন্টে জোরের সাথেই উচ্চারণ করেছিলেন। তারা বলেছিলেন, ভারতের সমাজমানস থেকে তাদের পুরনো সাংস্কৃতিক-ধর্মীয় ঐতিহ্য ও শিক্ষা থেকে বিচ্যুত করে ভারতে একটি শিক্ষিত শ্রেণীর জন্ম দেয়া হবে, যারা মনমানসিকতায় হবে ইংরেজদের অনুরূপ। তারা মূলত রাষ্ট্র পরিচালনার স্বার্থে ইংরেজী জানা কেরানি সৃষ্টি করার শিক্ষাব্যবস্থা চালু করেছিল। এর বেশি কিছু নয়। ভারতীয় রাজনীতির প্রথম প্রস্তাবক একজন বৃটিশ (অবসরপ্রাপ্ত সিভিল অফিসার) অক্টাভিয়ান হিউম মনে করেছিলেন, বৃটিশরা প্রায় দেড়শ’ বছর ভারত শাসন করার পরও এখানকার অর্থনৈতিক সমস্যার সমাধান করতে পারেনি। এ কারণে প্রয়োজনীয় সংস্কার প্রস্তাবকে সামনে রেখেই ভারতীয় একটি রাজনৈতিক প্ল্যাটফর্ম গড়ে তোলার উদ্যোগ নেন হিউম এবং ১৮৮৫ সালের ডিসেম্বরে বোম্বেতে প্রস্তাবিত জাতীয় কংগ্রেসের প্রথম অধিবেশনের মধ্য দিয়ে ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেস প্রতিষ্ঠা লাভ করে। ইন্ডিয়ান ন্যাশনাল কংগ্রেস প্রতিষ্ঠায় অক্টাভিয়ান হিউমের চিন্তা ও সাংগঠনিক তৎপরতার সাথে সবচেয়ে বেশি প্রভাব ছিল বৃটিশ-ভারতীয় পারসিক ধর্মগুরু, পন্ডিত ও অর্থনীতিবিদ দাদাভাই নওরোজী। ১৮৬০ সালের দিকে তিনি লন্ডনে বৃটিশ-ইন্ডিয়ান কাউন্সিল প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। সেই সংগঠনের সেক্রেটারির দায়িত্ব পালনকারী উমেশ ব্যানার্জি ছিলেন ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেসের প্রথম নির্বাচিত সভাপতি এবং সেক্রেটারি ছিলেন হিউম। পরের কমিটিতে নওরোজি ইন্ডিয়ান ন্যাশনাল কংগেসের সভাপতির দায়িত্ব গ্রহণ করেন। ১৯০৫ সালে ঢাকাকে রাজধানী করে পূর্ব বাংলা ও আসাম নিয়ে একটি নতুন প্রদেশ ঘোষণা করা হলে নতুন রাজনৈতিক বাস্তবতায় ১৯০৬ সালে ঢাকার শাহবাগে মুসলিম লীগ প্রতিষ্ঠিত হয়। আগা খানদের আমন্ত্রণে ব্যারিস্টার মোহাম্মদ আলী জিন্নাহ মুসলীম লীগে যোগদান করা থেকে বিরত থেকে কংগ্রেসে দাদাভাই নওরোজীর সহকর্মী হিসেবে যোগদেন। জিন্নাহ প্রথম দিকে ধর্মের ভিত্তিতে কোনো গণতান্ত্রিক রাজনৈতিক দলের ঘোর বিরোধী হলেও হিন্দু জাতীয়তাবাদীদের ক্রমবর্ধমান চাপ, বঙ্গভঙ্গ রদের আন্দোলনসহ নানাবিধ কারণে মুসলীম লীগে যোগ দিয়ে মুসলমানদের স্বার্থ রক্ষায় বৃহত্তর রাজনৈতিক কর্মকা-ে নেতৃত্ব দেয়ার প্রয়োজনীয়তা অনুভব করেন। তবে ইতিহাস সচেতন ভারতীয়দের কাছে মোহাম্মদ আলী জিন্নাহ এখনো ভারতের হিন্দু-মুসলমানের সম্প্রীতি ও সহাবস্থানের রাজনীতির উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত বলে মনে করেন। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর বৃটেনের নির্বাচনে লেবার পার্টি ক্ষমতা গ্রহণ করে। প্রসঙ্গত উল্লেখ্য, লেবার পার্টির নির্বাচনী মেনিফেস্টোতে বৃটিশ ঔপনিবেশিক শাসন বিলোপের ওয়াদা করা হয়েছিল। তারই আলোকে ১৯৪৬ সালে ক্যাবিনেট মিশন শান্তিপূর্ণ উপায়ে কংগ্রেস ও মুসলীম লীগের মধ্যে একটি সমঝোতা প্রতিষ্ঠার মধ্য দিয়ে শান্তিপূর্ণ উপায়ে ভারতের স্বাধীনতা অথবা ভারত ভাগের চেষ্টা করেছিল।

ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেসে হিন্দুত্ববাদীদের প্রভাব বেড়ে যাওয়া এবং ক্রমবর্ধমান মুসলিম বিদ্বেষী তৎপরতা, কলকাতা রায়টে হাজার হাজার মুসলমানকে হত্যার মধ্য দিয়ে জাতিগত নির্মূলের অপতৎপরতা স্পষ্ট হওয়ায় মুসলমানদের আলাদা রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা অনিবার্য হয়ে পড়েছিল। হোসেন শহীদ সহরাওয়ার্দী ও মাওলানা ভাসানীর দ্বারা প্রভাবিত হয়ে মুসলীম লীগের যুবকর্মী শেখ মুজিবুর রহমানও মুসলীম লীগের পাকিস্তান আন্দোলনে যোগ দিয়েছিলেন। কিন্তু তার শিক্ষা-দীক্ষা ও রাজনৈতিক দর্শন ভারত ও পাকিস্তানের রাজনীতিবিদ জিন্নাহ, গান্ধী, নেহেরু, সোহরাওয়ার্দী কিংবা ভাসানীর সুযোগ্য উত্তরাধিকারের সক্ষমতা বহন করতে পারেনি। পাকিস্তান স্বাধীন হওয়ার পর জিন্নাহর আকস্মিক মৃত্যু এবং পাকিস্তানের দুই অংশের রাজনৈতিক টানপোড়েনকে রাজনৈতিকভাবে মোকাবেলা করতে ব্যর্থ হওয়ার কারণে সেখানে সামরিক শাসন চেপে বসে। পশ্চিম পাকিস্তানিদের আধিপত্যবাদী হঠকারিতার কারণেই বাংলাদেশের স্বাধীনতা আন্দোলন ও মুক্তিযুদ্ধ অনিবার্য হয়ে পড়েছিল। সেই সাথে ভারতীয় আধিপত্যবাদী ষড়যন্ত্র ও গোয়েন্দা তৎপরতা আমাদের রাজনৈতিক আন্দোলন সংগ্রামে অদ্ভুত এক মনোজাগতিক রসায়ন তৈরী করেছিল। পুরো জাতিকে একটি পাকিস্তানবিরোধী মবে পরিনত করতে যা কিছু করা প্রয়োজন ছিল, ভারতের পক্ষ থেকে তার সবই করা হয়েছিল। আগরতলা ষড়যন্ত্রের পটভূমি, কালিদাস বৈদ্য ও চিত্তরঞ্জন সুতারদের তৎপরতা ও সাক্ষ্যে তা প্রমানিত হয়েছে। স্বাধীনতাত্তোর বাংলাদেশের সাংস্কৃতিক, রাজনৈতিক-অর্থনৈতিক বাস্তবতা ও ক্রমবর্ধমান ভারতীয় আগ্রাসনের মূল এজেন্ডা ছিল বাংলাদেশে অযোগ্য, দুর্বল ও ভারতীয় বশংবদ রাজনৈতিক দল ও নেতৃত্ব সৃষ্টি করা এবং তাদের ক্ষমতাসীন করতে ও টিকিয়ে রাখতে সম্ভাব্য সবকিছু করা। শেখ মুজিব, এরশাদ, ওয়ান-ইলেভেন এবং শেখ হাসিনার ফ্যাসিবাদী দু:শাসন তার প্রকৃষ্ট উদাহরণ। জিয়াউর রহমানের রাষ্ট্রনায়কোচিত নেতৃত্ব এবং স্বাধীন বাংলাদেশের নবজাগরণের রাজনীতিকে ভারতীয় আধিপত্যবাদীরা মেনে নিতে না পারলেও ভারতীয় মগজধোলাই প্রাপ্ত আমলা ও রাজনৈতিক নেতা পরিবেষ্টিত বিএনপি’র শাসনে ভারতের তেমন কোনো মাথাব্যথা না থাকলেও তাদের আস্থা ও বিশ্বাস শুধুই আওয়ামী লীগে। শেখ হাসিনার অগণতান্ত্রিক-অমানবিক দু:শাসন সারাবিশ্বে ফলাও হয়ে যাওয়ার পরও বাংলাদেশের গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা কিংবা বিকল্প কোনো রাজনৈতিক শক্তির কথা ভারতের হিন্দুত্ববাদী শাসকদের মাথায় আসেনি। তারা মূলত আওয়ামী লীগকে ভারতের বিজেপি’র বাংলাদেশি ভার্সন হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করতে চেয়েছে। মিথ্যা ইতিহাস ও বাংলাদেশের জনগণের স্বার্থ, আকাক্সক্ষা ও নিরাপত্তার সাথে সম্পর্কহীন রাজনৈতিক-সাংস্কৃতিক বিষয়কে ধারন করে তৈরী করা ন্যারেটিভ প্রতিষ্ঠার মধ্য দিয়ে আমাদের হাজার বছরের রাজনৈতিক-অর্থনৈতিক সংগ্রামের ঐতিহ্য ও ইতিহাসকে একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধ ও পাকিস্তান বিরোধিতায় গ-িবদ্ধ করে ফেলা হয়েছিল। শেখ মুজিবকে জাতীয় ইতিহাসের একমাত্র মহানায়কে পরিনত করার হঠকারিতা জাতি বারবার প্রত্যাখ্যান করার পরও ভারতীয়রা সেই ভাঙ্গা রেকর্ড নতুন প্রজন্মের মন-মগজে গেঁথে দিতে চেয়েছিল। কথিত আছে, শেরে বাংলা ফজলুল হক নাকি বলেছিলেন, কলকাতার বিশেষ গোষ্ঠী যখন আমার কঠোর সমালোচনা করবে, বিরোধিতা করবে, তখন বুঝবে আমি সঠিক পথেই আছি। আর তারা যখন আমাকে সমর্থন করবে, প্রশংসা করবে, তখন বুঝতে হবে, আমি মুসলমানদের স্বার্থের প্রশ্নে আপস করছি। স্বাধীনতাত্তোর বাংলাদেশে শেখ হাসিনাই ছিলেন ভারতের হিন্দুত্ববাদীদের সবচে বশংবদ ও পছন্দের নেতা। তার বিপরীতে বর্তমান অর্ন্তবর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূসের প্রতি অনবরত বিদ্বেষ, অপপ্রচার, হুমকি ও প্রতিবন্ধকতা থেকে বোঝা যাচ্ছে, ইউনূস ভারতীয় আধিপত্যবাদকে রুখে দিচ্ছেন। দেশের মানুষ বরাবরই দুইভাগে বিভক্ত ভারতপন্থী আওয়ামী লীগ এবং এন্টি আওয়ামী লীগ। ছাত্র-জনতার রক্তাক্ত অভ্যুত্থানে শেখ হাসিনা ভারতে পালিয়ে যাওয়ার পর নেতৃত্বহীন আওয়ামী লীগে কোনো বিকল্প নেতৃত্ব দেখা যায়নি। এমনকি, এমন একটি সমর্থক গোষ্ঠীর অস্তিত্বও চোখে পড়েনি, যারা শেখ হাসিনার দুঃশাসন, লুটপাট, অপরিনামদর্শিতা এবং আত্মঘাতী রাজনীতির সমালোচনা করে আওয়ামী লীগের মূলে ফিরে যাওয়া বা শেকড় সন্ধানের আহ্বান জানিয়েছেন। এ থেকে এটা মনে হতে পারে যে, শেখ হাসিনার সাথে পালিয়ে যাওয়া কয়েক হাজার নেতাকর্মীর বাইরে আওয়ামী লীগের লাখ লাখ নেতাকর্মীর কোনো আলাদা ভয়েস নেই। তারা এখনো ফ্যাসিবাদী ন্যারেটিভের বিভ্রান্তিতে ডুবে আছে।

ঐতিহাসিক সত্যকে ক্ষমতার রাজনীতির উদ্দেশ্যপ্রণোদিত ন্যারেটিভ দিয়ে দীর্ঘদিন ঢেকে রাখা অসম্ভব। ভুল ন্যারেটিভের বিরুদ্ধে সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষের জাগরণ অবশ্যম্ভাবী। ভারতের হিন্দুত্ববাদী ন্যারেটিভ সেখানে সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা, নির্মূলিকরণ, জেনোসাইড এবং আঞ্চলিক অস্থিতিশীলতা ও নিরাপত্তাহীনতার জন্ম দিয়েছে। গত দুই দশকের রাজনৈতিক বাস্তবতায় মধ্যপ্রাচ্য এবং দক্ষিণ এশিয়ায় জায়নবাদ ও হিন্দুত্ববাদ পরস্পরের পরিপূরক হিসেবে দেখা যাচ্ছে। এই দুই চরমপন্থী রাজনৈতিক মতবাদের বয়স এক-দেড়শ’ বছরের বেশি না হলেও এরা দুই প্রাচীন ধর্মীয় জনগোষ্ঠী ইহুদি ও হিন্দুদের প্রতিনিধিত্বের দাবি করছে। যদিও ইসরাইলের রাষ্ট্রীয় নিয়ন্ত্রণের বাইরে সংখ্যাগরিষ্ঠ ইহুদিরা জুদাইজমের স্থলে জায়নবাদের যুদ্ধবাদী কর্তৃত্ব ও তৎপরতাকে প্রত্যাখ্যান করছে। অন্যদিকে, ভারতের বহুত্ববাদী গণতান্ত্রিক রাজনৈতিক ঐতিহ্যকে নস্যাৎ করে হিন্দুত্ববাদীরা এখন অনেকটা হিটলারের ফ্যাসিবাদী ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়েছে। নেতানিয়াহু ইসরাইলকে আরো আগেই ফ্যাসিবাদী কায়দায় একটি আগ্রাসী শক্তিতে পরিনত করেছে। ইসরাইল যেমন প্রাচীন হিব্রু জাতীয়তাবাদের আদলে মধ্যপ্রাচ্যে বিবলিক্যাল ড্রিমল্যান্ড বা কথিত গ্রেটার ইসরাইল গঠনের নীলনকশা বাস্তবায়নে মাঠে নেমেছে। একইভাবে বিজেপি ভারতীয় উপমহাদেশে মহাভারতের অখ- ভারত প্রতিষ্ঠার জন্য অন্য সব ধর্ম ও জাতিগোষ্ঠীর উপর নিপীড়ন ও নির্মূলের দীর্ঘমেয়াদী এজেন্ডা গ্রহণ করেছে। ফিলিস্তিনে ইসরাইলের যুদ্ধাপরাধ ও গণহত্যা বিশ্ববিবেক ও বিশ্বব্যবস্থার মর্মমূলে আঘাত করলেও ভারতের সমর্থন এ যুদ্ধকে মুসলিম জাতিগত নির্মূলের দিকে নিয়ে যাচ্ছে। গাজা যুদ্ধ ইউরোপ-আমেরিকার জন্য অর্থনৈতিক ও সামরিক ঝুঁকি তৈরী করলেও ভারতের হিন্দুত্ববাদীরা এ যুদ্ধকে অর্থনৈতিক স্বার্থ ও ইসরাইলের সাথে নতুন সামরিক কৌশলগত বোঝাপড়ার সুযোগ হিসেবে গ্রহণ করেছে। ভারতের অর্থনীতির বড় অংশ জুড়ে আছে সে দেশের মুসলমান ও সংখ্যালঘু সম্প্রদায় এবং মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলো। ইসরাইলের সাথে অনৈতিক সম্পর্ক ভারতীয় সমাজের স্থিতিশীলতা ও অর্থনীতির জন্য ঝুঁকিপূর্ণ হওয়া সত্ত্বেও ভারত বরাবরই মুসলমানদের অধিকার হরণ ও রাজনৈতিক-অর্থনৈতিকভাবে দাবিয়ে রাখতে ইসরাইলের ফিলিস্তিন নীতির পদাঙ্ক অনুসরণ করে চলেছে। সে একই ধারায় শতকরা ৯০ ভাগ মুসলমানের দেশ বাংলাদেশে বাংলাদেশী জাতীয়তাবাদী ও মূল ধারার ইসলামপন্থী রাজনৈতিক দল ও সরকার বিরোধীদের নির্মূলের ফ্যাসিবাদী কৌশল গ্রহণ করেছিল। রাষ্ট্রের সাথে রাষ্ট্রের সম্পর্ক নির্ধারিত হয় পারস্পরিক অর্থনৈতিক-বাণিজ্যিক ও কৌশলগত স্বার্থের বিবেচনায়। সেখানে দেশগুলোর জনগণ তথা জনসমর্থনই হচ্ছে নিয়ামক শক্তি। কিন্তু ভারত যে বাংলাদেশকে একটি আলাদা রাষ্ট্রসত্ত্বা হিসেবে বিবেচনা করতে নারাজ কিংবা বাংলাদেশের স্বাধীনতায় বিশ্বাস করে না, বাংলাদেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষের গণতান্ত্রিক আকাক্সক্ষা ও বিশ্ব সম্প্রদায়ের প্রত্যাশাকে গ্রাহ্য করে না, তার কর্মকা-ে তা প্রমাণিত হয়েছে। গণতান্ত্রিক মূল্যবোধে বিশ্বাসী উদারপন্থী ভারতীয়রাও তাদের সরকারের বাংলাদেশ নীতি এবং বাংলাদেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষের ভারত বিদ্বেষী হওয়ার বিপদ সম্পর্কে কথা বললেও বিজেপি’র অবস্থান ফিলিস্তিনিদের প্রতি জায়নবাদী ইসরাইলীদের মতো বর্ণবাদী ও ধ্বংসকামী।

স্বাধীনতার পাঁচ দশক পেরিয়ে এসেও বাংলাদেশের সাংস্কৃতিক-অর্থনৈতিক ও ভূরাজনৈতিক নিরাপত্তার প্রশ্নে জাতীয় ঐক্যমত্য প্রতিষ্ঠিত হয়নি। ঔপনিবেশোত্তর বিশ্বের যুদ্ধ ও গৃহযুদ্ধ কবলিত অনেক দেশ ও অঞ্চলে নতুন রাজনৈতিক-অর্থনৈতিক বাস্তবতায় রিকনসিলিয়েশন ও জাতীয় ঐক্যমত্য প্রতিষ্ঠিত হওয়ার মধ্য দিয়ে জাতীয় অগ্রগতি, সমৃদ্ধি ও নিরাপত্তা নিশ্চিত করা সম্ভব হলেও বাংলাদেশে আওয়ামী লীগের ভ্রান্ত রাজনীতি ও ভারতীয় জাতীয়তাবাদীদের বশংবদ রাজনৈতিক এজেন্ডা বাস্তবায়নের কারণে তা সম্ভব হয়নি। কারণ, একটি স্থিতিশীল ও জাতীয় ঐক্যের বাংলাদেশ তাদের হিন্দুত্ববাদী এজেন্ডার জন্য বড় হুমকি বলে মনে করে। ভারতে শত শত বছর ধরে মুসলমান সুলতান ও মোঘলরা শান্তিপূর্ণভাবে রাষ্ট্র পরিচালনা করার সাথে সাথে বহুধাবিভক্ত ভারতীয়দের ঐক্যবদ্ধ বিশাল সালতানাত ও মোঘল সা¤্রাজ্য প্রতিষ্ঠা করেছিলেন, যা আজকের ভারতবর্ষের বুনিয়াদ। সমৃদ্ধ ও শক্তিশালী সা¤্রাজ্য প্রতিষ্ঠা করতে মুসলমান শাসক ও স¤্রাটদের নিপিড়নমূলক আইন ও হিন্দু বিদ্বেষের প্রয়োজন হয়নি। বাণিজ্য ও প্রযুক্তির বিশ্বায়নের এই যুগে বৃটিশদের কাছ থেকে বহুত্ববাদী সেক্যুলার সংবিধানের উত্তরাধিকার গ্রহণ করেও হিন্দুত্ববাদী ভারত নিজ দেশের নাগরিক এবং প্রতিবেশিদের জন্য গুরুতর সংকট সৃষ্টি করে চলেছে। এ অঞ্চলে গণচীন ভারতের চেয়ে অনেক বড় সামরিক-অর্থনৈতিক পরাশক্তি হওয়া সত্ত্বেও প্রতিবেশিরা চীনকে তাদের অস্তিত্বের জন্য হুমকি মনে করে না। চীন আমাদেরও অন্যতম বাণিজ্যিক-অর্থনৈতিক ও কৌশলগত উন্নয়ন অংশীদার। গত সাড়ে ৮ মাসে ড. মুহাম্মদ ইউনূস অনেকটাই প্রমাণ করেছেন, ভারতের হুমকি মোকাবেলা করা সম্ভব। এক্ষেত্রে, সবচেয়ে বড় শক্তি হচ্ছে, জাতীয় ঐক্য। গত ১৬ বছরের গণতন্ত্রহীনতা ও ফ্যাসিবাদী দুঃশাসন আওয়ামী লীগকে একটি জনবিচ্ছিন্ন, মাইনর রাজনৈতিক দলে পরিনত করেছে। তবে রাষ্ট্রীয় সম্পদ লুন্ঠনের মধ্য দিয়ে এই দলে একটি অলিগার্ক ও অর্থনৈতিকভাবে ক্ষমতাবান একটি গোষ্ঠীর জন্ম হয়েছে। তারা এখনো ভারতীয় প্রেসক্রিপশনে বাংলাদেশকে অস্থিতিশীল করে, দেশের নিরাপত্তা বিপন্ন করে বড় ধরণের হুমকি সৃষ্টির মাধ্যমে আওয়ামী লীগের রাজনৈতিক পুর্নবাসনের স্বপ্ন দেখছে। পতিত স্বৈরাচার হাসিনাকে ভারতে বসে উস্কানিমুলক বক্তব্য দেয়ার সুযোগ দিয়ে বিজেপি সরকারের অবস্থানও পরিস্কার হয়ে গেছে। শত শত মানুষের গুম-খুন, গণহত্যা ও লাখ লাখ কোটি টাকা বিদেশে পাচার করে দেশের অর্থনীতিকে দেউলিয়া করে দেয়ার পেছনে শেখ হাসিনা ও তার সমর্থনপুষ্ট অলিগার্কদের ভূমিকা দিবালোকের মত পরিষ্কার হয়ে গেছে। এ ধরণের অপরাধের কোনো ক্ষমা হয়না। জাতির জীবনে এ ধরণের ঘটনার পুনরাবৃত্তি রোধের স্বার্থেই গুম-খুন-গণহত্যা ও মানবতাবিরোধী অপরাধের বিচার হওয়া জরুরি। আওয়ামী লীগের নেতা ও নির্দেশদাতা হিসেবে শেখ হাসিনা যেমন এসব অপরাধের সাথে সরাসরি জড়িত, একইভাবে ফ্যাসিবাদী ন্যারেটিভ প্রচার এবং বিভিন্ন সময়ে রাজনৈতিক কর্মসূচি ও প্রতিপক্ষ নির্মূলের নামে নৃশংস ঘটনার জন্মদাতা সংগঠন হিসেবে আওয়ামী লীগের রাজনীতি নিষিদ্ধের দাবি খুবই সঙ্গত ও যৌক্তিক।

স্বাধীনতাত্তোর বাংলাদেশে জাসদের হাজার হাজার নেতাকর্মী হত্যা, পিলখানায় অর্ধশতাধিক সামরিক অফিসার হত্যা, ঢাকার রাজপথে লগি-বৈঠা দিয়ে পিটিয়ে মানুষ হত্যা, ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির ঢাকা সফরের প্রতিবাদ করায় ঢাকা-চট্টগ্রামের রাজপথে গুলি করে মানুষ হত্যা, শাপলা চত্ত্বরে বাতি নিভিয়ে লাখ লাখ মাদরাসা শিক্ষক-শিক্ষার্থী ও তৌহিদী জনতার উপর গুলি চালিয়ে ম্যাসাকার করার মত ন্যাক্কার ঘটনা আওয়ামী লীগের ফ্যাসিবাদী হয়ে ওঠার ধারাক্রম। এ ধরনের একটি ঘটনাই যেকোনো রাজনৈতিক দলের পতন ও নিষিদ্ধ হওয়ার জন্য যথেষ্ট। ভারতের প্রেসক্রিপশনে আওয়ামী লীগের শেকড় বিচ্ছিন্ন ও জনবিচ্ছিন্ন রাজনীতি স্বাধীন বাংলাদেশের জন্য অপ্রাসঙ্গিক হয়ে পড়েছিল। আওয়ামী লীগকে নিষিদ্ধ করার দাবি ক্রমেই জোরালো হয়ে উঠছে। গুম-খুন ও রাষ্ট্রীয় সম্পদ লুন্ঠনকারী, শেখ পরিবার ও তার সুবিধাভোগী অলিগার্কদের বাইরে আওয়ামী লীগের সাধারণ নেতাকর্মীদের তরফ থেকে এমন কণ্ঠ এখনো শোনা যায়নি যে, শেখ মুজিব বা শেখ হাসিনা আওয়ামী লীগের প্রথম ও শেষ কথা নয়। শেখ মুজিবের আগে আওয়ামী লীগের প্রতিষ্ঠাতা নেতা হিসেবে মাওলানা ভাসানি, মাওলানা শামসুল হক, হোসেন সোহরাওয়ার্দীর মতো নেতারা ছিলেন। শেখ মুজিবের হাত ধরে আওয়ামী লীগের ভ্রষ্টতা ও সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষের সাথে বিচ্ছিন্নতার শুরু। শেখ মুজিবের রাজনৈতিক আদর্শ আওয়ামী লীগ নয়, বাকশাল। আওয়ামী লীগ বাংলাদেশী জাতীয়বাদকে ধারণ করেনি, তারা ভারতের বাঙ্গালী জাতীয়বাদকে ধারন করেছে। এ দেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ মুসলমান এবং বিভিন্ন উপজাতি-গোষ্ঠীর জন্য তা অপ্রাসঙ্গিক। বর্তমান বাস্তবতায় গণহত্যা ও মানবতাবিরোধী অপরাধে আওয়ামী লীগ নেতাদের বিচার ও নীতিগত রাজনৈতিক সংস্কার ছাড়া আওয়ামী লীগের রাজনীতি বাংলাদেশে অপ্রাসঙ্গিক হয়ে পড়েছে। শেখ মুজিবের নির্মম হত্যাকা- এবং পরবর্তী রাজনৈতিক বাস্তবতা থেকে শিক্ষা নিতে ব্যর্থ হওয়ায় শেখ হাসিনার হাত ধরে আওয়ামী লীগ চরম পরিনতি লাভ করেছে। ভারতীয় আনুকূল্যপ্রাপ্ত আওয়ামী লীগের রাজনীতি একাত্তর পরবর্তী বাংলাদেশের প্রতিটি গণতান্ত্রিক রাজনৈতিক আন্দোলন-সংগ্রামকে ব্যর্থ করে দিয়েছে। এবারের ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানের পর ঐক্যবদ্ধ জনগণ দেশকে আবার গুম-খুন, বিচারহীনতা ও নির্মূলের রাজনৈতিক ধারায় ফিরে যাওয়ার পথ বন্ধ করতে দৃঢ় প্রতিজ্ঞ।

bari_zamal@yahoo.com


বিভাগ : সম্পাদকীয়


মন্তব্য করুন

HTML Comment Box is loading comments...

এই বিভাগের আরও

কৃষকের পণ্যের ন্যায্যমূল্য নিশ্চিত করতে হবে
ঢাকাকে বেহাল অবস্থা থেকে উদ্ধার করতে হবে
মহান মে দিবস
বাঁধের বিপরীতে বাঁধই হতে পারে ভারতের সাথে পানি সমস্যার সমাধান
বিজেপির আগ্রাসী সাম্প্রদায়িক রাজনীতি ভারতের জন্য বুমেরাং হবে
আরও
X

আরও পড়ুন

কবে ফিরবেন খালেদা জিয়া, জানালেন তার একান্ত সচিব

কবে ফিরবেন খালেদা জিয়া, জানালেন তার একান্ত সচিব

গাজীপুরে মে দিবস পালিত

গাজীপুরে মে দিবস পালিত

ব্রিটিশ আমেরিকান টোব্যাকোর চার কর্মকর্তার বিরুদ্ধে মামলা

ব্রিটিশ আমেরিকান টোব্যাকোর চার কর্মকর্তার বিরুদ্ধে মামলা

চাঁদপুরের পদ্মা-মেঘনায় ফিরেছে হাজারো জেলে

চাঁদপুরের পদ্মা-মেঘনায় ফিরেছে হাজারো জেলে

গাইবান্ধায় বিভিন্ন কর্মসূচির মধ্য দিয়ে মহান মে দিবস পালিত

গাইবান্ধায় বিভিন্ন কর্মসূচির মধ্য দিয়ে মহান মে দিবস পালিত

মতলবে বিভিন্ন কর্মসূচির মধ্য দিয়ে মে দিবস পালিত

মতলবে বিভিন্ন কর্মসূচির মধ্য দিয়ে মে দিবস পালিত

রাজশাহীতে যথাযথ মর্যাদায় মহান মে দিবস পালিত

রাজশাহীতে যথাযথ মর্যাদায় মহান মে দিবস পালিত

গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা হলে শ্রমিকের অধিকার প্রতিষ্ঠা হবে: ব্যারিস্টার কামরুজ্জামান

গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা হলে শ্রমিকের অধিকার প্রতিষ্ঠা হবে: ব্যারিস্টার কামরুজ্জামান

ফুলপুরে অতিরিক্ত ভাড়া আদায় প্রতিরোধে মোবাইল কোর্ট পরিচালনা

ফুলপুরে অতিরিক্ত ভাড়া আদায় প্রতিরোধে মোবাইল কোর্ট পরিচালনা

আশুলিয়ায় আন্তর্জাতিক শ্রমিক দিবস পালিত

আশুলিয়ায় আন্তর্জাতিক শ্রমিক দিবস পালিত

আমি কখনও সংস্কারের বিপক্ষে ছিলাম না : মির্জা আব্বাস

আমি কখনও সংস্কারের বিপক্ষে ছিলাম না : মির্জা আব্বাস

সাভারে মে দিবস এবং জাতীয় পেশাগত স্বাস্থ্য ও সেফটি দিবস পালিত

সাভারে মে দিবস এবং জাতীয় পেশাগত স্বাস্থ্য ও সেফটি দিবস পালিত

লড়াইয়ের মাধ্যমে অধিকার আদায় করে নিতে হবে: নজরুল ইসলাম খান

লড়াইয়ের মাধ্যমে অধিকার আদায় করে নিতে হবে: নজরুল ইসলাম খান

আশুলিয়ায় পূর্ব শত্রুতার জেরে রঙ মিস্ত্রিকে হত্যা, অভিযুক্তকে আটকের সময় আহত ৪

আশুলিয়ায় পূর্ব শত্রুতার জেরে রঙ মিস্ত্রিকে হত্যা, অভিযুক্তকে আটকের সময় আহত ৪

হেফাজতে ইসলামের কর্মসূচিতে ছারছীনা শরীফের পীর ছাহেব কেবলার পূর্ণ সমর্থন

হেফাজতে ইসলামের কর্মসূচিতে ছারছীনা শরীফের পীর ছাহেব কেবলার পূর্ণ সমর্থন

পশ্চিম নাইজারে ৫ ভারতীয় নাগরিককে অপহরণ

পশ্চিম নাইজারে ৫ ভারতীয় নাগরিককে অপহরণ

সিলেটে ফুফাতো ভাইয়ের ছুরিকাঘাতে মামাতো ভাইয়ের মৃত্যু

সিলেটে ফুফাতো ভাইয়ের ছুরিকাঘাতে মামাতো ভাইয়ের মৃত্যু

নাহিদ কি আওয়ামী লীগ নিষিদ্ধে কোনো পদক্ষেপ নিয়েছেন: প্রশ্ন রাশেদের

নাহিদ কি আওয়ামী লীগ নিষিদ্ধে কোনো পদক্ষেপ নিয়েছেন: প্রশ্ন রাশেদের

অবিলম্বে মজুরি কমিশন গঠন করে শ্রমিকের ন্যায্য অধিকার প্রতিষ্ঠা করুন: সেলিম উদ্দিন

অবিলম্বে মজুরি কমিশন গঠন করে শ্রমিকের ন্যায্য অধিকার প্রতিষ্ঠা করুন: সেলিম উদ্দিন

রিয়ালের সাবেক কোচ এবার কাতারের দায়িত্বে

রিয়ালের সাবেক কোচ এবার কাতারের দায়িত্বে