সউদী আরব ও ইরানের মধ্যে সুসম্পর্ক প্রতিষ্ঠা : মুসলিম বিশ্বের জন্য সুসংবাদ

Daily Inqilab ইনকিলাব

১১ মার্চ ২০২৩, ০৭:৪৬ পিএম | আপডেট: ৩০ এপ্রিল ২০২৩, ১০:২৯ পিএম

সাত বছর পর মুসলিম বিশ্বের দুই প্রভাবশালী রাষ্ট্র সউদী আরব ও ইরানের মধ্যে পুনরায় কূটনৈতিক সম্পর্ক স্থাপিত হতে যাচ্ছে। দেশ দুটি নিজেদের মধ্যকার দ্বন্দ্ব মিটিয়ে শান্তি প্রতিষ্ঠায় সম্মত হয়েছে। গত ৬ মার্চ চীনের মধ্যস্থতায় বেইজিংয়ে দুই পক্ষের প্রতিনিধিদের মধ্যে আলোচনা শুরু হয়। এতে অংশগ্রহণ করেন ইরানের সুপ্রিম ন্যাশনাল সিকিউরিটি কাউন্সিলের প্রধান আলী শামখানি এবং তার সমকক্ষ সউদী প্রতিনিধি। আলোচনা শেষে দুই দেশ এই সিদ্ধান্তে উপনীত হয় যে, আগামী ৬০ দিনের মধ্যেই দুই দেশের মধ্যে আবারও কূটনৈতিক স¤পর্ক স্থাপিত হবে। রিয়াদে চালু হবে ইরানি দূতাবাস এবং তেহরানে চালু হবে সউদী দূতাবাস। সমঝোতায় স্বাক্ষর করেছেন চীনের কমিউনিস্ট পার্টির নেতা ওয়েং ওয়েই। সমঝোতা স্বাক্ষরের পর বক্তৃতায় ইরানের প্রতিনিধি আলী শামখানি বলেন, দুই দেশের মধ্যকার আলোচনা ছিল অকপট, স্বচ্ছ ও ব্যাপক। এতে ভুল বোঝাবুঝির অবসান হয়েছে এবং তেহরান-রিয়াদ স¤পর্ক স্থাপন আঞ্চলিক স্থিতিশীলতা নিশ্চিত করবে। পাশাপাশি মধ্যপ্রাচ্যের নিরাপত্তা বৃদ্ধি করবে এবং পারস্য উপসাগরের দেশগুলোসহ গোটা ইসলামী বিশ্বের মধ্যে বিদ্যমান চ্যালেঞ্জ মোকাবেলায় সহযোগিতা করবে। দুই দেশই স¤পর্ক পুণঃস্থাপনের বিষয়টি নিশ্চিত করে যৌথ বিবৃতি দিয়েছে বলে জানিয়েছে প্রেস টিভি। মুসলিম বিশ্বের দুই প্রতাপশালী দেশের মধ্যে ঐক্য ও সমঝোতা প্রতিষ্ঠার এই উদ্যোগ নিঃসন্দেহে মুসলিম বিশ্বের জন্য তো বটেই, পুরো বিশ্বে শান্তি ও সমৃদ্ধি প্রতিষ্ঠায় অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করবে। আমরা সুসম্পর্ক পুনঃস্থাপনের জন্য সউদী আরব ও ইরান সরকারকে আন্তরিক মোবারকবাদ ও ধন্যবাদ জানাই। দুই দেশের বিরোধ মিটানোর উদ্যোগ নেয়ায় চীনকেও ধন্যবাদ জ্ঞাপন করছি। উল্লেখ্য, ২০১৬ সালে শিয়া ধর্মগুরু শেখ নিমর আল-নিমরের মৃত্যুদ- কার্যকর করে সউদী আরব। ওই ঘটনার প্রেক্ষিতে, সে সময় তেহরানে থাকা সউদী দূতাবাসে হামলা চালায় ইরানিরা। এরপরই দুই দেশের মধ্যেকার স¤পর্ক ছিন্ন হয়।

সউদী আরব ও ইরানের মধ্যে এমন এক সময় সম্পর্ক পুনঃস্থাপনের সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছে, যখন যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্যের নেতৃত্বাধীন পশ্চিমা সা¤্রাজ্যবাদী দেশগুলো পুরো বিশ্বে যুদ্ধ পরিস্থিতি চালিয়ে যাচ্ছে। চলমান রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধে ইন্ধন দিচ্ছে। এর আগে তারা মুসলিম বিশ্বের সমৃদ্ধ দেশ ইরাক, লিবিয়া, সিরিয়াকে ধ্বংস করেছে। দুই দশকের বেশি সময় ধরে আফগানিস্তানে যুদ্ধ চালিয়ে দেশটিকে নিঃশেষ করে দিয়েছে। মুসলিম বিশ্বে যুক্তরাষ্ট্র ও তার মিত্রদের হামলা ও যুদ্ধ চাপিয়ে দেয়ার মূল কারণ ছিল, বিশ্বে মুসলমানদের প্রভাব রোধ ও বিপুল সম্পদ লুট করা। পাশাপাশি তাদের বর্ণবাদী শ্বেতাঙ্গ নীতি ও খ্রিস্টান সুপ্রিমেসি প্রতিষ্ঠা করা। এজন্য, অগ্রসরমান ইসলাম ও মুসলমানদের দমাতে তারা বিভিন্ন উসিলায় আরব বিশ্বের দেশগুলোতে হামলা এবং মুসলমানদের মধ্যে শিয়া-সুন্নী বিভেদ উসকে দিয়ে ধ্বংস ও বিপর্যয় সৃষ্টি ঘটিয়েছে। এখনো তাদের অপচেষ্টা অব্যাহত আছে। মিথ্যা অজুহাতে ইরাকের মতো সমৃদ্ধ দেশে হামলা চালিয়ে সাদ্দাম হোসেনকে হত্যা ও পুরো দেশটিকে ধ্বংসস্তুপে পরিণত করা হয়েছে। গাদ্দাফীকে হত্যা করে লিবিয়াকে ধ্বংসের দ্বারপ্রান্তে নিয়ে যাওয়া হয়েছে। সিরিয়ার মতো সমৃদ্ধ দেশকে জঙ্গী নিধনের নামে হামলা চালিয়ে ধ্বংসস্তুপ করা হয়েছে। এতেই তারা ক্ষান্ত হয়নি। মুসলমানদের মধ্যে শিয়া-সুন্নীর মতো মনস্তাত্ত্বিক দ্বন্দ্ব ও বিভেদ সৃষ্টি করেছে এবং করে যাচ্ছে। মুসলমানরা যাতে ঐক্যবদ্ধ হয়ে বিশাল শক্তিতে পরিণত হতে না পারে, এজন্য যত ধরনের ষড়যন্ত্র রয়েছে, তা করে যাচ্ছে। তাদের পাতা ফাঁদে মুসলমানদের কেউ কেউ পা দিয়েছে। ইয়েমেনে চলমান সংঘাত ও দ্বন্দ্বের নেপথ্যেও এই সম্প্রদায়গত বিষয়টি জড়িয়ে রয়েছে। বলা বাহুল্য, সউদী আরব ও ইরানের মধ্যে সম্পর্ক ছিন্ন হওয়ার কারণও ছিল শিয়া-সুন্নী দ্বন্দ্ব। মুসলমানদের ধ্বংস করার জন্য পশ্চিমা সা¤্রাজ্যবাদী শক্তি যুদ্ধবিগ্রহ ও অশান্ত করে তোলার জন্য বছরের পর বছর ট্রিলিয়ন ট্রিলিয়ন ডলার খরচ করে চলেছে। দুই দশকের বেশি সময় ধরে যুক্তরাষ্ট্র আফগানিস্তানে যে যুদ্ধ চালিয়েছে, তাতে ২.৩৩ ট্রিলিয়ন ডলার খরচ করেছে। শেষ পর্যন্ত তালেবানদের কাছে পরাস্ত হয়ে রাতের আঁধারে পালিয়ে যেতে বাধ্য হয়েছে। এছাড়া প্রতি বছরই বিশ্বের বিভিন্ন দেশে যুদ্ধ চালাতে গিয়ে দেশটি বছরে শত শত বিলিয়ন ডলার খরচ করছে। স্টকহোম ইন্টারন্যাশনাল পিস রিসার্চ ইনস্টিটিউটের হিসাবে, ২০২১ সালে যুক্তরাষ্ট্র ৮০১ বিলিয়ন ডলার খরচ করেছে। এসবই করছে বিশ্বে শান্তি প্রতিষ্ঠার নামে তার সা¤্রাজ্যবাদী নীতি ও আধিপত্য প্রতিষ্ঠা করার জন্য। বাস্তবতা হচ্ছে, যুক্তরাষ্ট্র এ পর্যন্ত যত যুদ্ধ চালিয়েছে তার কোনোটিতেই সাফল্য পায়নি।
মুসলিম বিশ্বের জন্য এটা অত্যন্ত সুসংবাদ যে, সউদী আরব ও ইরানের মধ্যে পুনরায় সুসম্পর্ক স্থাপিত হতে যাচ্ছে। এতে মুসলমানদের মধ্যে যে চিরায়ত ‘ভাই-ভাই’ সম্পর্ক, তা আরও দৃঢ় হবে। মুসলমানরা পারস্পরিক সম্প্রীতি, হৃদ্যতা ও সুসম্পর্ক প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে বিশ্বে শক্তিশালী ভূমিকায় অবতীর্ণ হবে। বলা হয়ে থাকে, পুরো বিশ্বের শতকরা প্রায় ষাট ভাগ সম্পদ রয়েছে মুসলিম বিশ্বে। এই বিপুল সম্পদের পাশাপাশি মুসলমানরা ঐক্যবদ্ধ হলে বিশ্বের কোনো অপশক্তিই সামনে দাঁড়াতে পারবে না। এজন্য দরকার মুসলমানদের মধ্যে পারস্পরিক সুসম্পর্ক। সম্প্রদায়গত তুচ্ছ কোনো বিষয় নিয়ে যেমন মুসলমানদের মধ্যে মতবিরোধ থাকা উচিৎ নয়, তেমনি সা¤্রাজ্যবাদী দেশগুলো যাতে উসকানি দিতে না পারে এ ব্যাপারে সতর্ক ও সচেতন থাকা বাঞ্চনীয়। বর্তমান বিশ্ব রাজনীতির পরিবর্তনের সময়ে মুসলিম বিশ্বের ঐক্য অত্যন্ত জরুরি। ইতোমধ্যে যুক্তরাষ্ট্র ও তার মিত্রদেশগুলোর খবরদারি, আগ্রাসী ও সা¤্রাজ্যবাদী নীতির বিরুদ্ধে নতুন একটি বলয় গড়ে উঠার চিত্র স্পষ্ট হয়ে উঠেছে। এ বলয় গঠনে চীন-রাশিয়ার সম্পর্ক গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করছে। এর সাথে সউদী আরব, ইরান, তুরস্ক, পাকিস্তানসহ অন্যদেশগুলো যুক্ত হচ্ছে। এর ফলে নতুন এক ‘ওয়ার্ল্ড অর্ডার’ সৃষ্টি হতে যাচ্ছে। এ ধরনের পোলারাইজেশনের সময় মুসলমানদের ঐক্যবদ্ধতা এক নতুন দিগন্তের সৃষ্টি করবে। মুসলমান দেশগুলো বিশ্বনীতি নির্ধারণে অন্যতম নিয়ামক ভূমিকায় অবতীর্ণ হবে। বাংলাদেশকেও বিষয়টি গভীরভাবে লক্ষ্য রাকতে হবে এবং মুসলিম বিশ্বের ঐক্য ও সংহতির পক্ষে স্বীয় অবস্থান নিশ্চিত করতে হবে। সঙ্গত কারণেই আমরা আশান্বিত যে, সউদী আরব ও ইরান পারস্পরিক বিরোধ মিটিয়ে ফেলার উদ্যোগ শুধু মুসলিম বিশ্বকে শক্তিশালী করবে না, পশ্চিমা সা¤্রাজ্যবাদ, আগ্রাসন, খ্রিস্টান ও শ্বেতাঙ্গ সুপ্রিমেসির বিরুদ্ধে কার্যকর ভূমিকা রাখবে।


বিভাগ : সম্পাদকীয়


মন্তব্য করুন

HTML Comment Box is loading comments...

আরও পড়ুন

গভীর রাতে ঢাকার বিভিন্ন এলাকায় ‘ব্লক রেইড’ অব্যাহত

গভীর রাতে ঢাকার বিভিন্ন এলাকায় ‘ব্লক রেইড’ অব্যাহত

সেতু ভবন ও দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা বিভাগ পরিদর্শনে প্রধানমন্ত্রী

সেতু ভবন ও দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা বিভাগ পরিদর্শনে প্রধানমন্ত্রী

নতুন নির্বাচনের দাবি ড. ইউনুসের

নতুন নির্বাচনের দাবি ড. ইউনুসের

মঙ্গলের লাল মাটিতে ‘হলুদ গুপ্তধনের’ সম্ভার! বিরাট আবিষ্কারে চাঞ্চল্য নাসায়

মঙ্গলের লাল মাটিতে ‘হলুদ গুপ্তধনের’ সম্ভার! বিরাট আবিষ্কারে চাঞ্চল্য নাসায়

পর্যটকদের জন্য ঝুঁকিপূর্ণ শহরের তালিকায় কারাকাস, করাচি, ইয়াঙ্গুন

পর্যটকদের জন্য ঝুঁকিপূর্ণ শহরের তালিকায় কারাকাস, করাচি, ইয়াঙ্গুন

বন্ধ ফেসবুকেই সক্রিয় প্রতিমন্ত্রী, জনমনে নানা প্রশ্ন

বন্ধ ফেসবুকেই সক্রিয় প্রতিমন্ত্রী, জনমনে নানা প্রশ্ন

আজ কোথায় কত ঘণ্টা শিথিল থাকবে কারফিউ?

আজ কোথায় কত ঘণ্টা শিথিল থাকবে কারফিউ?

বিয়ের বছর না ঘুরতেই বিস্ফোরক মন্তব্য পরিণীতির

বিয়ের বছর না ঘুরতেই বিস্ফোরক মন্তব্য পরিণীতির

রাশিয়ার পর এবার ইউক্রেনে যাচ্ছেন মোদি

রাশিয়ার পর এবার ইউক্রেনে যাচ্ছেন মোদি

আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্র উৎসবে মেহজাবীনের ‘সাবা’

আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্র উৎসবে মেহজাবীনের ‘সাবা’

আজও ঢাকাসহ ৪ জেলায় কারফিউ শিথিল ৯ ঘণ্টা

আজও ঢাকাসহ ৪ জেলায় কারফিউ শিথিল ৯ ঘণ্টা

মহাকাশে ‘বন্দি’ সুনীতা উইলিয়াম, ফেরা নিয়ে বড় আপডেট দিল নাসা

মহাকাশে ‘বন্দি’ সুনীতা উইলিয়াম, ফেরা নিয়ে বড় আপডেট দিল নাসা

আহতদের দেখতে পঙ্গু হাসপাতালে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা

আহতদের দেখতে পঙ্গু হাসপাতালে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা

নির্বাচনে কঙ্গনার জয়কে চ্যালেঞ্জ করে মামলা, নোটিশ পাঠালো হাইকোর্ট

নির্বাচনে কঙ্গনার জয়কে চ্যালেঞ্জ করে মামলা, নোটিশ পাঠালো হাইকোর্ট

ক্যালিফোর্নিয়ায় দাবানল, পালিয়েছে হাজার হাজার মানুষ

ক্যালিফোর্নিয়ায় দাবানল, পালিয়েছে হাজার হাজার মানুষ

চীন-রাশিয়ার ৪ যুদ্ধবিমানকে ধাওয়া দিল যুক্তরাষ্ট্র-কানাডা

চীন-রাশিয়ার ৪ যুদ্ধবিমানকে ধাওয়া দিল যুক্তরাষ্ট্র-কানাডা

মরক্কোয় ২৪ ঘণ্টায় তীব্র তাপপ্রবাহে ২১ জনের মৃত্যু

মরক্কোয় ২৪ ঘণ্টায় তীব্র তাপপ্রবাহে ২১ জনের মৃত্যু

সালমানকে ‘হত্যাচেষ্টা’, জবানবন্দিতে যা বললেন অভিনেতা

সালমানকে ‘হত্যাচেষ্টা’, জবানবন্দিতে যা বললেন অভিনেতা

কোটা সংস্কার আন্দোলন চমেকে চিকিৎসাধীন চাঁদপুরের আরও একজনের মৃত্যু

কোটা সংস্কার আন্দোলন চমেকে চিকিৎসাধীন চাঁদপুরের আরও একজনের মৃত্যু

জলবায়ু ও কার্বন পর্যবেক্ষণে অত্যাধুনিক স্যাটেলাইট চালু হলো চীনে

জলবায়ু ও কার্বন পর্যবেক্ষণে অত্যাধুনিক স্যাটেলাইট চালু হলো চীনে