ঢাকা   শুক্রবার, ২৭ ডিসেম্বর ২০২৪ | ১৩ পৌষ ১৪৩১

মধ্যপ্রাচ্যে যুদ্ধ সম্প্রসারিত হলে প্রভাব পড়বে সর্বত্র

Daily Inqilab ড. মো. ফখরুল ইসলাম

১৪ অক্টোবর ২০২৪, ১২:১৪ এএম | আপডেট: ১৪ অক্টোবর ২০২৪, ১২:১৪ এএম

২ অক্টোবর ইসরাইলের অভ্যন্তরে ইরানের ১৮০টি সুপারসনিক মিসাইল হামলার পর হিজবুল্লাহ ২ ঘণ্টার ব্যবধানে ২০০টিরও বেশি রকেট হামলা চালিয়েছে ৩ অক্টোবর। ইসরাইলের একগুঁয়েমী মনোভাবের কারণ তার পেছনে মার্কিন ও ইউরোপীয় শক্তির সমর্থন। কিন্তু লেবাননে একটানা হামলা চালানোর পর গোটা বিশ্বের দৃষ্টিভঙ্গি পরিবর্তনের সাথে মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোর মধ্যে ইসরাইলের বিরুদ্ধে নতুন চেতনা জেগে উঠেছে। বিশ্লেষকগণ মনে করছেন, লেবাননের বেসামরিক মানুষের উপর বোমা বর্ষণের পর থেকে মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোর নড়বড়ে অবস্থান নতুনভাবে শক্ত হয়ে উঠেছে।

ইরানের রেভ্যুলুশনারী গার্ডস্-এর পরামর্শে বিভিন্ন দেশের ছোট ছোট জোটগুলো একই নির্দেশনায় কাজ করছে বলে মনে হচ্ছে। ফিলিস্তিনের হামাস, ইরাক ও ইরানের শিয়া মিলিশিয়া, ইয়েমেনের হুতি, লেবাননের হিজবুল্লাহ, সবার লক্ষ্য এখন ইসরাইলের আগ্রাসনকে প্রতিরোধের জন্য একসাথে ঝাঁপিয়ে পড়ার মাধ্যমে শত্রæ দমানো। সৌদি যুবরাজ সালমান এই প্রথম লেবাননের বেসামরিক মানুষের উপর ইসরাইলি বাহিনীর শতাধিকবার বোমা বর্ষণের প্রতিবাদ করেছেন। সম্মিলিত আক্রমণে দিশেহারা হয়ে পড়েছে ইসরাইলি বাহিনী।

ইয়েমেনের হুতিরা ইসরাইলের অভ্যন্তরে সাসা শহরে ড্রোন আক্রমণ চালিয়েছে। লেবাননের হিজবুল্লাহ সংগঠন ইসরাইলি বাহিনীর স্থল আক্রমণ প্রতিহত করতে শুরু করেছে। ইতোমধ্যে তারা সম্মুখ যুদ্ধে প্রবল প্রতিরোধ তৈরি করে তিনটি ট্যাংক ধ্বংস করেছে এবং ৮ জন ইসরাইলি সৈন্যকে হত্যা করেছে। ইয়েমেনের হুথিরা দাবি করেছে, তারা ইসরাইলের তেল আবিবেও ড্রোন হামলা চালিয়েছে। শত্রæপক্ষ এসব ড্রোন প্রতিহত ও ভ‚পাতিত করতে পারেনি।

গত বছরের ৭ অক্টোবর হামাস ও ইসরাইলের মধ্যে যুদ্ধ শুরু হয়েছিল। দীর্ঘ এক বছর ধরে চলা এই যুদ্ধে এখন পর্যন্ত ৪৩ হাজারের বেশি ফিলিস্তিনিকে হত্যা করেছে দখলদার ইসরাইল। এরমধ্যে হামাসের যোদ্ধা, কর্মকর্তা ছাড়াও হাজার হাজার বেসামরিক মানুষ রয়েছেন। যুদ্ধের শুরুতে ইসরাইল জানিয়েছিল, গাজা থেকে হামাসকে তারা পুরোপুরি নির্মূল করে দেবে। তবে এখন পর্যন্ত দখলদার ইসরাইল তাদের এই লক্ষ্য অর্জন করতে পারেনি। ২০২৪ সালের অক্টোবরের শুরুতে লেবাননে আক্রমণের পর ফিলিস্তিনের গাজায় ইসরাইলি হামলায় এ উপত্যকার শাসক গোষ্ঠী হামাস সরকারের প্রধান রাহী মুস্তাহাসহ আরও দুই উচ্চপদস্থ কর্মকর্তাকে হত্যার দাবি করেছে দখলদার ইসরাইল। অবস্থাদৃষ্টে মনে হচ্ছে, ইসরাইলের আক্রমণ মধ্যপ্রাচ্যে তাদের সকল বৈরী দেশগুলোর উপর একইসঙ্গে হামলা চালানো হচ্ছে।

মার্কিনীরা নির্লজ্জের মতো ইসরাইলি বাহিনীকে গোলাবারুদ, রসদ যোগাচ্ছে। ইরানকে তারা প্রত্যক্ষভাকে হুমকি দিলেও ইরান সেটারে পাল্টা জবাব হুমকির মাধ্যমে ফিরিয়ে দিতে দেরী করছে না। হামাসের সাবেক প্রধান ইসমাইল হানিয়া, হিজবুল্লাহর প্রধান নেতা হাসান নাসরাল্লাহ এবং ইসলামিক বিপ্লবী গার্ডের এক কমান্ডার হত্যার জবাব দিতে শেষ পর্যন্ত ইসরাইলে একসঙ্গে ১৮০টি মিসাইল ছোড়ে ইরান। এই মিসাইল হামলার পর ইরান-ইসরাইল উত্তেজনা নতুন মাত্রায় পৌঁছেছে। ইরানের প্রধান ধর্মীয় নেতা আয়াতুল্লাহ আলী খামেনিকে হত্যার ছক কষছে ইসরাইল। মূলত হিজবুল্লাহ প্রধান হাসান নাসরাল্লাহকে হত্যার পর ইসরাইলি সরকারের একটি ধারণা তৈরি হয়েছে, তারা এখন ভালো অবস্থানে আছে এবং চাইলে ইরানের ধর্মীয় নেতাকেও হত্যা করতে পারবে। আর এমন খবর প্রকাশের পরই নেতানিয়াহুকে ইরানের ‘হিট লিস্টে’ রাখার তথ্য প্রকাশিত হলো। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম এক্সে একটি তালিকায় ইরান ‘হত্যা করতে’ চায় এমন ব্যক্তিদের নাম বের হয়েছে। এই ‘হিট লিস্টে’ নাম আছে ইসরাইলি প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহুসহ তিন বাহিনীর প্রধানের। এছাড়া ইরানের হিট লিস্টে আছে ইসরাইলের প্রতিরক্ষামন্ত্রী ইয়োভ গ্যালান্টও।

ক্রমাগত হুমকি ও পাল্টা হুমকির মুখে সামনের দিনগুলিতে কী ঘটতে যাচ্ছে মধ্যপ্রাচ্যে? মধ্যপ্রাচ্যসহ পুরো বিশ্বের নজর এখন ইরান-ইসরাইল পরিস্থিতির দিকে। ইরানের হামলার জবাবে ইসরাইলের পদক্ষেপ কী হবে, সেটি নিয়েও উদ্বেগ রয়েছে। অপরদিকে দুই দেশের মধ্যে সরাসরি সংঘাত ঘিরে একটি আঞ্চলিক যুদ্ধ শুরুর আশঙ্কাও করছেন অনেকে। কারণ, সক্ষমতার দিক থেকে তুলনা করলে দেখা যায় দুটি দেশই সামরিক দিক থেকে বেশ শক্তিশালী। গেøাবাল ফায়ার পাওয়ার-এর পরিসংখ্যান অনুযায়ী, ইরান সামরিক সক্ষমতার দিক থেকে ইসরাইলের তুলনায় তিন ধাপ এগিয়ে আছে। দুটি দেশই বিশ্বের সামরিক শক্তিধর দেশের শীর্ষ ২০টি দেশের মধ্যে অবস্থান করছে। সামরিক সক্ষমতায় শীর্ষ দেশগুলোর মধ্যে র‌্যাংকিংয়ে ইরানের অবস্থান ১৪ আর ইসরাইলের অবস্থান ১৭। কিন্তু শক্তির ভারসাম্য যতই কাছাকাছি হোক না কেন, একবার ঘোরতর যুদ্ধ শুরু হয়ে গেলে শক্তির ক্ষয়সাধন কয়েক মিনিট বা ঘণ্টার ব্যাপার মাত্র।

অনেকের কাছে পারমাণবিক বোমা থাকায় নিশপিশ করছে তাদের কালো হাত। মানবতার নৃশংশ বিলুপ্তি ঘটানোর জন্য আরো অনেক নেতানিয়াহুরা এক অপরের সঙ্গে প্রতিনিয়ত যোগসাজশ করে যুদ্ধের উন্মাদনা ছড়িয়ে তাদের ঘৃণ্য অস্ত্র ব্যবসাকে শান দেবার চেষ্টা করে যাচ্ছে প্রতিনিয়ত। মার্কিনীরা তার জ্বলন্ত উদাহরণ। রাশিয়াও বা বাদ যাবে কীভাবে? জো বাইডেন বলেছেন, তার দেশ ইসরাইলের পারমাণবিক মক্তি ব্যবহারকে সমর্থন করবে না। কিন্তু ইতোমধ্যে সে ভয়ানক শক্তি ব্যবহার করার জন্য ইসরাইলকে উস্কে দিয়েছে, তা কি কোনভাবে ক্ষমার যোগ্য বলে মনে হয়?

এসব যুদ্ধ অপরাধকে কেউই আমলে নিচ্ছেন না। অস্ত্র ব্যবসার প্রয়োজনে এত ভয়ংকর বিষয়কে ওরা সদর্পে অগ্রাহ্য করেই যাচ্ছে। জাতিসংঘ মহাসচিব আন্তোনিও গুতেরেসকে অবাঞ্ছিত ঘোষণা করেছে ইসরাইল। কারণ, তিনি ইরানের মিসাইল হামলার নিন্দা জানাননি।

মধ্যপ্রাচ্যে যুদ্ধ পরিস্থিতি সৃষ্টি হলে আতঙ্ক ছড়িয়ে যাবে সবখানে। আমরাও এর প্রভাব থেকে রেহাই পাবো না। তেল-গ্যাসের দাম বৃদ্ধি পাবে কয়েকগুণ। মধ্যপ্রাচ্যের শ্রমিকদের পাঠানো অর্থনির্ভর আমাদের অর্থনীতিতে বড় ধাক্কা লাগবে। ২০২৪ সালের তথ্যানুযায়ী আমাদের দেশে রেমিটেন্স আসার প্রধান উৎস সংযুক্ত আরব আমিরাত, সৌদি আরব ও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র। এসব দেশ থেকে আসা রেমিটেন্স কমে গেলে বা বন্ধ হলে আমাদের বাজেট ফেল করতে থাকবে। ইরাক-কুয়েত যুদ্ধের সময়ের মতো মধ্যপ্রাচ্য থেকে চাকরিহারা শ্রমিকরা আতঙ্কগ্রস্ত হয়ে দেশে ফিরতে শুরু করলে আমাদের দেশের আর্থ-সামাজিক অবস্থা করুণ হয়ে দাঁড়াবে, তাতে সন্দেহ নেই। স¤প্রতি অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস তার প্রণীত ‘থ্রি জিরো’ তথা শূন্য দারিদ্র্য, শূন্য বেকারত্ব ও শূন্য নেট কার্বন নিঃসরণ অর্জনের ওপর গুরুত্বারোপ করেন। মধ্যপ্রাচ্যের যুদ্ধ আরো বিপজ্জক হয়ে উঠলে আমাদের জিরো দারিদ্র্য ও জিরো বেকারত্ব ধারণা বাস্তবায়ন খুব কঠিন হতে পারে।

লেখক: রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজকর্ম বিভাগের প্রফেসর ও সামাজিক বিজ্ঞান অনুষদের সাবেক ডীন।
[email protected]


বিভাগ : সম্পাদকীয়


মন্তব্য করুন

HTML Comment Box is loading comments...

এই বিভাগের আরও

শুধু নামেই জিমনেসিয়াম
মধ্যপ্রাচ্যের ভূরাজনীতিতে কী পরিবর্তন আসছে?
অন্তর্বর্তী সরকার ও রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে মতদ্বৈততা কাম্য নয়
সচিবালয়ে আগুন সন্দেহজনক
বিশেষ চাহিদাসম্পন্ন শিক্ষার্থীদের যত্ন নিতে হবে
আরও

আরও পড়ুন

পরলোকে সাবেক প্রধানমন্ত্রী মনমোহন সিং :ভারতে ৭ দিনের রাষ্ট্রীয় শোক ঘোষণা

পরলোকে সাবেক প্রধানমন্ত্রী মনমোহন সিং :ভারতে ৭ দিনের রাষ্ট্রীয় শোক ঘোষণা

কালীগঞ্জে রাঙ্গামাটিয়া ধর্মপল্লীর সংবাদ সম্মেলন

কালীগঞ্জে রাঙ্গামাটিয়া ধর্মপল্লীর সংবাদ সম্মেলন

গ্রাম আদালত সম্পর্কে জনসচেতনতা তৈরিতে সমন্বয় সভা অনুষ্ঠিত

গ্রাম আদালত সম্পর্কে জনসচেতনতা তৈরিতে সমন্বয় সভা অনুষ্ঠিত

মিসরে প্রেসিডেন্ট সিসির বিরুদ্ধে ব্যাপক বিক্ষোভ

মিসরে প্রেসিডেন্ট সিসির বিরুদ্ধে ব্যাপক বিক্ষোভ

কুর্দি যোদ্ধাদের ভয়ঙ্কর হুঁশিয়ারি এরদোগানের

কুর্দি যোদ্ধাদের ভয়ঙ্কর হুঁশিয়ারি এরদোগানের

৩৫শ’ এজেন্টের অধিকাংশই গুজরাটের পাচারকারী

৩৫শ’ এজেন্টের অধিকাংশই গুজরাটের পাচারকারী

৫ সাংবাদিককে হত্যা করল ইসরাইল বিমান

৫ সাংবাদিককে হত্যা করল ইসরাইল বিমান

তুষারপাতে অচল হিমাচল দুই শতাধিক রাস্তা বন্ধ

তুষারপাতে অচল হিমাচল দুই শতাধিক রাস্তা বন্ধ

ক্রিপ্টো রিজার্ভ গড়বেন ট্রাম্প?

ক্রিপ্টো রিজার্ভ গড়বেন ট্রাম্প?

মোজাম্বিকে কারাদাঙ্গায় নিহত ৩৩, পলাতক ১৫০০ কয়েদি

মোজাম্বিকে কারাদাঙ্গায় নিহত ৩৩, পলাতক ১৫০০ কয়েদি

গাজায় যুদ্ধবিরতি বিলম্বে পাল্টাপাল্টি দোষারোপ হামাস-ইসরাইলের

গাজায় যুদ্ধবিরতি বিলম্বে পাল্টাপাল্টি দোষারোপ হামাস-ইসরাইলের

পাকিস্তানে সড়ক অবরোধে শতাধিক শিশুর প্রাণহানি

পাকিস্তানে সড়ক অবরোধে শতাধিক শিশুর প্রাণহানি

আফগানিস্তানে ৭১ সন্ত্রাসীকে হত্যা করেছে পাকিস্তান

আফগানিস্তানে ৭১ সন্ত্রাসীকে হত্যা করেছে পাকিস্তান

শুধু নারীদের জন্য

শুধু নারীদের জন্য

নিথর দেহ

নিথর দেহ

আত্মহননে

আত্মহননে

জকিগঞ্জে প্রাক্সিসের ৭ দিনব্যাপী ইংলিশ স্পিকিং চ্যালেঞ্জ কম্পিটিশনের পুরস্কার বিতরণী

জকিগঞ্জে প্রাক্সিসের ৭ দিনব্যাপী ইংলিশ স্পিকিং চ্যালেঞ্জ কম্পিটিশনের পুরস্কার বিতরণী

মাদ্রাসার ছাদ থেকে পাইপ বেয়ে নামার সময় পড়ে গিয়ে শিশুর মৃত্যু

মাদ্রাসার ছাদ থেকে পাইপ বেয়ে নামার সময় পড়ে গিয়ে শিশুর মৃত্যু

গাজীপুরে নিষিদ্ধ ছাত্রলীগ নেতাকে ছাড়িয়ে আনতে থানায় বিএনপি নেতাদের ভিড়

গাজীপুরে নিষিদ্ধ ছাত্রলীগ নেতাকে ছাড়িয়ে আনতে থানায় বিএনপি নেতাদের ভিড়

শুধু নামেই জিমনেসিয়াম

শুধু নামেই জিমনেসিয়াম