মধ্যপ্রাচ্যে যুদ্ধ সম্প্রসারিত হলে প্রভাব পড়বে সর্বত্র
১৪ অক্টোবর ২০২৪, ১২:১৪ এএম | আপডেট: ১৪ অক্টোবর ২০২৪, ১২:১৪ এএম
২ অক্টোবর ইসরাইলের অভ্যন্তরে ইরানের ১৮০টি সুপারসনিক মিসাইল হামলার পর হিজবুল্লাহ ২ ঘণ্টার ব্যবধানে ২০০টিরও বেশি রকেট হামলা চালিয়েছে ৩ অক্টোবর। ইসরাইলের একগুঁয়েমী মনোভাবের কারণ তার পেছনে মার্কিন ও ইউরোপীয় শক্তির সমর্থন। কিন্তু লেবাননে একটানা হামলা চালানোর পর গোটা বিশ্বের দৃষ্টিভঙ্গি পরিবর্তনের সাথে মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোর মধ্যে ইসরাইলের বিরুদ্ধে নতুন চেতনা জেগে উঠেছে। বিশ্লেষকগণ মনে করছেন, লেবাননের বেসামরিক মানুষের উপর বোমা বর্ষণের পর থেকে মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোর নড়বড়ে অবস্থান নতুনভাবে শক্ত হয়ে উঠেছে।
ইরানের রেভ্যুলুশনারী গার্ডস্-এর পরামর্শে বিভিন্ন দেশের ছোট ছোট জোটগুলো একই নির্দেশনায় কাজ করছে বলে মনে হচ্ছে। ফিলিস্তিনের হামাস, ইরাক ও ইরানের শিয়া মিলিশিয়া, ইয়েমেনের হুতি, লেবাননের হিজবুল্লাহ, সবার লক্ষ্য এখন ইসরাইলের আগ্রাসনকে প্রতিরোধের জন্য একসাথে ঝাঁপিয়ে পড়ার মাধ্যমে শত্রæ দমানো। সৌদি যুবরাজ সালমান এই প্রথম লেবাননের বেসামরিক মানুষের উপর ইসরাইলি বাহিনীর শতাধিকবার বোমা বর্ষণের প্রতিবাদ করেছেন। সম্মিলিত আক্রমণে দিশেহারা হয়ে পড়েছে ইসরাইলি বাহিনী।
ইয়েমেনের হুতিরা ইসরাইলের অভ্যন্তরে সাসা শহরে ড্রোন আক্রমণ চালিয়েছে। লেবাননের হিজবুল্লাহ সংগঠন ইসরাইলি বাহিনীর স্থল আক্রমণ প্রতিহত করতে শুরু করেছে। ইতোমধ্যে তারা সম্মুখ যুদ্ধে প্রবল প্রতিরোধ তৈরি করে তিনটি ট্যাংক ধ্বংস করেছে এবং ৮ জন ইসরাইলি সৈন্যকে হত্যা করেছে। ইয়েমেনের হুথিরা দাবি করেছে, তারা ইসরাইলের তেল আবিবেও ড্রোন হামলা চালিয়েছে। শত্রæপক্ষ এসব ড্রোন প্রতিহত ও ভ‚পাতিত করতে পারেনি।
গত বছরের ৭ অক্টোবর হামাস ও ইসরাইলের মধ্যে যুদ্ধ শুরু হয়েছিল। দীর্ঘ এক বছর ধরে চলা এই যুদ্ধে এখন পর্যন্ত ৪৩ হাজারের বেশি ফিলিস্তিনিকে হত্যা করেছে দখলদার ইসরাইল। এরমধ্যে হামাসের যোদ্ধা, কর্মকর্তা ছাড়াও হাজার হাজার বেসামরিক মানুষ রয়েছেন। যুদ্ধের শুরুতে ইসরাইল জানিয়েছিল, গাজা থেকে হামাসকে তারা পুরোপুরি নির্মূল করে দেবে। তবে এখন পর্যন্ত দখলদার ইসরাইল তাদের এই লক্ষ্য অর্জন করতে পারেনি। ২০২৪ সালের অক্টোবরের শুরুতে লেবাননে আক্রমণের পর ফিলিস্তিনের গাজায় ইসরাইলি হামলায় এ উপত্যকার শাসক গোষ্ঠী হামাস সরকারের প্রধান রাহী মুস্তাহাসহ আরও দুই উচ্চপদস্থ কর্মকর্তাকে হত্যার দাবি করেছে দখলদার ইসরাইল। অবস্থাদৃষ্টে মনে হচ্ছে, ইসরাইলের আক্রমণ মধ্যপ্রাচ্যে তাদের সকল বৈরী দেশগুলোর উপর একইসঙ্গে হামলা চালানো হচ্ছে।
মার্কিনীরা নির্লজ্জের মতো ইসরাইলি বাহিনীকে গোলাবারুদ, রসদ যোগাচ্ছে। ইরানকে তারা প্রত্যক্ষভাকে হুমকি দিলেও ইরান সেটারে পাল্টা জবাব হুমকির মাধ্যমে ফিরিয়ে দিতে দেরী করছে না। হামাসের সাবেক প্রধান ইসমাইল হানিয়া, হিজবুল্লাহর প্রধান নেতা হাসান নাসরাল্লাহ এবং ইসলামিক বিপ্লবী গার্ডের এক কমান্ডার হত্যার জবাব দিতে শেষ পর্যন্ত ইসরাইলে একসঙ্গে ১৮০টি মিসাইল ছোড়ে ইরান। এই মিসাইল হামলার পর ইরান-ইসরাইল উত্তেজনা নতুন মাত্রায় পৌঁছেছে। ইরানের প্রধান ধর্মীয় নেতা আয়াতুল্লাহ আলী খামেনিকে হত্যার ছক কষছে ইসরাইল। মূলত হিজবুল্লাহ প্রধান হাসান নাসরাল্লাহকে হত্যার পর ইসরাইলি সরকারের একটি ধারণা তৈরি হয়েছে, তারা এখন ভালো অবস্থানে আছে এবং চাইলে ইরানের ধর্মীয় নেতাকেও হত্যা করতে পারবে। আর এমন খবর প্রকাশের পরই নেতানিয়াহুকে ইরানের ‘হিট লিস্টে’ রাখার তথ্য প্রকাশিত হলো। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম এক্সে একটি তালিকায় ইরান ‘হত্যা করতে’ চায় এমন ব্যক্তিদের নাম বের হয়েছে। এই ‘হিট লিস্টে’ নাম আছে ইসরাইলি প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহুসহ তিন বাহিনীর প্রধানের। এছাড়া ইরানের হিট লিস্টে আছে ইসরাইলের প্রতিরক্ষামন্ত্রী ইয়োভ গ্যালান্টও।
ক্রমাগত হুমকি ও পাল্টা হুমকির মুখে সামনের দিনগুলিতে কী ঘটতে যাচ্ছে মধ্যপ্রাচ্যে? মধ্যপ্রাচ্যসহ পুরো বিশ্বের নজর এখন ইরান-ইসরাইল পরিস্থিতির দিকে। ইরানের হামলার জবাবে ইসরাইলের পদক্ষেপ কী হবে, সেটি নিয়েও উদ্বেগ রয়েছে। অপরদিকে দুই দেশের মধ্যে সরাসরি সংঘাত ঘিরে একটি আঞ্চলিক যুদ্ধ শুরুর আশঙ্কাও করছেন অনেকে। কারণ, সক্ষমতার দিক থেকে তুলনা করলে দেখা যায় দুটি দেশই সামরিক দিক থেকে বেশ শক্তিশালী। গেøাবাল ফায়ার পাওয়ার-এর পরিসংখ্যান অনুযায়ী, ইরান সামরিক সক্ষমতার দিক থেকে ইসরাইলের তুলনায় তিন ধাপ এগিয়ে আছে। দুটি দেশই বিশ্বের সামরিক শক্তিধর দেশের শীর্ষ ২০টি দেশের মধ্যে অবস্থান করছে। সামরিক সক্ষমতায় শীর্ষ দেশগুলোর মধ্যে র্যাংকিংয়ে ইরানের অবস্থান ১৪ আর ইসরাইলের অবস্থান ১৭। কিন্তু শক্তির ভারসাম্য যতই কাছাকাছি হোক না কেন, একবার ঘোরতর যুদ্ধ শুরু হয়ে গেলে শক্তির ক্ষয়সাধন কয়েক মিনিট বা ঘণ্টার ব্যাপার মাত্র।
অনেকের কাছে পারমাণবিক বোমা থাকায় নিশপিশ করছে তাদের কালো হাত। মানবতার নৃশংশ বিলুপ্তি ঘটানোর জন্য আরো অনেক নেতানিয়াহুরা এক অপরের সঙ্গে প্রতিনিয়ত যোগসাজশ করে যুদ্ধের উন্মাদনা ছড়িয়ে তাদের ঘৃণ্য অস্ত্র ব্যবসাকে শান দেবার চেষ্টা করে যাচ্ছে প্রতিনিয়ত। মার্কিনীরা তার জ্বলন্ত উদাহরণ। রাশিয়াও বা বাদ যাবে কীভাবে? জো বাইডেন বলেছেন, তার দেশ ইসরাইলের পারমাণবিক মক্তি ব্যবহারকে সমর্থন করবে না। কিন্তু ইতোমধ্যে সে ভয়ানক শক্তি ব্যবহার করার জন্য ইসরাইলকে উস্কে দিয়েছে, তা কি কোনভাবে ক্ষমার যোগ্য বলে মনে হয়?
এসব যুদ্ধ অপরাধকে কেউই আমলে নিচ্ছেন না। অস্ত্র ব্যবসার প্রয়োজনে এত ভয়ংকর বিষয়কে ওরা সদর্পে অগ্রাহ্য করেই যাচ্ছে। জাতিসংঘ মহাসচিব আন্তোনিও গুতেরেসকে অবাঞ্ছিত ঘোষণা করেছে ইসরাইল। কারণ, তিনি ইরানের মিসাইল হামলার নিন্দা জানাননি।
মধ্যপ্রাচ্যে যুদ্ধ পরিস্থিতি সৃষ্টি হলে আতঙ্ক ছড়িয়ে যাবে সবখানে। আমরাও এর প্রভাব থেকে রেহাই পাবো না। তেল-গ্যাসের দাম বৃদ্ধি পাবে কয়েকগুণ। মধ্যপ্রাচ্যের শ্রমিকদের পাঠানো অর্থনির্ভর আমাদের অর্থনীতিতে বড় ধাক্কা লাগবে। ২০২৪ সালের তথ্যানুযায়ী আমাদের দেশে রেমিটেন্স আসার প্রধান উৎস সংযুক্ত আরব আমিরাত, সৌদি আরব ও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র। এসব দেশ থেকে আসা রেমিটেন্স কমে গেলে বা বন্ধ হলে আমাদের বাজেট ফেল করতে থাকবে। ইরাক-কুয়েত যুদ্ধের সময়ের মতো মধ্যপ্রাচ্য থেকে চাকরিহারা শ্রমিকরা আতঙ্কগ্রস্ত হয়ে দেশে ফিরতে শুরু করলে আমাদের দেশের আর্থ-সামাজিক অবস্থা করুণ হয়ে দাঁড়াবে, তাতে সন্দেহ নেই। স¤প্রতি অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস তার প্রণীত ‘থ্রি জিরো’ তথা শূন্য দারিদ্র্য, শূন্য বেকারত্ব ও শূন্য নেট কার্বন নিঃসরণ অর্জনের ওপর গুরুত্বারোপ করেন। মধ্যপ্রাচ্যের যুদ্ধ আরো বিপজ্জক হয়ে উঠলে আমাদের জিরো দারিদ্র্য ও জিরো বেকারত্ব ধারণা বাস্তবায়ন খুব কঠিন হতে পারে।
লেখক: রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজকর্ম বিভাগের প্রফেসর ও সামাজিক বিজ্ঞান অনুষদের সাবেক ডীন।
[email protected]
বিভাগ : সম্পাদকীয়
মন্তব্য করুন
আরও পড়ুন
আগামী জাতীয় নির্বাচন হবে জাতির জন্য কঠিন নির্বাচন
ভারত বিরোধী স্লোগানে উত্তাল খুলনা
রেকর্ডের মালা গেঁথে বাংলাদেশের সিরিজ জয়
মমতা ব্যানার্জির জাতিসংঘের শান্তিরক্ষী বাহিনী পাঠানোর প্রস্তাবটি বাস্তবতা বিবর্জিত গালগল্প
গত সাড়ে ১৫ বছর এ জাতি জিম্মি দশায় ছিল- জামায়াত আমির ডা.শফিকুর রহমান
বেনাপোলের বিএনপির সহ-সভাপতি দ্বীন ইসলামকে হত্যা, সাবেক তিন পুলিশ কর্মকর্তাসহ ১৬ জনের বিরুদ্ধে মামলা
গ্যাস লাইন সংযোগ সহ ১০ দফা দাবিতে সিলেটের জৈন্তাপুরে সাংবাদিক ও নাগরিক সমাজের সাথে মতবিনিময়
৬ দফার ভিত্তিতে মাসব্যাপী কর্মসূচি জাতীয় নাগরিক কমিটির
সব ভারতীয় টিভি চ্যানেলের সম্প্রচার বন্ধে হাইকোর্টে রিট
উইন্ডিজ শিবিরে নাহিদের জোড়া আঘাত
আন্তবিভাগ ফুটবল প্রতিযোগিতায় চ্যাম্পিয়ন জবির ফিন্যান্স বিভাগ
আগরতলা হাইকমিশনে ভাঙচুরের ঘটনায় ক্ষুব্ধ বাংলাদেশ
বায়তুল মোকাররমের খতিবসহ ১২ আলেমের বিরুদ্ধে সাদপন্থীদের মামলা
নেতাদের ভুল শুধরে নিয়ে জনগণের পাশে থাকার আহবান তারেক রহমানের
‘বাংলাদেশের ভাবমর্যাদা ক্ষুন্ন করতে জাতিসংঘে সেনাবাহিনীর আহবান করেছে মমতা ব্যানার্জি’
‘উগ্রহিন্দুদের আট দাবিতে বাংলাদেশকে অখণ্ড ভারতের অংশ বানানোর পরিকল্পনা চলছে’
ফুটবল মাঠে সংঘর্ষ, ৫৬ জন নিহত
বিগ ব্যাশে খেলবেন না রিশাদ
ভারতে বাংলাদেশ দূতাবাসে হামলা, ঢাবিতে ছাত্র অধিকারের বিক্ষোভ
হিন্দুত্ববাদী ভারত কোনোদিন বাংলাদেশের স্বাধীনতা মেনে নিতে পারেনি: মাহমুদুর রহমান