বসন্ত কালের রোগ-ব্যাধি

Daily Inqilab ইনকিলাব

০৯ মার্চ ২০২৩, ০৮:৫৪ পিএম | আপডেট: ৩০ এপ্রিল ২০২৩, ১০:৫১ পিএম

প্রকৃতিতে এসেছে ঋতুরাজ বসন্ত। এখন গাছে গাছে কচি পাতা। হরেক রকম রঙিন ফুলে সেজেছে ধরণী। তাপমাত্রাও স্বস্তিদায়ক। কিন্তু এ ঋতুতে রোগ-ব্যাধির প্রকোপও একটু বেশি। হাম, জলবসন্ত, ভাইরাস জ্বর, টাইফয়েড, চুলকানিসহ নানা রোগ এ সময় তাড়িয়ে বেড়ায়। জ্বরে বাড়ির একজন আক্রান্ত হলে ছড়িয়ে পড়ে তা অন্য সদস্যদের মধ্যে। এভাবে এক ঘর থেকে রোগ বাসা বদল করে অন্য ঘরে। এ ঋতুতে শীতের আবহাওয়ায় ঘুমন্ত ভাইরাস গরম পড়ার সঙ্গে সঙ্গে বাতাসের মাধ্যমে চারদিকে ছড়িয়ে পড়ে। তাই রোগে আক্রান্ত হওয়ার ঝুঁকি বেড়ে যায়। তাই দরকার কিছু সাধারণ জ্ঞান ও সচেতনতা। প্রথমত একটি বিষয় মাথায় রাখতে হবে যে, ঋতুভেদে যেমন রোগের ধরণে পার্থক্য আছে তেমনি ঋতুভেদে প্রকৃতিতে সব রোগের চিকিৎসা ব্যবস্থাও দেওয়া থাকে। ঋতুভেদে উৎপাদিত হয় আলাদা আলাদা ফল ও সবজি। আর এসব ফল ও সবজিতেই থাকে ওই ঋতুর সব রোগের সমাধান। তাই পর্যাপ্ত পরিমানে মৌসুমী ফল ও সবজি খেলে সহজেই মুক্ত থাকা যায় মৌসুমী রোগগুলো থেকে। বসন্ত একটি ভাইরাসঘটিত রোগ। এই রোগটি প্রধানত শীত ও বসন্তকালের সন্ধিক্ষনে হয়। অর্থাৎ ঋতু পরিবর্তনের সময় এর প্রাদুর্ভাব দেখা দেয়। কিন্তু এখন বসন্ত রোগটি প্রায় সবসময় সব ঋতুতেই এর প্রাদুর্ভাব দেখা যায়। এর আগমনের কোনও সঠিক সময় বা ক্ষন নেই। রোগটির যথাযথ চিকিৎসা না করালে এর ফল মারাত্মক হতে পারে। এই পরিস্থিতিতে বিভিন্ন জীবাণুরা সক্রিয় হয়ে ওঠে। সাধারণ জ্বর, সর্দিকাশি ছাড়াও এ সময়ে হাম ও বসন্তের প্রকোপ দেখা যায়।

বসন্ত রোগের ধরনঃ-
ভাইরাসঘটিত সংক্রামক রোগ। সাধারনত বসন্ত ২ ধরনের হয়। একটি হল জলবসন্ত ও অপরটি হল গুটিবসন্ত । তবে সাধারনত এখন যে বসন্ত রোগে মানুষ আক্রান্ত হয় তা হল জলবসন্ত বা এই দুই প্রকার বসন্তের মধ্যে গুটিবসন্ত ছিল সবচেয়ে মারাত্মক। তবে টীকাকরনের মাধ্যমে গুটি বসন্ত রোগটি পৃথিবী থেকে সম্পূর্ণ রুপে বিলুপ্ত করা হয়েছে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা ১৯৮০ সালে গুটিবসন্ত সারা বিশ্বব্যাপী বিলুপ্তির ঘোষণা করে।

* জলবসন্তঃ-যে ভাইরাসের আক্রমনে এই রোগটি হয় তা হল ভেরিসেলা জোসটার ভাইরাস এই ধরনের বসন্তে শরীরে জ্বরের সাথে তীব্র চুলকানির সাথে সারা গায়ে ফুসকুড়ি বেরোয়। রোগীকে ২/৩ সপ্তাহ ভুগতে হয়। * লক্ষণঃ-প্রথমদিকে রোগীর শরীরে দুর্বল ভাব, মাথাব্যথা, সর্দি-কাশি, জ্বরভাব ইত্যাদি হয়। কিছুদিনের মধ্যেই শরীরে ঘামাচির মতো দানা দেখা দেয়। পরে সেগুলো বড় হয়ে ভেতরে পানি জমতে থাকে। সেইসঙ্গে পাল্লা দিয়ে বাড়ে জ্বর ও শারীরিক দুর্বলতা। শরীরে ব্যথা ও সর্দি-কাশিও হতে পারে। এ রোগের আক্রমণে শরীরে পানিবাহী ছোট গোলাকার দানার সৃষ্টি হয় বলেই এর নাম জল বসন্ত।

বাতাসের মাধ্যমেই ভাইরাসটি বেশি ছড়ায়। জন্মের পর থেকে ১৪ বছর বয়স পর্যন্ত জল বসন্তের ঝুঁকি সবচেয়ে বেশি থাকে। বড়দেরও হতে পারে, তবে খুব কম। আর একবার কারও বসন্ত হয়ে গেলে দ্বিতীয়বার সাধারণত হয় না। কারণ একবার আক্রান্ত হলে শরীরে এই ভাইরাসের ‘অ্যান্টিবডি’ তৈরি হয়ে যায়। এভাবে টিকা দেয়া থাকলেও অ্যান্টিবডি তৈরী হয়ে রক্ষা পাওয়া যায়। রোগীর শরীর থেকেই এই ভাইরাস সুস্থদের মধ্যে ছড়ায়। এক্ষেত্রে বসন্তে আক্রান্ত হওয়ার প্রাথমিক অবস্থার চেয়ে সেরে ওঠার সময়টাই বেশি মারাত্বক। কারণ, সেরে ওঠার সময় পানিবাহী দানাগুলো ফেটে গিয়ে ওই স্থানের চামড়া শুকিয়ে যায়। এসময় স্বাভাবিকভাবে কিংবা চুলকানোর কারণে ওই শুকনো চামড়াগুলো ঝরে পড়ে। এই শুকনো চামড়াগুলোই বহন করে ভ্যারিসেলা জস্টার ভাইরাস। বাতাসের মাধ্যম ছাড়াও রোগীকে স্পর্শ করা, রোগীর ব্যবহৃত জামা-কাপড়, বিছানার চাদর ও অন্যান্য ব্যবহার্য জিনিসের সংস্পর্শে আসার মাধ্যমেও এই ভাইরাস ছড়িয়ে পড়তে পারে।

* হাম: হাম একটি অতি মারাত্মক অথচ নিরাময়যোগ্য ব্যাধি। হাম হলে কিছুতেই রোগীকে ঠান্ডা লাগাতে দেওয়া যাবে না। এতে নিউমোনিয়া কিংবা ব্রংকোনিউমোনিয়া দেখা দিতে পারে। হাম হলে শিশুকে প্রোটিন খাওয়া কমানো যাবে না বরং প্রোটিনযুক্ত খাবার বেশি করে দিতে হবে।

* ভাইরাস জ্বর: ভাইরাস জ্বরে সাধারণত সর্দি, কাশির সঙ্গে মাথাব্যথা এবং শরীর ব্যথা দেখা দেয়। এই ঋতুতে কিছু কিছু টাইফয়েড এবং প্যারাটাইফয়েড জ্বরও দেখা দিতে পারে। প্রথম দিকে এ জ্বর এবং টাইফয়েড জ্বরের মধ্যে পার্থক্য বের করা মুশকিল হয়ে পড়ে। জ্বরের ধরণ ও রক্ত পরীক্ষার মাধ্যমে বিষয়টি জানা যায়। ভাইরাস জ্বরে রোগীকে পুরোপুরি বিশ্রামে রাখতে হয়। ভালো এবং সুষম পুষ্টিকর খাবার খেতে দিতে হবে। জ্বর ১০১ ডিগ্রি ফারেনহাইটের ওপর থাকলে রোগীকে ভিজা স্পঞ্জিং দিতে হবে। রোগীকে বেশি করে তরল পানীয় খেতে দিতে হবে। এ অবস্থায় প্যারাসিটামল জাতীয় ওষুধে ১ থেকে ৪ দিনের মধ্যেই জ্বরের প্রকোপ কমতে থাকে, যা ৫ থেকে ৭ দিনের মধ্যে ভাল হয়ে যায়। এই নিয়মে জ্বর না কমলে চিকিৎসকের পরামর্শ নিতে হবে।

* অ্যালার্জি ও শ্বাসজনিত রোগ: এই ঋতুতে ফুলের সমারোহ থাকায় প্রকৃতিতে অ্যালার্জেনের মাত্রা খুব বেশি থাকে। গাছগাছালি থেকে ফুলের পরাগ রেণু বাতাসে ভেসে বেড়ায়। সেই সাথে বাড়ে ধুলিবালি। এজন্য এই সময় অ্যালার্জিক রাইনাইটিস, হে ফিভার এবং হাঁপানি রোগের আধিক্য দেখা যায়। গ্রাম বাংলায় এই ঋতুতে অ্যালার্জিক এলভিওলাইটিস দেখা দেয়। এটা হাঁপানির মতো এক ধরনের শ্বাসকষ্টজনিত রোগ। এক জাতীয় ছত্রাক দ্বারা এ রোগ হয় এবং খড়কুটো, গরুর ভুষি ব্যবহারের সময় নিঃশ্বাসের সঙ্গে ফুসফুসে ঢুকে এ ব্যাধির জন্ম দেয়। এ থেকে মুক্ত থাকতে নাকে-মুখে মাস্ক কিংবা রুমাল ব্যবহার করতে হবে। পরিস্থিতি বেশি খারাপ হলে ডাক্তারের শরণাপন্ন হতে হবে।

বসন্ত রোগ নিয়ে কিছু পরামর্শঃ-
রোগ মারাত্বক হলেও, ভয় পাওয়ার কোনো কারণ নেই। রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা ভাল থাকলে কোনোরকম ওষুধ ছাড়াই সাত থেকে ১০ দিনের মধ্যেই ভালো হয়ে যায় জল বসন্ত। রোগটা শিশুদেরই বেশি হয়। ছোঁয়াচে রোগ বলে আক্রান্ত শিশুকে সুস্থ ব্যক্তিদের কাছ থেকে একেবারেই আলাদা করে রাখতে হবে এমন কোনো কথা নেই। কারণ সবার থেকে আলাদা করে রাখলে শিশু মানসিকভাবে ভেঙে পড়ার সম্ভাবনা থাকে। তবে সুস্থ শিশুদের থেকে দূরে রাখা জরুরি। বিশেষ করে শেষ দুতিন দিন, যখন রোগি সেরে উঠছে।

এসময় রোগীর পরিষ্কার পরিচ্ছন্নতার দিকে বিশেষ নজর দেওয়াটা জরুরি। তার ব্যবহার্য জিনিষপত্র আলাদা রাখা এবং নিয়মিত পরিষ্কার রাখা উচিত। রোগীকে নিয়মিত গোসল করাতে হবে। তবে গোসলের পর গা মোছার ক্ষেত্রে সাবধান হতে হবে যাতে দানাগুলো ফেটে না যায়। সময়ের আগেই দানাগুলো ফেটে গেলে ওই স্থানে ঘা হয়ে যেতে পারে। এছাড়াও ভাইরাসযুক্ত পানি শরীরের অন্যন্য স্থানে লেগে যাওয়ায় পানিবাহি দানা বেড়ে যেতে পারে। দানগুলো শুকিয়ে যাওয়ার সময় চুলকানি হয়। তবে কষ্ট হলেও চুলকানো থেকে বিরত থাকার চেষ্টা করা উচিত। চুলকানি কমানোর জন্য হালকা গরম পানি দিয়ে গোসল করা যেতে পারে।

মুহাম্মাদ মাহতাব হোসাইন মাজেদ
প্রতিষ্ঠাতা চেয়ারম্যান, জাতীয় রোগী কল্যাণ সোসাইটি
মোবাইল নং: ০১৮২২৮৬৯৩৮৯
ইমেইল:[email protected]


বিভাগ : স্বাস্থ্য


মন্তব্য করুন

HTML Comment Box is loading comments...

এই বিভাগের আরও

হেপাটোলজি সোসাইটির নতুন সভাপতি অধ্যাপক শাহিনুল আলম
এসএমসির পথচলার ৫০ বছর পূর্তি
স্বাস্থ্য শিক্ষার মানোন্নয়নে শিক্ষক নিয়োগের উদ্যোগকে সাধুবাদ জানিয়েছে বিসিএস (স্বাস্থ্য) বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক ফোরাম
হঠাৎ ঘাড় বেঁকে যাওয়া
স্মৃতি শক্তি বাড়িয়ে নিন
আরও

আরও পড়ুন

জ্বালানি ট্যাঙ্কার বিস্ফোরণে নাইজেরিয়ায় নিহত ১৮

জ্বালানি ট্যাঙ্কার বিস্ফোরণে নাইজেরিয়ায় নিহত ১৮

আবু তাহের মিয়ার মৃত্যুতে শোক ও দোয়া মাহফিল

আবু তাহের মিয়ার মৃত্যুতে শোক ও দোয়া মাহফিল

চীন জুলাই-আগস্টে আহতদের চিকিৎসা সরঞ্জাম দেবে

চীন জুলাই-আগস্টে আহতদের চিকিৎসা সরঞ্জাম দেবে

সনাতন ধর্মই ভারতের জাতীয় ধর্ম : যোগী আদিত্যনাথ

সনাতন ধর্মই ভারতের জাতীয় ধর্ম : যোগী আদিত্যনাথ

হাজার হাজার ফিলিস্তিনি গাজার চেকপয়েন্টে অপেক্ষমাণ: জাতিসংঘ

হাজার হাজার ফিলিস্তিনি গাজার চেকপয়েন্টে অপেক্ষমাণ: জাতিসংঘ

মধ্যরাতে তোপের মুখে হাসনাত আবদুল্লাহ

মধ্যরাতে তোপের মুখে হাসনাত আবদুল্লাহ

মধ্যরাত থেকে সারা দেশে বন্ধ হতে পারে ট্রেন চলাচল

মধ্যরাত থেকে সারা দেশে বন্ধ হতে পারে ট্রেন চলাচল

দূষণের শীর্ষে ঢাকার বাতাস আজ ‘দুর্যোগপূর্ণ’, দ্বিতীয় স্থানে লাহোর

দূষণের শীর্ষে ঢাকার বাতাস আজ ‘দুর্যোগপূর্ণ’, দ্বিতীয় স্থানে লাহোর

সংঘর্ষের পর এবার ঢাকা অবরোধের ঘোষণা ৭ কলেজের শিক্ষার্থীদের

সংঘর্ষের পর এবার ঢাকা অবরোধের ঘোষণা ৭ কলেজের শিক্ষার্থীদের

গাজার উত্তরে ফেরার অনুমতি দিল ইসরায়েল, লেবাননে যুদ্ধবিরতি বাড়ল ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত

গাজার উত্তরে ফেরার অনুমতি দিল ইসরায়েল, লেবাননে যুদ্ধবিরতি বাড়ল ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত

শিক্ষার্থীদের দু’পক্ষের সংঘর্ষের ঘটনায় যা বললেন ঢাবি উপাচার্য

শিক্ষার্থীদের দু’পক্ষের সংঘর্ষের ঘটনায় যা বললেন ঢাবি উপাচার্য

ছাদের কার্নিশে ঝুলে থাকা তরুণকে গুলি করা সেই এসআই গ্রেফতার

ছাদের কার্নিশে ঝুলে থাকা তরুণকে গুলি করা সেই এসআই গ্রেফতার

গাজায় ইসরাইলি হামলায় নিহতের সংখ্যা ছাড়াল ৪৭ হাজার ৩০০

গাজায় ইসরাইলি হামলায় নিহতের সংখ্যা ছাড়াল ৪৭ হাজার ৩০০

মঞ্চে আসছে সুফিবাদী নাটক 'পাখিদের বিধানসভা; কেমন চলছে পাখিদের শেষ সময়ের প্রস্তুতি?

মঞ্চে আসছে সুফিবাদী নাটক 'পাখিদের বিধানসভা; কেমন চলছে পাখিদের শেষ সময়ের প্রস্তুতি?

ভ্যালেন্সিয়াকে গোলবন্যায় ভাসালো বার্সা

ভ্যালেন্সিয়াকে গোলবন্যায় ভাসালো বার্সা

বিবর্ণতা কাটিয়ে ইউনাইটেডের স্বস্তির জয়

বিবর্ণতা কাটিয়ে ইউনাইটেডের স্বস্তির জয়

সাবেক প্রতিমন্ত্রী ডা. এনামুর রহমান গ্রেফতার

সাবেক প্রতিমন্ত্রী ডা. এনামুর রহমান গ্রেফতার

রোনালদোর গোলে আল নাসেরের সহজ জয়

রোনালদোর গোলে আল নাসেরের সহজ জয়

মৌলভীবাজার সীমান্তে বাংলাদেশীকে কুপিয়ে হত্যা করল ভারতীয়রা

মৌলভীবাজার সীমান্তে বাংলাদেশীকে কুপিয়ে হত্যা করল ভারতীয়রা

আজ চরমোনাই পীরের সঙ্গে বৈঠক করবেন মির্জা ফখরুল

আজ চরমোনাই পীরের সঙ্গে বৈঠক করবেন মির্জা ফখরুল