ঢাকা   বৃহস্পতিবার, ১৯ সেপ্টেম্বর ২০২৪ | ৪ আশ্বিন ১৪৩১

মধু মাসে আম খান

Daily Inqilab ইনকিলাব

০৮ জুন ২০২৩, ০৮:২৭ পিএম | আপডেট: ০৯ জুন ২০২৩, ১২:০২ এএম

চলছে মধু মাস জ্যৈষ্ঠ। মধু মাসের ফল আমের ঘ্রাণ এখন সর্বত্র। রসাল ফল আম পুষ্টিগুণেও ষোলো আনা। মধু মাসে বিভিন্ন ফলের মধ্যে সবচেয়ে সুস্বাদু এবং লোভনীয় ফল আম। আম পছন্দ করে না এমন ব্যক্তি পাওয়া খুব মুশকিল। ভিটামিন এ, ভিটামিন সি, ভিটামিন কে, পটাশিয়াম, বিটা ক্যরোটিন, ম্যাগনেসিয়ামের মতো উপকারী উপাদানে ঠাসা এই ফল। তাই নানা শারীরবৃত্তীয় ক্রিয়ায় এর ভূমিকা গুরুত্বপূর্ণ। বেশ গরম থাকায় এই সময়টাতে ঘরের বাইরে বেশীক্ষণ থাকা প্রায় অসম্ভব। তবুও বেরোতে হবে, তাই এভাবেও বলা যায় যে, বাঙালির আনন্দ ফলে, গরমে নয়। তাই ফলের মাস জ্যৈষ্ঠ, রসের মাস জ্যৈষ্ঠ, মধু মাস জ্যৈষ্ঠ। আসুন জেনে নেওয়া যাক, আমের উপকারিতা, যে কারণে মধু মাস জ্যৈষ্ঠের মধুফল আম খাবেন।
বাংলাদেশ ঋতু-বৈচিত্রের দেশ। আবহমান কাল থেকে এদেশে ঋতু-বৈচিত্র বর্তমান ছিল, ছয়টি ঋতুর বৈশিষ্ট্য আলাদা আলাদাভাবে এই দেশে উপলব্ধ হয়; গ্রীষ্ম-বর্ষা-শরৎ-হেমন্ত-শীত-বসন্ত -এই ছয় ঋতুর কারণে দেশটিকে ষড়ঋতুর দেশ বলা হয়। মধু মাস মানে জ্যৈষ্ঠ-যখন আমের আগমন ঘটে। আম এক প্রকারের সুস্বাদু ফল। আমাদের আম কাঁচা অবস্থায় রং সবুজ এবং পাকা অবস্থায় হলুদ রং হয়ে থাকে। পৃথিবীতে প্রায় ৩৫ প্রজাতির আম আছে। আমের বিভিন্ন জাত আছে যেমন হিমসাগর, হাড়িভাঙ্গা, ফজলি, ল্যাংড়া, গোপালভোগ, খিরসা, আম্রপালি ইত্যাদি। আম গাছ এখন বাংলাদেশের জাতীয় বৃক্ষ যদিও আম জাতীয় ফল না। ২০১০ সালের ১৫ নভেম্বর আম গাছকে জাতীয় বৃক্ষ হিসেবে ঘোষণা করা হয়।

আমে প্রচুর ভিটামিন ‘এ’ বা ক্যারোটিন, ভিটামিন ‘সি, খনিজ ও ক্যালোরি রয়েছে । ভিটামিন ‘এ’ এর দিক থেকে আমের স্থান পৃথিবীর প্রায় সব ফলেরই উপরে । ইউএসডিএ পুষ্টি ডেটাবেস অনুসারে প্রতি ১০০ গ্রাম (৩.৫ আউন্স) আমে ৬০ কিলোকালরি শক্তি পাওয়া যায়। শর্করা (১৫ গ্রাম), স্নেহ পদার্থ (০.৩৮ গ্রাম), প্রোটিন ০.৮২ গ্রাম) এবং বিভিন্ন প্রকারের ভিটামিনের সাথে থাকে বিভিন্ন ধাতু।

> আমের উপকারিতা
এখন প্রশ্ন হল, আম কেন খাবেন? কারণ, এটি একটি পুষ্টিগুণ সম্পন্ন ফল যা আমাদের শরীরের বিভিন্ন অস্বাভাবিকতার বিরুদ্ধে কাজ করে, আমের উপকারিতা ব্যাপক । যেমন-

কর্মশক্তি বৃদ্ধি: আমে রয়েছে প্রচুর কার্বোহাইড্রেট, যা কর্মশক্তি বাড়াতে সাহায্য করে। তবে ডায়াবেটিস রোগীদের জন্য পরিমিত পরিমাণ আম শরীরে শর্করার মাত্রা ঠিক রাখে। যাদের ডায়াবেটিস আছে তারা যদি ৫-৬টি আম পাতা ধুয়ে একটি পাত্রে সেদ্ধ করে নিয়ে সারারাত রেখে সকালে এর ক্বাথ ছেকে নিয়ে পান করে তাহলে এটা ইন্সুলিনের মাত্রা নিয়ন্ত্রণে সাহায্য করে। এছাড়া, এই ফলে রয়েছে উচ্চ মাত্রার গ্লুটামাইন এসিড নামক প্রোটিন যা মনোযোগ ও স্মৃতিশক্তি বাড়াতে বেশ গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে।

চোখের যতেœ: আমে রয়েছে প্রচুর ক্যারোটিন যা চোখ সুস্থ রাখে, সর্দি-কাশিও দূর করে। শুধুমাত্র এক কাপ পাকা আম খেয়ে সারাদিনের ভিটামিন এর চাহিদার ২৫% পূরণ করা সম্ভব। এটা দৃষ্টিশক্তিকে উন্নত করতে সাহায্য করে, চোখের শুষ্কতা ও রাতকানা রোগ প্রতিরোধ করতেও সাহায্য করে।

হজমে সহায়ক : আম একটি প্রিবায়োটিক ফল, যা আমাদের পাকস্থলীর বিভিন্ন গাট ব্যাক্টেরিয়ার জন্য উপকারী। ৩/৪ কাপ আমে থাকে ডায়েটারি ফাইবারের প্রায় ৭%। যা হজম ক্রিয়া স্বাভাবিক রাখতে সাহায্য করে।
ঘুমে সহায়ক : আমে আছে ট্রিপটোফ্যান, মেলাটোনিন, ও ম্যাগনেসিয়াম যা আমাদের ঘুমকে ত্বরান্বিত করে। অনিদ্রা দূর করে।
ওজন কমায় আম : আমে আছে বিভিন্ন রকম ভিটামিন ও পুষ্টি উপাদান। তাই একটি আম খেলেই সারা দিনের ভিটামিনের চাহিদা মিটে যায়। আবার এতে থাকা ফাইবার হজমে সহায়তা করে। তাই ওজন কমাতে আম খেতে পারেন।
হিট স্ট্রোক ঠেকাবে : এই গরমে হিট স্ট্রোক সাধারণ ঘটনা। আম আমাদের ভেতরটা শীতল রাখে ও শরীরকে অতিরিক্ত গরম হয়ে যাওয়া থেকে বাঁচায়।
হাড় গঠনে : আমে রয়েছে ক্যালসিয়াম, যা হাড় গঠনে সাহায্য করে। সুতরাং প্রতিটি মানুষের আম খাওয়া প্রয়োজন। তাহলে হাড় ও দাঁত সুস্থ থাকবে।
কোষ্ঠকাঠিন্য দূরীকরণ এবং হজমে সাহায্য করে : আম প্রচুর খাদ্য আঁশ, ভিটামিন ও খনিজে ভরপুর। আম উচ্চ আঁশযুক্ত হওয়ায় তা স্বাস্থ্যের জন্য খুবই উপকারী। এটা হজমের জন্য ভালো এবং কোষ্ঠকাঠিন্য প্রতিরোধে খুবই কার্যকর। তাই যাদের হজমের সমস্যা আছে, তারা আম খেলে অনেক উপকার পাবেন।

কোলেস্টেরলের মাত্রা কমায়, হৃদযন্ত্রের সুরক্ষা দেয়: আমে থাকা উচ্চমাত্রার ভিটামিন ‘সি’, পেকটিন ও আঁশ কোলেস্টেরলের ক্ষতিকর মাত্রা কমাতে সাহায্য করে। আম পটাশিয়ামের খুব ভালো উৎস যা উচ্চ রক্তচাপ ও হৃৎস্পন্দন নিয়ন্ত্রণে সাহায্য করে। ঘামের কারণে শরীর থেকে সোডিয়াম বের হয়ে যায়। আর, কাঁচাআম শরীরের সেই সোডিয়ামের ঘাটতি পূরণ করতে পারে। কাঁচাআমের পেকটিন গ্যাস্ট্রোইন টেস্টাইনাল রোগের চিকিৎসায়ও অত্যন্ত উপকারী। আমে উচ্চ আঁশ ও এন্টিঅক্সিডেন্ট থাকায় তা হৃদরোগের সম্ভাবনাকে কমায় এবং এর বিদ্যমান পটাশিয়াম রক্তস্বল্পতা দূর করে ও হৃদযন্ত্র সচল রাখতে সাহায্য করে।

ক্যান্সার প্রতিরোধ : আম ক্যান্সার প্রতিরোধে গুরুত্বপূর্ণ অবদান পালন করে। গবেষকরা বলেছেন যে, আমে এন্টিঅক্সিডেন্ট ও উচ্চ পরিমাণ খাদ্য আঁশ থাকার কারণে এটা কোলন ক্যান্সার, স্তন ক্যান্সার, রক্তস্বল্পতা, লিউকেমিয়া ও প্রোস্টেট ক্যান্সার প্রতিরোধে সাহায্য করে থাকে। এছাড়াও ক্যারোটিন, আইসো-কেরোটিন, এস্ট্রাগ্যালিন, ফিসেটিন, গ্যালিক এসিড ইত্যাদি এনজাইম ক্যান্সার প্রতিরোধ করতে যথেষ্ট ভূমিকা রাখে।

তারুণ্য ধরে রাখতে : আমে থাকা ভিটামিন ‘সি’ কোলাজেনের উৎপাদনে সাহায্য করে যার ফলে ত্বক সতেজ ও টানটান হয়। এতে রয়েছে প্রচুর পরিমাণে ভিটামিন ‘ই’ যা ত্বক ও চুলের জন্য অত্যন্ত প্রয়োজনীয় উপাদান। এছাড়া, ভিটামিন ‘ই’ থাকাতে এটা সেক্স হরমোনকেও নিয়ন্ত্রণ করতে সাহায্য করে।
মর্নিং সিকনেস দূরীকরণ: কাঁচা আম গর্ভাবস্থার উপসর্গের তীব্রতা কমাতে এবং ঘন ঘন মর্নিং সিকনেস হওয়ার প্রবণতা কমাতে সাহায্য করে । নিয়মিত কাঁচা আম খেলে মর্নিং সিকনেস পুরোপুরি দূর হয়।

স্কার্ভি রোগ প্রতিরোধে : আম থেকে ভিটামিন সি পাওয়া যায় যা স্কার্ভি রোগ প্রতিরোধ করতে সাহায্য করে। দাঁত, মাড়ি, ত্বক ও হাড়ের সুস্থতা রক্ষা করতেও সাহায্য করে ভিটামিন ‘সি’। এছাড়া, আমে ভিটামিন ‘এ’ এবং বিভিন্ন ধরনের প্রায় ২৫টি ক্যারোটিনয়েড থাকে যা রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বৃদ্ধিতে খুবই কার্যকর ভূমিকা পালন করে।

আমের এত গুণ!!! তবে সাবধান! আজকাল বাজারের টসটসে আমের প্রায় সবই কার্বাইড নামক বিষ প্রয়োগ করে পাকানো হচ্ছে। কারণ, আম অত্যন্ত পচনশীল একটি ফল। ফরমালিনসহ বিভিন্ন ধরনের রাসায়নিক মিশিয়ে ব্যবসায়ীরা এ ফল ৬ থেকে ৭ মাস পর্যন্ত রেখে দিতে পারে। তাই বলে আম খাব না তা কী করে হয়! আর এ জন্য এ মাসকেই বেছে নিন যখন কার্বাইড, ফরমালিনের প্রয়োজনীয়তা নেই বললেই চলে।

আম খাওয়ার ক্ষেত্রে কিছু সতর্কতা ঃ
* আম ভালো করে ধুয়ে পরিষ্কার করে, পরিষ্কার পাত্রে নিয়ে খেতে হবে।
* আম খাওয়ার সময় এর সঙ্গে অতিরক্ত লবণ ও মরিচ মেশানো যাবে না। এতে পুষ্টিগুণ নষ্ট হবে।
* আম খাওয়ার পরপরই পানি বেশী খাওয়া যাবে না।
* মাত্রাতিরিক্ত আম খেলে হজমে সমস্যা দেখা দিতে পারে।
পরিশেষে বলতে চাই, আম যেমন শরীরের উপকার করে তেমনি অতিরিক্ত মাত্রায় খেলে তা শরীরের উপর ক্ষতিকর প্রভাবও ফেলে। পাকা আমে চিনির পরিমাণ বেশি থাকে। ফলে যাদের ডায়াবেটিসের সমস্যা রয়েছে, তাঁরা চিকিৎসকের পরামর্শ ছাড়া একেবারেই দূরে থাকুন আম থেকে। কেননা রক্তে গ্লুকোজের পরিমাণ বাড়িয়ে দিতে পারে আম। আর যারা অ্যাজমাতে ভুগছেন তাঁরা প্রয়োজনে আম কম খান। কিডনির সমস্যা যাদের রয়েছে তাঁদেরও বেশি আম খাওয়া উচিত নয়। পাকা আম অতিরিক্ত খেলে ওজন বেড়ে যাবে। তাই সব কিছুই সীমিত পরিমাণে খাওয়া ভালো।

মুহাম্মাদ মাহতাব হোসাইন মাজেদ
কলাম লেখক ও গবেষক
প্রতিষ্ঠাতা চেয়ারম্যান, জাতীয় রোগী কল্যাণ সোসাইটি
ইমেইল: [email protected]


বিভাগ : স্বাস্থ্য


মন্তব্য করুন

HTML Comment Box is loading comments...

আরও পড়ুন

ইত্তিহাদেই সিটিকে রুখে দিল ইন্টার

ইত্তিহাদেই সিটিকে রুখে দিল ইন্টার

রোনালদোদের নতুন কোচ পিওলি

রোনালদোদের নতুন কোচ পিওলি

দক্ষিণ আফ্রিকাকে গুড়িয়ে আফগানদের ঐতিহাসিক জয়

দক্ষিণ আফ্রিকাকে গুড়িয়ে আফগানদের ঐতিহাসিক জয়

যেই গৌরব কেবল শারজাহ ক্রিকেট স্টেডিয়ামের

যেই গৌরব কেবল শারজাহ ক্রিকেট স্টেডিয়ামের

রিট করে ‘খেলাপি ঋণ স্থগিত’ বন্ধ চান ব্যাংক-মালিকরা

রিট করে ‘খেলাপি ঋণ স্থগিত’ বন্ধ চান ব্যাংক-মালিকরা

বিদেশি ঋণ ফের ১০০ বিলিয়ন ডলার ছাড়িয়েছে

বিদেশি ঋণ ফের ১০০ বিলিয়ন ডলার ছাড়িয়েছে

টাকা উদ্ধারের নামে ‘ঘুষ’ চাওয়ার অভিযোগ জিএম শাহজাহান চৌধুরীর’র বিরুদ্ধে

টাকা উদ্ধারের নামে ‘ঘুষ’ চাওয়ার অভিযোগ জিএম শাহজাহান চৌধুরীর’র বিরুদ্ধে

জাতীয় ঐক্য বিনষ্টকারী কর্মকান্ড থেকে বিরত থাকতে হবে

জাতীয় ঐক্য বিনষ্টকারী কর্মকান্ড থেকে বিরত থাকতে হবে

৬০ হাজার টন ইউরিয়া সার কিনবে সরকার, ব্যয় ২৩৬ কোটি টাকা

৬০ হাজার টন ইউরিয়া সার কিনবে সরকার, ব্যয় ২৩৬ কোটি টাকা

আইকনিক লিডার তারেক রহমান ও বাংলাদেশের রাজনীতি

আইকনিক লিডার তারেক রহমান ও বাংলাদেশের রাজনীতি

পতিত স্বৈরাচার ও ভারতের চক্রান্ত চলছেই

পতিত স্বৈরাচার ও ভারতের চক্রান্ত চলছেই

তারেক রহমানের রাষ্ট্রনায়কোচিত বক্তব্য ও দিকনির্দেশনা

তারেক রহমানের রাষ্ট্রনায়কোচিত বক্তব্য ও দিকনির্দেশনা

ইসরাইলের দখলদারিত্ব বন্ধের প্রস্তাব বিবেচনা জাতিসংঘের

ইসরাইলের দখলদারিত্ব বন্ধের প্রস্তাব বিবেচনা জাতিসংঘের

উত্তপ্ত মণিপুরে অত্যাধুনিক অস্ত্র দিয়ে নতুন করে গোলাগুলি

উত্তপ্ত মণিপুরে অত্যাধুনিক অস্ত্র দিয়ে নতুন করে গোলাগুলি

২৭ দেশে ছড়িয়ে পড়েছে করোনার নতুন ভ্যারিয়্যান্ট

২৭ দেশে ছড়িয়ে পড়েছে করোনার নতুন ভ্যারিয়্যান্ট

২০০ হাতি নিধনের সিদ্ধান্ত জিম্বাবুয়ের

২০০ হাতি নিধনের সিদ্ধান্ত জিম্বাবুয়ের

কলেরাসহ মারাত্মক রোগের ঝুঁকিতে সুদানের ৩৪ লাখ শিশু

কলেরাসহ মারাত্মক রোগের ঝুঁকিতে সুদানের ৩৪ লাখ শিশু

১১ হাজার ফিলিস্তিনি শিক্ষার্থীর প্রাণ গেছে

১১ হাজার ফিলিস্তিনি শিক্ষার্থীর প্রাণ গেছে

বেলারুশে হামলা হলে তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধ শুরু হবে : লুকাশেঙ্কো

বেলারুশে হামলা হলে তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধ শুরু হবে : লুকাশেঙ্কো

তাইওয়ান প্রণালীতে চীনের যুদ্ধবিমান

তাইওয়ান প্রণালীতে চীনের যুদ্ধবিমান