শীতে শিশুর হাঁপানি

Daily Inqilab ইনকিলাব

০২ জানুয়ারি ২০২৫, ০১:৫৪ এএম | আপডেট: ০২ জানুয়ারি ২০২৫, ০১:৫৪ এএম

হাঁপানি বা অ্যাজমা একটি অতি পরিচিত রোগ, যা ফুসফুসের বায়ুনালীর মধ্যে বায়ু চলাচলে বাধা সৃষ্টি করে। আমরা যখন নিঃশ্বাস নেই তখন বাতাস শ্বাসনালীর বিভিন্ন শাখা প্রশাখা দিয়ে ফুসফুসে প্রবেশ করে আবার বেরিয়ে আসে। হাঁপানি রোগীর ক্ষেত্রে বাতাস চলাচলের এই পথগুলো বিভিন্ন কারণে সংবেদনশীল হয়ে সরু হয়ে পড়ে ফেলে নিঃশ্বাস নিতে কষ্ট হয়। এখন শীতের মৌসুম তাই হাঁপানি আক্রান্ত শিশুরা বেশি সংকটের সম্মুখীন। আমাদের দেশে হাঁপানি চিকিৎসায় এখনও অনেক কুসংস্কার রয়েছে বিশেষ করে গ্রামাঞ্চলে কিছু অসাধু প্রতারক ব্যক্তি হাঁপানিকে তাবিজ, মাদুলী দিয়ে গ্যারান্টি সহকারে চিকিৎসা দেয়ার আশ্বাস দিয়ে থাকে। ফলে অশিক্ষিত, সহজ-সরল মানুষ সুচিকিৎসার আলো দেখতে পায় না বরং অবৈজ্ঞানিক চিকিৎসায় মৃত্যুর দিকে এগিয়ে যায়।

হাঁপানিতে শ্বাসনালী সরু হয়ে যায় প্রধানত তিনটি কারণেÑ

১। বিভিন্ন রোগ জীবাণুর সংক্রমণে শ্বাসনালীর ভিতরের স্তরে প্রদাহ বা ইনফ্লামেশন হয়ে ফুলে ওঠে। ২। শ্বাসনালীর চারপাশের মাংসপেশী সংকোচিত হয় ফলে বাতাস চলার পথ সরু হয়ে যায় একে বলা হয় ব্রংকোকনস্ট্রিকশন। ৩। উত্তেজক পদার্থের প্রভাবে শ্বাসনালীর গ্রন্থি থেকে প্রচুর পরিমাণে মিউকাস জাতীয় আঠালো কফ নিঃসৃত হয়ে শ্বাসনালীতে জমা হয় ফলে বাতাস চলাচলের পথকে আটকে দেয় যার ফলে অল্প বাতাস সরু শ্বাসনালী দিয়ে প্রবাহের সময় শ্বাসের সাথে সাঁই সাঁই আওয়াজ হয়।

অনেক কিছুতেই হাঁপানির আক্রমণ শুরু হতে পারে যেমন-বাড়ি ঘরের ধুলো-ময়লায় থাকা মাইট, উগ্র গন্ধ বা স্প্রে, সিগারেট বা অন্যান্য ধোঁয়া, পরাগ বা ফুলের রেনু, পশুপাখির পালক, লোমস খেলনা, ছত্রাকের স্পোর, আবহাওয়ার পরিবর্তন, ঠা-া লাগা, বিশেষ বিশেষ কিছু খাদ্য, কিছু কিছু ওষুধ যেমন-এস্পিরিন, পেনিসিলিন ইত্যাদি, শিল্প কারখানায় ব্যবহৃত কোন কোন রাসায়নিক পদার্থ, শারীরিক পরিশ্রম বা ব্যায়াম ইত্যাদি। আজকাল দূষিত বাতাস গ্রহণের জন্য শিশুদের মধ্যে হাঁপানির প্রকোপ দিন দিন বেড়েই চলেছে, শিশুরাই এখন হাঁপানিতে বেশি ঝুঁকিপূর্ণ। সবচেয়ে বেশি শ্বাস কষ্ট দেখা যায় এলার্জিক কারণে। এ অ্যাজমা সাধারণত শিশুকাল থেকেই শুরু হয় এবং রক্ত সম্পর্কের আত্মীয় থেকে বা বংশানুক্রমে চলতে থাকে। পিতৃকূলের চেয়ে মাতৃকুল থেকে হাঁপানিতে আক্রান্ত হওয়ার আশঙ্কা প্রায় তিনগুন বেশি থাকে।

কতগুলো লক্ষণ বা উপসর্গ দেখে অ্যাজমা আক্রান্ত শিশু চিহ্নিত করা যায় যেমনÑবুকে আঁটসাঁট, দম খাটো অর্থাৎ ফুসফুস ভরে দম নিতে না পারা, শ্বাস নিতে ও ছাড়তে কষ্ট অনুভব করা, বুকের ভিতর বাঁশির মতো সাঁই শব্দ হওয়া। ঘন ঘন শুষ্ক কাশি, গলার নীচের অংশ এবং দুই পাঁজরের নিচের ও মধ্যবর্তী অংশ শ্বাস নেয়ার সময় ভিতরে ঢুকে যাওয়া, চিৎ হয়ে শুয়ে থাকতে না পারা এবং ঘুম থেকে উঠে বসে থাকা, সর্দি লাগার পর শ্বাসকষ্ট অনুভব করা। এসব উপসর্গ সাধারণত রাতে বৃদ্ধি পায়।

হাঁপানির চিকিৎসায় নানারকম ঔষধ রয়েছে। তবে নেবুলাইজার বা ইনহেলারের মাধ্যমে ব্যবহার করলে সুফল পাওয়া যায়। সাধারণত দুই ধরনের ওষুধ ব্যবহার করা হয়- দ্রুত আরামদায়ক ওষুধ বা ব্রংকোডাইলেটর যা শ্বাসনালীর সংকোচন রোধ করে দ্রুত শ্বাসকষ্ট লাঘব করে যেমন-সালবিউটামল, সালমেটেরল, টারবিউটালিন, থিওফাইলিন ইত্যাদি। মিউকাস সিক্রেশন কমানোর জন্য ইপ্রাটপিয়াম ব্যাবহার করা হয়। শ্বাসনালীর প্রদাহ নিরাময়ে প্রতিষেধক বা স্টেরয়েড জাতীয় ওষুধ দেয়া হয়। প্রতিষেধক ওষুধগুলো ধীরে ধীরে কাজ করে এবং শ্বাসনালীর সংকোচন ও প্রদাহ থেকে শ্বাসনালীকে রক্ষা করে। প্রতিষেক ওষধগুলো হাঁপানিকে নিয়ন্ত্রণে রাখতে সাহায্য করে। এগুলি অভ্যাসে দাঁড়িয়ে যায় না, এর পার্শ্বপ্রতিক্রিয়াও কম ফলে বহু বছর ব্যবহার করা যায়। আজকাল আমাদের দেশেও অ্যাজমার অত্যাধুনিক চিকিৎসা রয়েছে। ওষুধের পাশাপাশি সংক্রমন ও অ্যালাজি প্রতিরোধি ভেকসিন দিয়ে রোগীকে দীর্ঘদিন সুস্থ রাখা সম্ভব হয়।

এক একটি বাচ্চা আদালা আলাদা ট্রিগার বা উত্তেজকের প্রতি সংবেদনশীল। বাচ্চার যদি হাঁপানি থাকে, তাহলে বাচ্চার হাঁপানির ট্রিগারগুলো চিনে নিয়ে সেগুলো যথাসম্ভব এড়িয়ে চলা অত্যন্ত জরুরি।

হাঁপানি আক্রান্ত বাচ্চার বাবা-মায়ের ধূমপান করা উচিত নয় কারণ সিগারেটের ধোঁয়াও শিশুর উত্তেজক হিসেবে অ্যাজমার কারণ হতে পারে। বাসার অন্যান্য ধোঁয়া থেকেও বাচ্চাকে দুরে রাখতে হবে। শিশুর হাঁপানির ওপর খাবারের প্রভাব আছে কিনা সেদিকে খেয়াল রাখতে হবে। যদি দেখা যায় বিশেষ কোনো খাবার খেলে বাচ্চার হাঁপানির আক্রমণ হয় তবে ওইসব খাবার শিশুকে খেতে দেয়া যাবে না। হাঁপানি ছোঁয়াচে রোগ নয়। এটি সর্দি-কাশির মতো নয়, একজনের হলে অন্যজনের মধ্যে ছড়াবে না। অ্যাজমা আক্রান্ত মায়ের বুকের দুধ খেলে শিশুর অ্যাজমায় আক্রান্ত হওয়ার আশঙ্কা নেই। তবে এটি বংশগতভাবে হওয়ার সম্ভাবনা থাকে।

ডাক্তারের পরামর্শমত চললে এবং চিকিৎসা করলে হাঁপানিকে নিয়ন্ত্রণে রাখা যায় এবং আনন্দময়, কর্মক্ষম জীবন যাপন করা যেতে পারে। অনেকদিন ধরে নিয়মিত চিকিৎসা করালে বাচ্চার যে সব সুফল পাওয়া যাবে তা হলো হাঁপানির লক্ষণগুলো একেবারে চলে যাবে, বড় জোর দিনের বেলায় সামান্য লক্ষণ দেখা দিতে পারে। কোনো কষ্ট ছাড়াই রাতের বেলা শান্তিতে ঘুমাতে পারবে। কখনও লেখাপড়ার সমস্যা হবে না। শারীরিক কাজকর্মে কোনো ব্যাঘাতও হবে না।

বাচ্চা স্কুলে গেলে তার হাঁপানির সমস্যা শিক্ষককে জানান, বাচ্চার হাঁপানির লক্ষণগুলো নিয়ে শিক্ষকের সাথে আলোচনা করুন। স্কুলে বা ভ্রমণকালে বাচ্চার প্রয়োজনীয় ওষুধপত্র সাথে রাখুন। বাচ্চাকে সবসময় পরিষ্কার থাকতে উৎসাহিত করুন। ওকে ধুলোবালি, জীব-জন্তু, কম্বল, কার্পেট, লোমশ খেলনা দিয়ে খেলতে বারণ করুন, ঝাঝাল গন্ধ যুক্ত আতর, সেন্ট, স্প্রে, রং ওর কাছে দিবেন না। ডাক্তারের পরামর্শ অনুযায়ী বাচ্চাকে সাধারণত ব্যায়াম করতে উৎসাহিত করুন।

ডা. জ্যোৎস্না মাহবুব খান


বিভাগ : স্বাস্থ্য


মন্তব্য করুন

HTML Comment Box is loading comments...

এই বিভাগের আরও

‘এইচএমপিভি’ এশিয়ায় নতুন ভাইরাসের আতঙ্ক
ডায়াবেটিস রোগীদের নিরাপদে রোজা রাখার উপায় জানালো এসিইডিবি
১৪৮ চিকিৎসককে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে বদলি
মাছ খেয়ে সুস্থ থাকুন
স্বাস্থ্য সুরক্ষায় সরষে তেল
আরও

আরও পড়ুন

গফরগাঁওয়ে আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন ডাঃ সাবেক ভিসি এম এ হাদীর স্মরণে আলোচনা সভা

গফরগাঁওয়ে আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন ডাঃ সাবেক ভিসি এম এ হাদীর স্মরণে আলোচনা সভা

মোদির দেয়া মূল্যবান হিরা ব্যবহার করবেন না জিল বাইডেন, কেন?

মোদির দেয়া মূল্যবান হিরা ব্যবহার করবেন না জিল বাইডেন, কেন?

সাদপন্থিদের ইজতেমা করার নৈতিক অধিকার নেই : মামুনুল হক

সাদপন্থিদের ইজতেমা করার নৈতিক অধিকার নেই : মামুনুল হক

বাংলাদেশে নিয়ে আলোচনা! ভারত সফরে আমেরিকার জাতীয় উপদেষ্টা

বাংলাদেশে নিয়ে আলোচনা! ভারত সফরে আমেরিকার জাতীয় উপদেষ্টা

নীলফামারীতে জেলা ছাত্রশিবিরের সভাপতি তাজমুল, সেক্রেটারি রেজাউল

নীলফামারীতে জেলা ছাত্রশিবিরের সভাপতি তাজমুল, সেক্রেটারি রেজাউল

রাজশাহীর পুঠিয়ায় আওয়ামী লীগ নেতাকে বিদ্যুতের পোলের সঙ্গে বেঁধে পিটিয়েছে দুর্বৃত্তরা

রাজশাহীর পুঠিয়ায় আওয়ামী লীগ নেতাকে বিদ্যুতের পোলের সঙ্গে বেঁধে পিটিয়েছে দুর্বৃত্তরা

বগুড়ার নন্দীগ্রামে প্রবাসীর স্ত্রীকে কুপিয়ে হত্যা

বগুড়ার নন্দীগ্রামে প্রবাসীর স্ত্রীকে কুপিয়ে হত্যা

নীলফামারীতে ছাত্রলীগের ২ নেতা গ্রেফতার

নীলফামারীতে ছাত্রলীগের ২ নেতা গ্রেফতার

টাঙ্গাইলে সুলতান সালাউদ্দিন টুকুর পক্ষ থেকে চার শতাধিক শীতার্তদের মাঝে শীতবস্ত্র বিতরণ

টাঙ্গাইলে সুলতান সালাউদ্দিন টুকুর পক্ষ থেকে চার শতাধিক শীতার্তদের মাঝে শীতবস্ত্র বিতরণ

যশোর পৌষের দাপটে কাঁপছে

যশোর পৌষের দাপটে কাঁপছে

যশোরে সফল নারী কৃষি উদ্যোক্তা ফারহানা ইয়াসমিন

যশোরে সফল নারী কৃষি উদ্যোক্তা ফারহানা ইয়াসমিন

নারায়ণগঞ্জের বাবুরাইলে খাঁজা মঈনুদ্দিন চিশতীর বাৎসরিক ওরশ শুরু

নারায়ণগঞ্জের বাবুরাইলে খাঁজা মঈনুদ্দিন চিশতীর বাৎসরিক ওরশ শুরু

আইসিইউতে ভর্তি অভিনেতা মুশফিক আর ফারহান

আইসিইউতে ভর্তি অভিনেতা মুশফিক আর ফারহান

চীনে সবজি বাজারে ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ড, নিহত ৮

চীনে সবজি বাজারে ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ড, নিহত ৮

শেখ হাসিনার কড়া সমালোচনা করে যা বললেন তসলিমা নাসরিন

শেখ হাসিনার কড়া সমালোচনা করে যা বললেন তসলিমা নাসরিন

যশোর বাঘারপাড়ায় দুই হিন্দুবাড়িতে ডাকাতি

যশোর বাঘারপাড়ায় দুই হিন্দুবাড়িতে ডাকাতি

লিভারপুলে এটাই সালাহর শেষ মৌসুম

লিভারপুলে এটাই সালাহর শেষ মৌসুম

দাবি না মানলে বেরোবিতে তালা ঝুলানোর হুমকি শিক্ষার্থীদের

দাবি না মানলে বেরোবিতে তালা ঝুলানোর হুমকি শিক্ষার্থীদের

কালীগঞ্জে শীতার্তদের মধ্যে কম্বল বিতরণ

কালীগঞ্জে শীতার্তদের মধ্যে কম্বল বিতরণ

কাশ্মীরে ট্রাক দূর্ঘটনায় ভারতের ৪ সেনার মৃত্যু

কাশ্মীরে ট্রাক দূর্ঘটনায় ভারতের ৪ সেনার মৃত্যু