চায়নাতে বাংলাদেশি রোগীদের চিকিৎসা: আমার অভিজ্ঞতা ও সুপারিশ

Daily Inqilab মেহেদী হাসান পলাশ

২৮ মার্চ ২০২৫, ০৩:৫১ পিএম | আপডেট: ২৮ মার্চ ২০২৫, ০৩:৫১ পিএম

কুনমিং মিউনিসিপাল হসপিটাল এন্ড চাইনিজ ট্রেডিশনাল মেডিসিনের সামনে লেখক

প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনুস চায়নার প্রেসিডেন্ট সি জিং পিং এর দেয়া বিরল সম্মানে ভূষিত হয়ে চায়না সফরে গিয়েছেন। প্রেসিডেন্ট সি তার জন্য একটি বিশেষ চার্টার্ড বিমান পাঠিয়েছিলেন। বর্তমানে তিনি চীনের রাজধানী বেইজিং অবস্থান করছেন। সেখানে তিনি ব্যস্ত সময় পার করছেন। দুই দেশের মধ্যে একাধিক চুক্তি ও সমঝোতা হয়েছে। তার এই সফর দুই দেশের নানা মাত্রিক সম্পর্ক বিনির্মাণে যুগান্তকারী ভূমিকা রাখবে বলে ধারণা করি। এগুলোর মধ্যে একটি হচ্ছে চায়না বাংলাদেশ স্বাস্থ্য খাতে সম্পর্ক বিনির্মাণের আওতায় বাংলাদেশি রোগীরা যেমন চাইনিজ হসপিটালগুলোতে চিকিৎসা নিতে পারবেন, একই সাথে চাইনিজ হাসপাতাল কোম্পানিগুলো বাংলাদেশে হাসপাতাল নির্মাণ করবেন বলে আলোচনা রয়েছে। এছাড়াও ডাক্তারদের প্রশিক্ষণসহ নানা প্যাকেজ থাকতে পারে এই সমঝোতায়।

 

গত ১৭ থেকে ২১ মার্চ আমি ব্যক্তিগত স্বাস্থ্য পরীক্ষার জন্য চায়নার বাংলাদেশের সবচেয়ে নিকটবর্তী শহর কুনমিং সফর করেছি। কুনমিং এ এটা আমার দ্বিতীয় সফর এবং চায়নাতে তৃতীয়। আমি দীর্ঘদিন ধরে স্পন্ডলাইটিস ও রিউমাটয়েড আর্থারাইটিস রোগে ভুগছি। বাংলাদেশে শ্রদ্ধেয় প্রফেসর আতিকুল হক থেকে শুরু করে আরো অনেক ডাক্তারের চিকিৎসা নিয়েছি এর বাইরে থাইল্যান্ডের বামরুনগ্রাদে চিকিৎসা নিয়েছি। এসব চিকিৎসায় সাময়িক ভালো থাকলেও পুনরায় আক্রান্ত হয়েছি। আমি বিভিন্ন সময়ে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে এই রোগের চিকিৎসায় চাইনিজ ট্রেডিশনাল ট্রিটমেন্টের কথা শুনেছি। আমার চাইনিজ বন্ধুরা আমার এই অসুখের কথা জানতেন। তারা বেশ কয়েক মাস ধরেই আমাকে অনুরোধ করছিলেন চাইনিজ ট্রেডিশনাল মেডিসিনের চিকিৎসা গ্রহণ করতে। এরই অংশ হিসেবে উক্ত সফর সম্পন্ন হয়।

 

এই সফরকালে আমি কুনমিং এ একটি সরকারি হাসপাতালে ডাক্তার দেখাই। তখন থেকেই সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে অসংখ্য মানুষ আমাকে চাইনিজ চিকিৎসা ব্যবস্থা সম্পর্কে লেখার জন্য অনুরোধ করছিলেন, সে কারণে এই লেখা।

 

কুনমিং বাংলাদেশের সবচেয়ে কাছের চাইনিজ প্রদেশ ইউনান এর রাজধানী। আয়তনে শহরটি পুরো বাংলাদেশের সাত ভাগের এক ভাগ। তবে জনসংখ্যা মাত্র ৮৫ লাখ। সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে ৬ হাজার ফুট উচ্চতায় অবস্থিত এই শহরটাকে চির বসন্তের শহর বলা হয়। প্রাকৃতিক সৌন্দর্য এবং উন্নত নাগরিক শহর জীবনের মিসেলে এই শহরটি চায়নার অত্যন্ত আকর্ষণীয় নগরী। বিশ্বের প্রাকৃতিক সপ্তাশ্চর্যের একটি স্টোন ফরেস্টের অবস্থান এই শহরের খুব কাছে। এই শহর ভ্রমণকারীদের অন্যতম আকর্ষণীয় পর্যটন কেন্দ্র এই স্টোন ফরেস্ট।

 

আমার বন্ধুরা আমাকে জানিয়েছেন কুনমিং এ মোট তিনটি হসপিটাল রয়েছে এর মধ্যে দুইটি সরকারি এবং একটি বেসরকারি। জনসংখ্যার বিচারে চায়না পৃথিবীর বৃহত্তম দেশ হলেও তার রক্ষণশীল রাষ্ট্রনীতির কারণে সীমান্তবর্তী বা সীমান্তের দূরবর্তী কোনো দেশের জন্যই তার হসপিটাল গুলোকে ওপেন করেননি। চিকিৎসা ব্যবস্থায় চরম উন্নতি সত্ত্বেও চায়না তার দেশের এই বাজারটি বিদেশীদের জন্য ওপেন করেনি। এই প্রথম দেশ হিসেবে বাংলাদেশকে এবং বাংলাদেশের রোগীদের জন্য চায়না তার দেশের হসপিটালগুলো ওপেন করতে যাচ্ছে। এটি বাংলাদেশের জন্য যেমন একটি বড় পাওয়া, একই সাথে বাংলাদেশের মানুষের প্রতি চাইনিজ সরকারের ভালোবাসার একটি উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত।

 

চায়নায় আমি যে হসপিটালে চিকিৎসা গ্রহণ করেছিলাম তার নাম কুনমিং মিউনিসিপাল হসপিটাল এন্ড চাইনিজ ট্রেডিশনাল মেডিসিন। এটি একটি সরকারি হাসপাতাল এবং বেশ বড় হাসপাতাল। পুরো হাসপাতালের চিকিৎসা ব্যবস্থা সম্পূর্ণ ডিজিটাল পদ্ধতিতে নিয়ন্ত্রিত। অত্যন্ত পরিচ্ছন্ন এবং বাংলাদেশের বিলাসবহুল হসপিটাল গুলোর থেকেও আধুনিক সুবিধা সম্বলিত এই হসপিটাল। এখানকার ডাক্তারগণ অনেক আন্তরিকতার সাথে সময় নিয়ে রোগীদের সাথে কথা বলেন।

 

বাংলাদেশে ভালো মানের ডাক্তার এবং চিকিৎসা ব্যবস্থা থাকলেও চিকিৎসা সেবা একেবারেই নেই । এদেশের ডাক্তারদের কাছে রোগী একজন কাস্টমার মাত্র, যার কাছ থেকে যত বেশি সম্ভব লাভ করাটাই যেন তাদের লক্ষ্য। হাসপাতালগুলো মিনিমাম সেবা দিয়ে ম্যাক্সিমাম লাভ করার জন্য মুখিয়ে থাকে। এ কারণেই বাংলাদেশের রোগীরা বিদেশ অভিমুখী। চাইনিজ সরকার যদি সেদেশের হাসপাতালগুলো বাংলাদেশের রোগীদের জন্য উন্মুক্ত করে এবং চিকিৎসা সহযোগিতার করার জন্য প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করে তাহলে বাংলাদেশী রোগীদের ভারত নির্ভরতা অনেকখানি কমবে। এটা কেবল চিকিৎসার জন্য নয়, বাংলাদেশের সার্বভৌমত্বের জন্যেও একটি কৌশলগত উপাদান হিসেবে কাজ করবে বলে আমার ধারণা। এর পাশাপাশি চাইনিজ জনগণের সাথে বাংলাদেশের মানুষের সম্পর্ক সৌহার্দ্য ও সম্প্রীতি বৃদ্ধি পাবে। ফলে চায়না সম্পর্কে বাংলাদেশের সাধারণ মানুষের ভেতরেও ইতিবাচক ধারণা তৈরি হবে। দুই দেশের মানুষের মধ্যে সাংস্কৃতিক লেনদেন একটি সুদূরপ্রসারী সম্পর্কের ভিত্তি নির্মাণ করবে বলে ধারণা করা যায়। মেডিকেল ট্যুরিজমে বাংলাদেশের রোগীদের জন্য একটি বিকল্প সৃষ্টি হবে।

বাংলাদেশের মানুষের অন্যতম জানার আগ্রহ সেখানকার চিকিৎসা ব্যয় নিয়ে। সেক্ষেত্রে আমার অভিমত, যদি আমরা কলকাতার চিকিৎসা ব্যবস্থার কথা চিন্তা করি তাহলে তার থেকে ব্যয়বহুল। তবে চেন্নাই, মাদ্রাজ, দিল্লি বা ব্যাংককের খরচের তুলনায় এটা সমান। কিন্তু চিকিৎসার মান চেন্নাই বা মাদ্রাজের থেকে অনেক বেশি উন্নত। বেসিকালি, কলকাতার সাথে বিমান ভাড়া ছাড়া অন্য কোন খরচের পার্থক্য নেই। বরং আমার মনে হয়েছে সরকারি হাসপাতালগুলোতে বিভিন্ন পরীক্ষার খরচ তুলনামূলকভাবে কম। কাজেই বাংলাদেশ সরকার যদি এই খাতে চায়নার সাথে একটি সমঝোতা গড়ে তুলতে পারে তাহলে বাংলাদেশের মানুষ চিকিৎসা খাতে একটি উন্নত ব্যবস্থা গ্রহণ করতে সক্ষম হবে।

 

তবে এসবের পাশাপাশি অনেক অসুবিধাও রয়েছে। সেগুলো নিয়ে আমার চাইনিজ বন্ধুদের সাথে বিস্তারিত আলোচনা করেছি। তারা আশ্বাস দিয়েছেন এগুলো উত্তরণের জন্য তারা কাজ করবেন। আমার নিজের অভিজ্ঞতায় সবচেয়ে বেশি অসুবিধা মনে হয়েছে, ভাষাগত সমস্যা। চায়নাতে ভাষাগত সমস্যা একটি প্রবল সমস্যা। সেখানকার মানুষ নিজস্ব ভাষা ও সংস্কৃতিকে খুব বেশি প্রাধান্য দেয়ায় ইংরেজি ভাষা বলতে গেলে খুব কম জানে। এবং এবারে আমি অবাক হয়েছি এটা দেখে যে, সেখানকার ডাক্তারগন ইংরেজি ভাষায় পারদর্শী নন। ফলে বাংলাদেশের রোগীদের সাথে কমিউনিকেশনে একটি গ্যাপ তৈরি হতে পারে। তবে এটি সমাধান খুব কঠিন নয়। কুনমিং এ অনেক বাংলাদেশী স্টুডেন্ট পড়াশোনা করে। চাইলেই এই সকল বাংলাদেশী স্টুডেন্টদেরকে হাসপাতালগুলোতে দোভাষী হিসেবে ব্যবহার করা যায় এছাড়াও সেখানকার মেডিকেল কলেজগুলোতে যদি বাংলাদেশী ছাত্র ছাত্রীদের ব্যাপকভাবে ভর্তি করা হয়, তাহলে এই সকল মেডিকেল পড়ুয়া ছাত্র-ছাত্রীরা পড়াশোনার পাশাপাশি হাসপাতালগুলোতে চাকরি করে বাংলাদেশী ভর্তি রোগীদের ডাক্তারের সাথে কমিউনিকেশনের পাশাপাশি চিকিৎসা সেবা নিশ্চিত করতে পারে। এছাড়াও হোটেল রেস্টুরেন্ট ও এয়ারপোর্টে বাংলাদেশি স্টুডেন্টদেরকে দোভাষী হিসেবে ব্যবহার করলে এই ভাষাগত সমস্যা অনেকটাই দূর করা সম্ভব বলে আমার ধারণা।

 

কুনমিং এ আরও একটি সমস্যা আমার কাছে অত্যন্ত বিরক্তিকর মনে হয়েছে। আমি দুইবারই এই সমস্যা মোকাবেলা করেছি। কুনমিং এয়ারপোর্টে নামার পর ইমিগ্রেশনে যাওয়ার পূর্বেই ইমিগ্রেশন অফিসাররা বাংলাদেশী যাত্রীদের আলাদা করে ফেলে। এবং সেখানে সবাইকে বেশ বড় ধরনের জিজ্ঞাসাবাদের মুখোমুখি হতে হয়। এমন কি যে সমস্ত মানুষ চায়নাতে একাধিকবার ভ্রমণ করেছেন তাদেরকেও এই জেরার মুখোমুখি হতে হয়। এই জেরায় কোথায় এসেছেন, কোথায় যাবেন, কার কাছে, যাবেন কেন এসেছেন, কোথায় থাকবেন, কবে ফিরবেন, রিটার্ন টিকেট আছে কিনা, নানা প্রশ্নের পাশাপাশি কুনমিং এ আপনার কন্টাক্ট নাম্বার চাইবে। আপনার কন্টাক্ট চাইনিজ ব্যক্তিকে তারা ফোন করে নানা প্রশ্ন জিজ্ঞাসা করার পর সবকিছু ঠিক থাকলে তারপর আপনাকে ইমিগ্রেশনে পাঠাবে। এখানে ভাষাগত সমস্যা, মোবাইল নেটওয়ার্ক প্রভৃতি নিয়ে আমার কাছে বেশ বিরক্তিকর অভিজ্ঞতা মনে হয়েছে। আমার ব্যক্তিগত অভিমত, বন্ধুত্বপূর্ণ দেশ হিসেবে চাইনিজ সরকার বাংলাদেশি ভ্রমণকারীদের জন্য এই ব্যবস্থা সহজতর করবেন। কেননা সব রোগী কিন্তু শিক্ষিত বা সচেতন হবেন না। সাধারণ রোগীদের ক্ষেত্রে এইটা অত্যন্ত কঠিন ও জটিল একটি ব্যাপার হয়ে দাঁড়াতে পারে।

 

এর পাশাপাশি যদি চাইনিজ সরকার বাংলাদেশের মানুষের চিকিৎসার জন্য ভারতের বিকল্প একটি ডেস্টিনেশন হিসেবে নিজের দেশকে তুলে ধরতে চায় তাহলে আরো কিছু বিষয় করণীয় রয়েছে। এমনিতেই চাইনিজ ভিসা পাওয়া খুব কঠিন ব্যাপার নয় বাংলাদেশের জন্য। তবে এটি আরো দ্রুত এবং সহজতর করা প্রয়োজন। বিশেষ করে রোগীদের ক্ষেত্রে মাল্টিপল ভিসা দেওয়ার বিষয়টি চিন্তা করা যেতে পারে। বিমান ভাড়া খুব বেশি না হলেও তা আরো কমানোর জন্য বাজেট এয়ার বা কস্ট ইফেক্টিভ এয়ার চালু করা যেতে পারে। একই কথা হোটেলের বেলাতেও প্রযোজ্য। কুনমিং এ হাসপাতালগুলোর আশেপাশে কস্ট ইফেক্টিভ বা সাশ্রয়ী হোটেল ও রেস্টুরেন্ট নির্মাণ করা যেতে পারে। এবং সেখানে বাংলাদেশী খাবার যাতে সহজলভ্য হয় সে বিষয়ে দৃষ্টি দেয়া যেতে পারে। আগেই বলেছি এ সমস্ত হোটেল এবং রেস্টুরেন্টগুলোতে বাংলাদেশী স্টুডেন্টদেরকে দোভাষী হিসাবে ব্যবহার করতে হবে। এর পাশাপাশি চাইনিজ হাসপাতালগুলোতে চিকিৎসা খাতে বাংলাদেশী রোগীদের পরীক্ষা ও হাসপাতাল খরচে বিশেষ ডিসকাউন্ট দেয়ার বিষয়টি চাইনিজ সরকার বিবেচনা করবেন বলে প্রত্যাশা রাখি।

ভারতের মেডিকেল টুরিজমের প্রায় ৫৫% বাংলাদেশী রোগীদের অবদান। এ খাতে১০ বিলিয়ন ডলারের ভারতীয় বৈদেশিক মুদ্রা অর্জনের ক্ষেত্রে বাংলাদেশীদের অবদান ৫.৫ বিলিয়ন ডলার। এছাড়াও প্রায় সমপরিমাণ অর্থ থাইল্যান্ড, সিঙ্গাপুর, মালয়েশিয়া সহ ইউরোপীয় দেশগুলোতে বাংলাদেশিরা চিকিৎসা খাতে ব্যয় করে থাকে। অর্থাৎ বাণিজ্যিকভাবেও এটি চায়নার জন্য একটি লাভজনক বড় খাত হিসেবে বিবেচিত হতে পারে।

তবে বাংলাদেশী রোগীরা সেখানে গেলে কেবল চিকিৎসা খাতেই তাদের আয় হবে না, পাশাপাশি হোটেল, রেস্টুরেন্টে নতুন বিনিয়োগ হবে বলে ধারণা করা যায়, যেভাবে কলকাতায় হয়েছে। এছাড়াও যে সকল রোগী এবং তাদের সাথে যেসব এটেনডেন্ট যাবেন তারা কুনমিংয়ে পর্যটন কেন্দ্রগুলো ভ্রমণ করবেন এবং সেখানকার আকর্ষণীয় শপিং সেন্টার গুলোতে শপিং করবেন। ফলে সব মিলিয়ে চায়নার একটি বিপুল সম্ভাবনাময় বাণিজ্যের নতুন খাত সৃষ্টি হবে বলে ধারণা করা যায়।

তবে এই খাতটি ব্যবহার করতে হলে কেবল গভমেন্ট টু গভমেন্ট সম্পর্ক তৈরি করলে কোন লাভ হবে না। এ সম্পর্ক কেবল দুই দেশের উইন্ডো ওপেনিং হিসেবে কাজ করবে। কিন্তু মূলত ব্যবসাটা হতে হবে ব্যবসায়ীদের মাধ্যমে অর্থাৎ প্রাইভেট সেক্টরে। কুনমিং কে যদি ভারতের বিকল্প মেডিকেল ডেস্টিনেশন হিসেবে প্রতিষ্ঠা করতে হয় তাহলে দুই দেশের ব্যবসায়ীদের এগিয়ে আসতে হবে। বিশেষ করে সেখানকার হাসপাতালগুলোকে উদ্যোগ নিতে হবে বাংলাদেশে এ খাতে ব্যবসা করার জন্য। তবে প্রথমেই যেটা প্রয়োজন সেটা হচ্ছে বাংলাদেশের মানুষের মধ্যে কুনমিং চিকিৎসা ব্যবস্থার বিভিন্ন ফ্যাসিলিটি, যাতায়াত সুবিধা এবং অন্যান্য বিষয়গুলো সম্পর্কে ইতিবাচক ধারণা তৈরি করা। এক্ষেত্রে গণমাধ্যম ও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ব্যবহার করে ব্যাপক প্রচারণা চালাতে হবে। বাংলাদেশের বিভিন্ন মেলা গুলোতে চাইনিজ হাসপাতালগুলোর পক্ষে অংশগ্রহণ করা কিংবা সরাসরি বাংলাদেশের চাইনিজ মেডিকেল ফেয়ার করা যেতে পারে প্রমোশনের অংশ হিসেবে। সেক্ষেত্রে হাসপাতালগুলো বাংলাদেশে তাদের এজেন্সি দিতে পারে। এ সকল এজেন্সির মাধ্যমে বাংলাদেশের অভ্যন্তরে ব্যাপক প্রচারণা চালানো যেতে পারে। এছাড়াও এ সকল এজেন্সি নির্দিষ্ট হসপিটালগুলোর সাথে রোগীদের যোগাযোগ, ডাক্তার এপয়েন্টমেন্ট, ইনভিটেশন লেটার নিয়ে আসা, ভিসা প্রসেসিং, হোটেল বুকিং সহ অন্যান্য কাজে সহায়তা করতে পারে। ঠিক যেভাবে থাইল্যান্ডের হসপিটালগুলো বাংলাদেশে করে থাকে। এর পাশাপাশি সেখানকার হসপিটাল গুলোর বিদ্যমান ওয়েবসাইটগুলোর একটি ইংলিশ ভার্সন বা বাংলা ভার্সন রাখা যেতে পারে। যাতে সাধারণ রোগীরা সরাসরি তাদের প্রয়োজনীয় ডাক্তার সিলেক্ট করে তাদের সাথে কন্টাক্ট বুকিং করতে পারে। দোভাষীর মাধ্যমে ডাক্তারগন তাদের সাথে কথা বলে অ্যাপয়েন্টমেন্ট ও ইনভিটেশন পাঠাতে পারে।

তবে বাংলাদেশ সরকার যদি এদেশের মানুষকে চিকিৎসা খাতে ভারতমুখী হওয়ার প্রবণতা হ্রাস করতে চায় সেক্ষেত্রে কেবল চাইনিজ হাসপাতালগুলো বাংলাদেশী রোগীদের জন্য খুললে তা যথেষ্ট হবে না। কেননা বাংলাদেশের সীমান্তবর্তী অনেক জেলা ও শহরের মানুষগুলোর জন্য ঢাকায় এসে চিকিৎসা নেয়ার থেকে কলকাতায় গিয়ে চিকিৎসা নেয়া অনেক সহজতর ও সাশ্রয়ী। এই রোগীদের ফেরাতে হলে ঢাকায় এবং ঢাকার বাইরে বিভিন্ন বিভাগীয় শহরগুলোতে চাইনিজ সহায়তায় ও বিনিয়োগে বেশ কয়েকটি হাসপাতাল নির্মাণ করতে হবে। একই সাথে মেডিকেল কলেজ ও নার্সিং ইনস্টিটিউট নির্মাণ করা গেলে চাইনিজ তত্ত্বাবধানে বাংলাদেশে বিশ্বমানের ডাক্তার ও নার্স তৈরি হবে। ঢাকা ও বিভাগীয় শহরগুলোতে চাইনিজ তত্ত্বাবধানে পরিচালিত হাসপাতালগুলোতে যদি চাইনিজ স্ট্যান্ডার্ড এর চিকিৎসা নিশ্চিত করা যায় তাহলে বাংলাদেশের মানুষ ভারতমুখী হবে না। এর লক্ষ্য হবে বাংলাদেশের মানুষের ভারতমুখীনতা ও ভারত নির্ভরতা হ্রাস করা, এবং বাংলাদেশ ও চায়নার মধ্যে পিপলস টু পিপলস রিলেশন তৈরি করা।

এবারের সফরে বিভিন্ন আলাপ-আলোচনায় আমার মনে হয়েছে, প্রফেসর ডক্টর মোহাম্মদ ইউনুসের এই সফর প্রত্যাশার থেকেও বেশি সফল হবে। আমার মনে হয়েছে চাইনিজ সরকার বাংলাদেশকে তার প্রত্যাশা থেকেও বেশি দিতে প্রস্তুত। তবে আমরা কতটুকু নিতে পারব বা নেব সেটা আমাদের ব্যাপার। যুক্তরাষ্ট্র ও ভারতের রক্তচক্ষু এবং ষড়যন্ত্র মোকাবেলা করে আমরা কতটুকু চাইনিজ সহায়তা নিতে পারব সেটাই মূল আলোচ্য বিষয়। প্রফেসর ড. মুহাম্মদ ইউনূসের এই সফরের পূর্বে বাংলাদেশ অস্থিতিশীলতা সৃষ্টি হওয়া এবং দুজন মার্কিন প্রভাবশালী ব্যক্তির বাংলাদেশ ভ্রমণ এই সফরের উপরে কতটা প্রভাব ফেলবে তার উপরে এই অপরের সাফল্য নির্ভর করছে।

অন্যদিকে চায়নার দিক থেকেও কিছু বিষয়ে অস্বস্তি বা প্রশ্নবোধক পরিস্থিতি হয়ে গেছে। বিশেষ করে সরকারের উপরে যুক্তরাষ্ট্রের বিপুল প্রভাব এবং সরকারের সাথে জড়িত বিপুল পরিমাণ মার্কিন দ্বৈত নাগরিকদের বিষয়টি চাইনিজ সরকারের একটি গুরুত্বপূর্ণ কনসার্নের জায়গা। এছাড়াও বাংলাদেশ তাইওয়ানী বিভিন্ন কোম্পানির ব্যবসার সুযোগ পাওয়া চাইনিজ সরকারের খুবই উদ্বেগের একটি বিষয়। তাইওয়ান সেমিকন্ডাক্টর ম্যানুফেকচারিং কোম্পানি টিএসএমসি বর্তমান সরকারের আমলেও এই দেশে উৎপাদন কারখানা তৈরি করতে চেষ্টা করছে। এবং এতে সরকারের কোন কোন মহলের রয়েছে। বিষয়টি চাইনিজদের জন্য অত্যন্ত আপত্তির একটি জায়গা। এ বিষয়ে দেশবাসী বিএনপির আমলের অভিজ্ঞতার কথা জ্ঞাত রয়েছে। শেখ হাসিনার আমলেও এ দেশে তাইওয়ানী কোম্পানির বিনিয়োগ হলেও হাসিনা ও তার পরিবারের সদস্যরা এতে যুক্ত হয়নি। যদিও সেটা নিয়েও তাদের অস্বস্তি ছিল। এবারের সফরে এ বিষয়টি আলোচনায় আসতেও পারে হয়তো। আশা করি বাংলাদেশ সরকার তাদের চিরাচরিত এক চীন নীতির প্রতি অবিচল শ্রদ্ধা প্রদর্শন দেখিয়ে যাবে।


বিভাগ : স্বাস্থ্য


মন্তব্য করুন

HTML Comment Box is loading comments...

এই বিভাগের আরও

স্পেশাল হেলথকেয়ার ফাউন্ডেশনের নতুন কমিটি গঠন
নাটক ও চলচ্চিত্রে ধূমপানের দৃশ্য বন্ধের আহ্বান মানসের
তারুণ্য ধরে রাখতে হবে
এই সময়ে তরমুজ খান
প্রোস্টেট গ্রন্থির বৃদ্ধি
আরও
X

আরও পড়ুন

ঈদ মিছিলে মূর্তি ঈদের মূল স্পিরিটের সঙ্গে সাংঘর্ষিক: হেফাজত

ঈদ মিছিলে মূর্তি ঈদের মূল স্পিরিটের সঙ্গে সাংঘর্ষিক: হেফাজত

ফার্নান্দেসের রিয়ালে যাওয়ার ব্যাপারে যা বললেন তার কোচ

ফার্নান্দেসের রিয়ালে যাওয়ার ব্যাপারে যা বললেন তার কোচ

রোনালদোকে ছাড়িয়ে যেতে পারেন এমবাপে: আনচেলত্তি

রোনালদোকে ছাড়িয়ে যেতে পারেন এমবাপে: আনচেলত্তি

উইন্ডিজের নেতৃত্ব ছাড়লেন ব্র্যাথওয়েট

উইন্ডিজের নেতৃত্ব ছাড়লেন ব্র্যাথওয়েট

ঈদের আনন্দ ৫ আগস্ট শুরু হয়েছে : শিবির সভাপতি

ঈদের আনন্দ ৫ আগস্ট শুরু হয়েছে : শিবির সভাপতি

আমাকে যুদ্ধাপরাধের মামলায় ফাঁসানোর ভয় দেখানো হয়েছিল: জামায়াত আমির

আমাকে যুদ্ধাপরাধের মামলায় ফাঁসানোর ভয় দেখানো হয়েছিল: জামায়াত আমির

বাকিটা জীবন বুড়িচং-ব্রাহ্মণপাড়াবাসীর পাশে থাকতে চাই : ব্যারিস্টার আব্দুল্লাহ আল মামুন

বাকিটা জীবন বুড়িচং-ব্রাহ্মণপাড়াবাসীর পাশে থাকতে চাই : ব্যারিস্টার আব্দুল্লাহ আল মামুন

পশ্চিমবঙ্গ-গুজরাটে আতশবাজি কারখানায় বিস্ফোরণ, নিহত ২১

পশ্চিমবঙ্গ-গুজরাটে আতশবাজি কারখানায় বিস্ফোরণ, নিহত ২১

আমাদের চেতনার প্রাণপুরুষ আল্লামা ফুলতলী (র.)

আমাদের চেতনার প্রাণপুরুষ আল্লামা ফুলতলী (র.)

লক্ষ্মীপুরে অস্ত্রধারীদের গুলিতে শিশু গুলিবিদ্ধ

লক্ষ্মীপুরে অস্ত্রধারীদের গুলিতে শিশু গুলিবিদ্ধ

রামুতে গুলিতে নিহতের ঘটনায় ২ টি দেশীয় তৈরি অস্ত্র উদ্ধার আটক ২

রামুতে গুলিতে নিহতের ঘটনায় ২ টি দেশীয় তৈরি অস্ত্র উদ্ধার আটক ২

সিলেটে ৬ তলা ভবন থেকে লাফ দিয়ে এক গৃহবধুর আত্মহত্যা

সিলেটে ৬ তলা ভবন থেকে লাফ দিয়ে এক গৃহবধুর আত্মহত্যা

ঈদ পরবর্তী শুভেচ্ছা বিনিময়ে মোরেলগঞ্জের পথে প্রান্তরে বিএনপি নেতা কাজী শিপন

ঈদ পরবর্তী শুভেচ্ছা বিনিময়ে মোরেলগঞ্জের পথে প্রান্তরে বিএনপি নেতা কাজী শিপন

ঈদে কক্সবাজার সমুদ্র সৈকত পর্যটকে মুখরিত

ঈদে কক্সবাজার সমুদ্র সৈকত পর্যটকে মুখরিত

কুমিল্লায় বিদ্যুতের খুঁটিতে ধাক্কা বাসের, নিহত ৩

কুমিল্লায় বিদ্যুতের খুঁটিতে ধাক্কা বাসের, নিহত ৩

দাউদকান্দিতে এক যুবকের লাশ উদ্ধার

দাউদকান্দিতে এক যুবকের লাশ উদ্ধার

ঈদের পাঞ্জাবি নিয়ে বিপাকে বাবর, ডিজাইনারকে ছাঁটাই করতে বললেন ভক্তরা

ঈদের পাঞ্জাবি নিয়ে বিপাকে বাবর, ডিজাইনারকে ছাঁটাই করতে বললেন ভক্তরা

লন্ডনে ঈদের জামাতে প্রকাশ্যে হাছান মাহমুদ

লন্ডনে ঈদের জামাতে প্রকাশ্যে হাছান মাহমুদ

সুপ্রিম কোর্টে মুখ পুড়ল যোগী আদিত্যনাথের

সুপ্রিম কোর্টে মুখ পুড়ল যোগী আদিত্যনাথের

মির্জাপুরে প্রশাসনের হস্তক্ষেপে বিরোধপূর্ণ দুই ঈদগাহসহ আড়াই শতাধিক মাঠে উৎসবমুখর পরিবেশে ঈদের জামাত

মির্জাপুরে প্রশাসনের হস্তক্ষেপে বিরোধপূর্ণ দুই ঈদগাহসহ আড়াই শতাধিক মাঠে উৎসবমুখর পরিবেশে ঈদের জামাত