বহুজাতিক কোম্পানি কূটকৌশলে বাড়াচ্ছে ই-সিগারেট লক্ষ্য যুব সমাজ, ‘তামাকমুক্ত বাংলাদেশ’ লক্ষ্য ব্যাহত হবে
০৪ এপ্রিল ২০২৩, ০৪:২০ পিএম | আপডেট: ৩০ এপ্রিল ২০২৩, ১০:৫৬ পিএম
‘তামাকমুক্ত বাংলাদেশ’ গড়ার লক্ষ্য ব্যাহত করতে তামাক কোম্পানীগুলো তরুণদের আসক্ত করতে বিভিন্ন কূটকৌশল প্রয়োগ করে দেশে ই-সিগারেটের বাজার দ্রুত সম্প্রসারণ করছে। মঙ্গলবার (৪ এপ্রিল ২০২৩) একটি সেমিনারে এ সংক্রান্ত একটি গবেষণার ফলাফল প্রকাশ করা হয়। ইন্টার প্রেস নেটওয়ার্ক-আইপিএন ঢাকা রিপোর্টার্স ইউনিটি (ডিআরইউ)-তে এই সেমিনারের আয়োজন করে।
‘বাংলাদেশে নতুন পণ্য বিস্তারে তামাক শিল্পের কূটকৌশল’ শীর্ষক গবেষণাটি যৌথভাবে সম্পাদন করেন ঢাকা বিশ^বিদ্যালয়ের পিএইচ.ডি গবেষক ও গণমাধ্যমকর্মী এহসানুল হক জসীম এবং তামাক নিয়ন্ত্রণ গবেষক সৈয়দ সাইফুল আলম। ছয় মাস ব্যাপী মাঠ পর্যায়ের এই গবেষণাটি পরিচালিত হয় ২০২২ সালে।
ফলাফল উপস্থাপনে বলা হয়, ২০১২ সালে বাংলাদেশে প্রথম ই-সিগারেট আগমনের পর প্রথম ৪/৫ বছর পর্যন্ত কেবলই রাজধানীর কিছু অভিজাত এলাকায় ই-সিগারেটের অল্প কিছু দোকান ছিল। ই-স্মোকারের সংখ্যাও তখন খুবই কম ছিল। এখন সারাদেশে ই-সিগারেট পাওয়া যায়। জ্যামিতিক হারে আশংকাজনকভাবে বাড়ছে ই-স্মোকারের সংখ্যা, ই-সিগারেটের ব্যবহার।
সমীক্ষা অনুযায়ী, ২০১২ থেকে ২০১৬ পর্যন্ত সময়ের মধ্যে চালু হয়েছে এবং এখনো ই-সিগারেট বিক্রি করছে, এমন দোকানের সংখ্যা ২২%। বাকি ৭৮% ই-সিগারেেেটর দোকান ২০১৬ সালের পর (২০১৭-২০২১) পাঁচ বছরের মধ্যে চালু হয়। মাত্র পাঁচ বছরে কয়েকগুণ ভ্যাপিং শপ বৃদ্ধি পেলেও পুরাতন দোকানগুলোর বিক্রি কমেনি; বরং নতুন ও পুরাতন দোকানগুলোতে দিন দিন বিক্রি বাড়ছে। মাত্র কয়েক বছরে বেশির ভাগ ই-সিগারেটের দোকান চালু হওয়ার বিষয়টি বাংলাদেশে সাম্প্রতিক সময়ে ই-সিগারেট খুবই দ্রুত ও আশংকাজনক হারে বিস্তারের প্রমাণবহ। তামাক কোম্পানীগুলোর বিভিন্ন কূটকৌশলের কারণে বাংলাদেশে ই-সিগারেটের ব্যবহার ও নতুন এই তামাক পণ্যের বাজার জ্যামিতিক হারে বিস্তৃত হচ্ছে।
আইনের মাধ্যমে বাংলাদেশে ই-সিগারেট নিষিদ্ধ করার সুপারিশ করা হয়েছে এই গবেষণায়। ই-সিগারেটের বাজার সম্প্রসারণ রোধে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ধীন জাতীয় তামাক নিয়ন্ত্রণ সেল (এনটিসিসি) এর অধীনে একটি পৃথক বিভাগ গঠনেরও সুপারিশ করা হয়।
সুপারিশগুলোর প্রতি একাত্মতা প্রকাশ করে বিভিন্ন তামাক-বিরোধী সংগঠনের প্রতিনিধি ও জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা বক্তব্য রাখেন। সেমিনারে প্যানেল আলোচক ছিলেন মানসের প্রতিষ্ঠাতা চেয়ারম্যান ও বারডেমের ডেন্টাল বিভাগের প্রধান বীরমুক্তিযোদ্ধা অধ্যাপক ডা. অরূপ রতন চৌধুরী, জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের সাবেক চেয়ারম্যান ড. নাসির উদ্দীন আহমদ, বাংলাদেশ ক্যানসার সোসাইটির প্রকল্প পরিচালক অধ্যাপক ডা. মহিউদ্দীন ফারুক, পরিবেশ বাঁচাও আন্দোলন (পবা) এর চেয়ারম্যান আবু নাসের খান, জনস্বাস্থ্য বিষয়ক আইনজীবী এডভোকেট সৈয়দ মাহবুবুল আলম তাহিন, স্টামফোর্ড বিশ^বিদ্যালয়ের পরিবেশ বিজ্ঞাপন বিভাগের চেয়ারম্যান অধ্যাপক ড. আহমদ কামরুজ্জামান মজুমদার এবং বাংলাদেশ তামাক বিরোধী জোটের ভারপ্রাপ্ত সমন্বয়কারী হেলাল আহমদ। ইন্টার প্রেস নেটওয়ার্কের নির্বাহী পরিচালক মোঃ গোলাম মাওলার সভাপতিত্বে অন্যান্যদের মধ্যে বক্তব্য রাখেন ঢাকা ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটির সহযোগী অধ্যাপক মোঃ বজলুর রহমান এবং বিএনপিটিপির হামিদুল ইসলাম হিল্লোল।
ডা. অরূপ রতন চৌধুরী বলেন, অনেক তরুণ-তরুণী প্রথমে ই-সিগারেট গ্রহন করে, পরে ইয়াবা, হিরোইন, কোকেইন ইত্যাদি মাদকে ঝুঁকছে। আইনের মাধ্যমে ই-সিগারেট বন্ধের আহ্বান জানিয়ে তিনি বলেন, তামাক নিয়ন্ত্রণ আইন দ্রুত সংশোধন করতে হবে। ড. নাসির উদ্দীন আহমদ বলেন, ই-সিগারেটের মতো ক্ষতিকর তামাক পণ্য আমদানির অনুমোদন দেওয়া যাবে না। অধ্যাপক ডা. মহিউদ্দীন ফারুক বলেন, ই-সিগারেট ব্যবহারের ফলে তরুণরা স্বাস্থ্য ঝুঁকির মধ্যে আছে। তরুণ প্রজন্মকে ই-সিগারেটের ভয়াবহতা থেকে বাঁচাতে পদক্ষেপ নিতে হবে।আবু নাসের খান বলেন, তরুণদেরকে ধ্বংশ করার ভয়ংকর নিয়ে উদ্দেশ্য নিয়ে বাংলাদেশে ই-সিগারেটের বিস্তার ঘটানো হচ্ছে; এই ভয়ংকর তামাক পণ্য এখনই থামাতে হবে। অধ্যাপক ড. আহমদ কামরুজ্জামান মজুমদার বলেন, শুধু তরুণ নয়, শিশুদের মধ্যেও ই-সিগারেটের বিস্তার ঘটছে। ই-সিগারেটের পরিবেশত ক্ষতি ও বায়ু দূষণ নিয়ে আলাদা গবেষণার উপর তিনি গুরুত্বারোপ করেন।
সৈয়দ মাহবুবুল আলম তাহিন বলেন, বাংলাদেশে নতুন এই তামাক পণ্যের বিস্তারে বহুজাতিক তামাক কোম্পানিগুলো আগ্রাসী বিপণন কৌশলের মাধ্যমে এগিয়ে যাচ্ছে। তাদের আগ্রাসী কার্যক্রম এভাবে অব্যাহত থাকলে ২০৪০ সালের মধ্যে বাংলাদেশকে তামাকমুক্ত করার লক্ষ্যমাত্রা অর্জিত হবে না। তাই অবিলম্বে ই-সিগারেটের নিষেধাজ্ঞা আরোপই হচ্ছে সবচেয়ে ভালো সমাধান।
গবেষণা ও অনুসন্ধানে দেখা যায়, ব্রিটিশ আমেরিকার টোব্যাকো (বিএটি)-সহ বিভিন্ন বহুজাতিক তামাক কোম্পানি বাংলাদেশ ই-সিগারেট বিস্তারে কাজ করছে। জনসংখ্যার অনপাতে গত কয়েক বছরে দেশে প্রচলিত ধূমপায়ীর হার কমেছে। কিন্তু বহুজাতিক বিভিন্ন তামাক কোম্পানির কৌশল এবং প্রচারমূলক কর্মকা-ের কারণে ই-সিগারেট এখন তরুণদের মধ্যে জনপ্রিয় হয়ে উঠছে।
ই-সিগারেট গ্রাহকদের বেশিরভাগই যুবক, বিশেষ করে ছাত্র। তথাকথিত ইতিবাচক তুলে ধরে তরুণদের ই-সিগারেটের প্রতি আকৃষ্ট করা হয়। ফলে কখনো ধূমপান করেনি এমন তরুণ-যুবকদের অনেকেও ই-সিগারেটের প্রতি অভ্যস্ত করতে তামাক কোম্পানীগুলো এবং তাদের সহযোগী বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান বিভিন্ন কৌশল প্রয়োগ করছে।
তামাক কোম্পানীগুলোর প্রধান টার্গেটে বাংলাদেশ হওয়ার কারণ এদেশের বিশাল জনগোষ্ঠী। সেই জনগোষ্ঠীর বড় অংশটি তরুণ-যুবক। ঐতিহাসিকভাবে, তামাক কোম্পানীগুলো দীর্ঘমেয়াদী ভোক্তা তৈরির কৌশলের অংশ হিসেবে তরুণ-যুবকদেরই টার্গেট করে থাকে। কৌশলের অংশ হিসেবে তামাক শিল্প সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমও ব্যবহার করে এবং বিভিন্ন সাইট ব্যবহার করে তরুণ-যুবকদের টার্গেট করে থাকে, যারা সাধারণত সামাজিক মাধ্যমে সক্রিয় থাকে।
সমীক্ষায় অংশগ্রহণকারী ৮০% বিক্রেতা জানিয়েছেন, ই-সিগারেট ব্যবসা সম্প্রসারণের জন্য তারা অনলাইন প্ল্যাটফর্ম এবং সামাজিক সাইট উভয়ই ব্যবহার করেন। ৯৪% দোকান সামাজিক মাধ্যম ব্যবহার করে। তারা অফ-লাইন মিডিয়াও ব্যবহার করে। তরুণদের ই-সিগারেট ব্যবহারে উৎসাহিত করতে বাংলাদেশে প্রথমবারের মতো একটি ভ্যাপিং উৎসবেরও আয়োজন করা হয়।
বহুজাতিক তামাক কোম্পানির বিভিন্ন ব্রান্ডের ভ্যাপিং পণ্য বাংলাদেশে দেদারছে বিক্রি হচ্ছে। অনুসন্ধানে দেখা গেছে, অনেক জায়গায় শীর্ষস্থানীয় কোন কোন তামাক কোম্পানির সরাসরি তত্ত্বাবধানে ই-সিগারেটের দোকান পরিচালিত হচ্ছে। ঢাকা নগরীতে অন্তত ৩৯টি আউটলেটের সন্ধান পাওয়া যায় যেখান থেকে বহুজাতিক তামাক কোম্পানি পর্দার অন্তরাল থেকে ই-সিগারেট বিক্রি করছে।
বিগত ২২ বছরের ট্রেডমার্ক নিবন্ধনের তথ্য পর্যালোচনা করে দেখা গেছে, বাংলাদেশে অনেক বহুজাতিক তামাক কোম্পানি নিরবে অনেক ই-সিগারেট ব্রান্ড এবং ই-সিগারেটের সম্পৃক্ত অন্যান্য অনেক পণ্যের ট্রেডমার্ক নিবন্ধন নিয়ে রেখেছে। সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের কাছ থেকে অনুমোদন পাওয়ার মাধ্যমে ই-সিগারেট আমদানি করা যেমন এই তামাক পণ্য বাংলাদেশে বৈধকরণের কূটকৗশলের অংশ, তেমনি ট্রেডমার্ক নিবন্ধন বৈধকরণের আরেকটি কূটকৗশল।
বাংলাদেশে ই-সিগারেটের বাজার সম্প্রসারণ এবং এর ব্যবহারকারী বাড়াতে আইনের ফাঁকফোকর কাজে লাগিয়ে তামাক কোম্পানিগুলোও ধূমপান জোনের সদ্ব্যবহার করছে।
বিভাগ : অর্থনীতি
মন্তব্য করুন
আরও পড়ুন
সিসিকের সাবেক কাউন্সিলর ১৩ মামলার আসামী আ‘লীগ নেতা লায়েক গ্রেফতার
যার হাত ধরে পরীমনি এসেছিলেন চলচ্চিত্রে,তার মরণ দিনে করলেন খাসি জবাই
ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ে পরিবর্তন হচ্ছে লেকের নাম, নতুন নাম ‘মুগ্ধ সরোবর’
সোনারগাঁয়ে বিএনপির কার্যালয় উদ্বোধন
সেনবাগে ইসলামী আন্দোলনের গণ সমাবেশে আওয়ামীলীগ নিষিদ্ধের দাবী
পঞ্চগড়ে সিন্ডিকেট ভাঙতে তেঁতুলিয়ায় ৫৫ টাকায় আলু বিক্রি
স্বতন্ত্র ইবতেদায়ী মাদরাসা জাতীয়করণের দাবী অত্যন্ত যৌক্তিক ধর্ম উপদেষ্টা ড.খালিদ হোসেন
সাধারণ মানুষের পেটে লাথি মেরে আ.লীগ নিজেদের ভাগ্য গড়েছে : এমরান সালেহ প্রিন্স
মাদক শুধু ব্যক্তিকে নয় পরিবারকেও ধ্বংস করে
অ্যাম্বাসেডর কাপ উশুতে সেনাবাহিনী চ্যাম্পিয়ন
সিলেটে মাজিদের ফিফটি
বঙ্গবন্ধু স্টেডিয়ামেই হবে অনূর্ধ্ব-২০ নারী সাফের খেলা
বাংলাদেশে খেলা নিয়ে অনিশ্চিয়তায় হামজা!
ফের বাড়লো সোনার দাম, ভরি ১ লাখ ৪২ হাজার টাকা
বাফুফের নতুন সভাপতি তাবিথের কাছে ২৭ রেফারির চিঠি
দিনের শুরুতেই হাসানের জোড়া আঘাত
তারেক রহমান দেশের সাধারণ মানুষের কাছে আস্থার প্রতিক-মোরেলগঞ্জে কাজী খায়রুজ্জামান শিপন
ফ্যাসিবাদের দোসররাই সিন্ডিকেট করে দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতি করছে: ছাত্রদল সাধারণ সম্পাদক নাছির
আইপিএলের মেগা নিলামে নজর বাংলাদেশের ১২ ক্রিকেটারের উপর
বেনাপোল থেকে দূরপাল্লার বাস চলাচল বন্ধ