নদীদূষণ দখল ভরাট ও প্রতিকার
১৮ এপ্রিল ২০২৩, ০৭:১৯ পিএম | আপডেট: ৩০ এপ্রিল ২০২৩, ০৬:৪০ এএম
প্রকৃতি ও পরিবেশ বদলে গেছে। পশু-পাখির জন্য অরণ্য নেই। নদীতে নেই পানি। তারপরও নদী আছে। আছে নদীর জন্য কান্না। একদিকে নদীদূষণ, অন্যদিকে নদী খনন কাজে দক্ষতার অভাবে নদ-নদীগুলোর পলি অপসারণ করার পরপরই নদ-নদীগুলো আবার ভরাট হয়ে যাচ্ছে। এভাবে বছরের পর বছর নদীতে পলি ও বালু এবং আবর্জনা পড়ে ডুবোচরের সংখ্যা ও দূষণ বেড়েছে। নদী খনন কাজে জবাবদিহি ও পরিকল্পনার অভাবে নদ-নদীগুলোর আজ বেহাল দশা। বাংলাদেশ যখন মধ্যম আয়ের দেশ হওয়ার পথে এগিয়ে চলেছে তখনও আমাদের জানা নেই, আমাদের দেশের অনেক নদীর অস্তিত্ব মানচিত্রে আছে, অথচ বাস্তবে নেই।
অনেকের লোভ-লালসা পড়েছে নদীর ওপর। নদী অবৈধ দখল করে অনেকে মাছ চাষ করছেন, বিভিন্ন স্থাপনা তৈরি করছেন, নদীর জমি দখল করে গড়ে উঠেছে শিল্প প্রতিষ্ঠান, দূষণের জন্য জুড়ে দিয়েছে বর্জ্যরে লাইন। সব ধরনের বর্জ্য গিয়ে পড়ছে নদীতে। আবার কোনো কোনো স্থানে শহরের সিটি করপোরেশনের ময়লা-আবর্জনা গিয়ে পড়ছে নদীতে। শিল্পকারখানার বর্জ্যে নদী সবচেয়ে বেশি দূষিত হচ্ছে। নদ-নদী দূষণ-দখল আর ভরাটের সঙ্গে যারা জড়িত তারা অত্যন্ত প্রভাবশালী। বিভিন্ন সময় তারা দলের নাম ভাঙিয়ে ক্ষমতার অপব্যবহার করে নদ-নদীগুলোকে ধ্বংসের দিকে ঠৈলে দিচ্ছে। যুগের পর যুগ নদ-নদীগুলো আমাদের অর্থনৈতিক ব্যবস্থাকে সচল রেখেছে। নদীগুলো আমাদের ঐতিহ্য ও সংস্কৃতি ধারণ করে চলেছে। নদীতে বছরের পর বছর অপরিকল্পিতভাবে বাঁধ নির্মাণ করা হয়েছে, উৎসমুখ বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে। খাল-বিল, শাখানদী, উপনদীগুলো ধীরে ধীরে মেরে ফেলা হয়েছে। বড় বড় নদ-নদীতে পানি সরবরাহের উৎসে এখন টান পড়েছে। নদী থেকে অপরিকল্পিতভাবে বালু উত্তোলন করা হয়েছে এবং হচ্ছে। সরকার বছরের পর বছর নদ-নদী বাঁচাতে কোটি কোটি টাকা বরাদ্দ দিলেও সেসব অর্থের যথার্থ ব্যবহার হয়নি। সময়মতো নদীগুলো খনন করা হয়নি। নৌপথ ক্রমাগত কমতে কমতে এখন নেমে এসেছে চার হাজার কিলোমিটারে। তথ্য মতে, এখন দেশে নদ-নদীর সংখ্যা প্রায় ২৩০টির মতো। ব্রিটিশ শাসনামলে দেশে নৌপথের দৈর্ঘ্য ছিল প্রায় ১৪ হাজার কিলোমিটার। পাকিস্তানি আমলে বর্ষা মৌসুমে নৌপথের দৈর্ঘ্য দাঁড়ায় প্রায় ১২ হাজার কিলোমিটার। আমাদের মতো নদীমাতৃক দেশে নৌপথের সুবিধা অনেক। পরিবহন খরচ কম, জ্বালানি সাশ্রয়ী, পরিবেশবান্ধব ও নিরাপদ। একজন মানুষের যেমন আইনগত অধিকারের সুযোগ আছে, তেমনি নদ-নদীর সে ধরনের অধিকার আছে।
হাইকোর্ট ‘জাতীয় নদী রক্ষা কমিশন’কে নদ-নদীর অভিভাবক ঘোষণা করেছে। তাই সময় এসেছে জাতীয় নদী রক্ষা কমিশনকে আরও লোকবল, সুযোগ-সুবিধা ও প্রয়োজনীয় স্বাধীন ক্ষমতা দেওয়ার। এছাড়া নদী বিষয়ে আলাদা ট্রাইব্যুনাল করলে তা নদ-নদী রক্ষার্থে ব্যাপক ভূমিকা রাখতে পারবে। নদী পুলিশও গঠন করা যেতে পারে। নদ-নদী তথা প্রকৃতির ওপর বছরের পর বছর অত্যাচার করে কোন সভ্যতা টিকেনি। তাই আমাদের সম্পদ, অর্থনৈতিক ক্ষেত্র নদ-নদীগুলোকে সুরক্ষা, সংরক্ষণ ও সৌন্দর্য বৃদ্ধিতে মনোযোগ দিতে হবে। মনে রাখতে হবে, এক একটি নদী এক একটি পর্যটন ক্ষেত্রও বটে। পর্যটনের এ সম্ভাবনার দ্বার যত বেশি সুস্থ থাকবে নদ-নদী রক্ষাসহ পর্যটনের বিকাশ তত ত্বরান্বিত হবে। দেশের সব ধরনের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থীদের কাছে নদ-নদীর গুরুত্ব তুলে ধরে ভবিষ্যৎ রক্ষক হিসেবে তাদের সচেতনতা বৃদ্ধির উদ্যোগ নিতে হবে। কারণ, নদী ঝরনা জলপ্রপাত প্রকৃতির এক অসাধারণ অনুষঙ্গ। মানববসতি গড়ে উঠেছে এ অসাধারণ প্রকৃতি ঘিরে। তবে মানুষ এর ওপর অনাচার করেছে। শত শত বছর ধরে এতে বিপর্যয় সৃষ্টি করা হয়েছে। বর্তমানে মানুষ উপলব্ধি করতে শুরু করেছে কাজটি ঠিক হয়নি। নদী না থাকলে তাদের জীবন উপভোগ্য ও মসৃণ থাকবে না। ইউরোপে নদীকে জীবন্ত সত্তার মর্যাদা দেয়া হয়েছে। কোনো কোনো দেশে একে প্রাণের আলাদা অস্তিত্ব হিসেবে স্বীকৃতি দিয়ে আইন করা হয়েছে। আমাদের দেশের সর্বোচ্চ আদালতও নদীকে ‘জীবন্ত সত্তা’ ঘোষণা করেছেন। একে প্রাণ ফিরিয়ে দিতে রক্ষণাবেক্ষণের তাগিদ দিয়েছেন। বাস্তবে এখনো আমাদের নদ-নদী রক্ষায় কার্যকর কিছু করা যায়নি। প্রতিনিয়ত খবর আসছে সারাদেশের নদীগুলো করুণ অবস্থায় পতিত হচ্ছে। জালের মতো ছড়িয়ে-ছিটিয়ে থাকা নদী জনপদের অধিবাসীদের বহুবিধ উপকারে এসেছে। সেজন্য বাংলাদেশকে বলা হয় নদীমাতৃক দেশ। মাছে ভাতে বাঙালি- এ প্রবাদটির মূল কারণ এ নদী। এটি ছিল অফুরন্ত মাছের ভা-ার। শুকনো মৌসুমে ফসলের জন্য পানির উৎস ও যোগাযোগের সহজ মাধ্যম। এখন প্রতিনিয়ত খবর প্রকাশ হচ্ছে, নদী মরে যাচ্ছে। এ কারণে মরুকরণের পথে চলছে দেশ। এর পেছনে আমাদের সীমাহীন লোভ-লালসা একদিকে দায়ী; অন্যদিকে দায়ী প্রতিবেশী দেশের একচেটিয়া পানি প্রত্যাহার। প্রভাবশালীরা যারা যেখানে পারছে নদী দখল করছে। এর ওপর নির্মাণ করছে অবৈধ স্থাপনা। কোথাও নদীতে সরাসরি বাঁধ দিয়ে মাছের ঘের তৈরি করা হয়েছে। নদীরক্ষা কমিশন তাদের বিরুদ্ধে কার্যকর পদক্ষেপ নিতে পারছে না। আরেক দিকে চলছে ভয়াবহ দূষণ। কলকারখানার ক্ষতিকর বর্জ্য ও শহরের পয়ঃনিষ্কাশন হচ্ছে সরাসরি নদীতে। বহু নদীতে পানি থাকলেও এখন আর কোনো মাছ নেই। এসব নদীর পানি ব্যবহার দূরের কথা, রাসায়নিকের প্রভাবে অন্যান্য জলজপ্রাণী এবং উদ্ভিদ নদীতে টিকতে পারছে না।
এগুলো রক্ষায় আইনের অভাব নেই, কিন্তু এর সফল প্রয়োগ দেখা যায় না। আবার অভিন্ন নদীগুলো থেকে একচেটিয়া পানি প্রত্যাহার করছে ভারত। এক ফারাক্কা বাঁধ পরীক্ষামূলক চালু হওয়ার পর সেটি আর বন্ধ হয়নি; বরং নতুন নতুন চ্যানেল করে দেশটি পানি সরিয়ে নিচ্ছে। তিস্তার পানিবণ্টন চুক্তি নিয়ে শুধু আলোচনা আছে। এখন সেই আলোচনাও সম্ভবত আর টেবিলে নেই। সরকারি হিসাবে নদ-নদীর সংখ্যা ৭০০ থেকে কমে এখন ৪০০ হয়েছে। বেসরকারি হিসাবে নদী দেড় সহস্রাধিক ছিল, এখন ২৫০-এর মতো হয়েছে। দেশের আনাচে-কানাচে থাকা ৫৫০টি নদী বিলীন হয়ে গেছে। প্রধান নদীর মধ্যে ৫৯টি আন্তর্জাতিক। এগুলোর মধ্যে আবার ৫৪টি ভারত হয়ে বাংলাদেশে প্রবেশ করেছে। নদী-নদীর অবস্থা কেমন সেটি নৌপথের বর্তমান অবস্থা থেকে অনুমান করা যায়। স্বাধীনতার পরপর বিআইডব্লিউটিএর এক জরিপ অনুযায়ী, দেশের নদীপথের দৈর্ঘ্য ছিল ২৪ হাজার কিলোমিটার। এখন কমে দাঁড়িয়েছে মাত্র সাত হাজার কিলোমিটার। অর্থাৎ ৭০ শতাংশের বেশি সঙ্কুচিত হয়েছে নদীপথ। পরিবেশবাদীদের হিসাবে, গত চার দশকে ৫০ থেকে ৮০টি নদী, শাখা ও উপনদী বিলীন হয়ে গেছে। এর প্রভাব সরাসরি নদীর পাড়ের জনবসতিতে পড়েছে। এর ওপর নির্ভরশীল জেলে ও কৃষকরা হয়েছে বিপন্ন। মানুষ বঞ্চিত সুস্বাদু মিঠা পানির মাছ থেকে। সেচের জন্য ভূগর্ভস্থ পানির ওপর নির্ভরতা বাড়াতে হচ্ছে। যা প্রাকৃতিক ভারসাম্য বিনষ্ট করছে। এভাবে নদী ধ্বংস করে দেয়ার মূল উৎসগুলো চিহ্নিত করে তা মোকাবেলার কার্যকর কোনো উদ্যোগ দেখা যাচ্ছে না। দখল ও দূষণ রোধে সামান্য কিছু প্রশাসনিক উদ্যোগ বিচ্ছিন্নভাবে দেখা যায়। অন্যদিকে আন্তর্জাতিক নদীর পানি হিস্যা আদায়ে সরকারের কোনো জোরালো উদ্যোগ বিগত এক যুগে দেখা যায়নি। এ অবস্থায় আমরা দেখছি, যমুনা নদী ছোট করার মতো উদ্ভট উদ্যোগ। মন্ত্রণালয়ের এক শ্রেণীর কর্মকর্তা বিপুল অর্থের এ প্রকল্প নিয়ে খুব উৎসাহী। তারা নদীটির প্রশস্ততা অর্ধেক কমিয়ে দিতে চায়। অথচ সরকার আন্তরিক হলে নদীর জীবন রক্ষায় এগিয়ে আসতে পারে, যা আমাদের প্রাণ ও পরিবেশ রক্ষায় কার্যকর হতে পারে। স্থানীয় জনপ্রতিনিধিদের নিজ নিজ এলাকার নদী রক্ষার দায়িত্ব বুঝে নিলে ওই এলাকার নদী দখল-দূষণ আর ভরাট করতে কেউ সাহস পাবে না। এছাড়া কোন প্রভাবশালী ব্যক্তি ক্ষমতার প্রভাব দেখিয়ে আর নদী দখল করতে পারবে না। সর্বোপরি, নদীর দখল-দূষণ রোধে ‘জিরো টলারেন্স’ নীতি গ্রহণ করতে হবে। ফলে নদী বাঁচবে, মানুষ বাঁচবে। প্রকৃতি বাঁচবে, বাঁচবে আমাদের পরিবেশও।
লেখক: গবেষক-কলামিস্ট।
বিভাগ : সম্পাদকীয়
মন্তব্য করুন
আরও পড়ুন
বাংলাদেশের বিপক্ষে যে একাদশ দিয়ে মাঠে নামছে ওয়েস্ট ইন্ডিজ
কিশোরগঞ্জের আওয়ামী লীগ নেতা আনোয়ার কামালসহ তিনজন গ্রেফতার
প্রেসিডেন্টের সঙ্গে তিন বাহিনীর প্রধানের সাক্ষাৎ
বেইজিং সংস্কৃতি ও পর্যটন ব্যুরো ও আটাবের মধ্যে চুক্তি স্বাক্ষরিত
উইন্ডিজের বিপক্ষে মাঠে নামছে বাংলাদেশ
গাজায় যুদ্ধবিরতি ছাড়া বন্দী বিনিময় হবে না : হামাস
শান্তিরক্ষা মিশন মোতায়েন করতে চায় জাতিসংঘ হাইতিতে
চকরিয়ার বিএনপি নেতা আবু তাহের চৌধুরীর মৃত্যুতে সালাহউদ্দিন আহমদ ও হাসিনা আহমদের শোক
পুতিন পারমাণবিক অস্ত্র ব্যবহার করতে দ্বিধা করবেন না : সার্বিয়া
ক্লাইমেট অর্থায়ন ইস্যুতে দেশগুলোর মধ্যে দ্বন্দ্ব
লালমোহনে দুই গ্রুপের সংঘর্ষে আহত যুবদল নেতা চিকিৎসাধীন অবস্থায় মৃত্যু
ট্রাম্পের অ্যাটর্নির বিরুদ্ধে তদন্ত প্রতিবেদন আটকে গেল
‘ফিলিস্তিনের পর ইরান, সউদী ও তুরস্ক হবে পরবর্তী টার্গেট’
প্রতি বছর ৩ লাখ নথিবিহীন অভিবাসীকে বৈধতা দানের ঘোষণা স্পেনের
প্রেম-ভালোবাসা নিয়ে সবচেয়ে অসুখী দেশ জাপান-কোরিয়া
মুসলিম চিকিৎসক
শীর্ষে দিল্লি
সৈয়দ মোসাদ্দেক বিল্লাহ আল মাদানীকে জমিয়াতুল মোদার্রেসীন ও দারুননাজাত মাদরাসা’র সংবর্ধনা
ইসলামিক ফাউন্ডেশন এর বোর্ড অব গভর্নর সৈয়দ মোসাদ্দেক বিল্লাহ আল মাদানীকে জমিয়াতুল মোদার্রেসীন ও দারুননাজাত মাদরাসা’র সম্বর্ধনা
বাংলাদেশ, নেপাল ও ভুটানের মধ্যে আঞ্চলিক সহযোগিতার আহ্বান