বিনিয়োগের বাধা দূর করতে হবে
২৭ জুন ২০২৪, ১২:০১ এএম | আপডেট: ২৭ জুন ২০২৪, ১২:০১ এএম
দেশের বিনিয়োগের অবস্থা ভালো নয়। বিদেশি সরাসরি তথা এফডিআই কমেছে। দেশীয় বেসরকারি বিনিয়োগও কম। দেশের ব্যবসায়ীদের অধিকাংশের মানসিকতা হচ্ছে, নিজস্ব উৎপাদন নয়, বিদেশি পণ্য কেনা-বেচা ও অধিক মুনাফা করা। ফলে আমদানিনির্ভর দেশ থেকে উত্তরণ ঘটছে না বাংলাদেশের। তাই জিনিসের দাম বেশি হচ্ছে বিশ্বের বেশিরভাগ দেশের তুলনায়। সরকারি বিনিয়োগ জিডিপির প্রায় ১০%। সেটা শুধুমাত্র অবকাঠামো ভিত্তিক, তাও ঋণে, যার পরিমাণ ব্যাপক। জিডিপির প্রায় অর্ধেক, যা পরিশোধ করা সহজসাধ্য নয়। গত ২০ জুন প্রকাশিত আংকটাডের ‘ওয়ার্ল্ড ইনভেস্টমেন্ট রিপোর্ট-২০২৪’ শীর্ষক প্রতিবেদন মতে, ২০২৩ সালে সারাবিশ্বে এফডিআই পৌনে ২ শতাংশ কমে ১ লাখ ৩৩ হাজার ২০০ কোটি ডলার হয়েছে। আর বাংলাদেশের পৌনে ১৪ শতাংশ কমে হয়েছে ৩০০ কোটি ডলার (একই সময়ে ভারত ২ হাজার ৮১৬ কোটি ডলার ও পাকিস্তান ১৮২ কোটি ডলার এফডিআই পেয়েছে)। ইতোপূর্বে বাংলাদেশে এফডিআই এসেছে ২০২২ সালে ৩৪৮ কোটি ডলার, ২০২১ সালে ২৮৯ কোটি ডলার ও ২০২০ সালে ২৫৮ কোটি ডলার। অর্থাৎ বাংলাদেশে গড়ে এফডিআই প্রাপ্তির পরিমাণ ৩০০ কোটি ডলারের নীচেই থেকেছে! শুধুমাত্র ২০১৮ সালে সর্বোচ্চ ৩৬১ কোটি ডলার এফডিআই এসেছিল, তাও সেটা হয়েছিল একটি তামাক প্রতিষ্ঠান জাপান কিনে নেওয়ার কারণে। যাহোক, ২০২২ সালের তুলনায় ২০২৩ সালে এফডিআই কমেছে বাংলাদেশে! অথচ একই সময়ে এফডিআই এলডিসিভুক্ত দেশগুলোয় ১৭ শতাংশ ও উন্নত দেশগুলোতে ৯ শতাংশ বেড়েছে। তবে উন্নয়নশীল দেশগুলোতে এফডিআই ৭ শতাংশ কমেছে। উক্ত প্রতিবেদনের মুখবন্ধে বলা হয়েছে, এসডিজি লক্ষ্য অর্জন এবং জলবায়ু অর্থায়নের ঘাটতি মেটাতে আন্তর্জাতিকভাবে বছরে প্রায় ৫০০ বিলিয়ন ডলারের সরকারি অর্থায়ন এবং ৫০০ বিলিয়ন ডলারের বেসরকারি অর্থায়ন প্রয়োজন, যার বেশির ভাগই হবে এফডিআই হিসেবে। বিশ্বের বিভিন্ন দেশে অর্থনীতির শ্লথগতি ও ভূরাজনৈতিক অস্থিতিশীলতা বৃদ্ধির কারণে এফডিআই প্রবাহ কিছু কমেছে।
উপরন্তু বাংলাদেশে ২০২৩ সালে এফডিআই স্টকও কমে হয়েছে ২ হাজার ৫৪ কোটি ডলার, যা ২০২২ সালে ছিল ২ হাজার ৭৫ কোটি ডলার। অবশ্য, ২০২৩ সালে বাংলাদেশে বিদেশি বিনিয়োগকারীদের নতুন ৩৪টি প্রকল্পে বিনিয়োগের জন্য ঘোষিত অর্থের পরিমাণ বেড়ে ২৮৯ কোটি ডলার হয়েছে, যা ২০২২ সালে ছিল ৬৫ কোটি ডলার ২২টি প্রকল্পের জন্য। অপরদিকে, ২০২৩ সালে বাংলাদেশের উদ্যোক্তারা বিভিন্ন দেশে বৈধভাবে বিনিয়োগ করেছে ৩৮ কোটি ৫০ লাখ ডলার, যা ২০২২ সাল ৪০ কোটি ডলার ও ২০২১ সালে ৩৯ কোটি ডলার ছিল। অন্যদিকে, দেশে দেশীয় বেসরকারি বিনিয়োগও আশানুরূপ নয়।জিডিপির ২২-২৩% এর মতো চলছে বহু দিন যাবত। অথচ এটা হওয়ার কথা জিডিপির এক তৃতীয়াংশের মতো। অর্থাৎ দেশে বিনিয়োগের অবস্থা আশানুরূপ নয়। উপরন্তু খবরে প্রকাশ, দেশে চলতি ২০২৩-২৪ অর্থবছরের প্রথম আট মাসে দেশি ও বিদেশি বিনিয়োগে ধস নেমেছে। বিনিয়োগকৃত অনেক অর্থ প্রত্যাহার হয়েছে ও হচ্ছে।
বাংলাদেশে বিনিয়োগ করার মতো সুযোগ-সুবিধার অভাব নেই। ১০০টি অর্থনৈতিক অঞ্চল গড়ে তোলার কার্যক্রম চলছে। তন্মধ্যে ১০টি অঞ্চলে উৎপাদন শুরু হয়েছে। এছাড়া, বিসিকের অধীনে ২১টি শিল্প নগর রয়েছে। তাতে ১ হাজার ৯৮টি শিল্প প্লট খালি রয়েছে বহু দিন যাবত। সর্বোপরি ৯২টি আইটি পার্ক গড়ে তোলা হচ্ছে। তন্মধ্যে ৮টির কাজ শেষ হয়ে ব্যবসায়িক কাজ চলছে। বাংলাদেশকে ডিজিটাল কান্ট্রি হিসাবে ঘোষণা করেছে সরকার। তথাপিও বাংলাদেশ ব্যাংকের সাম্প্রতিক তথ্য অনুযায়ী, গত দেড় দশকে দেশের তথ্যপ্রযুক্তি খাতে বিদেশি বিনিয়োগ এসেছে মাত্র ১৮ কোটি ডলার।দেশীয় বিনিয়োগও কম। উপরন্তু সেখানে যেটুকু বিনিয়োগ হয়েছে, তার বেশিরভাগ নন আইটি। অথচ, দেশে বিনিয়োগ বাড়ানোর জন্য দেশ-বিদেশে ব্যাপক ঢাক-ঢোল পিটিয়ে প্রচারণা চালানো এবং বহু দেশে রোড শো করা হচ্ছে দীর্ঘদিন থেকে। উপরন্তু বিনিয়োগের বিভিন্ন ক্ষেত্রে ওয়ান স্টপ সার্ভিস চালু এবং কর রেয়াত প্রদান করা হয়েছে। তবুও দেশে বিনিয়োগের অবস্থা সন্তোষজনক নয়, যা প-িতদের ভাষায় চরম উদ্বেগজনক! স্মরণীয় যে, ইতোপূর্বে অনেক বড় বিনিয়োগের প্রস্তাব ফেরত দেওয়া হয়েছে। প্রস্তাবগুলো অনুমোদন করা হলে দেশের কল্যাণ হতো। উপরন্তু তাদের দেখাদেখি অনেক বড় বড় বিনিয়োগকারী এ দেশে আসতো। তাতে দেশের রফতানি, কর্মসংস্থানে উন্নতি হতো।
প্রসঙ্গত উল্লেখ্য, মহামন্দা ও ভয়াবহ যুদ্ধ সত্ত্বেও বিভিন্ন দেশে বিনিয়োগ বাড়ছে। যেমন: অ্যামাজন গত ১৯ জুন জানিয়েছে, তারা জার্মানিতে আরও ১০ বিলিয়ন ইউরো বা এক লাখ ২৬ হাজার কোটি টাকা বিনিয়োগ করবে। সংস্থাটি বলেছে, ২০১০ সাল থেকে জার্মানিতে এখন পর্যন্ত বিনিয়োগের পরিমাণ প্রায় ৭৭ বিলিয়ন ইউরো হয়েছে। আঙ্কারার সুইস চেম্বার অব কমার্সের চেয়ারম্যান অরপাট সেনোকাক সম্প্রতি জানিয়েছেন, তুরস্কে ১০ বিলিয়ন ডলার বিনিয়োগ করেছে সুইজারল্যান্ডের ৩০০টি কোম্পানি। মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোতেও বিনিয়োগ অনেক বৃদ্ধি পেয়েছে। দেশগুলো তেলনির্ভর অর্থনীতি থেকে বের হওয়ার চেষ্টা করছে, যার অন্যতম হচ্ছে, সৌদি আরবের ৫০ হাজার কোটি ডলার ব্যয়সম্বলিত নিওম প্রকল্প বাস্তবায়ন। আফগানিস্তানের তালেবান সরকারের সাথেও গত বছর খনি চুক্তি হয়েছে ৬.৫ বিলিয়ন ডলারের।
বাংলাদেশে বিনিয়োগের অবস্থা ভালো না হওয়ার কারণ নিয়ে নানা জনের নানা মত রয়েছে। তবে কমন মত হচ্ছে, ব্যাপক দুর্নীতি, আমলাতন্ত্র, চাঁদাবাজি, অর্থ পাচার, বেশিরভাগ কাজে অযথা বিলম্ব, দক্ষ লোকের অভাব, ডলার সংকট, মুদ্রার বিনিময় হারে অস্থিরতা, বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ কমে যাওয়া, আমদানি নিয়ন্ত্রণ, জ্বালানি সংকট, পুঁজি বাজার দুর্বল, বিনিয়োগের ক্ষেত্রে নেতিবাচক মনোভাব ইত্যাদি বাংলাদেশে বিনিয়োগের প্রধান অন্তরায়। যুক্তরাষ্ট্র বাংলাদেশে বিনিয়োগে বাধা হিসেবে ঘুষ, দুর্নীতি, অস্বচ্ছতাকে চিহ্নিত করেছে (গত ২৯ মার্চ ’২৪ প্রকাশিত মার্কিন বাণিজ্য প্রতিনিধির দপ্তরের প্রতিবেদন)। তাই বৈশ্বিক ব্যবসা সহজীকরণ সূচকে বাংলাদেশের অবস্থান তলানিতে থাকছে দীর্ঘদিন থেকে (১৯০টি দেশের মধ্যে ১৭৬তম)। কোনো উন্নতি হচ্ছে না। সম্প্রাতি প্রকাশিত পলিসি এক্সচেঞ্জের গবেষণা প্রতিবেদন মতে, বাংলাদেশে ২০২২-২৩ অর্থবছরের তুলনায় ২০২৩-২৪ অর্থবছরে ব্যবসার পরিবেশের অবনতি ঘটেছে। স্মরণীয় যে, বিনিয়োগ কেন, দেশের সাধারণ কাজও সময় মতো হয় না। বিশেষ করে, সরকারি অফিসে। সরকারের বেশিরভাগ জনবলের মানসিকতা হচ্ছে, মাস গেলেই বেতন। তাই ঝামেলার দরকার কী? সরকারি ব্যাংকের অবস্থাও তথৈবচ। পুরাতন একাউন্টধারীদেরও নতুন চেক বই নিতে প্রায় দুই মাস সময় লাগে। টাকা তুলতেও অনেক সময় লাগে। আর নতুন একাউন্ট খোলা এবং ঋণ নেওয়ার ঝামেলা ও বিলম্ব মঙ্গলে যাওয়ার মতো কঠিন। উপরন্তু সরকারি কর্মচারীদেরও অবসর নেওয়ার পর পাওনাদি পেতে অনেক বিলম্ব হয়। কিছু অর্থও ব্যয় করতে হয়। কোথাও জবাবদিহি না থাকায় এই দৈনদশা সৃষ্টি হয়েছে! তাতে দেশের উন্নতির ব্যাপক ক্ষতি হচ্ছে!
দেশের চরম বেকারত্ব দূর, রফতানি বৃদ্ধি, অভ্যন্তরীণ চাহিদা পূরণ এবং সার্বিক উন্নতি বৃদ্ধি ও টেকসই করার জন বিনিয়োগ বাড়াতে হবে আশানুরূপভাবে। সে লক্ষ্যে দেশের স্বাধীনতা, আইন এবং পরিবেশ রক্ষা করে যে বা যারা বিনিয়োগের যে প্রস্তাব দেবে তা অনুমোদন করতে হবে। মনে রাখতে হবে যে, পরিবেশ সুরক্ষা না করে বিনিয়োগ হলে তা উপকারের চেয়ে ক্ষতিই বেশি হয়। উপরন্তু বিনিয়োগের সব বাধা। বিশেষ করে দুর্নীতি, চাঁদাবাজি, অর্থ পাচার ও বিলম্ব ইত্যাদি দূর করতে হবে। এসব ক্ষেত্রে কঠোর জবাবদিহি প্রতিষ্ঠা করতে হবে। জ্বালানি সংকট দূর করতে হবে। সর্বোপরি ব্যাপক সংখ্যক দক্ষ লোক গড়ে তুলতে হবে। সে জন্য কারিগরি, বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি এবং ইংরেজি শিক্ষা এবং এসবের মানোন্নয়নের দিকে সর্বাধিক গুরুত্ব দিতে হবে। সব কাজ নির্ধারিত সময়ে, মানে ও অর্থে সম্পন্ন করার ব্যবস্থা করতে হবে। প্রয়োজন মতো প্রযুক্তি ব্যবহার করতে হবে সর্বত্রই। দেশে ব্যবসাবান্ধব পরিবেশ সৃষ্টি করতে হবে যথা শিগগির। অবকাঠামো নির্মাণ, খনিজ ও সামুদ্রিক সম্পদ আহরণ, আইটি খাত, ৫জি চালু, কৃষিভিত্তিক ও শ্রমঘন শিল্প প্রতিষ্ঠা ইত্যাদিতে জোর দিতে হবে। এসব ক্ষেত্রে বেসরকারি বিনিয়োগ কাক্সিক্ষতভাবে না হলে সরকারিভাবেই করতে হবে। বর্তমানে ব্যাপকভাবে হালাল অর্থনীতির বাজার সম্প্রসারিত হচ্ছে। আগামী বছর ৭ লাখ ৭০ হাজার কোটি ডলারে পৌঁছাবে, যা ২০১৫ সালে ছিল ৩ লাখ ২০ হাজার কোটি ডলার। বাংলাদেশ হালাল পণ্যের আদর্শ স্থান।তাই এই খাতে ব্যাপক বিনিয়োগ হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে।
লেখক: সাংবাদিক ও কলামিস্ট।
[email protected]
বিভাগ : সম্পাদকীয়
মন্তব্য করুন
আরও পড়ুন
মোরেলগঞ্জে গৃহবধূর ঝুলন্ত মরদেহ উদ্ধার স্বামী আটক।
দেশনেত্রী খালেদাকে মুক্তি দিন অন্যথায় যেকোনো পরিণতির জন্য তৈরি থাকুন : ফখরুল
কেমন হবে ফাইনালের পিচ
বিএনপিতে এখন আতঙ্কের নাম তারেক রহমান : ওবায়দুল কাদের
মাদারীপুরে লোডশেডিংয়ে ভোগান্তি চরম
৭৫ বছরে আওয়ামী লীগ সবসময় অগণতান্ত্রিক ও অপশক্তির বিরুদ্ধে দাঁড়িয়েছে : পররাষ্ট্রমন্ত্রী
এফবিসিসিআই’র স্ট্যান্ডিং কমিটির সভা নিত্যপণ্যের দাম নাগালে রাখতে সাপ্লাই-চেইন স্থিতিশীল রাখার আহ্বান
শুল্ক রেয়াত কর্মকর্তা তাজুলের বিরুদ্ধে দুর্নীতির অভিযোগ
সরকার দেশের স্বার্থ জলাঞ্জলি দিয়ে ভারতের স্বার্থ রক্ষায় মরিয়া পীর সাহেব চরমোনাই
‘আশা করি, তারা এবার চোক করবে না'
নির্বাচন জায়েজ করতে শেখ হাসিনা দেশবিরোধী চুক্তি করেছেন : রিজভী
কুষ্টিয়ায় পাহারাদারকে আগুনে পুড়িয়ে হত্যা
অ্যান্টার্কটিকার বৃহত্তম হিমবাহ সরে যাচ্ছে
স্লোভাকিয়ার বিপক্ষে স্বরূপে ফেরার অপেক্ষায় ইংল্যান্ড
নোয়াখালীর হাতিয়ায় মসজিদের পুকুরে ধরা পড়ল ১০ ইলিশ!
স্পেনের সামনে চমক দেখানো জর্জিয়া
ভোটে জেতার প্রতিশ্রুতি বাইডেনের
শিক্ষকতা শুধু চাকরি নয়, এতে অনেক দায়িত্ব-কর্তব্য রয়েছে: ডিএমপি কমিশনার
খালেদা জিয়াকে মুক্ত করতে না পারলে বাংলাদেশ মানচিত্র থেকে মুছে যাবে : গয়েশ্বর
রাজশাহীতে অবশেষে স্বস্তির বৃষ্টি