আল্লামা ইকবাল দর্শনে মানবতা

Daily Inqilab প্রফেসর ড. শমশের আলী

২৯ জুন ২০২৪, ১২:০৪ এএম | আপডেট: ২৯ জুন ২০২৪, ১২:০৪ এএম

 

আল্লামা ইকবালের মৃত্যুবার্ষিকী উপলক্ষে প্রেস ক্লাবে যে অনুষ্ঠান হচ্ছে সেই অনুষ্ঠানে আমার যাবার কথা ছিল। কিন্তু, দুর্ভাগ্য। আমি হঠাৎ অসুস্থ হয়ে পড়ি। এজন্য আমি যেতে পারলাম না। স্বভাবতই আমি খুব দুঃখিত। তবে আমি আজকে দু একটা কথা বলতে চাই, যা ইকবাল সম্পর্কে এদেশের মানুষকে কোনো সময় বলতে শুনিনি। সেই ঘটনাটা হচ্ছে এরকম, আজ থেকে অনেক বছর আগে বাংলাদেশে হাকিম সাঈদ সাহেব এসেছিলেন। হাকিম সাঈদ হচ্ছেন হামদর্দের প্রতিষ্ঠাতা। একজন হিউম্যানিস্ট, জনদরদী। হামদর্দ বাংলাদেশেও আছে। বাংলাদেশ হামদর্দ এই অনুষ্ঠানটার আয়োজন করেছিলো ইকবালের উপর। আমাকে সেখানে ডাকা হয়েছিল। আমি হাকিম সাঈদকে জীবনে প্রথম দেখলাম। উনিও আমাকে প্রথম দেখলেন। নাম শুনেছিলেন হয়তো। আমিও তার নাম শুনেছি। আমাকে বলতে বললেন। আমি একটা বিষয় বললাম। এই যে বইটা ইকবাল লিখলেন, জবপড়হংঃৎঁপঃরড়হ ড়ভ জবষরমরড়ঁং ঞযড়ঁমযঃ রহ ওংষধস. এর অনুপ্রেরণাটা তিনি কোথা থেকে পেলেন?

এ প্রসঙ্গে বলতে গিয়েই আমি বললাম, এক্ষেত্রে একটা প্রসঙ্গ জানা দরকার। উনি ইউরোপে গেলেন। সে সময়টার মধ্যে উনি জার্মানিতে পিএইচডি করলেন। এরপর ইংল্যান্ডে আইনশাস্ত্র পড়লেন। আরেকটি বিষয় হলো, তিনি আর্নল্ড, যিনি লিগ্যাসি অফ ইসলাম লিখেছিলেন, তার প্রিয় ছিলেন। এই আর্নল্ড গভর্মেন্ট কলেজ অফ লাহোরে এসে লেকচার দিয়েছিলেন। তিনি ইকবালকে সব সময় বলতেন, তুমি ইউরোপে যাও। পড়াশোনা করো।

এখন অধিকাংশ লোক বুঝতে পারে না যে, ইউরোপে যাওয়ার পরে ইকবালের সত্তায় কী পরিবর্তন আসলো? আমি বললাম, এই পরিবর্তনটা যে এসেছিল, এটা অন্য কোনো কারণে নয়। এর প্রসঙ্গটা হচ্ছে এ রকম: ১৯০৫ সালে উনি যখন ইউরোপে পৌঁছালেন, তখন আইনস্টাইনের স্পেশাল থিওরি অফ রিলেটিভিটি অলরেডি পাবলিশড হয়ে গেছে, যে, সময় এবং স্থান আলাদা নয়। সময় হচ্ছে ঘটনার তিনটা স্থানাঙ্ক এবং একটা সময়াঙ্ক। সময় একটা আলাদা কো-অর্ডিনেইট। এই স্পেশাল থিওরি অফ রিলেটিভিটির ফলাফল হলো ঊ=সপ২। যার প্রমাণ তখনও হয়নি। কিন্তু অনেকদিন পরে মানুষ এটার প্রত্যক্ষ প্রমাণ পেয়েছে।

বলেছিলাম, উনি ইউরোপে যখন পৌঁছালেন, দেখলেন, সমস্ত ইউরোপ এই রিলেটিভিটি ফিভারে আক্রান্ত। যেখানেই যাচ্ছেন, দেখছেন, মানুষ এই রিলেটিভিটি থিওরি নিয়ে আলোচনা করছে। উনি তখন ভাবলেন রিলেটিভিটি জিনিসটা কী? যা হোক, যতটা পারলেন উনি জানলেন। তখন মনে হলো, ইউরোপের মানুষ এই যে নতুন বিজ্ঞানের চিন্তা, ধ্যান-ধারণায় এত আপ্লুত, অথচ আমরা ইসলামের লোকেরা আমাদের কোরআনে বিজ্ঞানসংক্রান্ত যে জিনিস আছে, সেই জিনিস নিয়ে তো কোনো সময় চিন্তা করি না।

এই কথা যখন তার মনে আসলো, তখন ভাবলেন, আমাদের ধর্মটাকে নিয়ে কী করছি! ইসলাম ধর্মের পটেনশিয়াল, যে সম্ভাবনা, প্রত্যেক মানুষের মধ্যে আল্লাহ তা’য়ালা দিয়েছেন তা হচ্ছে অপার সম্ভাবনা। মানুষকে সৃষ্টি করা হয়েছিল খলিফা হিসেবে। কিন্তু, সেই মানুষ নিজেকে পরিপূর্ণভাবে প্রতিষ্ঠিত করতে পারেনি। অন্যান্য জীবজন্তু যেভাবে পৃথিবীতে বেঁচে আছে, দেখা গেলো, একটা সময় ঠিক সেই জীবজন্তুর মতো আমরাও খাচ্ছি, ঘুরছি, ফিরছি। কিন্তু এই ইউরোপে জ্ঞানের মাধ্যমে মানুষের কল্যাণ এবং এই যে জ্ঞানমুখী চিন্তা এটা ইসলামের, এটা উনি বুঝতে পারলেন। তখন তিনি মুসলমানদের উপর একটা ক্ষোভ প্রকাশ করলেন। কিন্তু তাকে ভুল বুঝলে চলবে না। তিনি শেকায়েত (কমপ্লেইন) করেছেন। আবার জবাবও তিনি নিজেই দিয়েছেন। সুতরাং এটা বুঝতে হবে, উনার চিন্তা ছিল, মানুষের ভেতরে যে অপার সম্ভাবনাগুলো দেয়া হয়েছে, সেই সম্ভাবনাগুলোকে আমাদের জাগিয়ে তুলতে হবে। এই যে আগে বললাম, রিলেটিভিটি ফিভারে সবাইকে দেখলেন আক্রান্ত হয়ে গেছে। সবাই রিলেটিভিটি নিয়ে আলোচনা করছে। এই জিনিসটা উনি যেইমাত্র টের পেলেন, তখন উনার লেখনিতে অন্য ধরনের চিন্তা দেখা দিল।

এই কথাটা আমি যখন ওখানে সভায় বললাম, হাকিম সাঈদ সাহেব আমাকে এসে বললেন, আপনি এতদিন কোথায় ছিলেন? আমি বললাম, আমি তো বাংলাদেশেই ছিলাম। ইংল্যান্ডে চার বছর ছিলাম। ইতালিতে দু’বছর ছিলাম। ইউরোপ-আমেরিকাতেও অনেক কাজ করেছি। দেশের মধ্যেই এখন আছি, এই আর কি! উনি বললেন, না, আপনার সঙ্গে আমার দেখা হলো না কেন? আজকে আপনার থেকে একটা নতুন কথা শুনলাম। এরপর হাকিম সাঈদ নিজের দেশ পাকিস্তানে গিয়ে হামদর্দের সমস্ত গবেষণা আমাকে পাঠাতে শুরু করলেন। এরপর একদিন শুনলাম, কোনো এক আততায়ী এই জনদরদী লোকটাকে হত্যা করেছে।

মূল বিষয় হচ্ছে, এই যে হাকিম সাঈদ, উনি মানুষের কল্যাণে একটা প্রতিষ্ঠান গড়ে তুলেছিলেন। এটাই হচ্ছে হিউম্যান ওয়েলফেয়ার। ইকবালেরও এই ম্যান এম্পিসিস ছিলো। মানবকল্যাণ করতে হলে তো জ্ঞান দরকার। মানবকল্যাণ করতে হলে আরেকটা জিনিস দরকার। সাম্যবাদের প্রতিষ্ঠা না হলে মানবকল্যাণ সম্পাদিত হয় না। আমি এ প্রসঙ্গে বলি যে, আল্লামা ইকবালের মধ্যে মাঝেমাঝে কেউ টের পান যে, একটা কমিউনিস্ট ভাবধারা তার মধ্যে আছে। কমিউনিস্ট ভাবধারার কিন্তু এটাই আসল কথা।

আমি এ প্রসঙ্গে ছোট্ট একটা গল্পের কথা বলি। সেই গল্পটা হচ্ছে এই:
‘রাশিয়া এন্ড দি ইসলামিক ওয়ার্ল্ড’ নামে একটা অনুষ্ঠান রাশিয়াতে অনুষ্ঠিত হয়। এটা হলো তখন, যখন রাশিয়া ভেঙে গেল পেরেস্ত্রোইকা এবং গ্লাস্তনস্তের কথায়, ‘কোনো বুলেট বা যুদ্ধ ছাড়াই যখন সব ভাঙ্গাভাঙ্গি হয়ে গেল’, ঠিক সে সময়টাতেই আমাকে ডাকা হলো। আমি রাশিয়াতে অনেকবার গেছি। কিন্তু এবার গেলাম ‘রাশিয়া এন্ড দি ইসলামিক ওয়ার্ল্ড’ অনুষ্ঠানে। ওখানে গিয়ে দেখলাম প্রিম্যাকভকে। তিনি একসময় রাশিয়ার প্রধানমন্ত্রী ছিলেন। এরপর দেখলাম, আলেকজান্ডার পপঅপকে। উনি চমৎকার আরবী বলেন। যখন অনুষ্ঠান শুরু হলো, আমি নতুন গিয়েছি, তখন আমাকে বলা হলো, তুমি কিছু বলো।

আমি বললাম, আমাদের যে দুরবস্থা এই দুরবস্থার জন্য তোমরা দায়ী। তখন উনারা নড়েচড়ে বসলেন। বললেন, হাও? হোয়াই ডু ইউ সে দ্যাট? আমি বললাম, তোমরা মানবজাতিকে এক ধরনের ভাগ করেছিলে। সেটা হলো, লেফটিস্ট এন্ড রাইটিস্ট। রাইটিস্ট বলতে তোমরা বোঝাও এমন মানুষকে যে খুব কনজারভেটিভ, কিছুতেই নতুন আইডিয়াকে সে নিতে চায় না। সে ব্যাকওয়ার্ড লুকিং, শুধু পশ্চাৎমুখিতা আছে। সে নন-প্রোগ্রেসিভ। সে নতুন চিন্তাধারার মধ্যে আসে না। এই ধরনের একটা ইমেজ ইসলাম ধর্মেরও তোমরা করে দিয়েছো। আর তোমাদের জন্য একটা কনসেপ্ট রেখে দিয়েছ, সেটা হচ্ছে ফরোয়ার্ড লুকিং, হিউম্যানিস্টিক। অর্থাৎ সবকিছুতে নতুন দৃষ্টিভঙ্গি, সামনে এগোবার কথা, প্রোগ্রেসিভনেস আছে, এইসব জিনিস তোমরা তোমাদের জন্য রেখে দিয়েছিলে। তোমরা তোমাদেরকে বলতে লেফটিস্ট। তোমরা অক্টোবর রেভ্যুলেশন করেছিলে। এই রেভ্যুলেশনটা না হলে অনেক লোক মারা যেতো। খাদ্যের অভাবে, অন্যান্য কারণে। সেজন্য তোমরা ধন্যবাদ পাও। কিন্তু তোমরা একটা কাজ করলে। তোমরা চার্চকে বন্ধ করে দিলে। আমি এই রোববার এসে দেখলাম, ক্রেমলিন, তোমাদের রাজধানীটা, সারাউন্ডেড বাই চার্চেস। আমাদের বাংলাদেশের সেক্রেটারিয়েট তো সারাউন্ডেড বাই অনলি ওয়ান মস্ক। কিন্তু এখানে ক্রেমলিনে যে চার্চগুলো আছে, এই চার্চগুলোকে তোমরা নন-ফাংশানাল করে রেখেছিলে। চার্চ তো তোমাদের ছিল। তোমাদের কমিউনিস্টিক আইডিয়ার উপরে এই চার্চগুলোকে নন-ফাংশনাল করে রেখেছিলে। কিন্তু আমি তো এখন এসে দেখলাম, এই চার্চগুলো আবার ফাংশনাল হয়ে গেছে। আমি দেখলাম, মানুষ রোববারে আবার চার্চে আসছে। তাহলে তোমরা এখন ফিরে এসেছো। এখন দেখা যাচ্ছে, ডান আর বাম-এর মধ্যে তোমরা যে বিভেদ আগে করেছিলে, এই বিভেদটা নিরর্থক।

তোমরা কি জানো যে, ইসলাম ধর্মে বলা হচ্ছে, ‘সম্পদ যেন ধনীদের মধ্যে আবর্তিত না হয়’। এটার মধ্যে কি একটা মার্কসিয়ান ফিলিংস নেই? আমাদের কোরআনে বর্ণিত আছে, ‘তোমার সম্পদে অন্যের অধিকার আছে’। এটার মধ্যেও কি একটা মার্কসিয়ান ফিলিংস নেই? আবার বললাম, আমাদের নবী যে বলেছেন, ‘শ্রমিকের ঘাম শুকাবার আগেই তার পারিশ্রমিক দিয়ে দাও’ মার্ক্সিস্ট ফিলোসফির এটাও কি একটা গুরুত্বপূর্ণ বৈশিষ্ট্য নয়? তাহলে এটা বুঝো যে, আমাদের কোনো মুসলমান যদি সারা জিন্দেগি খালি মসজিদে কাটায়, সে যদি মানুষের ভালো-মন্দের দিকে না তাকায়, সে আল্লাহর খলিফা হিসাবে, লিগ্যাল জাস্টিস, সোশ্যাল জাস্টিস এবং ইকোনমিক জাস্টিস যদি না ঘটায়, তাহলে তাকে মৌলিক অর্থে মুসলিম বলা যাবে না। তাহলে তোমরা এখন বুঝতে পারছ, ইসলামের যেই ফিলোসফি সেটাই হচ্ছে তোমাদের ফিলোসফি। শুধুমাত্র তোমাদের ফেইথটা প্রকাশ্য হতে হবে। ফেইথ এবং ইসলাম + কম্যুনিস্ট ফিলোসফিÑ ইজ দা নেয়ারেস্ট এপ্রক্সিমেশন অফ ইসলাম। এক আল্লাহর উপর বিশ্বাস এবং হিউম্যান ওয়েলফেয়ারের কথা চিন্তা করা, এটা হচ্ছে ইসলামের সবচাইতে বড় কনসার্ন। কুরআনে আছে, তারাই বেহেশতে যাবে, যারা ঈমান এনেছে এবং মানুষের জন্য ভালো কাজ করেছে, তাছাড়া আর কেউ যেতে পারবে না জান্নাতে। পরিষ্কার করে আমাদের কুরআনে এসব লেখা আছে। তোমরা তো আমাদের কুরআনের অনেকটা অংশ করছ। মানুষের কল্যাণের জন্য করছো, সবাইকে সাম্যবাদের কথা বলছ, কিন্তু বিশ্বাস অবশ্যই গুরুত্বপূর্ণ।

আমি সারাংশ করলাম এইভাবে: বিশ্বাস এবং মানবতা, এই দুটো যদি একসাথে করা যায়, তাহলে ইসলামের অনেক কাছাকাছি আসা যায়। এই কথা বলার পর চারপাশে তাকিয়ে দেখি তোলপাড় সৃষ্টি হয়েছে। রেডিওর মাধ্যমে পৌঁছে মস্কোসহ অন্যান্য জায়গায়ও তোলপাড় শুরু হলো। আমি ফিরে আসার পর রাশিয়ান এম্বাসি আমাকে বলে, তুমি কী করেছিলে? আমি বলি, কী করেছি? বলে, না, তোমার কথাতে আমরা নতুন জিনিস পেলাম। আমাদের দেশের কম্যুনিস্টরা এই জিনিসটা কোনো সময় বুঝল না। কম্যুনিজমে বিশ্বাস একটা টার্ম। কম্যুনিজমের সাথে আল্লাহর উপর বিশ্বাস যুক্ত হলে তা ইসলামের খুব কাছাকাছি একটা বিষয়। আমাদের দেশের যারা লেফটিস্ট ফিলোসফি চর্চা করে তারা এটা কোনো সময় বুঝতে চায় না।

আমি আজ এখানে এসব কথা বলতে গেলাম কেন? ইকবালের মৃত্যু উপলক্ষে আয়োজিত অনুষ্ঠানে তার সম্পর্কে অল্পকিছু বলেই আমি এসব বলতে গেলাম কেন? এর কারণ অত্যন্ত সহজ। ইকবাল মানবতায় বিশ্বাসী ছিলেন। তিনি যখন বলেন, যেই ক্ষেতের ফসল দিয়ে মানুষের উদরপূর্তি হয় না, সেই ক্ষেতের ফসল তুমি জ্বালিয়ে দাও। এর চাইতে বড় রেভ্যুলেশনারি কথা আর কী হতে পারে? বামপন্থীরা হয়তো এই কথার প্রতি খুব আকৃষ্ট হতে পারে। কিন্তু তারা ভুলে যায় যে, ইকবালের এই যে দর্শন, সাম্যবাদের দর্শন, যে জাস্টিস, লিগ্যাল জাস্টিস, সোশ্যাল জাস্টিস, ইকোনমিক জাস্টিসÑ যদি একটা দেশে না থাকে, তাহলে সেই দেশে মানুষ যতই নামাজ-কালাম করুক না কেন, বলা যেতে পারে না তারা মুসলিম। আমাদের দেশে সেই জিনিসটাই ঘটেছে। ইকবাল, যখন ইউরোপে গেলেন তখন এক নতুন জ্ঞানের উন্নতি হচ্ছে, সেটা উনি দিব্য চোখে দেখলেন। যে কয়েক বছর ছিলেন তখন বিজ্ঞান চেতনা দেখলেন। দেখলেন, মানুষের জন্য মানুষের কনসার্ন, অন্তত সামাজিক পর্যায়ে। আর ফিরে এসে যেসব কথা লিখলেন, তাতে সেসব কথা বলা হচ্ছিল, যা পড়ে অনেক লেফটিস্ট অনুপ্রাণিত হয়েছিল।

কিন্তু, উনি আল্লাহতে গভীরভাবে বিশ্বাসী ছিলেন। উনার মধ্যে এক ধরনের সুফিজম ছিল। সময়ের স্বল্পতার জন্য আর কিছু না বলে আমি শুধু এই দুটো জিনিসের দিকে নজর দিলাম। ইকবালের মননে আচ্ছা ধাক্কা দিয়েছিল দুটি বিষয়। প্রথমে চিন্তা হচ্ছে বিজ্ঞানের এবং দ্বিতীয়ত তিনি চিন্তা করলেন, প্রত্যেকটা মানুষকে আল্লাহ তা’আলা অপার সম্ভাবনা দিয়ে সৃষ্টি করেছেন, যা এখন মুসলমানরা জাগাতে পারছে না। অতীতে তারা জাগিয়েছিল। এখন জাগাতে পারছে না। এরপর যেই সাম্যবাদের প্রতিষ্ঠা ছিল সেই সাম্যবাদও নষ্ট হয়ে গেছে। এই দুটো জিনিস ইকবালের মননে গভীরভাবে নাড়া দিয়েছিল। সেই কারণেই উনি বলেছিলেন ওই কথা, যে ক্ষেতের ফসল দিয়ে মানুষের উদরপূর্তি হয় না, সেই ক্ষেতের ফসল তুমি জ্বালিয়ে দাও। এই যে রেভ্যুলেশনারি কথাবার্তা এর মূল কথাটা হলো, আল্লাহ মানুষকে যে অসাধারণ প্রতিভা বা পটেনশিয়ালিটি দিয়েছেন সেটা মুসলমানরা ইউরোপ-স্পেনে গিয়ে জাগিয়ে ছিল বলেই রেনেসাঁ তথা নতুন নবজাগরণ হয়েছিল, সেটাই উনার মনে দারুণভাবে ধাক্কা দিয়েছিল এবং উনার মনে হয়েছিল, আবার আমাদের জেগে উঠতে হবে।

এই বিখ্যাত পলিম্যাথ, যিনি আইন, দর্শন, সাম্যবাদ, কবিতা এবং সুফিজম নানান গুণের অধিকারী হয়ে পৃথিবীতে এক অনন্য স্থাপনা গড়ে গেছেন। দুঃখজনকভাবে আমাদের দেশের লোকেরা এটা জানে না। আমি বলতে বাধ্য হচ্ছি, ভারতবর্ষে, আমাদের পার্শ্ববর্তী দেশে ইকবালের উপরে যে শ্রদ্ধাবোধ, সেটা আমাদের চাইতে অনেক বেশি। পশ্চিমবঙ্গে মমতা বন্দোপাধ্যায় ইকবালের নাতিকে ডেকেছিলেন। উনি আসার পর তাকে একটা সম্মাননা দেয়া হলো। আপনারা সবাই জানেন, তাদের জাতীয় সংগীত রবি ঠাকুরের ঠিকই, কিন্তু স্বাধীনতা এবং অন্যান্য অনুষ্ঠান উপলক্ষে যখন প্যারেড হয়, তখন ইকবালের কতগুলো নির্বাচিত স্তুতি ওরা সংগীতে বাজায়। যেমন, সারে জাহাঁ সে আচ্ছে, হিন্দুস্তা হামারা। এই কথাগুলো ভারতীয়রা মনে রেখেছে এবং সশস্ত্র বাহিনীর সেকেন্ড এন্থেম হিসাবে গ্রহণ করেছে। মমতা ব্যানার্জী আরেকটা কথা বলেছেন, ইকবালের একটা জসনে জুলুস কেন হয় না?

আলীয়া ইউনিভার্সিটি যখন হলো তখন তিনি এসে বললেন, উর্দু ডিপার্টমেন্টে একটা ইকবাল চেয়ার করা হোক। ওখানকার লোকেরা বলল, আলিয়া ইউনিভার্সিটিতে তো উর্দু ডিপার্টমেন্ট নেই। উনি সাথে সাথে ঘোষণা করলেন, আলিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ে একটা উর্দু বিভাগ থাকবে এবং সেখানে ইকবাল চেয়ার হবে। এটা শুনে ইকবালের নাতি মুগ্ধ হয়ে বললেন, আমরা দুই দেশের লোক হয়েও, আমাদের মাঝে নানারকম মতভেদ থাকা সত্ত্বেও, আমি এখানে এসে আপ্লুত হয়ে গেছি। আমার দাদার প্রতি অনুভূতি দেখে তাতে আমি খুবই আপ্লুত।

ইকবাল যখন হোমল্যান্ডের কথা বলেছিলেন, সেই হোমল্যান্ড তো ভারতবর্ষের বাইরে ছিল না, এর ভেতরেই ছিল। নিজস্ব স্বকীয়তা, নিজস্ব বৈশিষ্ট্য, মানবতাবোধ এবং আল্লাহতে গভীর বিশ্বাস, এই সব দিক দিয়েই তার সমস্ত সৃষ্টিকর্ম প্রসারিত। এদেশে ইকবাল সম্পর্কে জনসচেতনতার আশা করে আমার কথা এখানেই শেষ করছি।

(জাতীয় প্রেসক্লাবে আল্লামা ইকবাল সংসদ আয়োজিত ইকবাল দিবসের সেমিনারে প্রধান অতিথির অডিও ভাষণ)

লেখক: সাবেক ভাইস চ্যান্সেলর, বাংলাদেশ উন্মুক্ত বিশ্ববিদ্যালয়


বিভাগ : সম্পাদকীয়


মন্তব্য করুন

HTML Comment Box is loading comments...

আরও পড়ুন

দাপুটে ফুটবলে কোয়ার্টার ফাইনালে স্পেন

দাপুটে ফুটবলে কোয়ার্টার ফাইনালে স্পেন

বেলিংহ্যাম ম্যাজিকে অবিশ্বাস্য জয়ে কোয়ার্টার ফাইনালে ইংল্যান্ড

বেলিংহ্যাম ম্যাজিকে অবিশ্বাস্য জয়ে কোয়ার্টার ফাইনালে ইংল্যান্ড

ফিলিপিন্সের আতশবাজি গুদামে বিস্ফোরণে নিহত ৫

ফিলিপিন্সের আতশবাজি গুদামে বিস্ফোরণে নিহত ৫

আবার বিশ্বের সবচেয়ে ব্যয়বহুল শহর হংকং

আবার বিশ্বের সবচেয়ে ব্যয়বহুল শহর হংকং

অনির্দিষ্টকালের জন্য বন্ধ কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয়

অনির্দিষ্টকালের জন্য বন্ধ কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয়

নেত্রকোনায় বারহাট্টায় ছেলের কাঠের চেলার আঘাতে বাবা নিহত

নেত্রকোনায় বারহাট্টায় ছেলের কাঠের চেলার আঘাতে বাবা নিহত

নিরাপত্তা জোরদার সহ হুমকি দাতাদের আইনের আওতায় নিয়ে আসার দাবীতে সিলেটে মানববন্ধন

নিরাপত্তা জোরদার সহ হুমকি দাতাদের আইনের আওতায় নিয়ে আসার দাবীতে সিলেটে মানববন্ধন

ভারতের সাথে চুক্তি দেশকে আজীবন গোলামে পরিণত করবে: মির্জা ফখরুল

ভারতের সাথে চুক্তি দেশকে আজীবন গোলামে পরিণত করবে: মির্জা ফখরুল

রামুর বাঁকখালী নদী থেকে ভাসমান গলাকাটা লাশ উদ্ধার

রামুর বাঁকখালী নদী থেকে ভাসমান গলাকাটা লাশ উদ্ধার

ভারতীয় রেল ট্রানজিট আমাদের সার্বভৌমত্ব ও জাতীয় নিরাপত্তা মারাত্মক হুমকির মুখে পড়বে: ফখরুল

ভারতীয় রেল ট্রানজিট আমাদের সার্বভৌমত্ব ও জাতীয় নিরাপত্তা মারাত্মক হুমকির মুখে পড়বে: ফখরুল

ছাগলকাণ্ডে বিতর্কিত মতিউরের স্ত্রী লায়লা কানিজকে সাংবাদিকদের নিয়ে উদ্দেশ্যমূলক বক্তব্য প্রত্যাহার করতে হবে : ডিইউজে

ছাগলকাণ্ডে বিতর্কিত মতিউরের স্ত্রী লায়লা কানিজকে সাংবাদিকদের নিয়ে উদ্দেশ্যমূলক বক্তব্য প্রত্যাহার করতে হবে : ডিইউজে

বান্দরবানে কেএনএফ প্রধান নাথান বমের অন্যতম সহযোগী আটক

বান্দরবানে কেএনএফ প্রধান নাথান বমের অন্যতম সহযোগী আটক

কুমিল্লায় স্ত্রী হত্যার দায়ে স্বামীর মৃত্যুদণ্ড

কুমিল্লায় স্ত্রী হত্যার দায়ে স্বামীর মৃত্যুদণ্ড

ফলদ, বনজ ও ঔষধি গাছের যে কোনো একটি রোপণে পরিবেশমন্ত্রীর আহ্বান

ফলদ, বনজ ও ঔষধি গাছের যে কোনো একটি রোপণে পরিবেশমন্ত্রীর আহ্বান

ঈদগাঁও রেল স্টেশনে ট্রেন থামানোর পদক্ষেপ নিতে আইনী নোটিশ

ঈদগাঁও রেল স্টেশনে ট্রেন থামানোর পদক্ষেপ নিতে আইনী নোটিশ

স্ট্যান্ডার্ড ব্যাংক পিএলসি. এর ৩৯৪তম বোর্ড সভা অনুষ্ঠিত

স্ট্যান্ডার্ড ব্যাংক পিএলসি. এর ৩৯৪তম বোর্ড সভা অনুষ্ঠিত

কমিউনিটি ব্যাংকের পরিচালনা পরিষদের ৫৪তম সভা অনুষ্ঠিত

কমিউনিটি ব্যাংকের পরিচালনা পরিষদের ৫৪তম সভা অনুষ্ঠিত

তরুণদের জন্য ভিসা প্ল্যাটিনাম ফ্লেক্সি কার্ড চালু করেছে ব্র্যাক ব্যাংক

তরুণদের জন্য ভিসা প্ল্যাটিনাম ফ্লেক্সি কার্ড চালু করেছে ব্র্যাক ব্যাংক

ঢাকার সব ইউনিয়নের হোল্ডিং ট্যাক্স দেয়া সহজ হলো বিকাশ-এ

ঢাকার সব ইউনিয়নের হোল্ডিং ট্যাক্স দেয়া সহজ হলো বিকাশ-এ

ঢাকায় ইরানের শহীদ প্রেসিডেন্ট ইব্রাহীম রায়িসির স্মরণে আলোচনা সভা অনুষ্ঠিত

ঢাকায় ইরানের শহীদ প্রেসিডেন্ট ইব্রাহীম রায়িসির স্মরণে আলোচনা সভা অনুষ্ঠিত