ঢাকা   শুক্রবার, ২২ নভেম্বর ২০২৪ | ৮ অগ্রহায়ণ ১৪৩১

সংস্কারের পথ দেখালেন ড. ইউনূস

Daily Inqilab ইনকিলাব

১৩ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ১২:১০ এএম | আপডেট: ১৩ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ১২:১০ এএম

ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে স্বৈরশাসনের পতনের পর অর্ন্তবর্তী সরকারের দায়িত্ব গ্রহণের প্রথম মাস পূর্তি উপলক্ষ্যে জাতির উদ্দেশ্যে দেয়া ভাষণে এক বিস্তৃত কর্মপরিকল্পনা তুলে ধরেছেন ড. ইউনূস। জটিল ও বিশৃঙ্খল রাষ্ট্রীয় বাস্তবতায় ড. ইউনূসের ৩২ মিনিটের ভাষণ জাতিকে আশার আলো দেখাচ্ছে। বাস্তব পরিস্থিতির আলোকে জরুরি করণীয় এবং সম্ভাব্য সংস্কার কর্মসূচি তুলে ধরে দেয়া তাঁর পুরো বক্তব্য ছিল কার্যত একটি মোটিভেশনাল ষ্পীচ। বাহুল্য বর্জিত এই ভাষণে চলমান বাস্তবতায় দেশের ১৮ কোটি মানুষের প্রত্যাশার অনেক কিছুই উঠে এসেছে। রাষ্ট্র সংস্কারের প্রশ্নে তিনি প্রথম ধাপে দেশের ৬ বিশিষ্ট নাগরিকের নেতৃত্বে ৬টি কমিশন গঠনের কথা প্রকাশ করলেও আরো যে সব বিষয়ে কমিশন গঠন করে সংস্কারের উদ্যোগ নেয়া হবে তারও একটি প্রচ্ছন্ন ধারণা দিয়েছেন। একাত্তরের স্বাধীনতার পরই এসব কমিশন গঠন করে দেশকে বৈষম্যহীন গণতান্ত্রিক ধারায় এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার দায়িত্ব যাদের উপর পড়েছিল, তারা সকলেই ব্যর্থ হয়েছেন। হাসিনার ফ্যাসিবাদী স্বৈরশাসনে রাষ্ট্রের সব প্রতিষ্ঠান অকার্যকর হয়ে পড়েছে। গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় জনগণই যেখানে রাষ্ট্রের মালিক, সেখানে সংবিধান, নির্বাচন কমিশন, বিচার বিভাগ, জনপ্রশাসন, পুলিশ ও দুর্নীতি দমন কমিশনের মত অতি গুরুত্বপূর্ণ সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠান সংস্কারের ক্ষেত্রে রাষ্ট্রকে দলনিরপেক্ষ , জনকল্যাণমূলক ভ’মিকা গ্রহণ করতে হয়। এ ক্ষেত্রে ড. ইউনূসের প্রজ্ঞা, মেধা, অভিজ্ঞতা ও বিশ্ববীক্ষা বাংলাদেশের রাষ্ট্র সংস্কারে নতুন পথ দেখাচ্ছে। তিনি তাঁর উপদেষ্টামন্ডলিতে এবং সহকারী হিসেবে যাদের অন্তর্ভুক্ত করেছেন তারাও সুশিক্ষিত ও স্ব স্ব ক্ষেত্রে সফল ও স্বনামধন্য। রাষ্ট্র সংস্কারের প্রয়োজনে কোনো রাজনৈতিক সরকারের পক্ষে এমন একটি সুসমন্বিত টীম গঠন করা এ সময়ে প্রায় অসম্ভব।

জুলাই-আগষ্টে হাসিনার ফ্যাসিবাদ বিরোধী অভ্যুত্থানে শহীদ ও আহত মুক্তিযোদ্ধাদের স্বপ্ন এবং দেশের ১৮ কোটি মানুষের প্রত্যাশা একই মেরুতে দাঁড়িয়েছে। দেশের জন্য যারা স্বৈরাচারের বাহিনীর প্রাণঘাতী অস্ত্রের সামনে বুক চিতিয়ে দাঁড়িয়ে অকাতরে প্রাণ বিসর্জন দিয়ে বিজয় ছিনিয়ে এনেছে, তাদের প্রত্যাশা ও আত্মার শান্তির জন্য বৈষম্যহীন একটি রাষ্ট্র নির্মাণের বিশাল কর্মযজ্ঞে ঝাঁপিয়ে পড়ার বাস্তব প্রেক্ষাপট তুলে ধরেছেন ড. ইউনূস। দীর্ঘ ৫৩ বছরের অমিমাংসিত ইস্যুগুলো দু’চার মাসেই সঠিক পন্থায় সমাধান করা সম্ভব নয়। গঠিত ৬টি কমিশনকে ৩ মাসের মধ্যে সংস্কারের কাজ সম্পন্ন করার যে সময়সীমা তিনি নির্ধারণ করেছেন তা’ খুবই যৌক্তিক এবং ইতিবাচক। এতেই বোঝা যাচ্ছে, রাষ্ট্র সংস্কারের কাজে তিনি সময় ক্ষেপণের পক্ষপাতি নন। তবে শুধুমাত্র ড. ইউনূস ও তার উপদেষ্টাদের উপর সব দায়ভার ছেড়ে দিয়ে বসে থাকলে রাষ্ট্র সংস্কার এবং ভেঙ্গে পড়া অর্থনীতি ও রাষ্ট্রব্যবস্থাকে তার সঠিক ট্র্যাকে তুলে আনা সম্ভব নয়। বিশেষত জনরোষের মুখে পালিয়ে যাওয়া স্বৈরাচারের বর্ণচোরা দোসররা এখনো নানা সেক্টরে সক্রিয় থেকে সরকারকে বেকায়দায় ফেলার ষড়যন্ত্র ও কারসাজি অব্যাহত রেখেছে। তাদের ষড়যন্ত্র মোকাবেলা করে তৈরী পোশাক শিল্প, ওষুধ শিল্পসহ রফতানিমুখী ও কর্মসহায়ক খাতগুলোকে অস্থির করে তোলার দেশি-বিদেশি ষড়যন্ত্র রুখে দিতে দেশবাসিকে সজাগ ও সক্রিয় ভূমিকা রাখতে হবে। দেউলিয়াত্বের দ্বারপ্রান্তে থাকা অর্থনীতিকে শক্ত ভিত্তির উপর দাঁড় করাতে বিশ্বব্যাংক, আইএমএফ, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রসহ উন্নয়ন সহযোগীরা ড. ইউনূসের আহ্বানে সাড়া দিয়ে পাশে থাকার প্রতিশ্রুতি ব্যক্ত করছে। এমনকি ভারতের প্রধান বিরোধীদল কংগ্রেস নেতা রাহুল গান্ধীও ড.ইউনূসের সাথে কাজ করার আগ্রহের কথা জানিয়েছেন। বিএনপি-জামায়াতসহ রাজনৈতিক দলগুলোকে নির্বাচন ও সংস্কারের প্রশ্নে অন্তর্বর্তীকালীন সরকারকে প্রয়োজনীয় সময় দিতে হবে। ড.ইউনূস তার বক্তব্যে গত একমাসে গৃহিত নানা পদক্ষেপ ও প্রশাসনিক রদবদলের যে বিবরণ তুলে ধরেছেন, তা অকিঞ্চিৎকর নয়। নির্বিঘেœ কাজ করে প্রত্যাশা পুরণে এগিয়ে যাওয়াই সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ।

গণতন্ত্রের প্রাতিষ্ঠানিক রূপায়ণ এবং বৈষম্যহীন সমাজ ও রাষ্ট্র বিনির্মাণে ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে শহীদদের স্মৃতিরক্ষা ও অবদানের স্বীকৃতি স্বরূপ ‘জুলাই গণহত্যা স্মৃতি ফাউন্ডেশন’ গঠন এবং শহীদ, আহত ও ক্ষতিগ্রস্ত পরিবারগুলোর পাশে দাঁড়ানোর উদ্যোগ নেয়া হয়েছে। শহীদ ও হতাহতদের পূর্ণাঙ্গ তালিকা প্রকাশ এবং আহতদের সর্বত্তোম চিকিৎসা নিশ্চিত করতে আরো কার্যকর পদক্ষেপ প্রয়োজন। শহীদ পরিবারের পাশে দাঁড়াতে জুলাই গণহত্যা স্মৃতি ফাউন্ডেশনে আর্থিক সহায়তা নিয়ে পাশে দাঁড়ানোর আহ্বান জানিয়েছেন ড. ইউনূস। অভ্যুত্থানের পরেও ছাত্র-জনতাকে নানা ধরণের ষড়যন্ত্র মোকাবেলা করতে হচ্ছে। ইতিমধ্যে সাংগঠনিক প্রক্রিয়ায় ছাত্র সমন্বয়কদের নেতৃত্বে নাগরিক কমিটি গঠন করা হয়েছে। রাষ্ট্র সংস্কারের প্রয়োজনে সমন্বয়ক ও সাধারণ শিক্ষার্থীদের ভূমিকা নাগরিক কমিটির কার্যক্রমের মাধ্যমে নিয়ন্ত্রিত হওয়াই সমীচিন। শিক্ষাঙ্গণগুলোতে শিক্ষা ও শান্তিপূর্ণ সহাবস্থানের পরিবেশ ফিরিয়ে আনতে বৈষম্য বিরোধী ছাত্র আন্দোলনে জড়িত সকলকে শ্রেণীকক্ষে ফিরে যেতে হবে এবং আগামি দিনের নেতৃত্ব ও পেশাগত লক্ষ্য অর্জনের জন্য প্রস্তুত হতে হবে। গার্মেন্ট ও রফতানিমুখী ওষুধ শিল্পখাতসহ শিল্পাঞ্চলে অস্থিরতা সৃষ্টির পাঁয়তারা এবং জনপ্রশাসনে বিশৃঙ্খলা সৃষ্টির সাথে যারা জড়িত হবে, তাদের বিরুদ্ধে কঠোর আইনগত ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে। কুমিল্লা-নোয়াখালী অঞ্চলে আকষ্মিক বন্যায় আর্ত-মানবতার সেবা ও ত্রাণ তৎপরতায় সশস্ত্র বাহিনী ও দেশের সাধারণ মানুষের অবদানকে কৃতজ্ঞচিত্তে স্মরণ করেছেন ড.ইউনূস। দেশের আইনশৃঙ্খলা বাহিনী এখনো অনেকটাই নিস্ক্রীয়। এহেন বাস্তবতায় ড.ইউনূসের হাতকে শক্তিশালী রাখতে দেশপ্রেমিক সেনাবাহিনী, ছাত্র-জনতা ও সাধারণ মানুষের সর্বাত্মক সহযোগিতা প্রয়োজন। দায়িত্ব গ্রহণের এক মাস পূর্তিতে আমরা ড. ইউনূস ও তার অন্তর্বর্তী সরকারকে অভিনন্দন জানাই। রাষ্ট্র সংস্কার ও বৈষম্যহীন সমাজ প্রতিষ্ঠার অঙ্গীকার পূরণে সুদৃঢ় প্রাচীরের মতো দেশবাসী সরকারের পাশে থাকবে, এটাই আমাদের প্রত্যাশা।


বিভাগ : সম্পাদকীয়


মন্তব্য করুন

HTML Comment Box is loading comments...

এই বিভাগের আরও

মানসিক সুস্থতায় কর্মবিরতি
মুনতাহার মর্মান্তিক মৃত্যু এবং কিছু কথা
ট্রাম্পের বিজয়ে ফ্যাসিস্ট শেখ হাসিনার কি কোনো লাভ হবে?
ব্যাটারিচালিত রিকশা-অটোচালকদের তাণ্ডব রুখতে হবে
স্মৃতির দর্পণে সালাউদ্দিন কাদের চৌধুরী
আরও

আরও পড়ুন

কুষ্টিয়ায় প্রতিমা ভাঙচুরের পর যুবক আটক, কথাবার্তা অসংলগ্ন

কুষ্টিয়ায় প্রতিমা ভাঙচুরের পর যুবক আটক, কথাবার্তা অসংলগ্ন

জুরাইনে পুলিশের সঙ্গে অটোরিকশা চালকদের সংঘর্ষ, রেলপথ অবরোধ

জুরাইনে পুলিশের সঙ্গে অটোরিকশা চালকদের সংঘর্ষ, রেলপথ অবরোধ

রাশিয়ার নতুন ক্ষেপণাস্ত্র ব্যবহারে বিশ্বকে প্রতিক্রিয়া জানাতে হবে : জেলেনস্কি

রাশিয়ার নতুন ক্ষেপণাস্ত্র ব্যবহারে বিশ্বকে প্রতিক্রিয়া জানাতে হবে : জেলেনস্কি

সার্বিয়ার রেলওয়ে স্টেশন দুর্ঘটনা,দুর্নীতির অভিযোগে প্রতিবাদ

সার্বিয়ার রেলওয়ে স্টেশন দুর্ঘটনা,দুর্নীতির অভিযোগে প্রতিবাদ

রিকশা লীগ হয়ে ফিরে আসতে চায় স্বৈরাচার হাসিনা

রিকশা লীগ হয়ে ফিরে আসতে চায় স্বৈরাচার হাসিনা

"অভিষেক-ঐশ্বরিয়ার বিবাহ বিচ্ছেদের বিষয়ে মিডিয়ার গুজব নিয়ে অমিতাভ বচ্চন প্রতিক্রিয়া"

"অভিষেক-ঐশ্বরিয়ার বিবাহ বিচ্ছেদের বিষয়ে মিডিয়ার গুজব নিয়ে অমিতাভ বচ্চন প্রতিক্রিয়া"

জীবিত স্বামীকে মৃত দেখিয়ে মামলার পেছনের কারিগর শফিক-রুহুল গ্রেফতার

জীবিত স্বামীকে মৃত দেখিয়ে মামলার পেছনের কারিগর শফিক-রুহুল গ্রেফতার

আন্দোলনের মোড় ঘুরিয়েছিলেন বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা : শফিকুল আলম

আন্দোলনের মোড় ঘুরিয়েছিলেন বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা : শফিকুল আলম

শেরপুরে অগ্নিকাণ্ডের কোটি টাকার ক্ষতি : অল্পের জন্যে প্রাণে বাচঁলো ৪০ ছাত্র শিক্ষক

শেরপুরে অগ্নিকাণ্ডের কোটি টাকার ক্ষতি : অল্পের জন্যে প্রাণে বাচঁলো ৪০ ছাত্র শিক্ষক

আন্তর্জাতিক জলবায়ু সম্মেলন ও বিশ্বব্যাপী বাস্তুচ্যুতি, এক ভয়াবহ বাস্তবতা

আন্তর্জাতিক জলবায়ু সম্মেলন ও বিশ্বব্যাপী বাস্তুচ্যুতি, এক ভয়াবহ বাস্তবতা

রাশিয়া উ.কোরিয়াকে এক মিলিয়ন ব্যারেল তেল সরবরাহ করেছে

রাশিয়া উ.কোরিয়াকে এক মিলিয়ন ব্যারেল তেল সরবরাহ করেছে

শরীয়তপুরের জাজিরায় ব্রিজের নিচ থেকে অজ্ঞাত পরিচয়ে এক ব্যক্তির লাশ উদ্ধার

শরীয়তপুরের জাজিরায় ব্রিজের নিচ থেকে অজ্ঞাত পরিচয়ে এক ব্যক্তির লাশ উদ্ধার

ইমরান খানের সরকার পতনে সউদীর হাত ছিল : দাবি স্ত্রী বুশরার

ইমরান খানের সরকার পতনে সউদীর হাত ছিল : দাবি স্ত্রী বুশরার

'ভারতের গোয়ায় জয়া আহসানের বিশেষ প্রদর্শনী'

'ভারতের গোয়ায় জয়া আহসানের বিশেষ প্রদর্শনী'

ওমানে সড়ক দুর্ঘটনায় ২ জনের মৃত্যু, ২২ জন আহত

ওমানে সড়ক দুর্ঘটনায় ২ জনের মৃত্যু, ২২ জন আহত

লেবানন থেকে ফিরলেন আরো ৮২ বাংলাদেশি

লেবানন থেকে ফিরলেন আরো ৮২ বাংলাদেশি

"পিটিআই" প্রধান ইমরান খানকে নতুন মামলায় ৫ দিনের রিমান্ড

"পিটিআই" প্রধান ইমরান খানকে নতুন মামলায় ৫ দিনের রিমান্ড

রবিবার নতুন নির্বাচন কমিশনের শপথ

রবিবার নতুন নির্বাচন কমিশনের শপথ

প্রশংসায় ভাসছে পাকিস্তান

প্রশংসায় ভাসছে পাকিস্তান

কেশবপুরে গাছ থেকে পড়ে একজনের মৃত্যু

কেশবপুরে গাছ থেকে পড়ে একজনের মৃত্যু