ঢাকা   বৃহস্পতিবার, ২১ নভেম্বর ২০২৪ | ৭ অগ্রহায়ণ ১৪৩১

গণতন্ত্র, সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি ও জাতীয় ঐক্যের শত্রুদের রুখতে হবে

Daily Inqilab জামালউদ্দিন বারী

১৬ অক্টোবর ২০২৪, ১২:১১ এএম | আপডেট: ১৬ অক্টোবর ২০২৪, ১২:১১ এএম

সনাতন ধর্মাবলম্বীদের চারদিনব্যাপী শারদীয় দুর্গাপূজা উৎসবমুখর পরিবেশে সমাপ্ত হয়েছে। এবারের দুর্গাপূজাকে ঘিরে এক ধরণের আশঙ্কা ও উত্তেজনা লক্ষ্য করা যাচ্ছিল। ১৩ অক্টোবরে ঢাকায় শান্তিপূর্ণভাবে বিজয়া দশমিতে প্রতিমা বির্সজনের মধ্য দিয়ে উত্তেজনা ও আশঙ্কার পরিসমাপ্তি ঘটেছে। কিন্তু শত বছর ধরে চলা বাঙ্গালী সনাতন ধর্মাবলম্বীদের ধর্মীয় উৎসবকে ঘিরে হঠাৎ করে কেন উদ্বেগ-উৎকণ্ঠার আশঙ্কা করা হয়েছিল ? এর পেছনে রয়েছে দেশের চলমান রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে সাম্প্রদায়িক রাজনৈতিক দুরভিসন্ধি। প্রতিটি রাজনৈতিক ক্রান্তিকালে দুর্গাপূজাকে ঘিরে স্বার্থান্বেষী মহলকে নাশকতার কলকাঠি নাড়তে এবং দেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ ধর্মপ্রাণ মানুষকে চাপে রাখতে প্রতিবেশি দেশের হিন্দুত্ববাদী রাজনীতির দ্বারা প্রভাবিত হয়ে মাইনরিটি কার্ড খেলা বহু বছর ধরেই চলে আসছে। মূর্তি বা প্রতিমা পূজা ইসলামের দৃষ্টিতে হারাম বা বর্জনীয় হলেও এ দেশের ধর্মপ্রাণ মুসলমানদের মধ্যে কখনোই সনাতন ধর্মীয় উৎসব নিয়ে কোনো আপত্তি বা এলার্জি দেখা যায়নি। বরং তারা সব সময়ই এ বিষয়ে সহনশীল ও সহযোগিতামূলক মনোভাব পোষণ করে এসেছে। অন্যদিকে, ভারত বিশ্বের বৃহত্তম গো মাংস রফতানিকারক দেশ হওয়ার পাশাপাশি বিশ্বের অন্যতম বৃহৎ মুসলমান জনগোষ্ঠির দেশ হওয়া সত্ত্বেও সেখানে গো হত্যার অভিযোগে মুসলমানদের পিটিয়ে মেরে ফেলার মত বর্বরতার অনেক উদাহরণ রয়েছে। ঈদুল আজহায় গরু কোরবানি দেয়া হিন্দুত্ববাদী ভারতে এক প্রকার নিষিদ্ধই হয়ে গেছে। ভারতের মুসলমান নির্যাতন, দাঙ্গা বাধিয়ে মুসলিম গণহত্যা কিংবা হিন্দু মন্দিরের কাল্পনিক দাবি তুলে ঐতিহ্যবাহী মসজিদ ভেঙ্গে ফেলার মত সাম্প্রদায়িক উগ্রতার পাল্টা জবাব হিসেবে শতকরা ৯২ ভাগ মুসলমানের দেশে নেতিবাচক প্রভাব পড়া অস্বাভাবিক ছিল না। কিন্তু এ দেশের সাধারণ মানুষ এবং ধর্মীয় নেতৃত্ব সে পথে কখনোই হাঁটেনি। এভাবেই উগ্র হিন্দুত্ববাদী ভারতের পাশে সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত হয়ে উঠেছে বাংলাদেশ। কিন্তু বাংলাদেশের এমন সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি যাদের কাছে সবচেয়ে প্রত্যাশিত হওয়ার কথা, সেই ভারত এবং তার বশংবদ হিন্দু-মুসলমান একটি গোষ্ঠির কাছে তা অসহ্য। তারা সাম্প্রদায়িক সংঘাত সৃষ্টি করে এবং বৈষম্য, নাশকতা ও নিপীড়নমূলক কর্মকাণ্ডের মিথ্যা প্রচারণা ও প্রপাগান্ডা হাজির করে বাংলাদেশের উপর ভারতীয় আধিপত্যবাদের চাপ বাড়ানোর ঘৃণ্য অপচেষ্টায় লিপ্ত থাকতে দেখা গেছে। এদেশের শান্তিপ্রিয় সনাতন ধর্মাবলম্বীদের শান্তিপূর্ণ সহাবস্থানের পরিবেশ ও সামাজিক নিরাপত্তার কথা না ভেবে প্রতিবেশি দেশের গোয়েন্দা ও সফ্ট পাওয়ারের বদৌলতে একটি স্বার্থান্বেষী চক্র দুইটি ধর্মীয় সম্প্রদায়ের মধ্যে অদ্ভুত ও জটিল এক রাজনৈতিক সমীকরণ দাঁড় করিয়েছে। দেশের সনাতন ধর্মাবলম্বীরা প্রতিবেশী দেশের ভূরাজনৈতিক দাবা খেলার গুরুত্বপূর্ণ গুটি হিসেবে এ দেশে ভারতীয় আধিপত্যবাদের দোসর একটি রাজনৈতিক দলের ক্রীড়নকের ভ’মিকা পালন করে চলেছে। দেশের ৯২ শতাং নাগরিককে বাদ দিয়ে তথাকথিত হিন্দু-বৌদ্ধ-খৃষ্টান ঐক্য পরিষদ আসলে কি চায় এখন তা সহজেই অনুমেয়। তাদের পক্ষ হয়ে হোয়াইট হাউজে গিয়ে মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের কাছে প্রিয়া সাহা নামের এক হিন্দু নারী কি বলেছিলেন, তা আমরা শুনেছি। এটি কোনো বিচ্ছিন্ন ঘটনা নয়। বছরের পর বছর ধরে ভারতীয় প্রোপাগান্ডার অংশ হিসেবে বাংলাদেশে সংখ্যালঘু নির্যাতনের এমন কাল্পনিক অভিযোগ তোলা হচ্ছে।

চরম বৈষম্যমূলক বর্ণভেদ প্রথার কারণে হিন্দুধর্মের কোনো আনুষ্ঠানিকতায় সার্বজনীনতার সুযোগ ছিল না। হাজার বছরের মুসলমান শাসনের সময় সুলতান-মুঘলরা বর্ণভেদ প্রথা, সতীদাহ প্রথাসহ হিন্দুধর্মের বৈচিত্রময় বিষয়গুলোর উপর কোনো হস্তক্ষেপ করেননি। তবে সময়ের বির্বতনে বৃটিশ শাসনের শেষপ্রান্তে এসে রাজা রামমোহন রায়, মোহনদাস গান্ধী প্রমূখ স্থানীয় হিন্দুদের সংস্কারপন্থী অংশের রাজনৈতিক প্রভাবে বৃটিশ শাসকরা সতীদাহ, বিধবা বিবাহ, অস্পৃশ্যতা ও বর্ণভেদ প্রশ্নে কিছু আইনগত সংস্কার করেন। তবে বাঙ্গালী হিন্দুদের প্রধান ধর্মীয় উৎসব বষন্তকালীণ দূর্গাপূজা ব্রাহ্মণ জমিদারদের একচেটিয়া অধিকার থেকে সার্বজনীন হয়ে ওঠার পেছনে মুসলিম বিদ্বেষ ও ইঙ্গ-হিন্দুইজমের রাজনৈতিক বোঝাপড়ার ইতিহাস রয়েছে। জমিদার বাড়ির বষন্তকালীন দূর্গাপূজা শরৎকালে টেনে এনে তা সার্বজনীন দূর্গোৎসবে পরিনত করার পেছনে ১৭৫৭ সালের ২৩জুন নবাবের সেনাবাহিনীকে পরাজিত করে রবার্ট ক্লাইভের বাহিনীর বিজয়ের মধ্য দিয়ে হাজার বছরের মুসলমান শাসনের পরিসমাপ্তি এবং ইংরেজের আধিপত্য প্রতিষ্ঠার ঘটনাটিকে কলকাতার প্রভাবশালী হিন্দুদের একটি অংশ নিজেদের বিজয় বলে মনে করেছিল। তারা সেই বিজয় উৎসবকে সেলিব্রেশন করতে শত শত বছর ধরে চলা বষন্তকালীন দূর্গাপূজাকে ব্যাপক আয়োজনে ঘটা করে শরৎকালে উদযাপনের উদ্যোগ নেয়া হয়। সেই থেকে দূর্গাপূজা হয়ে উঠেছিল শারদীয় দুর্গোৎসব। নবাব সিরাজদ্দৌলার পরাজয়ে সবেচেয়ে বেশি উল্লসিত নদিয়ার জমিদার কৃষ্ণচদ্র, কলকাতার নবকৃষ্ণ হাজার হাজার টাকা খরচ করে মহাসমারোহে দুর্গাপূজা জমিদার বাড়ীর অন্দরমহল থেকে উন্মুক্ত প্রাঙ্গণে নিয়ে আসেন। পলাশি কাণ্ডের পর প্রথম সেই দুর্গাপূজায় রবার্ট ক্লাইভ নিজেও শতটাকা চাঁদা দিয়ে সঙ্গি-সাথীসহ উৎসবে অংশগ্রহণ করেছিলেন বলে জানা যায়। বর্ণভেদ ও কঠোরভাবে নিয়মনিষ্ঠ হিন্দু বাঙ্গালীর প্রধান ধর্মীয় উৎসবটি ছিল বেইমানি, গাদ্দারির ষড়যন্ত্রে নবাবেব পরাজয় ও ইংরেজের কাছে বাংলার স্বাধীনতা বিকিয়ে দেয়ার আনন্দ আয়োজন! হিন্দুদের সংস্কার মূর্তিপূজার বিশ্বাসের সাথে ইংরেজের ধর্মীয় বিশ্বাস সাংঘর্ষিক হলেও অধিকৃত ভূখন্ডে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির শাসন-নিয়ন্ত্রণ নিরঙ্কুশ করতে সংখ্যাগরিষ্ঠ হিন্দুদের সমর্থন পাওয়ার জন্য ধুর্ত রবার্ট ক্লাইভ নবকৃষ্ণ, কৃষ্ণচন্দ্রদের পূজার আয়োজনে ১০১ টাকা দক্ষিণা দিয়ে ঝুড়ি ঝুড়ি ফল পাঠিয়ে বষন্তকালীণ দূর্গাপূজাকে শরৎকালে টেনে আনিয়ে দুর্গাপূজার এক নতুন বারোয়ারি সংস্কৃতির জন্ম দিয়েছেলেন। এরপরও কলিকাতার দুর্গাপূজাকে সার্বজনীন করতে আরো অনেক বছর লেগেছিল। ইংরেজদের পরামর্শে ও সহায়তায় শুরু হওয়া শারদীয় দূর্গোৎসবে স্থানীয় জমিদাররা আড়ম্বরতার জৌলুস প্রদর্শনের প্রতিযোগিতায় মেতে ওঠে। ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানীর উচ্চপদস্থ কর্মচারীরা এসব পূজার আয়োজনে আমন্ত্রিত অতিথি হতেন। ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানীর চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের মধ্য দিয়ে সারা বাংলায় যে নব্য জমিদার শ্রেণী গড়ে উঠেছিল সে সব জমিদার ও তাদের সুবিধাভোগী আমাত্য-আমলারা শরৎকালের দুর্গাপূজায় নিজেদের সামর্থ্য প্রদর্শনের প্রতিযোগিতা নেমে পড়ে। কাশিমবাজারের জমিদার রাজা হরিনাথের উদ্যোগে ১৮৩২ সালে প্রথম কলকাতায় বারোয়ারি দূর্গাপূজার আয়োজন করার ইতিহাস জানা যায়। তবে আরো ৮ দশক পর ১৯১০ সালে বারোয়ারি দূর্গাপূজা সার্বজনীন দুর্গাপূজায় পরিনত হয়। দূর্গাপূজার এই বির্বতনের সাথে জড়িত রয়েছে পলাশির বিয়োগান্তক পরিনতির সাথে হিন্দু জমিদারদের যোগসাজশ, বাংলার স্বাধীনতা হরণ ও মুসলমানদের বৈষম্য-বঞ্চনার ইতিহাস।

বিভেদ-বৈষম্য ও শত বছরের বঞ্চনার ইতিহাস বাংলার মুসলমানদের হিন্দুদের প্রতি বৈরী বা বিক্ষুব্ধ করে তুলতে পারেনি। সবকিছু মেনে নিয়েই তারা সামনে এগিয়ে যেতে চেয়েছে। আজকাল একটি পরিসংখ্যান সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে উঠে আসতে দেখা যাচ্ছে। তা হচ্ছে, সামাজিক-অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে পশ্চিম বাংলার মুসলমান ও বাংলাদেশের হিন্দুদের মধ্যকার একটি তুলনামূলক চালচিত্র। বিচার-বিশ্লেষণে দেখা যায়, পশ্চিম বাংলায় মুসলমান জনগোষ্ঠির সংখ্যা শতকরা প্রায় ৩০ ভাগ হলেও সেখানকার সরকারি বেসরকারি চাকরিতে মুসলমানদের নিয়োগের হার শতকরা ২ ভাগের বেশি নয়। অন্যদিকে, বাংলাদেশে হিন্দু জনসংখ্যা শতকরা ৭-৮ ভাগ হলেও সরকারি চাকরিতে কমপক্ষে ৩০ শতাংশ কর্মকর্তা-কর্মচারি হিন্দু ধর্মাবলম্বী। বেসরকারি চাকরিতে এ হার আরো বেশি। এ বাংলায় হিন্দু-মুসলমানের এমন বৈষম্য শত বছর আগে যেমন ছিল, এখনো তেমনই আছে। পশ্চিম বাংলার সামগ্রিক জৌলুষ অথবা সনাতন ধর্মাবলম্বীদের প্রতিযোগিতামূলক ধর্মীয় উন্মাদনায় কিছুটা ভাটা পড়লেও বাংলাদেশে তা যেন বেড়েই চলেছে। একটি তুলনামূলক চিত্র তুলে ধরলে তা অনেকটা পরিষ্কার হয়ে যায়। ২০২২ সালের জনশুমারি অনুসারে বাংলাদেশে হিন্দু জনসংখ্যা দেড় কোটির কম। পশ্চিমবঙ্গের মোট জনসংখ্যার প্রায় ৩০ শতাংশ মুসলমান। সেখানকার সাড়ে ৭ কোটি সনাতন ধর্মাবলম্বী সম্প্রদায় এবারের দুর্গাপূজায় প্রায় ৪০ হাজার মন্ডপে পূজা করেছে। অন্যদিকে, বাংলাদেশের হিন্দু সম্প্রদায়ের জনসংখ্যা দেড়কোটির কম হলেও তারা এবার সাড়ে বত্রিশ হাজার মন্ডপে দুর্গাপূজা উদযাপন করেছে। আরেকটি তথ্য বিচার করলে এদেশের হিন্দু সম্প্রদায়ের ধর্ম পালনের বাড়-বাড়ন্ত আঁচ করা যায়। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে একজন লিখেছেন, ২০২৪ সালে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে সরস্বতী পূজার মন্ডপ ছিল একটি আর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে সরস্বতী পূজার মন্ডপ ছিল ৭২টি। এ দেশে মসজিদ-মাদরাসার কমিটি নিয়ে যেমন দ্বন্দ, বিভক্তি দলাদলি থাকে, একইভাবে মন্দির বা পূজা কমিটি নিয়েও দ্বন্দ্ব ও বিভক্তি থাকা অস্বাভাবিক নয়। সাড়ে ৩২ হাজার মন্ডপের দু-চারটি যদি প্রতিপক্ষের দ্বারা আক্রান্ত কিংবা নাশকতার শিকার হয়, তাতে খুব বেশি বিষ্ময় কিংবা উদ্বেগের কিছু নেই। কিন্তু নাশকতা যদি হয় রাজনৈতিক পরিকল্পিত? সেই নাশকতার ছক ব্যবহার করে দেশকে অস্থিতিশীল করে তোলা, ভারত হয়ে আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমে তা বহুগুণ অতিরঞ্জিত করে প্রপাগান্ডা আকারে প্রচার করা এবং অবান্তর কথা তুলে পতিত স্বৈরাচার শেখ হাসিনাকে পুনর্বাসিত করার কাল্পনিক জিগির জারি রাখা? এমন বাতাবরণ সৃষ্টির অপপ্রয়াস দেখা গেলেও দুর্গাপূজায় স্বার্থান্বেষী মহলের সে অভিলাস ভেস্তে গেছে। দেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ মুসলমান ও হিন্দুর ঐক্যবদ্ধ প্রয়াসে তা ব্যর্থ হয়েছে। তবে কিছু চিত্র ও মোটিফ থেকে বুঝা যায় কারা, কেন দূর্গাপূজাকে টার্গেট করেছিল। ফেইসবুকে অরাত্রিকা বাগচি নামের একটি আইডিতে করা এক পোস্টে লেখা হয়েছে, ‘দেশের বিভিন্ন স্থানের প্রায় ৩১টি মন্দির ভাঙতে গিয়ে আমাদের হিন্দু ধর্মের লোকরাই ধরা পড়ছে, এর চেয়ে লজ্জার আর কি হতে পারে? বিশ্বে এই ঘটনা বিরল যে আমরা হিন্দুরা নিজেরাই নিজেদের উপাসনালয় ভাঙি।’ সেপ্টেম্বরের মাঝামাঝি ফরিদপুরের ভাঙ্গা বাজারের হরিমন্দির এবং থানা রোডের কালি মন্দিরে নির্মাণাধীন প্রতিমা ভাঙ্গচুরের সন্দেহভাজন হিসেবে একজনকে আটক করে পুলিশ। খোঁজ নিয়ে জানা যায়, গ্রেপ্তার ব্যক্তির নাম সঞ্চিত বিশ্বাস, তার বাড়ি ভারতের নদীয়া জেলায়। রাজবাড়ীতে প্রতিমা ভাঙ্গচুরের ঘটনায় আটক হিন্দু যুবক আদালতে ১৬৪ ধারায় জবানবন্দি দিয়েছে। পাবনায় প্রতিমা ভাঙ্গচুরের ঘটনায় একজন যুবলীগ কর্মী গ্রেপ্তার হয়েছে। এ তালিকা আরো অনেক লম্বা হতে পারে।

এ দেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ মুসলমান যতই শান্তি, সহাবস্থান ও উদারতার পথে চলুন, সামাজিক-রাজনৈতিকভাবে প্রতিবেশী সনাতন ধর্মাবলম্বিদের আত্মনিয়ন্ত্রণের কলকাঠি যেন কাশিমবাজারের নীলকুঠিতেই আবদ্ধ। একাত্তরের স্বাধীনতার পর থেকেই যেন এ দেশের মুসলমানদের উপর অত্যন্ত পরিকল্পিতভাবে প্রতিবেশি দেশের নাগপাশ চাপিয়ে দেয়া হয়েছে। পতিত স্বৈরাচার শেখ হাসিনা বলেছেন, তিনি ভারতকে যা দিয়েছেন, তারা তা কোনোদিন ভুলতে পারবে না। ইংরেজ ও হিন্দু জমিদারদের ষড়যন্ত্রের গ্যারাকলে পড়ে এ দেশের এক সময়ের সম্ভ্রান্ত মুসলমানরা নি:স্ব, হতদরিদ্র শ্রেণিতে পরিনত হওয়ার বাস্তবতা থেকে গত ৮ দশকেও খুব বেশি উত্তরণ ঘটেনি। এ সময়ে দিল্লীর শাসনে পশ্চিম বঙ্গের রাজনৈতিক-অর্থনৈতিক গুরুত্ব অনেকটা কমে গেলেও স্বাধীন বাংলাদেশ এখনো অনেক ক্ষেত্রে পশ্চিম বাংলা থেকে পিছিয়ে আছে। সেই ভারত সবগুলো অভিন্ন নদীর উজানে বাঁধ দিয়ে বাংলাদেশকে পানি বঞ্চিত করা, দেশের নদনদীগুলোকে শুকিয়ে মারা এবং স্রোতহীন নদী বালিতে ভরাট হয়ে যাওয়ার পর বর্ষাকালে হঠাৎ বাঁধের স্লুইস গেটগুলো খুলে দিয়ে আকষ্মিক বন্যায় ডুবিয়ে মারার সাংবাৎসরিক অপকর্মের পরও কেন ভারতকে প্রায় বিনাশুল্কে স্থল ও নৌট্রানজিট-করিডোর দিতে হবে? আন্তর্জাতিক নদী তিস্তার পানিচুক্তি না করে উজানে একতরফাভাবে গজলডোবা বাঁধ দিয়ে দেশের উত্তর-পশ্চিমাঞ্চলকে চরমভাবাপন্ন প্রাকৃতিক ঝুঁকির দিকে ঠেলে দিয়ে দশকের পর দশক ধরে তিস্তার পানি বন্টন নিয়ে টালবাহানার পরও কোনো বাংলাদেশি ভারতকে বন্ধুভাবাপন্ন কিংবা দায়িত্বশীল প্রতিবেশি বলে মনে করতে পারেনা। এবারের ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থান মূলত একটি ভারত বিরোধী গণঅভ্যুত্থান। আন্দোলনের সময় শিক্ষার্থীদের শ্লোগান ও গ্রাফিতিতে তার প্রতিফলন ছিল স্পষ্ট। উদারপন্থী ভারতীয় রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা মোদি সরকারের বাংলাদেশ নীতির সমালোচনায় ‘সব ডিম এক ঝুড়িতে’ রাখার বিপদ সম্পর্কে বলেছিলেন। অর্থাৎ বহুদলীয় গণতান্ত্রিক বাংলাদেশে তারা শুধুই আওয়ামী লীগ ও শেখ হাসিনার প্রতি একক সমর্থন দিয়ে তাকে গণতন্ত্র হত্যাকারী ও ফ্যাসিবাদী স্বৈরাচারে পরিনত করার নেপথ্যের শক্তি যে ভারতের হিন্দুত্ববাদী শাসকরা, তা এ দেশের একজন শিশু কিংবা অশিক্ষিত সাধারণ মানুষও বোঝে। গণবিরোধী অবস্থানের কারণে জনসমন হারিয়ে পালিয়ে যাওয়া শেখ হাসিনাকে রাজনীতিতে পুর্নবাসিত করতে এবং ক্যারিশম্যাটিক ব্যক্তিত্ব হিসেবে বিশ্বজোড়া সুখ্যাত ড. মুহাম্মদ ইউনূসের অন্তবর্তী সরকারের আসনকে টালমাটাল করে দিতে গত দুইমাসে যে সব নাটকীয় প্লট দেখা গেছে সেখানে বিভিন্ন পেশার আওয়ামী সুবিধাভোগীদের পাশাপাশি দেশের হিন্দু সমাজের একটি অংশকে লাইমলাইটে উঠে আসতে দেখা গেছে। ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানের পর বাড়িঘরে হামলা, ভাঙ্গচুর ও দখলবাজির অভিযোগ তুলে আগস্টের দ্বিতীয় সপ্তায় হাজার হাজার হিন্দু নরনারীকে শাহবাগে জমায়েত হয়ে বিক্ষোভ-সমাবেশ করতে দেখা গেছে। দেশের চলমান প্রেক্ষাপটে এটি মোটেও অপ্রত্যাশিত ছিলনা। আওয়ামীলীগ ক্ষমতাচ্যুত হলে এক শ্রেণীর হিন্দুর সেন্টিমেন্টকে ব্যবহার করে দেশের একটি মতলববাজ রাজনৈতিক গোষ্ঠি এমন প্লট অতীতেও তৈরী করেছে। এবারের দূর্গাপূজাকে ঘিরে সে আশঙ্কা আরো প্রকট হয়ে উঠেছিল। সনাতন ধর্মাবলম্বীরা আর কারো তুরুপের তাস হতে না চাইলেও তাদের সামাজিক-রাজনৈতিক সিদ্ধান্তের সবকিছুর নিয়ন্ত্রণ নিজেদের হাতে নেই। যেখানে আওয়ামী লীগের মত দেশের অন্যতম প্রধান রাজনৈতিক দলের নিয়ন্ত্রণ ভারতের হাতে, সেখানে ইসকন মন্দিরের কার্যক্রম কিংবা হিন্দু-বৌদ্ধ খৃষ্টান ঐক্য পরিষদের কর্মকান্ডের সাথে ভারতীয় হেজিমনিক সফ্ট পাওয়ার যোগসুত্রের আলাপ নতুন কিছু নয়। ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থান কোনো বিশেষ দল, ধর্ম বা গোষ্ঠির অভ্যুত্থান ছিল না। সেখানে অনেক হিন্দু শিক্ষার্থীও যোগ দিয়েছে এবং কেউ কেউ শহীদ হয়েছে। কিন্তু অর্šÍবর্তী সরকারকে ব্যর্থ করে দিতে এবং দেশে অস্থিতিশীলতা সৃষ্টি করতে ভারতীয়দের প্রপাগান্ডা এবং দেশের হিন্দু সম্প্রদায়কে শিখন্ডী হিসেবে ব্যবহারের ধারাবাহিক তৎপরতা বড় বিষ্ময়কর। অসাম্প্রদায়িক, গণতান্ত্রিক, সমৃদ্ধ ও ঐক্যবদ্ধ বাংলাদেশ তাদের কাঙ্খিত নয়। আমাদের বিশ্বাস, সনাতন ধর্মাবলম্বী সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষের অজান্তেই রাষ্ট্রবিরোধী শক্তি এসব ঘটিয়ে বিশ্বের কাছে বাংলাদেশ সম্পর্কে ভুল বার্তা দিতে চায়। সম্মিলিতভাবে এসব অপচেষ্টা ব্যর্থ করে দিতে হবে।

[email protected].


বিভাগ : সম্পাদকীয়


মন্তব্য করুন

HTML Comment Box is loading comments...

এই বিভাগের আরও

স্মৃতির দর্পণে সালাউদ্দিন কাদের চৌধুরী
ডিকার্বনাইজেশনে আরো জোর দিতে হবে
ঐক্য ও সংহতি অটুট রাখতে হবে
আগামীর বাংলাদেশের স্বপ্ন
ইস্পাত কঠিন জাতীয় ঐক্য ও আন্তর্জাতিক সম্পর্কের ভারসাম্য জরুরি
আরও

আরও পড়ুন

এক সপ্তাহে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ বাড়ল ৬ কোটি ১০ লাখ ডলার

এক সপ্তাহে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ বাড়ল ৬ কোটি ১০ লাখ ডলার

প্রবাসীদের যে জন্য সুখবর দিলো মালয়েশিয়া

প্রবাসীদের যে জন্য সুখবর দিলো মালয়েশিয়া

জাবি শিক্ষার্থী মৃত্যুর ঘটনায় মামলা, তদন্ত কমিটি গঠন, ফটকে তালা, মশাল মিছিল

জাবি শিক্ষার্থী মৃত্যুর ঘটনায় মামলা, তদন্ত কমিটি গঠন, ফটকে তালা, মশাল মিছিল

মাদকের বিরুদ্ধে শক্ত অবস্থানে থাকবে জাতীয়তাবাদী ছাত্রদল

মাদকের বিরুদ্ধে শক্ত অবস্থানে থাকবে জাতীয়তাবাদী ছাত্রদল

"নতুন সিনেমা নিয়ে ফিরছেন গ্লোবাল তারকা অ্যাঞ্জেলিনা জোলি"

"নতুন সিনেমা নিয়ে ফিরছেন গ্লোবাল তারকা অ্যাঞ্জেলিনা জোলি"

ড. ইউনূসকে নিয়ে খালেদা জিয়ার পুরোনো যে বক্তব্য ভাইরাল

ড. ইউনূসকে নিয়ে খালেদা জিয়ার পুরোনো যে বক্তব্য ভাইরাল

নতুন নির্বাচন কমিশনের প্রতি ইসলামী আন্দোলনের শুভ কামনা

নতুন নির্বাচন কমিশনের প্রতি ইসলামী আন্দোলনের শুভ কামনা

আলোচনায় ফ্যাসিস্ট হাসিনার ‘টুস করে ফেলে দেয়ার’ হুমকি

আলোচনায় ফ্যাসিস্ট হাসিনার ‘টুস করে ফেলে দেয়ার’ হুমকি

দীর্ঘ ১৫ বছর সাংবাদিকরা বস্তুনিষ্ঠ সংবাদ পরিবেশন করতে পারেনি: খোকন

দীর্ঘ ১৫ বছর সাংবাদিকরা বস্তুনিষ্ঠ সংবাদ পরিবেশন করতে পারেনি: খোকন

'ইউটিউব ট্রেন্ডিংয়ে রয়েছে অভিনেতা তারিক আনাম খানের নাটক'

'ইউটিউব ট্রেন্ডিংয়ে রয়েছে অভিনেতা তারিক আনাম খানের নাটক'

বাংলাদেশ, নেপাল ও ভুটানের মধ্যে আঞ্চলিক সহযোগিতার আহ্বান

বাংলাদেশ, নেপাল ও ভুটানের মধ্যে আঞ্চলিক সহযোগিতার আহ্বান

ইসলামিক ফাউন্ডেশন এর বোর্ড অব গভর্নর সৈয়দ মোসাদ্দেক বিল্লাহ আল মাদানীকে জমিয়াতুল মোদার্রেসীন ও দারুননাজাত মাদরাসা’র সম্বর্ধনা

ইসলামিক ফাউন্ডেশন এর বোর্ড অব গভর্নর সৈয়দ মোসাদ্দেক বিল্লাহ আল মাদানীকে জমিয়াতুল মোদার্রেসীন ও দারুননাজাত মাদরাসা’র সম্বর্ধনা

সৈয়দ মোসাদ্দেক বিল্লাহ আল মাদানীকে জমিয়াতুল মোদার্রেসীন ও দারুননাজাত মাদরাসা’র সংবর্ধনা

সৈয়দ মোসাদ্দেক বিল্লাহ আল মাদানীকে জমিয়াতুল মোদার্রেসীন ও দারুননাজাত মাদরাসা’র সংবর্ধনা

লালমোহনে দুই গ্রুপের সংঘর্ষে আহত যুবদল নেতা চিকিৎসাধীন অবস্থায় মৃত্যু

লালমোহনে দুই গ্রুপের সংঘর্ষে আহত যুবদল নেতা চিকিৎসাধীন অবস্থায় মৃত্যু

চকরিয়ার বিএনপি নেতা আবু তাহের চৌধুরীর মৃত্যুতে সালাহউদ্দিন আহমদ ও হাসিনা আহমদের শোক

চকরিয়ার বিএনপি নেতা আবু তাহের চৌধুরীর মৃত্যুতে সালাহউদ্দিন আহমদ ও হাসিনা আহমদের শোক

উইন্ডিজের বিপক্ষে মাঠে নামছে বাংলাদেশ

উইন্ডিজের বিপক্ষে মাঠে নামছে বাংলাদেশ

বেইজিং সংস্কৃতি ও পর্যটন ব্যুরো ও আটাবের মধ্যে চুক্তি স্বাক্ষরিত

বেইজিং সংস্কৃতি ও পর্যটন ব্যুরো ও আটাবের মধ্যে চুক্তি স্বাক্ষরিত

প্রেসিডেন্টের সঙ্গে তিন বাহিনীর প্রধানের সাক্ষাৎ

প্রেসিডেন্টের সঙ্গে তিন বাহিনীর প্রধানের সাক্ষাৎ

দেশের বাজারে ফের বাড়ল সোনার দাম

দেশের বাজারে ফের বাড়ল সোনার দাম

সবচেয়ে কম মূল্যে বাংলাদেশকে বিদ্যুৎ দিচ্ছে নেপাল: নেপাল রাষ্ট্রদূত

সবচেয়ে কম মূল্যে বাংলাদেশকে বিদ্যুৎ দিচ্ছে নেপাল: নেপাল রাষ্ট্রদূত