ঢাকা   বৃহস্পতিবার, ১৪ নভেম্বর ২০২৪ | ৩০ কার্তিক ১৪৩১

ভারতীয় হেজিমনি ও আওয়ামী লীগের আত্মঘাতী রাজনীতি

Daily Inqilab জামালউদ্দিন বারী

১৩ নভেম্বর ২০২৪, ১২:০৪ এএম | আপডেট: ১৩ নভেম্বর ২০২৪, ১২:০৪ এএম

আওয়ামী লীগ ইতিমধ্যেই বাংলাদেশের রাজনৈতিক মানচিত্র থেকে ছিটকে পড়তে শুরু করেছে। নবম থেকে দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের মধ্য দিয়ে কিংবা গত ১৬ বছরের গুম-খুন, গণহত্যা, রাষ্ট্র বিধ্বংসি ও জাতিবিরোধী তৎপরতার মধ্য দিয়েই আওয়ামী লীগের আত্মঘাতী রাজনীতি শুরু হয়নি। এই মুহূর্তে আওয়ামী লীগ বাংলাদেশে গণহত্যা ও রাজনৈতিক-অর্থনৈতিক ধ্বংসযজ্ঞের দায়ে অভিযুক্ত হয়ে এক প্রকার নির্বাসিত ও পলাতক অবস্থায় থেকে ভারতের হিন্দুত্ববাদীদের এজেন্ডার আওতায় দেশকে অস্থিতিশীল করতে করতে সম্ভাব্য সবকিছু করছে। আর ভারতের হিন্দু জাতীয়তাবাদীদের মুসলিম বিদ্বেষী এজেন্ডা শত বছরের পুরনো। সেখানে উপমহাদেশে কোনো মুসলমান জনগোষ্ঠির রাজনৈতিক সার্বভৌমত্বের অধিকারের স্বীকৃতি নেই। সেই ১৯০৫ সালের বঙ্গভঙ্গ রদের মধ্য দিয়ে সে স্বীকৃতে রহিত করা হয়েছিল। সাতচল্লিশে কৌশলগতম কারণে তা মেনে নিতে বাধ্য হলেও আদতে তারা কখনোই পাকিস্তান বা বাংলাদেশের স্বাধীনতা মেনে নিতে পারেনি। দেশভাগের পর পূর্ব পাকিস্তানের রাজনৈতিক পরিক্রমায় মাওলানা ভাসানির নেতৃত্বে বঙ্গীয় প্রাদেশিক মুসলিম লীগের একাংশের উদ্যোগে ১৯৪৯ সালের ২৩ জুন ঢাকার কেএম দাস লেনের রোজ গার্ডেনে আওয়ামী মুসলিম লীগ প্রতিষ্ঠিথ হওয়ার পর থেকেই এই সংগঠনের উপর ভর করে পাকিস্তান ভাঙ্গার রাজনৈতিক খেলা শুরু হয়। পশ্চিমা পাকিস্তানের রাজনৈতিক নেতাদের কিছু ভুল বক্তব্য ও রাজনৈতিক-অর্থনৈতিক বৈষম্য সে লক্ষ্য এগিয়ে নিতে সহায়ক ভূমিকা পালন করে। আওয়ামী লীগকে একটি ধর্মনিরপেক্ষ রাজনৈতিক সংগঠন হিসেবে প্রতিষ্ঠার উদ্যোগ এবং অপেক্ষাকৃত তরুণ নেতৃত্ব হিসেবে শেখ মুজিবকে আওয়ামী লীগের মূল নেতৃত্বের আসনে বসানোর মধ্য দিয়ে তার মাধ্যমে পাকিস্তান ভাগের পরিকল্পনা এগিয়ে নেয় নেপথ্যের কুশীলবরা। পাকিস্তানের দুই অংশের ভূরাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও সাংস্কৃতিক পার্থক্য এবং ঐতিহাসিক বির্বতনের ধারাক্রম বিবেচনায় রাখলে চল্লিশ সালের লাহোর প্রস্তাব অনুসারে দুই বাংলার সংখ্যাগরিষ্ঠ মুসলমানদের নিয়ে আলাদা রাষ্ট্র গঠনই ছিল সঙ্গত। কিন্তু পশ্চিম বাংলার রাজনীতিবিদ ও বুদ্ধিজীবীরা ১৯০৫ সালের পরের বিপরীত ভূমিকায় নেমে বাংলা ভাগের দাবিকে অনিবার্য করে তুলেছিল। কলকাতা ও আসামে ভয়াবহ দাঙ্গা সৃষ্টি করে হাজার হাজার মানুষ হত্যার মধ্য দিয়ে পাকিস্তানের সাথে পূর্বে বাংলাকে জুড়ে দেয়ার বাস্তবতাকে অনিবার্য করে তোলা হয়েছিল। কট্টর হিন্দু জাতীয়তাবাদীরা শুরু থেকেই পাকিস্তানকে ডি-স্ট্যাবিলাইজ করার প্রকল্প হাতে নিয়েছিল। পূর্ববাংলাকে পাকিস্তান থেকে বিচ্ছিন্ন করা সেই প্রকল্পেরই অংশ ছিল।

শেখ মুজিবুর রহমানের ঘনিষ্ঠ সহচর ডাক্তার কালিদাস বৈদ্যের লেখা ‘বাঙালীর মুক্তিযুদ্ধে অন্তরালের শেখ মুজিব’ গ্রন্থের ভূমিকায় কলকাতার সাংবাদিক পবিত্রকুমার ঘোষ লিখেন,‘১৯৫০ সালেই তিনি ফিরে গিয়েছিলেন ঢাকায়, পাকিস্তানকে ভাঙ্গার ব্রত নিয়ে।’ কলিকাতায় বসে পাকিস্তান ভাঙ্গার শপথ গ্রহণ করে ১৯৫১ সালে কালিদাস বৈদ্য, চিত্তরঞ্জন সুতার এবং নীরদ মজুমদার ঢাকায় এসে কালিদাস ঢাকা মেডিকেল কলেজে ভর্তি হন, চিত্তরঞ্জন এবং নীরদ মজুমদার সমাজসেবা, গণসংযোগ ও জনমত গঠনে আত্মনিয়োগ করেন। পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা বিতর্ক রাজনৈতিক প্রসঙ্গ হয়ে ওঠার আগেই হিন্দু যুবকরা পাকিস্তান ভাঙ্গার শপথ নিয়ে কলিকাতা থেকে ঢাকায় ফিরে এসে তাদের গোপন সাংগঠনিক তৎপরতা শুরু করেছিল। ধর্মনিরপেক্ষ আওয়ামী লীগ এবং শেখ মুজিবের নেতৃত্বের হাত ধরে তারা সেই স্বপ্ন বাস্তবায়নের উদ্যোগ গ্রহণ করলেও পাকিস্তানের সামরিক জান্তা সরকারের অদূরদর্শি নেতৃত্ব বাংলাদেশের মুক্তিকামী জনতাকে স্বাধীনতার পথ বেছে নিতে উদ্বুদ্ধ করেছিল। রক্তাক্ত মুক্তিযুদ্ধ ইতিহাসের অনিবার্য বাস্তবতা হলেও বাংলাদেশকে স্বাধীনভাবে তার সাংস্কৃতিক- রাজনৈতিক-অর্থনৈতিক গতিপথ নির্ধারণে সুযোগ থেকে বঞ্চিত করে ভারতের বশংবদ একটি করদ রাজ্যে পরিনত করে শেষ পর্যন্ত হায়দারাবাদ, কাশ্মির ও সিকিমের মত গ্রাস করাই ছিল ভারতীয় শাসকদের গোপন এজেন্ডা। স্বাধীনতাত্তোর বাংলাদেশে রাজনৈতিক-অর্থনৈতিক ও মানবিক বিপর্যয় সৃষ্টির পেছনে ভারতীয়দের নেপথ্য ভূমিকা ছিল। মুক্তিযুদ্ধে সহায়তার জন্য আসা ভারতীয় সেনারা বাংলাদেশে মধ্যযুগের বর্গিদের মত লুন্ঠন চালিয়েছিল। মুক্তিযোদ্ধা মেজর জলিল ভারতীয় বাহিনীল লুন্ঠনের বিরোধিতা ও প্রতিবাদ করতে গিয়ে গ্রেফতার হয়েছিলেন। সিন্ডিকেটেড মজুতদারির মাধ্যমে কৃত্রিম সংকট সৃষ্টি, অস্বাভাবিক মূল্যস্ফীতি, খাদ্যসহ বিদেশি সহায়তা সীমান্ত পথে ভারতে পাচার হয়ে যাওয়ার মধ্য দিয়ে চুয়াত্তরের দুর্ভিক্ষে লাখ লাখ মানুষকে মৃত্যুর মুখে ঠেলে দেয়া হয়েছিল। পঁচাত্তরের ১৫ আগষ্ট সপরিবারে শেখ মুজিব হত্যাকান্ড জনগণের সমর্থন ও একটি বিপ্লবী পরিবর্তনের সূচনা হিসেবে গণ্য করার পেছনে দুর্ভিক্ষ ও মানবিক বিপর্যয়ের চেয়েও জনমনে বেশি প্রভাব সৃষ্টি করেছিল তার একদলীয় বাকশাল প্রতিষ্ঠা এবং আজীবন ক্ষমতায় থাকার স্বৈরতান্ত্রিক ব্যবস্থা। গণতন্ত্র, সাম্য, সামাজিক ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠার স্বপ্ন নিয়ে লাখো মানুষের রক্তের বিনিময়ে বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর চার বছরেও বাংলাদেশকে আন্তর্জাতিক বিশ্বের সাথে সম্পৃক্ত এর সম্ভাবনাময় ভবিষ্যতের দিকে পরিচালিত করতে না পারার ব্যর্থতার দায় রাজনৈতিক দল হিসেবে আওয়ামী লীগের, নেতৃত্ব হিসেবে শেখ মুজিবের এবং তাদের উপর ডি-ফ্যাক্টো নিয়ন্ত্রক হিসেবে ভারতের। ট্রাজিক হত্যাকা-ের মধ্য দিয়ে শেখ মুজিবের শাসন থেকে জাতি মুক্ত হওয়ার পর বাংলাদেশের প্রতি মধ্যপ্রাচ্যসহ আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের সমর্থন ও সহযোগিতার হস্ত প্রসারিত হয়। বিপ্লব-প্রতিবপ্লবের দোলাচলে পঁচাত্তরের ৭ নভেম্বরের সিপাহী জনতার বিপ্লবের মধ্য দিয়ে অসম সাহসী মুক্তিযোদ্ধা সেনা কমান্ডার জিয়াউর রহমানের তীক্ষè মেধা ও প্রজ্ঞাপূর্ণ নেতৃত্বের হাত ধরে বাংলাদেশ নতুন সম্ভাবনার পথে যাত্রা করেছিল। কিন্তু দেশকে সব সময় অস্থিতিশীল করে দেয়ার গোপন এজেন্ডায় ভারতীয় দোসরদের তৎপরতা একদিনের জন্যও বন্ধ হয়নি। সব প্রতিবন্ধকতার ঊর্মিমালা ডিঙ্গিয়ে বাংলাদেশকে এক বিপুল সম্ভাবনার দুয়ারে এগিয়ে নেয়ার দক্ষ নাবিক প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমানকে হত্যার মধ্য দিয়ে হোসেন মুহাম্মদ এরশাদের ক্ষমতা দখল এবং শেখ হাসিনা ও আওয়ামী লীগের সমর্থন নিয়ে ৮ বছর ক্ষমতায় থাকার কারসাজির পেছনে ভারতের সমর্থন ছিল মূল অনুঘটক। ১৬ বছর ধরে শেখ হাসিনার ভুয়া নির্বাচন ও স্বৈরতান্ত্রিক শাসনে ভারতীয় বশংবদ মেকি রাজনৈতিক দল এরশাদের জাতীয় পার্টি আওয়ামী লীগের বি-টিম হিসেবে কাজ করেছে। এখন তারা ভারতে পালিয়ে থাকা আওয়ামী লীগ নেতাদের ইশারায় বাংলাদেশে ঘোলা পানিতে মাছ শিকারের অপচেষ্টা করছে। ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানের প্রথম সারির সমন্বয়কদের সম্পর্কে বাজে মন্তব্য করা, তাদের প্রতি চ্যালেঞ্জ ছুঁড়ে দেয়া এবং সবশেষে ঢাকায় ছাত্র-জনতার সাথে সংর্ঘষে জড়িয়ে জাতীয় পার্টি তার স্বৈরতান্ত্রিক দোসরদের সাথে পুরনো লেনদেনের সম্পর্কটাকে আরেকবার জাতির সামনে তুলে ধরেছে।

সারাবিশ্ব যখন বাংলাদেশের গণতন্ত্র, মানবাধিকার ও মত প্রকাশের স্বাধীনতার পক্ষে কথা বলেছে, ভারত তখন এ দেশের ১৭ কোটি মানুষের আকাক্সক্ষা ও স্বার্থের বিপরীতে গিয়ে শেখ হাসিনার গুম-খুন, বাক স্বাধীনতা হরণ ও নিষ্ঠুর স্বৈরতন্ত্র রক্ষা ও চিরস্থায়ী করার বয়ান সৃষ্টি ও লজিস্টিক সাপোর্ট দিয়েছে। এভাবেই যুগে যুগে বাংলাদেশে স্বৈরাচার ও ভারতপন্থী রাজনীতি অভিন্ন হয়ে উঠেছে। মানুষ ঘৃনাভরে বার বার স্বৈরতন্ত্রকে প্রত্যাখ্যান ও পতন ঘটানোর সাথে সাথে ভারতীয় সেবাদাসদেরও পতন ঘটেছে। জুলাই আগস্টের ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে শেখ হাসিনার পতনকে ভারতীয়রা তাদের সফ্ট পাওয়ারের পতন হিসেবেও মনে করতে পারে। কোটি মানুষের রুদ্ররোষে শেখ হাসিনার ভারতে পালিয়ে যাওয়ার পর থেকে অর্ন্তবর্তী সরকারকে অস্থিতিশীল করে রাখা এবং একের পর এক নানা রকম মাইনর ইস্যুকে ট্রামকার্ড হিসেবে ব্যবহার করতে ভারতীয় হিন্দুত্ববাদী মিডিয়াগুলো যেভাবে দায়িত্বহীন ভূমিকা পালন করছে, তাতে ভারত ও শেখ পরিবারের গণবিরোধী তৎপরতা নতুন প্রজন্মের কাছে খোলাসা হয়ে গেছে। আওয়ামী লীগের প্রতিষ্ঠাতা শেখ মুজিব বা শেখ পরিবার নয়। আওয়ামী লীগের প্রতিষ্ঠা এবং অগ্রযাত্রার পেছনে মাওলানা ভাসানি, খোন্দকার মোশতাক ও তাজ উদ্দিনের পরিবারের সদস্যদের ভূমিকা শেখ পরিবারের চেয়ে বেশি। শেখ মুজিব থেকে শেখ হাসিনা পর্যন্ত শেখ পরিবারের নেতৃত্বাধীন আওয়ামী লীগের আত্মঘাতী প্রবণতা ও চরম ব্যর্থতার খেসারত বার বার এ দেশের মানুষকে দিতে হয়েছে। আওয়ামী লীগের নিরব সরল-সাধারণ কর্মী-সমর্থকরা তাদের দ্বারা বার বার প্রতারিত হয়েছে। একাত্তরের ২৫মার্চ শেখ মুজিব কার্যত পাকিস্তানিদের কাছে আত্মসমর্পণ করার পর তাজউদ্দিন আহম্মদ দলের হাল ধরে গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব পালন করেছিলেন। পঁচাত্তরের ১৫ আগস্ট ও ৩ নভেম্বরের জেল হত্যাকান্ডের পর আওয়ামী লীগের চরম দুর্দিনে জোহরা তাজউদ্দিন আওয়ামী লীগের হাল ধরেছিলেন। সেই তাজউদ্দিন পরিবারের সুযোগ্য সন্তানরা এবার আওয়ামী লীগের দায়িত্ব গ্রহণে অনীহা প্রকাশ করেছেন। শেখ হাসিনা জাতির সাথে বিশ্বাস ঘাতকরা করেছেন, তার গুম-খুন-লুটপাট ও কুকর্মের মূল হোতারা লাখ লাখ নেতাকর্মীকে বিপদের মুখে ঠেলে দিয়ে ভারতেন পালিয়ে যাওয়ার পরও শেখ হাসিনা ও তার সহযোগিদের মধ্যে কোনো অনুশোচনার ছাপ নেই। সোহেল তাজ বলেছেন, গুম-খুন ও অপরাধিদের বিচার এবং স্বৈরাচারের সমর্থক-অনুগামিদের অনুশোচনা ও আত্মসমালোচনা ছাড়া এই আওয়ামী লীগের দায়িত্ব গ্রহণের প্রশ্নই আসেনা। উল্লেখ্য, শেখ হাসিনার প্রথম মেয়াদে স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রীর দায়িত্ব পেয়েও স্বৈরতান্ত্রিক তৎপরতা মেনে নিতে না পেরে পদত্যাগ করে বিদেশে চলে গিয়েছিলেন সোহেল তাজ। সম্প্রতি ঢাকার বাংলা একাডেমি মিলনায়তনের এক প্রকাশনা অনুষ্ঠানে আওয়ামী লীদের নেতৃত্ব তথা দায়িত্ব গহণে গণমাধ্যম কর্মীদের প্রশ্নের জবাবে সোহেল তাজ বলেন, ‘আওয়ামী লীগের দায়িত্ব নেয়ার প্রশ্ন তখনই আসবে, আওয়ামী লীগ যখন সংগঠন হিসেবে আত্মসমালোচনা করবে এবং আত্মোপলব্ধি করবে, তাদের কর্মকান্ডগুলো স্বীকার করবে এবং যারা আওয়ামী লীগকে এই পথে নেতৃত্ব দিয়ে ধ্বংসের পথে নিয়ে গেছে তাদেরকে জবাবদিহি করবে, যারা হত্যা, গুম-খুনের সাথে জড়িত, দুর্নীতির সাথে জড়িত তাদের বিচারের আওতায় এনে শাস্তি দেবে এবং আওয়ামী লীগ যখন ক্লিন হবে, তারপরে যদি তারা আমার নেতৃত্ব চায়, দেন আমি বিবেচনা করব।’ একটি ঐতিহ্যবাহী রাজনৈতিক দলের শীর্ষ নেতৃত্বে থেকে শেখ মুজিব থেকে শেখ হাসিনার বার বার পদস্খলন, আত্মঘাতী অবস্থান, গণতন্ত্র ও আইনের শাসন ধ্বংস করে জাতিকে গুম-খুন, দুর্নীতি, দুর্ভিক্ষ ও অভ্যুত্থানের মুখে ঠেলে দেয়ার ইতিহাসের পুনরাবৃত্তি চিরতরে বন্ধ করতে হলে শেখ হাসিনা ও সংগঠন হিসেবে আওয়ামী লীগের বিচার নিশ্চিত করা জরুরি।

ভারতে পালিয়ে গিয়ে দেশ বিরোধী চক্রান্তে লিপ্ত হয়েছেন শেখ হাসিনা। ভারতের বিজেপি সরকার তাকে আশ্রয় দিয়ে বাংলাদেশের অর্ন্তবর্তী সরকারকে অস্থিতিশীল করতে নানা রকম ইস্যু সৃষ্টির পাশাপাশি গুজব ও প্রোপাগান্ডা ক্যাম্পেইন চালাচ্ছে। এ ক্ষেত্রে বাংলাদেশের হিন্দু ধর্মাবলম্বী একটি মতলববাজ শ্রেণী তাদের কুশীলব হিসেবে কাজ করছে। শত শত বছর ধরে সম্প্রীতি ও শান্তিপূর্ণ সহাবস্থানে থাকা দুটি সম্প্রদায়কে একটি বিপজ্জনক বৈরীতার মুখে ঠেলে দিয়ে ভারত ও বাংলাদেশের দুটি রাজনৈতিক পক্ষ আঞ্চলিক স্থিতিশীলতাকে চ্যালেঞ্জের মুখে নিক্ষেপ করতে চাইছে। গত হাজার বছরে ভারত বাংলাদেশের হিন্দু-মুসলমানদের মধ্যে একটি চমৎকার বোঝাপড়া সৃষ্টি হয়েছিল। বৃটিশরা এখানে রাজত্ব দীর্ঘায়িত করতে ডিভাইড অ্যান্ড রোল পলিসির আওতায় হিন্দু-মুসলমানের মধ্যে অবিশ্বাস ও দ্বন্দ্ব সৃষ্টি করেছিল। সুলতান ও মুঘলদের ভারত শাসনের মূল সূত্র ছিল দুই সম্প্রদায়ের ঐক্য আর বৃটিশদের ভারত শাসনের মূল সুত্র ছিল দুই সম্প্রদায়ের অনৈক্য ও দ্বন্দ্বে জড়িয়ে দেয়া। আজকের ভারতীয় বিজেপি শাসকরা ইহুদি জায়নবাদীদের প্রেসক্রিপশনে ইসলামোফোবিক এজেন্ডা নিয়ে পুরো উপমহাদেশের মুসলমানদের অস্থির ও নিরাপত্তাহীন করে তোলার চেষ্টা করছে। এর ফলে তারা কোনো প্রতিবেশীকেই নিজের আস্থায় রাখতে পারছে না। প্রতিযোগিতা ও প্রতিদ্বন্দ্বিতামূলক পুঁজিবাদী বিশ্বরাজনীতিতে আঞ্চলিক ও আন্তর্জাতিক পরাশক্তিগুলো তার চারপাশে থাকা অপেক্ষাকৃত ছোট দেশগুলোকে নিজের কব্জায় রাখার চেষ্টা করবে, এটাই স্বাভাবিক। সেখানে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সাথে কিউবা, মেক্সিকো কিংবা কানাডার সম্পর্কে কিছু মতবিরোধ থাকতে পারে, রাশিয়ার সাথে ইউক্রেনের যুদ্ধ কিংবা চীনের সাথে তার প্রতিবেশী দেশ ভারত, মিয়ানমার, পাকিস্তান, আফগানিস্তান, তাজিকিস্তান, নেপাল, ভুটান, উত্তর কোরিয়া, মঙ্গোলিয়া,ভিয়েতনাম ও লাওসের মত দেশের অবস্থান থাকলেও ভারতের মত আধিপত্যবাদী নীতি ও বৈরীতার নানা কিসিমের তৎপরতার নজির আর কোনো দেশের নেই। ভারত তার অন্য সব প্রতিবেশী দেশের চেয়ে বাংলাদেশের উপর প্রভাব ও আধিপত্য ধরে রাখতে আওয়ামী লীগের মত একটি ঐতিহ্যবাহী রাজনৈতিক দলের শীর্ষ নেতৃত্বকে বশে রেখে পুতুলের মত ব্যবহারের মওকা গ্রহণ করেছে বার বার। সামরিক স্বৈরশাসনের বাই-প্রোডাক্ট হিসেবে এরশাদের জাতীয় পার্টির মত নি¤œ পর্যায়ের রাজনৈতিক দলকেও ব্যবহার করেছে। আর সফ্ট পাওয়ার হিসেবে এদেশের হরেক সাংস্কৃতিক সংগঠন, চলচ্চিত্র ফোরাম, মঞ্চ নাটক, কবি পরিষদ, রবীন্দ্র সংগীত পরিষদ, ছায়ানট, উদীচি, আবৃত্তি সংসদ, বিশেষ মদতপুষ্ট সুশীল সমাজ ও গণমাধ্যম, নানা ছদ্মাবরণে বেশকিছু এনজিও, পাহাড়ি সংগঠন, হিন্দু-বৌদ্ধ খৃষ্টান ঐক্য পরিষদের পাশাপাশি রামকৃষ্ণ মিশন ও ইসকনের মত হিন্দু ধর্মীয় সংগঠনকেও বাংলাদেশে ভারতীয় আধিপত্য কায়েমের কাজে ব্যবহার করা হচ্ছে। গৌড়ীয় বৈষ্ণব সনাতন ধর্মের একত্ববাদী ভক্তি যোগ প্রচারের উদ্দেশ্যে স্বামী শ্রীল প্রভূপাদ ১৯৬৬ সালে আমেরিকার নিউ ইয়র্ক শহরে প্রথম কৃষ্ণ ভাবনামৃত হরে কৃষ্ণ আন্দোলন বা ইসকন প্রতিষ্ঠা করেন। ঊনবিংশ শতকের শেষ দশকে স্বামী বিবেকানন্দ প্রতিষ্ঠিত রামকৃষ্ণ মিশন এবং প্রভূপাদের ইসকন এখন বিশ্বব্যাপী ভারতীয় সফ্ট পাওয়ার ও গোয়েন্দা তৎপরতার দায়ে অভিযুক্ত হচ্ছে। রামকৃষ্ণ পরম হংসের মত মহাপুরুষের দর্শন এবং বৈষ্ণব ভক্তিবাদের আশ্রয়ে তারা হিন্দু ধর্মের অহিংস নীতির বিপরীত তৎপরতায় লিপ্ত হয়ে পড়েছে।

বাংলাদেশে শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন আওয়ামী ফ্যাসিবাদের পতনের পর গত তিন মাসে সনাতন ধর্মের বিভিন্ন সংগঠন অর্ন্তবর্তী সরকারের বিরুদ্ধে রাস্তায় নামার সমাবেশ ও রণহুঙ্কার শোনা গেছে। ভারতের হিন্দুত্ববাদীরা নানা অজুহাতে মব সৃষ্টি করে সেখানে মুসলমানদের পিটিয়ে হত্যা ও মসজিদ-মাদরাসা ভাঙ্গার মত ঘটনা ঘটাচ্ছে। এখন তারা বাংলাদেশেও অনুরূপ পরিস্থিতি সৃষ্টির মাধ্যমে দাঙ্গা সৃষ্টির চেষ্টা করছে। ইসকনের বিরুদ্ধে একটি ফেইসবুক পোস্ট দেয়ার অভিযোগে চট্টগ্রামের এক ব্যবসায়ীর প্রতিষ্ঠানে হামলা করলে যৌথ বাহিনীর হস্তক্ষেপে উক্ত ব্যবসায়ী প্রাণে বেঁচে গেলেও হিন্দুত্ববাদীরা হাজারি লেন এলাকায় সেনা বাহিনীর গাড়িতে হামলা চালিয়ে ভাঙ্গচুর ও পুলিশের উপর এসিড নিক্ষেপ করে। এই ঘটনায় যৌথ বাহিনীর অন্তত ২০ সদস্য আহত হয়েছে। হিন্দু জাগরণ মঞ্চের ব্যানারে চট্টগ্রামের লাল দিঘী ময়দানে সমাবেশ করে যে সব অভিযোগ ও আল্টিমেটাম প্রকাশ করা হয়েছে তা ভিত্তিহীন অপপ্রচারের পুনরাবৃত্তি ও উস্কানিমূলক। হেফাজতে ইসলাম বাংলাদেশ এর পাল্টা সমাবেশ ডেকে বাংলাদেশে ইসকনের কার্যক্রম নিষিদ্ধের দাবি তুলেছে। এভাবেই দুই ধর্মের ধর্মপ্রাণ মানুষগুলো আধিপত্যবাদী রাজনৈতিক এজেন্ডায় দাঙ্গা-সংঘাতের উস্কানিতে পা দিচ্ছে। এ দেশে ভারতীয় সফ্ট পাওয়ার ও হেজিমনিক গোয়েন্দা অ্যাপারেটাসগুলো পতিত শেখ হাসিনা ও আওয়ামী লীগের রাজনৈতিক পুর্নবাসনের জন্য অতি তৎপর হয়ে উঠেছে। গুম-খুন, গণহত্যা, রাষ্ট্রীয় সব প্রতিষ্ঠান ধ্বংস ও হাজার হাজার কোটি ডলার লুন্ঠন ও পাচারের দায়ে শেখ হাসিনা ও তার দোসরদের বিচার ছাড়া তাদের পুর্নবাসিত হওয়ার কোনো সুযোগ ছাত্র-জনতা ও বিএনপিসহ মূলধারার রাজনৈতিক দলগুলো মেনে নেবে না। গত ৫৩ বছর ধরে তারা জাতিকে বিভক্ত করে দেশের রাজনৈতিক-অর্থনৈতিকভাবে সমৃদ্ধ হয়ে সামনে এগিয়ে যাওয়ার সম্ভাবনাকে নস্যাৎ করার চেষ্টা করেছে। এখন বিদেশে পালিয়ে গিয়ে নিজের দলকে ধ্বংসের মুখে রেখে ভারত প্রভাবিত ইসকন ও সনাতন ধর্মীয় সংগঠনগুলোকে মাঠে নামিয়ে অর্ন্তবর্তী সরকারকে অস্থিতিশীল করে বাংলাদেশে প্রাতিষ্ঠানিক সংস্কার ও গণতন্ত্রের অগ্রযাত্রা রুখে দেয়ার ষড়যন্ত্র চলছে। বার বার স্বৈরশাসন, রাজনৈতিক-অর্থনৈতিক ব্যর্থতা, গণহত্যা ও পতনের মধ্য দিয়ে শেখ পরিবার আওয়ামী লীগের রাজনৈতিক ও আইনগত ভিত্তিকেই ধ্বংস করে দিয়েছে। সোহেল তাজের মত আওয়ামী লীগের সাধারণ কর্মী সমর্থকরা নিজেদের অবস্থান পরিষ্কার করে সৎ সাহস নিয়ে ন্যায়ের পক্ষে দাঁড়াতে না পারলে বাংলাদেশে আওয়ামী লীগ নামক রাজনৈতিক দলটির পরিনতি হতে পারে জার্মানীর নাৎসী পার্টির মত। গুম-খুনের বিচার ও পাচার করা সম্পদ ফিরিয়ে আনা ছাড়া তাদের রাজনৈতিক পুর্নবাসনের কোনো সুযোগ নেই।

[email protected]


বিভাগ : সম্পাদকীয়


মন্তব্য করুন

HTML Comment Box is loading comments...

এই বিভাগের আরও

মূল্যস্ফীতি রোধে জরুরি পদক্ষেপ নিতে হবে
যৌথবাহিনীর অভিযান জোরদার করতে হবে
সামাজিক শৃঙ্খলা রক্ষায় নজর দিন
পুলিশকে জনবান্ধব বাহিনী হিসেবে গড়ে তুলতে হবে
মূল্যস্ফীতি রোধে জরুরি পদক্ষেপ নিতে হবে
আরও

আরও পড়ুন

সিসিকের সাবেক কাউন্সিলর ও আ'লীগ নেতা মতিউরকে গ্রেফতার করেছে র‌্যাব-৯

সিসিকের সাবেক কাউন্সিলর ও আ'লীগ নেতা মতিউরকে গ্রেফতার করেছে র‌্যাব-৯

মালয়েশিয়ার সাবেক অর্থমন্ত্রী দাইম জয়নুদ্দিন আর নেই

মালয়েশিয়ার সাবেক অর্থমন্ত্রী দাইম জয়নুদ্দিন আর নেই

সংস্কৃতি উপদেষ্টার আশ্বাসে প্রতিবাদ সমাবেশ বাতিল করলো গ্রুপ থিয়েটার ফেডারেশন

সংস্কৃতি উপদেষ্টার আশ্বাসে প্রতিবাদ সমাবেশ বাতিল করলো গ্রুপ থিয়েটার ফেডারেশন

শান্তিপূর্ণভাবে ক্ষমতা হস্তান্তরের আশ্বাস, হোয়াইট হাউজে ট্রাম্প-বাইডেন বৈঠক

শান্তিপূর্ণভাবে ক্ষমতা হস্তান্তরের আশ্বাস, হোয়াইট হাউজে ট্রাম্প-বাইডেন বৈঠক

ভারত-পাকিস্তান বিরোধ: আইসিসিকে যে পরামর্শ দিলেন রশিদ লতিফ

ভারত-পাকিস্তান বিরোধ: আইসিসিকে যে পরামর্শ দিলেন রশিদ লতিফ

পুরস্কারের অর্থ এখনও বুঝে পাননি অনেক ক্রিকেটার

পুরস্কারের অর্থ এখনও বুঝে পাননি অনেক ক্রিকেটার

গাজায় যুদ্ধের অবসান হওয়া উচিৎ : অ্যান্থনি ব্লিঙ্কেন

গাজায় যুদ্ধের অবসান হওয়া উচিৎ : অ্যান্থনি ব্লিঙ্কেন

আবারও ইমরানের মুক্তির দাবিতে বিক্ষোভে উত্তাল পাকিস্তান

আবারও ইমরানের মুক্তির দাবিতে বিক্ষোভে উত্তাল পাকিস্তান

শীতে এই ৫টি জিনিস ব্যবহারে ত্বক দেখে মুগ্ধ হবে সবাই!

শীতে এই ৫টি জিনিস ব্যবহারে ত্বক দেখে মুগ্ধ হবে সবাই!

ব্যক্তিগত কারণ দেখিয়ে বসুন্ধরা গ্রুপের চাকরি ছাড়লেন শহীদ আবু সাঈদের দুই ভাই

ব্যক্তিগত কারণ দেখিয়ে বসুন্ধরা গ্রুপের চাকরি ছাড়লেন শহীদ আবু সাঈদের দুই ভাই

প্রতিরক্ষামূলক টানেল নেটওয়ার্ক নির্মাণ করবে ইরান

প্রতিরক্ষামূলক টানেল নেটওয়ার্ক নির্মাণ করবে ইরান

আইন উপদেষ্টাকে হেনস্তার ঘটনায় জেনেভা মিশনের শ্রম কাউন্সেলরকে ‘স্ট্যান্ড রিলিজ’

আইন উপদেষ্টাকে হেনস্তার ঘটনায় জেনেভা মিশনের শ্রম কাউন্সেলরকে ‘স্ট্যান্ড রিলিজ’

তারুণ্যের প্রভিভা অনুসন্ধানে আসছে রক রিয়েলিটি শো "দ্য কেইজ"

তারুণ্যের প্রভিভা অনুসন্ধানে আসছে রক রিয়েলিটি শো "দ্য কেইজ"

মন্দ কাজের সমালোচনায় সরব থাকবে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন

মন্দ কাজের সমালোচনায় সরব থাকবে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন

বশির-ফারুকীকে অপসারণসহ ৯ দাবি প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের

বশির-ফারুকীকে অপসারণসহ ৯ দাবি প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের

পাকিস্তানে সেনাবাহিনীর অভিযানে নিহত ১২

পাকিস্তানে সেনাবাহিনীর অভিযানে নিহত ১২

হত্যা মামলায় ভোলার সাবেক এমপি আলী আজম মুকুল ঢাকায় গ্রেপ্তার

হত্যা মামলায় ভোলার সাবেক এমপি আলী আজম মুকুল ঢাকায় গ্রেপ্তার

ঘোড়াঘাটে শ্বাসরোধে যুবকের মৃত্যু, হত্যাকান্ডের অভিযোগে স্ত্রী আটক

ঘোড়াঘাটে শ্বাসরোধে যুবকের মৃত্যু, হত্যাকান্ডের অভিযোগে স্ত্রী আটক

ইসরাইলি বাহিনীর বর্বর হামলায় গাজায় নিহত ৪৭

ইসরাইলি বাহিনীর বর্বর হামলায় গাজায় নিহত ৪৭

করাচি থেকে প্রথম সরাসরি কার্গো পৌঁছেছে চট্টগ্রামে

করাচি থেকে প্রথম সরাসরি কার্গো পৌঁছেছে চট্টগ্রামে