পুলিশকে জনবান্ধব বাহিনী হিসেবে গড়ে তুলতে হবে
১৪ নভেম্বর ২০২৪, ১২:০৪ এএম | আপডেট: ১৪ নভেম্বর ২০২৪, ১২:০৪ এএম
যে কোনো রাষ্ট্রের পুলিশ অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ বাহিনী। পুলিশ ছাড়া কোনো রাষ্ট্রের অস্তিত্ব কল্পনাও করা যায় না। পুলিশ এবং রাষ্ট্র পরস্পর অবিচ্ছেদ্য। প্রত্যেক দেশেই পুলিশ ছিল, আছে এবং থাকবে। সুতরাং পুলিশের গুরুত্ব নিয়ে নতুন ব্যাখ্যার কোনো প্রয়োজন নেই। পুলিশ মুলত একটি আইনশৃংখলা এবং নিরাপত্তা রক্ষাকারী বাহিনী। দেশের আইনশৃংখলা রক্ষা করা, মানুষের জানমালের নিরাপত্তা বিধান করা এবং শান্তি প্রতিষ্ঠা করা পুলিশের প্রধান দায়িত্ব এবং কর্তব্য। সমাজে অশান্তি সৃষ্টিকারীদের দমন এবং তাদের যথাযথ শাস্তির ব্যবস্থা করা ও পুলিশের দায়িত্ব। চুরি, ডাকাতি, সন্ত্রাস, খুনাখুনি ও নারী নির্যাতন বন্ধ করা এবং এজন্য দায়ী ব্যক্তিদের আইনের মুখোমুখি করে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি প্রদান করাও পুলিশের দায়িত্ব। চোরাচালান ও মাদকদ্রব্য রোধ, দুর্নীতি এবং অনৈতিক কার্যকলাপ প্রতিরোধ করাটাও পুলিশের দায়িত্ব। স্বাভাবিকভাবেই একটি আধুনিক, সুন্দর, সভ্য এবং শান্তির সমাজ বির্নিমাণে পুলিশের ভূমিকা অপরিহার্য। পুলিশ যখন যথাযথভাবে তার দায়িত্ব পালন করে তখন অপরাধীরা দুর্বল হয়ে যায়। ফলে সমাজে এবং দেশে শান্তিশৃংখলা বজায় থাকে, আইনশৃংখলা পরিস্থিতি ভালো থাকে, অপরাধ কমে যায়, জানমালের নিরাপত্তা থাকে এবং মানুষের জীবনে শান্তি আসে। দেশে তখন আইনের শাসন প্রতিষ্ঠিত হয়। মানুষ তখন নিশ্চিন্তে ঘুমাতে পারে। পুলিশ যখন তার দায়িত্ব যথাযথভাবে পালন করে না, তখন অপরাধীরা সক্রিয় হয়ে ওঠে। ফলে অপরাধ বেড়ে যায়। তখন সমাজে শান্তি থাকে না। মানুষের জানমালের নিরাপত্তা থাকে না এবং জীবন হয়ে ওঠে দুর্বিষহ। এ অবস্থায় সমাজে পেশিশক্তির দাপট প্রতিষ্ঠিত হয় এবং আইনের শাসন বিদায় নেয়। সুতরাং সত্য, সুন্দর এবং কল্যাণের স্বার্থে পুলিশকে তার দায়িত্ব যথাযথভাবে পালন করতে হবে। পুলিশকে হতে হবে দুষ্টের দমন আর শিষ্টের লালনের নীতির ওপর প্রতিষ্ঠিত। পুলিশকে হতে হবে জনগণের বন্ধু।
পুলিশ শব্দটি অত্যন্ত অর্থবহ এবং গুরুত্ববহ। ইংরেজি Police শব্দটি ছয়টি শব্দের প্রথম অক্ষর নিয়ে গঠিত। ইংরেজি শব্দ Polite (বিনয়ী) এর P, Obedient (অনুগত) এর O, Loyal (বিশ্বস্ত) এর L, Intelligent (বুদ্ধিমান) এর I, Courageous (সাহসী) এর C, এবং Eager to help (সাহায্য করার জন্য ব্যাকুল) এর ঊ নিয়ে গঠিত। তার মানে পুলিশ হচ্ছে এমন কতকগুলো ব্যক্তির সমন্বয়ে গঠিত একটি বাহিনী, যারা হবে বিনয়ী, অনুগত, বিশ্বস্ত, বুদ্ধিমান, সাহসী এবং মানুষকে সাহায্য করার জন্য ব্যাকুল। সুতরাং প্রতিটি পুলিশ সদস্যের মাঝে এসব গুণের উপস্থিতি থাকতে হবে। প্রতিটি পুলিশ সদস্যের এসব বৈশিষ্ট্য ধারণ করতে হবে। যারা পুলিশ হিসাবে কর্মরত, তাদের সবারই এসব বিষয় সম্পর্কে সঠিক ধারণা থাকতে হবে। তাদেরকে স্বীয় দায়িত্ব এবং কর্তব্য বুঝতে হবে। তাদের কাছে মানুষের প্রত্যাশা কী সেটাও বুঝতে হবে। কারণ, এটি একটি বিশেষ ধরনের পেশা। একই সাথে এটি একটি মহৎ এবং মর্যাদাবান পেশা। সুতরাং পুলিশ বাহিনীর সদস্যরা যদি তাদের দায়িত্ব এবং কর্তব্য সম্পর্কে বুঝে আর সে দায়িত্ব যদি যথাযথভাবে পালন করে, তাহলে সমাজে, দেশে, রাষ্ট্রে অন্যায় এবং বিশৃংখলা থাকবে না। সর্বত্রই শান্তি প্রতিষ্ঠিত হবে। পুলিশের কাজটি কিন্তু অনেক চ্যালেঞ্জিং। এখানে কাজের কোনো নির্দিষ্ট সময় নেই। যখনই প্রয়োজন তখনই তাকে কাজে ঝাঁপিয়ে পড়তে হয়। এখানে দিন রাতের কোনো বালাই নেই। ছুটির দিনে, এমনকি গভীর রাতেও আরামের ঘুমকে হারাম করে দায়িত্ব পালনে বের হতে হয়। প্রকৃতির সাথেও তাদের যুদ্ধে নামতে হয়। কনকনে শীত, তপ্ত রোদ এবং মুষলধারে বৃষ্টিÑ এর কোনটিতেই তারা বিশ্রামে যেতে পারে না। তাদের দায়িত্ব পালন করতে হয়। নিজেদের জীবনকে হুমকির মুখে রেখেও তাদের দায়িত্ব পালন করতে হয়। দায়িত্ব পালন করতে গিয়ে পুলিশের অনেকে জীবন দিয়েছে। অনেকে আবার চিরতরে পঙ্গু হয়েছে। এক কথায় পুলিশ হচ্ছে সদা জাগ্রত এক বাহিনী, যারা দেশ ও মানুষের কল্যাণে সর্বদা নিয়োজিত এবং নিবেদিত।
কিন্তু বিগত আওয়ামী লীগ সরকারের সাড়ে ১৫ বছরের শাসনামলে এদেশের পুলিশ সম্পর্কে জনগণের মাঝে বিরূপ ধারণা সৃষ্টি হয়। পুলিশের ওপর মানুষ আস্থা হারিয়ে ফেলে। কিছু পুলিশ সদস্যের কার্যকলাপ এজন্য দায়ী। আওয়ামী লীগ সরকার অনেক দলীয় কর্মীকে পুলিশের বিভিন্ন পদে নিয়োগ দেয় এবং পুলিশকে দলীয় বাহিনী হিসেবে ব্যবহার করে। আওয়ামী লীগ সরকার তার শাসনামলে পুলিশে ৮৩ হাজার নতুন পদ সৃষ্টি করে এবং পুলিশের বিভিন্ন পদে প্রায় ১ লাখ ২০ হাজার মানুষ নিয়োগ দেয়। সরকার এর মাধ্যমে তাদের ক্ষমতাকে টিকিয়ে রাখতে চেয়েছে। বিরোধী দলের নেতাকর্মীদের প্রতি কিছু পুলিশ সদস্যের আচরণ রীতিমত প্রশ্নবিদ্ধ ছিল। কিছু পুলিশ কর্মকর্তা বিরোধী দলকে তাদের প্রতিপক্ষ বানিয়েছে। বিরোধী দলের নেতাকর্মীদের নামে পুলিশের মামলা, দ্রুততম সময়ে তদন্ত শেষ করে চার্জশিট প্রদানে পুলিশের অতি আগ্রহ জনগণের মাঝে প্রশ্নের সৃষ্টি করেছে। এক্ষেত্রে আসামীদের ধরতে পুলিশের আগ্রহের কমতি ছিল না এবং এক্ষেত্রে তারা খুবই সফল। বিএনপি-জামায়াতের নেতাকর্মীদের গ্রেপ্তারে পুলিশের দক্ষতার কোনো অভাব ছিল না। প্রতিদিনেই দেশজুড়ে বিএনপি-জামায়াতের ডজন ডজন নেতাকর্মীকে পুলিশ গ্রেপ্তার করেছে। জামায়াত-শিবির কোনো অফিসে বেঠক করলেও পুলিশ খবর পেয়ে গেছে এবং সেটাকে গোপন বৈঠক অভিহিত করে জামায়াত-শিবিরের নেতাকর্মীদের গ্রেপ্তার করেছে। বলেছে, নাশকতার আশংকায় তাদের গ্রেপ্তার করা হয়েছে। পুলিশ কর্তৃক বিরোধী দলের নেতাকর্মীদের বিরুদ্ধে মামলা ছিল নিত্যনৈমিত্তিক ব্যাপার। কিন্তু এসব পুলিশ অপহৃত হওয়া অসংখ্য মানুষকে উদ্ধার করতে পারেনি। বিএনপি নেতা ইলিয়াস আলী, চৌধুরী আলম, ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ের শিবির নেতা মোসাদ্দেক এবং ওয়ালী উল্লাহসহ অসংখ্য মানুষ বছরের পর বছর ধরে নিখোঁজ থাকলেও পুলিশ এখনো এদের উদ্ধার করতে পারেনি। একইভাবে নিহত সাংবাদিক দম্পতি সাগর-রুনির হত্যাকারীদেরও গ্রেপ্তার করতে পারেনি। কিছু পুলিশ সদস্যের দুর্নীতি ছিল ভয়াবহ। বেনজীর আর হারুনরা তার বড় প্রমাণ। পুলিশের অনেক সদস্য বিভিন্ন ধরনের চোরাচালান এবং মাদক ব্যবসায়ও জড়িত হয়।
ছাত্র-জনতার আন্দোলনের মুখে গত ৫ আগস্ট শেখ হাসিনা পালিয়ে যাওয়ায় আওয়ামী লীগ সরকারের পতন হয়। সরকারের পতনের সাথে সাথে পুলিশের অনেক সদস্যও পালিয়ে যায়। এখনো অনেকেই কর্মস্থলে যোগদান করেনি এবং এদের আর যোগদানের সম্ভাবনা নাই। আবার বিভিন্ন অপরাধে অনেক পুলিশ কর্মকর্তাকে অবসর দেয়া হয় এবং অনেকে গ্রেপ্তারও হয়। সবকিছু মিলে পুলিশে একটা শূন্যতা এবং অস্থিরতা সৃষ্টি হয়েছে। এ অবস্থায় পুলিশকে নতুনভাবে পুনর্গঠন করতে হবে এবং এখন সেই কাজ চলছে। তার জন্য অতি দ্রুত পুলিশে সৎ এবং দক্ষ জনশক্তি নিয়োগ দিতে হবে। তাদের নৈতিকতা শিক্ষা দিতে হবে। পুলিশকে আজ দক্ষ বাহিনী হিসেবে গড়ে তুলতে হবে। পুলিশের জন্য প্রশিক্ষণ কর্মসূচি চালু করতে হবে এবং তাদের সুযোগ সুবিধা বৃদ্ধি করতে হবে। প্রয়োজনে পুলিশ বাহিনীর জন্য আলাদা বেতন কাঠামো প্রণয়ন করা যেতে পারে। কারণ, পুলিশের চাকরির ধরন ও প্রকৃতি এবং তাদের দায়িত্ব ও কর্তব্য অন্যান্য বিভাগ হতে অনেকটা ভিন্ন। যারা জীবনের ঝুঁকি নিয়ে সবসময় জনগণের সেবা এবং নিরাপত্তায় ব্যস্ত থাকে তাদের সুযোগ সুবিধা একটু বেশিই হতে পারে এবং তা যুক্তিসংগত। বিষয়টি নিয়ে ভাবতে হবে। প্রয়োজনীয় প্রশিক্ষণ এবং সুযোগ-সুবিধার অভাবে একটি দক্ষ বাহিনী যেমন অদক্ষ বাহিনীতে পরিণত হয়, ঠিক তেমনি প্রয়োজনীয় প্রশিক্ষণ এবং সুযোগ-সুবিধা পেলে একটি অদক্ষ বাহিনীও সময়ের ব্যবধানে দক্ষ বাহিনীতে পরিণত হয়। তাই একটি শান্তিময় এবং নিরাপদ সমাজ গঠনের প্রত্যয়ে একটি সুশৃংখল, দক্ষ, আধুনিক এবং উন্নত নৈতিক চরিত্র সমৃদ্ধ পুলিশ বাহিনী গড়ে তুলতে হবে।
লেখক : প্রকৌশলী ও উন্নয়ন গবেষক।
[email protected]
বিভাগ : সম্পাদকীয়
মন্তব্য করুন
আরও পড়ুন
ডিসেম্বরে বাংলাদেশ ও ভারতের পররাষ্ট্র বৈঠক, হাসিনাকে ফেরানো নিয়ে আলোচনা থাকবে
রামু সেনানিবাসে সশস্ত্র বাহিনী দিবস পালিত
এক সপ্তাহে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ বাড়ল ৬ কোটি ১০ লাখ ডলার
প্রবাসীদের যে জন্য সুখবর দিলো মালয়েশিয়া
জাবি শিক্ষার্থী মৃত্যুর ঘটনায় মামলা, তদন্ত কমিটি গঠন, ফটকে তালা, মশাল মিছিল
মাদকের বিরুদ্ধে শক্ত অবস্থানে থাকবে জাতীয়তাবাদী ছাত্রদল
"নতুন সিনেমা নিয়ে ফিরছেন গ্লোবাল তারকা অ্যাঞ্জেলিনা জোলি"
ড. ইউনূসকে নিয়ে খালেদা জিয়ার পুরোনো যে বক্তব্য ভাইরাল
নতুন নির্বাচন কমিশনের প্রতি ইসলামী আন্দোলনের শুভ কামনা
আলোচনায় ফ্যাসিস্ট হাসিনার ‘টুস করে ফেলে দেয়ার’ হুমকি
দীর্ঘ ১৫ বছর সাংবাদিকরা বস্তুনিষ্ঠ সংবাদ পরিবেশন করতে পারেনি: খোকন
'ইউটিউব ট্রেন্ডিংয়ে রয়েছে অভিনেতা তারিক আনাম খানের নাটক'
বাংলাদেশ, নেপাল ও ভুটানের মধ্যে আঞ্চলিক সহযোগিতার আহ্বান
ইসলামিক ফাউন্ডেশন এর বোর্ড অব গভর্নর সৈয়দ মোসাদ্দেক বিল্লাহ আল মাদানীকে জমিয়াতুল মোদার্রেসীন ও দারুননাজাত মাদরাসা’র সম্বর্ধনা
সৈয়দ মোসাদ্দেক বিল্লাহ আল মাদানীকে জমিয়াতুল মোদার্রেসীন ও দারুননাজাত মাদরাসা’র সংবর্ধনা
লালমোহনে দুই গ্রুপের সংঘর্ষে আহত যুবদল নেতা চিকিৎসাধীন অবস্থায় মৃত্যু
চকরিয়ার বিএনপি নেতা আবু তাহের চৌধুরীর মৃত্যুতে সালাহউদ্দিন আহমদ ও হাসিনা আহমদের শোক
উইন্ডিজের বিপক্ষে মাঠে নামছে বাংলাদেশ
বেইজিং সংস্কৃতি ও পর্যটন ব্যুরো ও আটাবের মধ্যে চুক্তি স্বাক্ষরিত
প্রেসিডেন্টের সঙ্গে তিন বাহিনীর প্রধানের সাক্ষাৎ