পুলিশ সংস্কার ও একটি কৌশলপত্র
১৫ নভেম্বর ২০২৪, ১২:০৬ এএম | আপডেট: ১৫ নভেম্বর ২০২৪, ১২:০৬ এএম
৫ আগস্ট ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে দীর্ঘকাল ধরে ক্ষমতায় থাকা স্বৈরাচারী প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা দেশ ত্যাগ করতে বাধ্য হন। তার সাড়ে ১৫ বছরের শাসনকাল বিভিন্ন সরকারি প্রতিষ্ঠান, বিশেষ করে পুলিশ বাহিনীকে ব্যাপকভাবে ও রাজনীতিকরণ করা হয়েছিল। এ বাহিনী তার নিপীড়ন ও সহিংসতার হাতিয়ারে পরিণত হয়েছিল। আওয়ামী লীগ ও ছাত্রলীগের প্রভাবের ফলে পুলিশকে বিচারবহির্ভূত হত্যাকা-, অপহরণ এবং অন্যান্য নির্যাতনের সঙ্গে জড়িত করা হয়েছিল, বিশেষ করে জুলাই বিপ্লবের সময়।
হাসিনার পতনের পর অন্তর্বর্তী সরকার পুলিশের সার্বিক সংস্কারের দায়িত্ব হাতে নিয়েছে। আমেরিকা ও অন্যান্য উন্নত দেশের পুলিশ ব্যবস্থার অনুসরণে বাংলাদেশের জন্য একটি আরও সুশৃঙ্খল, জবাবদিহিমূলক ও কার্যকর আইন প্রয়োগকারী সংস্থা হিসেবে গড়ে তোলা সম্ভব হতে পারে। এই নিবন্ধে পুলিশের সংস্কারের জন্য কিছু কৌশল তুলে ধরা হলো।
১. একটি স্বচ্ছ পর্যবেক্ষণ ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা করা: বাংলাদেশ পুলিশ বাহিনী বহু মানবাধিকার লঙ্ঘন, বিচারবহির্ভূত হত্যাকা- এবং রাজনৈতিক পক্ষপাতিত্বের অভিযোগে অভিযুক্ত। একটি স্বাধীন পর্যবেক্ষণ ব্যবস্থা না থাকায় এসব সমস্যার সমাধান কঠিন হয়ে পড়েছে, যা জনসাধারণের মধ্যে আরও অবিশ্বাস সৃষ্টি করেছে। পুলিশের জবাবদিহি ও স্বচ্ছতা নিশ্চিত করার জন্য একটি স্বাধীন পর্যবেক্ষণ ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা করা জরুরি।
উন্নত দেশ থেকে শিক্ষা: যুক্তরাষ্ট্রের বিভিন্ন শহরে বেসামরিক পর্যালোচনা বোর্ড রয়েছে, যারা পুলিশের কার্যক্রম তদারকি করে। এই বোর্ডগুলো সমাজের বিভিন্ন সদস্য ও আইনি বিশেষজ্ঞদের নিয়ে গঠিত, যারা পুলিশের বিরুদ্ধে অভিযোগ পর্যালোচনা ও অনিয়ম তদন্ত করে। যুক্তরাজ্যের ইনডিপেনডেন্ট অফিস ফর পুলিশ কনডাক্ট (ওঙচঈ) পুলিশের কার্যক্রমের ওপর স্বাধীন পর্যালোচনা পরিচালনা করে এবং তাদের আচরণের ওপর তদন্ত চালায়।
বাংলাদেশের জন্য সুপারিশ: পুলিশ বাহিনীর অনিয়ম, দুর্নীতি ও ক্ষমতার অপব্যবহারের তদন্ত করার জন্য বাংলাদেশে একটি স্বাধীন কমিশন প্রতিষ্ঠা করা উচিত। এই সংস্থায় আইন বিশেষজ্ঞ, মানবাধিকার কর্মী, সুশীল সমাজের প্রতিনিধি এবং কমিউনিটি নেতাদের অন্তর্ভুক্ত করা উচিত।
স্বচ্ছতা নিশ্চিত করা: পর্যবেক্ষণ সংস্থাটি নিয়মিতভাবে তদন্ত, ফলাফল এবং নেওয়া শাস্তিমূলক ব্যবস্থার বিষয়ে প্রতিবেদন প্রকাশ করবে। এই স্বচ্ছতার প্রক্রিয়া জনআস্থা পুনঃস্থাপন করতে সাহায্য করবে।
২. বিস্তৃত প্রশিক্ষণ এবং পেশাদার উন্নয়ন বাস্তবায়ন: বাংলাদেশ পুলিশ বাহিনী প্রায়ই অপ্রশিক্ষিত বলে সমালোচিত হয়, যেখানে অনেক অফিসার মানবাধিকার, সংঘাত নিরসন বা ডি-এস্কেলেশন কৌশল সম্পর্কে সচেতন নয়।
উন্নত দেশ থেকে শিক্ষা: জার্মান পুলিশ মানবাধিকার, নৈতিক আচরণ এবং সংঘাত নিরসনের মতো বিষয়ে বিস্তৃত প্রশিক্ষণ গ্রহণ করে। তারা নিয়মিত প্রশিক্ষণ প্রাপ্তির মাধ্যমে সর্বশেষ পদ্ধতি সম্পর্কে আপডেট থাকে। কানাডিয়ান পুলিশ কমিউনিটি-অরিয়েন্টেড পুলিশিংয়ের উপর গুরুত্ব দেয়, যা ডি-এস্কেলেশন কৌশল এবং আইন প্রয়োগে নির্ভরযোগ্যতার দিকে মনোনিবেশ করে।
বাংলাদেশের জন্য সুপারিশ: মানবাধিকার, নৈতিক আচরণ এবং সম্প্রদায়ের সঙ্গে জড়িত থাকার ওপর ভিত্তি করে একটি বিস্তৃত প্রশিক্ষণ পাঠ্যক্রম তৈরি করা উচিত। কর্মজীবনে নিয়মিত প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা রাখা উচিত, যা আইন প্রয়োগের সর্বশেষ কৌশল, আইনি মানদ- এবং সেরা অনুশীলন সম্পর্কে আপডেট থাকতে সহায়তা করবে।
৩. নিয়োগ ও নির্বাচন প্রক্রিয়া উন্নতকরণ: শেখ হাসিনার শাসনামলে বাংলাদেশে পুলিশ বাহিনীর নিয়োগ প্রক্রিয়া ব্যাপকভাবে রাজনীতিকরণ হয়ে গেছে। এর ফলে পেশাদারিত্বের মান এবং কার্যকারিতা গুরুতরভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। রাজনীতির এই প্রভাব নিয়োগ প্রক্রিয়াকে দুর্বল করেছে এবং জনগণের মধ্যে পুলিশের প্রতি আস্থা নষ্ট করেছে।
উন্নত দেশ থেকে শিক্ষা: নেদারল্যান্ডসের পুলিশ বাহিনী একটি কঠোর নিয়োগ প্রক্রিয়া অনুসরণ করে। তারা মানসিক মূল্যায়ন, পুঙ্খানুপুঙ্খ পটভূমি যাচাই এবং বিস্তারিত সাক্ষাৎকারের মাধ্যমে যোগ্য ব্যক্তিদের নির্বাচন নিশ্চিত করে। এই প্রক্রিয়া পুলিশ বাহিনীর পেশাদারিত্ব এবং কার্যকারিতা বৃদ্ধির ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে।
বাংলাদেশের জন্য সুপারিশ: একটি স্বচ্ছ ও যোগ্যতা-ভিত্তিক নিয়োগ প্রক্রিয়া প্রবর্তন করা উচিত, যা পেশাদার যোগ্যতা ও সততার উপর গুরুত্বারোপ করে। এটি পুলিশ বাহিনীতে সত্যিকার পেশাদারিত্বের উদ্ভব ঘটাবে এবং রাজনীতির প্রভাব কমাবে। নিয়োগপ্রাপ্তদের মানসিক এবং পটভূমি যাচাইয়ের ব্যবস্থা রাখতে হবে। এর মাধ্যমে অপরাধমূলক কার্যকলাপ বা অযৌক্তিক আচরণের আশঙ্কা কমানো সম্ভব হবে এবং যোগ্য প্রার্থীদের নির্বাচন করা সহজ হবে।
৪. কমিউনিটি পুলিশিং ও আস্থা পুনরুদ্ধার করা: বাংলাদেশের পুলিশ বাহিনীর একটি দীর্ঘকালীন দুর্নাম রয়েছে, যা জনসাধারণের মধ্যে আস্থা পুনরুদ্ধারের ক্ষেত্রে বড় বাধা সৃষ্টি করে। কমিউনিটি পুলিশিং কার্যক্রম এই আস্থার পুনরুদ্ধারে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে পারে।
উন্নত দেশ থেকে শিক্ষা: সুইডিশ পুলিশ স্থানীয় সম্প্রদায়ের সঙ্গে ইতিবাচক সম্পর্ক গড়ে তোলার জন্য বিভিন্ন পদক্ষেপ গ্রহণ করে। তারা স্থানীয় সমস্যাগুলো বোঝার জন্য এবং জনগণের আস্থা অর্জনের জন্য সেবামূলক কার্যক্রম চালিয়ে থাকে।
বাংলাদেশের জন্য সুপারিশ: কমিউনিটি পুলিশিং প্রোগ্রাম শুরু করা উচিত। এই প্রোগ্রামটি স্থানীয় জনগণের সাথে পুলিশ বাহিনীর সম্পর্ক উন্নত করবে এবং জনসাধারণের মধ্যে পুলিশের প্রতি বিশ্বাস ও আস্থা তৈরি করবে।
৫. কার্যক্রমে জবাবদিহি ও স্বচ্ছতা নিশ্চিতকরণ: বাংলাদেশ পুলিশ বাহিনী বিভিন্ন ক্ষেত্রে জবাবদিহির অভাবের জন্য সমালোচিত। এটি পুলিশের কার্যক্রমের স্বচ্ছতা ও দায়িত্বশীলতার অভাবের দিকে ইঙ্গিত করে, যা জনগণের মধ্যে অখুশি সৃষ্টি করছে।
উন্নত দেশ থেকে শিক্ষা: ফ্রান্সে পুলিশের কার্যক্রম কঠোর নিয়ন্ত্রণের অধীনে থাকে এবং সেখানে জবাবদিহি নিশ্চিত করা হয়। ফরাসি পুলিশ বাহিনী কর্তৃক নিয়মিত অডিট ও নজরদারির মাধ্যমে তাদের কার্যক্রমের স্বচ্ছতা বজায় রাখা হয়।
বাংলাদেশের জন্য সুপারিশ: অনিয়মের জন্য পুলিশ অফিসারদের জবাবদিহিমূলক ব্যবস্থা রাখা প্রয়োজন। জবাবদিহির এই কাঠামো প্রতিষ্ঠা করলে পুলিশ বাহিনীর কার্যক্রমের স্বচ্ছতা বৃদ্ধি পাবে এবং জনগণের আস্থা পুনরুদ্ধারে সাহায্য করবে।
বাংলাদেশের পুলিশ বাহিনী সংস্কারের জন্য কঠোর কিন্তু প্রয়োজনীয় প্রচেষ্টা অপরিহার্য। একটি স্বাধীন পর্যবেক্ষণ সংস্থা প্রতিষ্ঠা, প্রশিক্ষণ ও পেশাদার উন্নয়নে বিনিয়োগ, নিয়োগ পদ্ধতি সংস্কার, কমিউনিটি পুলিশিং এবং জবাবদিহি নিশ্চিতকরণের মাধ্যমে বাংলাদেশ একটি আধুনিক পুলিশ বাহিনী গড়ে তুলতে পারে। এই সংস্কারগুলি দেশের সুরক্ষা ও সুবিচারের অগ্রগতি নিশ্চিত করতে সহায়ক হবে।
লেখক: নিরাপত্তা বিশ্লেষক।
বিভাগ : সম্পাদকীয়
মন্তব্য করুন
আরও পড়ুন
ডিসেম্বরে বাংলাদেশ ও ভারতের পররাষ্ট্র বৈঠক, হাসিনাকে ফেরানো নিয়ে আলোচনা থাকবে
রামু সেনানিবাসে সশস্ত্র বাহিনী দিবস পালিত
এক সপ্তাহে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ বাড়ল ৬ কোটি ১০ লাখ ডলার
প্রবাসীদের যে জন্য সুখবর দিলো মালয়েশিয়া
জাবি শিক্ষার্থী মৃত্যুর ঘটনায় মামলা, তদন্ত কমিটি গঠন, ফটকে তালা, মশাল মিছিল
মাদকের বিরুদ্ধে শক্ত অবস্থানে থাকবে জাতীয়তাবাদী ছাত্রদল
"নতুন সিনেমা নিয়ে ফিরছেন গ্লোবাল তারকা অ্যাঞ্জেলিনা জোলি"
ড. ইউনূসকে নিয়ে খালেদা জিয়ার পুরোনো যে বক্তব্য ভাইরাল
নতুন নির্বাচন কমিশনের প্রতি ইসলামী আন্দোলনের শুভ কামনা
আলোচনায় ফ্যাসিস্ট হাসিনার ‘টুস করে ফেলে দেয়ার’ হুমকি
দীর্ঘ ১৫ বছর সাংবাদিকরা বস্তুনিষ্ঠ সংবাদ পরিবেশন করতে পারেনি: খোকন
'ইউটিউব ট্রেন্ডিংয়ে রয়েছে অভিনেতা তারিক আনাম খানের নাটক'
বাংলাদেশ, নেপাল ও ভুটানের মধ্যে আঞ্চলিক সহযোগিতার আহ্বান
ইসলামিক ফাউন্ডেশন এর বোর্ড অব গভর্নর সৈয়দ মোসাদ্দেক বিল্লাহ আল মাদানীকে জমিয়াতুল মোদার্রেসীন ও দারুননাজাত মাদরাসা’র সম্বর্ধনা
সৈয়দ মোসাদ্দেক বিল্লাহ আল মাদানীকে জমিয়াতুল মোদার্রেসীন ও দারুননাজাত মাদরাসা’র সংবর্ধনা
লালমোহনে দুই গ্রুপের সংঘর্ষে আহত যুবদল নেতা চিকিৎসাধীন অবস্থায় মৃত্যু
চকরিয়ার বিএনপি নেতা আবু তাহের চৌধুরীর মৃত্যুতে সালাহউদ্দিন আহমদ ও হাসিনা আহমদের শোক
উইন্ডিজের বিপক্ষে মাঠে নামছে বাংলাদেশ
বেইজিং সংস্কৃতি ও পর্যটন ব্যুরো ও আটাবের মধ্যে চুক্তি স্বাক্ষরিত
প্রেসিডেন্টের সঙ্গে তিন বাহিনীর প্রধানের সাক্ষাৎ