ভারতে বসে শেখ হাসিনার লাগাতার চক্রান্ত
২৫ নভেম্বর ২০২৪, ১২:০২ এএম | আপডেট: ২৫ নভেম্বর ২০২৪, ১২:০২ এএম
দেশের রাজনীতির পট আমূল পরিবর্তন হয়েছে। প্রায় ১৬ বছর ধরে গেড়ে বসা স্বৈর শাসনের অবসান হয়েছে। সেই সাথে দেশে নতুন সম্ভাবনা তৈরি হয়েছে। দৃশ্যপটে বাংলাদেশের ছাত্র-জনতার মনোনীত বিপ্লবী সরকার। গত ৫ আগস্ট আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর ৮ আগস্ট ড. ইউনূসের নেতৃত্বে উপদেষ্টা পরিষদ শপথ গ্রহণ করেছে এবং শক্ত হাতে দেশের হাল ধরেছে। যে সরকারকে ছাত্র-জনতা অকুণ্ঠ সমর্থন দিয়ে ক্ষমতায় বসিয়েছে এবং সেই সরকারও দেশের সর্বস্তরের মানুষের প্রত্যাশা পূরণে কাজ শুরু করেছে ক্ষমতা গ্রহণের সাথে সাথেই। জাতির উদ্দেশ্যে দেওয়া একাধিক ভাষণে প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস স্পষ্ট করেছেন অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের নীতিমালা এবং কর্ম পরিকল্পনা। ঘোষণা দেন রাষ্ট্রের গুরুত্বপূর্ণ দফতর বা মন্ত্রণালয়ের সংস্কারের।
বর্তমান সরকার ক্ষমতা গ্রহণের পর যেসব কাজ করেছে তার উল্লেখযোগ্য হলো, প্রশাসনে ব্যাপক রদবদল, বিচার বিভাগে বড় পরিবর্তন, ফ্যাসিবাদের সাথে সম্পৃক্ত আওয়ামী সরকারের প্রভাবশালী নেতাদের বিরুদ্ধে মামলা, গুমের ঘটনা তদন্তে কমিশন, দুর্নীতির বিরুদ্ধে অবস্থান, আর্থিক খাত সংস্কারে উদ্যোগ, শিক্ষাখাতে পরিবর্তনসহ রাষ্ট্রের আরো কতগুলি মৌলিক বিষয়। রাষ্ট্র সংস্কারের জন্য প্রথমে ৬টি আলাদা কমিশন গঠন করা হয়েছে এবং পরবর্তীতে কমিশনের সংখ্যা বৃদ্ধি করা হয়েছে।
অন্তর্বর্তীকালীন সরকার ইতোমধে ১০০ দিন পূর্ণ করেছে। এর মধ্যেই এই সরকারের সাফল্য বা ব্যর্থতা নিয়ে ব্যাপক আলোচনা ও সমালোচনা চলছে। বিভিন্ন মহল থেকে বিভিন্ন রকম প্রশ্ন তোলা হচ্ছে। কেউ প্রশ্ন তুলছেন বর্তমান সরকারের বৈধতা নিয়ে, কেউ আবার অন্তর্বর্তী সরকারের মেয়াদ নিয়ে এবং কোনো কোনো রাজনৈতিক দল পরবর্তী জাতীয় নির্বাচন নিয়ে। ছাত্র-জনতার রোষানলে পড়ে পালিয়ে যাওয়া সাবেক প্রধানমন্ত্রী ভারতে আশ্রয় নিয়েছেন। সেখানে বসেই বাংলাদেশ বিরোধী অপতৎপরতার নির্দেশ দিচ্ছেন শেখ হাসিনা। স্বাভাবিকভাবেই বোঝা যায়, পতিত স্বৈরাচার এবং তাদের দোসরদের শক্তির উৎস হচ্ছে নরেন্দ্র মোদি তথা ভারত। ভারতের মদদেই বর্তমান সরকারকে সর্বদা বিব্রত করার জন্য কাজ করে যাচ্ছে পতিত ফ্যাসিবাদী সরকারের প্রধান থেকে শুরু করে সিঙ্গাড়া-পেপসি খাওয়া ছোট-বড় নেতাকর্মীরা।
ভারতে অবস্থান করে শেখ হাসিনা তার নেতাকর্মীদের নির্দেশনা দেওয়ার জন্য বিভিন্ন কৌশল অবলম্বন করে আসছেন। এরই অংশ হিসেবে বেশ কয়েকবার টেলিফোনে নেতাকর্মীদের উসকে দিয়েছেন। প্রত্যেকটি ফোনালাপেই তার চক্রান্তমূলক বক্তব্য পৌঁছে দেন তার অনুসারীদের কাছে। গত ৮ নভেম্বর এমনই একটি ফোনালাপ প্রকাশ করা হয়। সেখানে তিনি আওয়ামী ঘরানার সকলকে নির্দেশ দেন, তারা যেন বাংলাদেশে একটি সমাবেশ করে। সেই সমাবেশে ট্রাম্পের ছবিযুক্ত প্ল্যাকার্ড নিয়ে উপস্থিত হয়ে বিশৃঙ্খল অবস্থা সৃষ্টি করে এবং সেটির ভিডিও ধারণ করারও নির্দেশ দেন সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। তিনি বলেন, যারা সেদিন আসবেন তারা সবাই ডোনাল্ড ট্রাম্পের রঙ্গিন ছবি অ৪ সাইজের প্রিন্ট করে সাথে রাখবেন। যাতে বুঝা যাবে ট্রাম্প নির্বাচিত হওয়ায় তাকে বাংলাদেশের পক্ষ থেকে অভিনন্দন জানানো হচ্ছে। সবার কাছে ক্যামেরা আছে এমন মোবাইল সাথে রাখবেন। যাতে রাস্তায় কেউ হেনস্থা বা গ্রেফতার করতে আসলে ট্রাম্পের ছবিসহ ভিডিও করতে পারেন। যাতে প্রমাণ করা যায়, ট্রাম্পকে অভিনন্দন জানাতে আসা লোকজনকে অবৈধ ইউনূস সরকার বাধা দিচ্ছে। সারাবিশ্বে এটি ছড়িয়ে যাবে। আন্তর্জাতিক গণমাধ্যম সব কিছু কাভার করবে, ভিডিও চিত্র তুলে ধরবে।
মাত্র কিছুদিন আগেও আমেরিকার চরম বিরোধিতা করা আওয়ামী লীগ সরকারের প্রধান স্বয়ং ডোনাল্ড ট্রাম্প তথা আমেরিকার সমর্থনপুষ্ট হওয়ার জন্য বিভিন্ন কূটকৌশল অবলম্বন করছেন। এটি সকলেরই জানা যে, ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির সাথে ডোনাল্ড ট্রাম্পের বন্ধুত্ব রয়েছে। শেখ হাসিনা ধারণা করছেন, নরেন্দ্র মোদির মাধ্যমে তিনি ট্রাম্পের কাছে নালিশ করে ইউনূস সরকারকে বিব্রত করতে পারবেন। তার এই ধারণার ওপরই কয়েকটি প্রশ্ন এসে যায়। সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বহুবার এই বলে বক্তৃতা করেছেন যে, আমেরিকা আওয়ামী লীগ সরকারকে উৎখাতের জন্য তৎপরতা চালাচ্ছে। যদি তিনি সেন্টমার্টিনের নিয়ন্ত্রণ আমেরিকার কাছে হস্তান্তর করেন তাহলে আমেরিকা শেখ হাসিনাকে বাংলাদেশের ক্ষমতায় রাখবেন। অথচ, ছাত্র-জনতার তোপের মুখে শেখ হাসিনা দেশ ছেড়ে ভারতে পালিয়ে যাওয়ার পর আমেরিকার প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে ডোনাল্ড ট্রাম্প প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হলে আমেরিকার উপরই তিনি নির্ভরশীল হয়ে পড়েছেন। প্রশ্ন হলো, বাইডেন সরকার কি কখনো বলেছেন যে তারা সেন্টমার্টিনের নিয়ন্ত্রণ নিতে চান? আওয়ামী লীগ তথা শেখ হাসিনা যে আমেরিকা বিরোধী অবস্থান নিয়েছিলেন সেটি কি শুধুমাত্র আমেরিকার রাজনৈতিক দল ডেমোক্র্যাটদের বিরুদ্ধে? বরং তিনি যখন বলেন যে আমেরিকা সেন্টমার্টিন চায়, তখন তিনি ডেমোক্র্যাট ও রিপাবলিকান নির্বিশেষে সমগ্র আমেরিকাকেই অভিযুক্ত করেন। পরিতাপের বিষয়, একটানা সাড়ে ১৫ বছর রাজত্ব করলেও শেখ হাসিনা বৃহৎ শক্তিগুলোর পররাষ্ট্রনীতির মূলনীতিগুলো এখনো বুঝতে পারেননি।
বিগত সরকারের আমলে প্রায়সই বলা হতো, ভারত বাংলাদেশ বন্ধু রাষ্ট্র। কিন্তু কথা হচ্ছে, ভারতের সেই বন্ধুত্ব ছিল বাংলাদেশের সাথে? নাকি আওয়ামী লীগের সাথে? উত্তর অত্যন্ত সোজা। ভারত আওয়ামী লীগকে ব্যবহার করে বাংলাদেশ থেকে যত প্রকার সুবিধা পেয়ে আসছিল, বিগত অন্য কোনো রাজনৈতিক দল বা ব্যক্তির মাধ্যমে সেই সুবিধা তারা ভোগ করতে পারেনি। বাংলাদেশ থেকে ভারত যতগুলো সুবিধা নিচ্ছিল তারমধ্যে অন্যতম হচ্ছে ট্রানজিটের নামে করিডোর, সমুদ্র বন্দর ব্যবহার, রেল করিডোর ইত্যাদি। ভারত এসব সুযোগ-সুবিধা হাসিলের জন্য বাংলাদেশ সৃষ্টির আগে থেকেই তৎকালীন অখণ্ড পাকিস্তানের কাছে আবদার করে আসছিল। পাকিস্তান তাদের এই আবদার রক্ষা করেনি। ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধে পূর্ব পাকিস্তান তথা বাংলাদেশকে সামরিকভাবে সমর্থন করে ভারত বাংলাদেশের স্বাধীনতা অর্জনে সাহায্য করে। অবশ্য ভারত সেটা বিনা স্বার্থে করেনি। সেই বাংলাদেশ সৃষ্টির পর থেকেই ভারত তাদের আবদার আদায়ে নিয়মিত আলোচনা চালু রাখে। তাদের সেই আবদারের প্রেক্ষিতে কাক্সিক্ষত ফলাফল আসতে শুরু করে আওয়ামী লীগের হাত ধরে, যখন আওয়ামী লীগ ২০০৯ সালে ক্ষমতায় আরোহণ করে।
প্রতিটা রাষ্ট্রেরই কতগুলো মৌলিক নীতিমালা থাকে এবং সুদূরপ্রসারী পরিকল্পনা থাকে। যে নীতিমালা ও পরিকল্পনাগুলো সরকার পবির্তনেও অপরিবর্তিত থাকে। ভারত তার স্বার্থ সিদ্ধির জন্য আওয়ামী লীগকে ব্যবহার করেছে। নরেন্দ্র মোদি শেখ হাসিনাকে সমর্থন করছে ব্যাপারটি এমন নয়। আগেই বলেছি যে ১৯৪৭ সাল থেকেই তারা এসব দাবি করে আসছে। ২০০৯ সালের আগে কোনো সরকার ভারতের এসব দাবি বা আবদার পূরণ করেনি। কিন্তু ক্ষমতায় এসে শেখ হাসিনা নিজের ক্ষমতাকে চিরস্থায়ী করার জন্য ভারতের কাছে বাংলাদেশের স্বার্থ বিকিয়ে দেন। শেখ হাসিনা নিজেই বলেছেন, তিনি ভারতকে যা দিয়েছেন সেটা ভারত চিরদিন মনে রাখবে। কথা হচ্ছে, বিনিময়ে বাংলাদেশ কী পেয়েছে? আসলে বাংলাদেশ পেয়েছে বন্ধুত্বের মূলা। আর আওয়ামী লীগ পেয়েছে অবৈধভাবে ক্ষমতা কুক্ষিগত করার ব্যাপারে ভারতের অকুণ্ঠ সমর্থন।
প্রত্যেকটা দেশের রাজনৈতিক দলের ভিন্নমত থাকতেই পারে। কিন্তু প্রশ্ন যখন রাষ্ট্রের, তখন সেই রাষ্ট্রের স্বার্থ রক্ষায় দল মত নির্বিশেষে সকলকে ঐক্যবদ্ধ থাকতে হয়। কিন্তু বিগত সাড়ে ১৫ বছরে রাষ্ট্রীয় স্বার্থ বিসর্জন দেওয়া হয়েছে ক্ষমতা পাকাপোক্ত করার জন্য। বহির্বিশে^র সাথে সুদূরপ্রসারী পরিকল্পনা প্রত্যেকটা দেশেরই থাকে। কোনো দেশের নিকট থেকে সুবিধা পেতে হলে সমপরিমাণ সুবিধা ওই দেশকে দিতে হয়। অন্যদিকে, রাষ্ট্রস্বার্থকে উপেক্ষা করে অসম সুবিধা প্রদানের মাধ্যমে ক্ষমতায় টিকে থাকার নামই ভিন্ন রাষ্ট্রের তাবেদারি করা। জো বাইডেন, ডোনাল্ড ট্রাম্প আমেরিকার স্বার্থ রক্ষায় কাজ করেন। নরেন্দ্র মোদিও ভারতের স্বার্থকেই প্রাধান্য দেন। কিন্তু শেখ হাসিনা রাষ্ট্রীয় স্বার্থকে জলাঞ্জলি দিয়ে ব্যক্তি ও পারিবারিক স্বার্থকে প্রাধান্য দেন। সে কারণেই ট্রাম্প মানেই আমেরিকা, নরেন্দ্র মোদি মানেই ভারত; কিন্তু শেখ হাসিনা মানেই বাংলাদেশ নয়। শেখ হাসিনা মানে তার পরিবার এবং আওয়ামী ঘরানা।
তবে আমরা মনে করি না যে, ডোনাল্ড ট্রাম্প ১৭ কোটি বাংলাদেশির স্বার্থের বিপরীতে এক ব্যক্তি বা পরিবার অর্থাৎ শেখ হাসিনা এবং তার পরিবারের ক্ষমতার লিপ্সাকে প্রাধান্য দেবেন। আমেরিকার সচেতন জনগণ এমন অবস্থান কোনোদিনও মেনে নেবেন বলে আমরা বিশ^াস করি না।
লেখক: প্রাবন্ধিক।
[email protected]
বিভাগ : সম্পাদকীয়
মন্তব্য করুন
আরও পড়ুন
গুমের দায়ে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর ২২ সদস্য চাকরিচ্যুত
কুরস্ক অঞ্চলের ৪০ ভাগ খোয়ানোর স্বীকারোক্তি ইউক্রেনের
মুক্ত বাণিজ্য চুক্তি নিয়ে বাংলাদেশ চীনের সাথে কাজ করতে আগ্রহী: বাণিজ্য উপদেষ্টা
হাজীদের সর্বোত্তম স্বার্থ রক্ষায় সরকার প্রতিশ্রুতিবদ্ধ ধর্ম উপদেষ্টা ড. খালিদ হোসেন
শরীয়তপুরে যুবদল, স্বেচ্ছাসেবক দল ও ছাত্রদলের যৌথ কর্মী সভা
মানিকগঞ্জে সড়ক দুর্ঘটনায় সিকিউরিটি গার্ড নিহত
পাকিস্তানকে উড়িয়ে দিল জিম্বাবুয়ে
১৫ দিন রিমান্ড শেষে কারাগারে আব্দুর রাজ্জাক
লক্ষ্মীপুরে ১২০ টাকায় পুলিশে চাকরি পেলেন ৫০ জন
নির্বাচিত সরকারই দেশকে পুনর্গঠন করতে পারে : তারেক রহমান
বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন জেলা কমিটিতে অচেনা ৭ জন
মৌলভীবাজারে কৃষি ও প্রযুক্তি মেলা শুরু
দ্রব্যমূল্য নিয়ন্ত্রণের মডেল উদ্ভাবন
ব্রহ্মপুত্রে অবৈধ ড্রেজার বসিয়ে চলছে বালু ব্যবসা
বাঘায় কৃষি শ্রমিককে গলা কেটে হত্যা
কেশবপুরে অবৈধ ইটভাটা বন্ধে বিভিন্ন দফতরে অভিযোগ
হামলার শিকার হয়েও মুখ খুলতে পারছে না বোয়ালমারীর বহু পরিবার
ইসলামী আন্দোলনের গণসমাবেশে আ.লীগ নিষিদ্ধের দাবি
বিপিএলের প্রথম দিনই মাঠে নামছে বসুন্ধরা-মোহামেডান
সাগরে মিলছে না আশানুরূপ ইলিশ হতাশায় মীরসরাইয়ের জেলেরা