গ্যাস-বিদ্যুতের নিরবচ্ছিন্ন সরবরাহ নিশ্চিত করতে হবে
২৫ নভেম্বর ২০২৪, ১২:০২ এএম | আপডেট: ২৫ নভেম্বর ২০২৪, ১২:০২ এএম
গ্যাস-বিদ্যুতের সংকটে শিল্পোৎপাদন ব্যাহত হচ্ছে। অবস্থা এতটাই মারাত্মক যে, শিল্প টিকিয়ে রাখাই কঠিন হয়ে পড়েছে। অনেক কারখানা ইতোমধ্যে বন্ধ হয়ে গেছে। বন্ধ হওয়ার মুখে রয়েছে আরও বহু কারখানা। গ্যাস-বিদ্যুতের এই সংকট নতুন নয়। দীর্ঘদিন ধরে এ সংকট চলছে। পতিত স্বৈরাচারী সরকার জ্বালানি ও বিদ্যুৎ খাতে হাজার হাজার কোটি টাকা খরচ করলেও নিরবচ্ছিন্ন গ্যাস ও বিদ্যুতের সরবরাহ নিশ্চিত করতে ব্যর্থ হয়। জ্বালানি ও বিদ্যুৎ খাত অনিয়ম, দুর্নীতি ও লুটপাটের অভয়ক্ষেত্রে পরিণত হয়। গ্যাস অনুসন্ধান ও উত্তোলন বাদ দিয়ে এলএনজি আমদানির ওপর গুরুত্বারোপ, বিদ্যুৎ উৎপাদনে কার্যকর উদ্যেগ না নিয়ে বেসরকারি রেন্টাল-কুইক রেন্টাল বিদ্যুৎ কেন্দ্র প্রতিষ্ঠা ও বিদ্যুৎ আমদানি করা ছিল ভুল বা উদ্দেশ্যপ্রণোদিত নীতিব্যবস্থা। লক্ষ্য ছিল, অবাধ লুটপাট কার্যকর করা। এই লুটপাট যে যথেচ্ছই হয়েছে, এখন একের পর এক তার প্রমাণ মিলছে। অনেকেরই স্মরণ থাকার কথা, বিগত লুটেরা সরকারের কাছে ব্যবসায়ীরা এই মর্মে প্রস্তাব দিয়েছিলেন যে, তাদের গ্যাস-বিদ্যুতের সরবরাহ নিরবচ্ছিন্ন করা হলে তারা বাড়তি দাম দিতে সম্মত আছেন। এর পরও সরকার তাদের চাহিদা পূরণ করতে পারেনি। ওই সরকারের লুটপাটে যত মনোযোগ ছিল, গ্যাস-বিদ্যুতের সংকট মোচনে তার কিছুমাত্র ছিল না। গণঅভ্যুত্থানে স্বৈরাচারী সরকার পালিয়ে গেছে বটে, তবে তার সৃষ্ট সকল সংকট এসে পড়েছে অন্তর্বর্তী সরকারের ঘাড়ে। এই সরকারের পক্ষে তাৎক্ষণিকভাবে গ্যাস-বিদ্যুতের চাহিদা পূরণ করা সম্ভব নয় সংগতকারণেই। এর মধ্যেই গার্মেন্টসহ বিভিন্ন শিল্পে গ্যাস সংকট বেড়েছে। বিদ্যুতের লোডশেডিংও বেড়েছে। গত রোববার বাংলাদেশ চেম্বার অব ইন্ডাস্ট্রি (বিসিআই) আয়োজিত এক সেমিনারে বলা হয়েছে, গ্যাসের অভাবে শিল্পের উৎপাদন কমে যাচ্ছে। ঢাকা, সাভার, আশুলিয়া, গাজীপুর, নরসিংদী, নারায়ণগঞ্জ ও চট্টগ্রামের শিল্প এলাকার বহু কারখানা বন্ধের উপক্রম হয়েছে। সেমিনারে পঠিত মূল প্রবন্ধে অধ্যাপক ইজাজ হোসেন জানিয়েছেন, গ্যাসের অভাবে গার্মেন্ট খাতে ৩০-৩৫ শতাংশ, স্টিল শিল্পে ২৫-৩০ শতাংশ এবং সিরামিক শিল্পে ৫০ শতাংশ উৎপাদন ব্যাহত হচ্ছে। পক্ষান্তরে বিদ্যুতের অভাবে বড় শিল্পে তো বটেই, ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্পেও উৎপাদন ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। গ্রামে গ্রামে বিদ্যুৎ লাইন যাওয়ায় বিদ্যুতের ওপর নির্ভর করে বিভিন্ন শিল্প ও ব্যবসায়ী উদ্যোগ গড়ে উঠেছে। বিদ্যুতের নিরবচ্ছিন্ন সরবরাহ না হলে এসব শিল্প ও ব্যবসায়ী উদ্যোগ লোকসান গুনতে গুনতে হয়তো একসময় বন্ধ হয়ে যাবে। গ্রামীণ অর্থনীতিতে তার ভয়াবহ প্রতিক্রিয়া হবে।
গার্মেন্ট, স্টিল, সিরামিক ইত্যাদি শিল্পের বিস্তার ও বিকাশ ঘটেছে মূলত গ্যাসের সংস্থান ও সস্তা শ্রমের কারণে। গার্মেন্ট আমাদের রফতানি আয়ের প্রধান উৎস। মোট রফতানি আয়ের অন্তত ৮১ শতাংশ আসে গার্মেন্ট থেকে। স্টিলশিল্প আমাদের নির্মাণ খাতের জন্য অপরিহার্য একটি শিল্প। সিরামিকশিল্প শুধু দেশীয় চাহিদাই মেটাচ্ছে না, সিরামিক পণ্য রফতানিও হচ্ছে। অন্যান্য গ্যাসসম্পৃক্ত শিল্পের ক্ষেত্রেও একথা সমান প্রযোজ্য। ব্যবসায়ীদের দাবি, দেশের শিল্পঘন এলাকাগুলোতে বিশেষভাবে গ্যাস সরবরাহ বাড়াতে হবে। নিরবচ্ছিন্ন সরবরাহ নিশ্চিত করতে হবে। একইভাবে বিদ্যুতের সরবরাহও সার্বক্ষণিক করতে হবে। একথা বলার অপেক্ষা রাখে না, জাতীয় সম্পদ গ্যাসের ওপর নির্ভর করে শিল্প কারখানা যেমন গড়ে উঠেছে, তেমনি ইউরিয়া সার উৎপাদনে গ্যাসই প্রধান কাঁচামাল। বিদ্যুৎ উৎপাদনেও গ্যাস জ্বালানি হিসেবে ব্যবহৃত হয়। দেশে সার কারখানা ও বিদ্যুৎকেন্দ্র গড়ে উঠার পেছনে গ্যাস একমাত্র অবলম্বন হিসেবে কাজ করেছে। দেশে উৎপাদিত বিদ্যুতের চতুর্থাংশ আসে গ্যাসনির্ভর বিদ্যুৎ কেন্দ্র থেকে। দুঃখজনক বাস্তবতা এই যে, গ্যাসের অভাবে সার কারখানা বন্ধ হয়েছে। বন্ধ হয়েছে বিদ্যুৎ কেন্দ্রও। এক সময় এমন হয়েছিল, সার উৎপাদন সচল রাখতে বিদ্যুৎ কেন্দ্রে গ্যাস সরবরাহ বন্ধ রাখতে হতো। আবার বিদ্যুৎ কেন্দ্র চালু রাখতে সার কারখানা বন্ধ রাখতে হতো। এভাবে চলতে চলতে সার কারখানা বন্ধ হয়েছে। বিদেশ থেকে সার আমদানি করতে হাজার হাজার কোটি টাকা এখন ব্যয় হচ্ছে। বিদ্যুতের যখন হাহাকার চলছে তখন বেশ কিছু গ্যাস নির্ভর বিদ্যুৎ কেন্দ্র বন্ধ রয়েছে। শিল্পকারখানার গ্যাসের জোগান বাড়ানোর ব্যাপারে যদি যথাসময়ে পদক্ষেপ নেয়া হতো, তাহলে এখন যে দুর্ঘট চলছে, তা সৃষ্টি হতো না। গ্যাসের জোগান বাড়াতে গ্যাস অনুসন্ধান ও উত্তোলন যখন অপরিহার্য ছিল তখন তাতে অবহেলা করা হয়েছে। গত সাড়ে ১৫ বছরে এমন কোনো উদ্যোগ-পদক্ষেপ নেয়া হয়নি, যাতে নতুন গ্যাসক্ষেত্র আবিষ্কৃত এবং নতুন গ্যাসকূপ থেকে বড় রকমে গ্যাস পাওয়া যায়। স্থলে যেমন গ্যাস অনুসন্ধানে নজর দেয়া হয়নি, তেমনি সমুদ্রেও দেয়া হয়নি। সমুদ্রসীমা নির্ধারণের পর ভারত ও মিয়ানমার সমুদ্র থেকে গ্যাস উত্তোলন করছে। অথচ, বাংলাদেশ অনুসন্ধানও চালাতে পারেনি। আমাদের স্থল ও সমুদ্রে প্রচুর গ্যাস মজুত আছে বলে মনে করা হয়। যথার্থ অনুসন্ধান হলে এর সত্যতা প্রমাণিত হতো। নতুন করে গ্যাস পাওয়া গেলে গ্যাসের সংকট হতো না। আমদানিরও প্রয়োজন হতো না।
পর্যবেক্ষকরা মনে করেন, স্থলে ও সমুদ্রে ব্যাপকভাবে গ্যাস অনুসন্ধানের পদক্ষেপ নেয়া হয়নি। বিগত লুটেরা সরকার সেটা করেনি তার স্বার্থে। অন্তর্বর্তী সরকারকে এ ব্যাপারে দ্রুত ও জোরালো উদ্যোগ নিতে হবে। প্রয়োজনীয় গ্যাস পেলে আমাদের শিল্পকারখানা প্রসারিত হবে, বিদ্যুৎ সমস্যারও সুরাহা হবে। গ্যাস-বিদ্যুতের সংকট না থাকলে বিনিয়োগের ক্ষেত্রে একটা জোয়ার তৈরি হবে। দেশি-বিদেশি বিনিয়োগে দীর্ঘদিন ধরে খরা চলছে। কী দেশি, কী বিদেশিÑ কোনো বিনিয়োগই বাড়ছে না, বরং কমার লক্ষণ দেখা যাচ্ছে। গ্যাস, বিদ্যুৎ, জমি, ব্যাংক ঋণ এবং লাভের প্রাপ্তি নিশ্চিত না হলে বিনিয়োগ বাড়ার আশা করা যায় না। দেশের ইপিজেড ও বিশেষ অর্থনৈতিক জোনগুলোতে বিনিয়োগ, বিশেষ করে বিদেশি বিনিয়োগ আশা করা হলেও খুব একটা পাওয়া যাচ্ছে না। কাজেই, বিনিয়োগের অপরিহার্য পূর্বশর্তগুলো প্রতিপালন করতে হবে। বিনিয়োগের আকাক্সিক্ষত পরিবেশের নিশ্চয়তা প্রতিষ্ঠা করতে হবে। তাহলে বিনিয়োগ আসবে। শিল্পায়ন হবে, উৎপাদন ও রফতানি বাড়বে। বাড়বে কর্মসংস্থানও। এ মূহূর্তের গ্যাস-বিদ্যুতে সংকট মোকাবিলায় বাস্তবানুগ কার্যব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে। গ্যাস-বিদ্যুতের অপচয় রোধ করতে হবে, সাশ্রয়ী ব্যবহার নিশ্চিত করতে হবে। জরুরি বিবেচনায় সাময়িকভাবে গ্যাস-বিদ্যুতের আমদানিও বাড়ানো যেতে পারে। যে কোনো মূল্যে গ্যাস-বিদ্যুতের সরবরাহ স্বাভাবিক ও নিরবচ্ছিন্ন করতে হবে।
বিভাগ : সম্পাদকীয়
মন্তব্য করুন
আরও পড়ুন
গুমের দায়ে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর ২২ সদস্য চাকরিচ্যুত
কুরস্ক অঞ্চলের ৪০ ভাগ খোয়ানোর স্বীকারোক্তি ইউক্রেনের
মুক্ত বাণিজ্য চুক্তি নিয়ে বাংলাদেশ চীনের সাথে কাজ করতে আগ্রহী: বাণিজ্য উপদেষ্টা
হাজীদের সর্বোত্তম স্বার্থ রক্ষায় সরকার প্রতিশ্রুতিবদ্ধ ধর্ম উপদেষ্টা ড. খালিদ হোসেন
শরীয়তপুরে যুবদল, স্বেচ্ছাসেবক দল ও ছাত্রদলের যৌথ কর্মী সভা
মানিকগঞ্জে সড়ক দুর্ঘটনায় সিকিউরিটি গার্ড নিহত
পাকিস্তানকে উড়িয়ে দিল জিম্বাবুয়ে
১৫ দিন রিমান্ড শেষে কারাগারে আব্দুর রাজ্জাক
লক্ষ্মীপুরে ১২০ টাকায় পুলিশে চাকরি পেলেন ৫০ জন
নির্বাচিত সরকারই দেশকে পুনর্গঠন করতে পারে : তারেক রহমান
বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন জেলা কমিটিতে অচেনা ৭ জন
মৌলভীবাজারে কৃষি ও প্রযুক্তি মেলা শুরু
দ্রব্যমূল্য নিয়ন্ত্রণের মডেল উদ্ভাবন
ব্রহ্মপুত্রে অবৈধ ড্রেজার বসিয়ে চলছে বালু ব্যবসা
বাঘায় কৃষি শ্রমিককে গলা কেটে হত্যা
কেশবপুরে অবৈধ ইটভাটা বন্ধে বিভিন্ন দফতরে অভিযোগ
হামলার শিকার হয়েও মুখ খুলতে পারছে না বোয়ালমারীর বহু পরিবার
ইসলামী আন্দোলনের গণসমাবেশে আ.লীগ নিষিদ্ধের দাবি
বিপিএলের প্রথম দিনই মাঠে নামছে বসুন্ধরা-মোহামেডান
সাগরে মিলছে না আশানুরূপ ইলিশ হতাশায় মীরসরাইয়ের জেলেরা