পোশাক শিল্পে স্থিতিশীলতা রক্ষা করতে হবে
০৩ ডিসেম্বর ২০২৪, ১২:০৪ এএম | আপডেট: ০৩ ডিসেম্বর ২০২৪, ১২:০৪ এএম
৫ আগস্ট গনঅভ্যুত্থানের পর থেকে পোশাক শিল্পে অস্থিরতা লেগেই আছে। সবার আন্তরিক পরিশ্রমের কারণে পোশাক রফতানিতে দ্বিতীয় অবস্থানে আছে বাংলাদেশ। প্রথম অবস্থানে আছে চীন। বর্তমানে বিশ্ববাজারে বাংলাদেশের হিস্যা ৬ দশমিক ৪ শতাংশ। চীনের হিস্যা ৩১ শতাংশের কিছু বেশি। এ খাতে প্রচুর লোকের কর্মসংস্থান হয়েছে। এ সেক্টরকে ঘিরে প্রশিক্ষণ ইন্সটিটিউট এবং বিশ্ববিদ্যালয়ও হয়েছে। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর ২০২২ সালের তথ্য অনুযায়ী, তৈরি পোশাক শিল্পের মোট লোকবল আছে ৪৩ লাখ ১৬ হাজার। এর মধ্যে ৬২ শতাংশই নারী। কারখানা আছে ৪ হাজার ১১৪টি। গত দুই অর্থ বছরের চিত্র অনুযায়ী, পোশাক রফতানি ইতিবাচক ধারায় ছিল। যেমন: ২০২২ সালে তৈরি পোশাক রফতানি হয়েছে ৪ হাজার কোটি ডলারের এবং ২০২৩ সালে ৪ হাজার ৭৩৯ কোটি ডলারের। এখাতে প্রবৃদ্ধি ১ দশমিক ৭২ শতাংশ। মোট রফতানির ৮১ শতাংশ আয় আসে পোশাক রফতানি খাত থেকে।
উদ্বেগজনক তথ্য হচ্ছে, এই বাজারে বাংলাদেশের পোশাক রফতানি কমেছে। প্রধান প্রতিযোগী ভিয়েতনামের পোশাক রফতানি বেড়েছে। একই সঙ্গে কম্বোডিয়া ও পাকিস্তানেরও বেড়েছে। ইতিবাচক ধারায় ফিরছে ভারতের পোশাক রফতানি প্রবৃদ্ধিও। চলতি বছরের প্রথম ৯ মাসে জানুয়ারি-সেপ্টেম্বর সময়ে বাংলাদেশ যুক্তরাষ্টের বাজারে ৫৪১ কোটি ৬২ লাখ (৫ দশমিক ৪২ বিলিয়ন ডলার) পোশাক রফতানি করেছে। এই অংক গত বছরের একই সময়ের চেয়ে ৬ দশমিক ৩ শতাংশ কম। এর কারণ দেশে তৈরি পোশাক কারখানার শ্রমিক অসন্তোষ ও উৎপাদনে বাধা সৃষ্টি।
রফতানি আয়ের প্রধান উৎস তৈরি পোশাক শিল্পে শ্রমিক অসন্তোষ বন্ধে মালিকদের পাশাপাশি সরকারের পক্ষ থেকে বেশ উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। কিন্তু এই খাতে শ্রমিক অসন্তোষ যেন থামছেই না। অনেকে বলছেন, পরিকল্পিতভাবে এই খাতকে অস্থিতিশীল করতে কাজ করছে শ্রমিকদের পাশাপাশি কিছু কারখানা মালিক। পতিত স্বৈরাচারের দোসর কিছু মালিক ব্যবসা করলেও শ্রমিকদের বেতন দিতে গড়িমসি করছে। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, বেতন না দিয়ে পরিকল্পিতভাবে অস্থিরতা সৃষ্টি করা হয়েছে। বেশ কিছু প্রতিষ্ঠানের মালিক রাজনৈতিক কারণে বিদেশে পালিয়ে রয়েছে। মালিক দেশে নেই এমন যুক্তি দেখিয়ে শ্রমিকদের বেতন দেওয়া হচ্ছে না। এদের শ্রমিকরা আন্দোলনের সুযোগ পাচ্ছে। বিশেষ করে অক্টোবর মাসের বেতনের দাবিতে দেশের পোশাক খাতে তীব্র অসন্তোষ দেখা দেয়। বেতন না পেয়ে সাভার, আশুলিয়া, টঙ্গী, গাজীপুর ও মিরপুরে বিভিন্ন কারখানায় শ্রমিকরা রাস্তায় বিক্ষোভ ও অবরোধ কর্মসূচি পালন করেছে। সংশ্লিষ্টরা আশংকা করছেন শ্রমিকদের বেতন সমস্যা দ্রুত সমাধান করা না হলে অস্থিরতা আরও বাড়বে। দেখা গেছে, টঙ্গীর তারাগাছ অ্যাপারেলসের প্রায় ২ হাজার শ্রমিক বকেয়া বেতনের দাবিতে সড়ক অবরোধ করে। কর্তৃপক্ষ তাদের আশ্বস্ত করে ১৪ নভেম্বরের মধ্যে বেতন পরিশোধ করা হবে। পরবর্তীতে আইনশৃংখলা বাহিনীর হস্তক্ষেপে শ্রমিকরা অবরোধ তুলে নেয়। সাভারের এজিআই অ্যাপারেলসের প্রায় ২ হাজার শ্রমিক অক্টোবর মাসের বেতন না পেয়ে কারখানার বাইরে সড়কে বিক্ষোভ করে। মিরপুরের রিশাল গ্রুপের প্রায় দেড় হাজার শ্রমিক অক্টোবর মাসের বেতন না পেয়ে কারখানার প্রাঙ্গনে অবস্থান নেয়। শৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনতে গিয়ে সেনাবাহিনী ও পুলিশের সাথে তুমুল সংঘর্ষ বাঁধে। অনেক শ্রমিক আহত হয়। উত্তেজিত শ্রমিকেরা সেনাবাহিনীর গাড়ি আগুন দিয়ে পুড়িয়ে দেয়। আরও জানা যায়, গত ১ নভেম্বর থেকে গাজীপুরের পানিশাইল এলাকায় ডরিন ফ্যাশন লিমিটেড কারখানাটি অনির্দিষ্ট কালের জন্য বন্ধ ঘোষণা করে কর্তৃপক্ষ। পরবর্তীতে কারখানা খুলে দেওয়া হলেও লাঞ্চের পর ছুটি দিয়ে দেওয়া হয়। পরদিন শ্রমিকেরা কাজে যোগদান করতে এসে দেখেন ফের তাদের কারখানাটি বন্ধ ঘোষণা করে নোটিশ টাঙ্গিয়ে দেওয়া হয়েছে। ঐ নোটিশ দেখে তীব্র প্রতিবাদ জানান তারা। কারখানা খুলে দেওয়ার জন্য বিক্ষোভ শুরু করেন। এক পর্যায়ে ডরিন ফ্যাশন শ্রমিকেরা চন্দ্রা ও নবীনগর সড়কের জিরানি এলাকায় অবস্থান নিয়ে সড়ক অবরোধ করে। ঐ সময় একই দাবিতে বেক্সিমকো ইন্ডাস্ট্রিয়াল পার্কের শ্রমিকরা ও আন্দোলনরত ছিল। উভয় কারখানার শ্রমিকদের মাঝে কর্মসূচি নিয়ে ধাওয়া ও পাল্টা ধাওয়াও হয়। এ গন্ডগোল এলাকাবাসীর মধ্যে ছড়িয়ে পড়ে। এতে করে ত্রিমুখী সংঘর্ষের সৃষ্টি হয়। কিছু শ্রমিক অহেতুকভাবে বিনা উসকানিতে পূর্বকলতাসূতি এলাকার অ্যামাজান নিটওয়ার নামের একটি কারখানায় অগ্নি সংযোগ করে এবং ব্যাপক ক্ষতিসাধন করে।
তৈরি পোশাক কারখানার মালিকদের মতে, বিগত সরকারের সময় ৪ হাজার কারখানার মধ্যে দু’-একটি কারখানায় সবসময় সমস্যা ছিল। কিন্তু শ্রমিকরা মহাসড়ক অবরোধ করতে দেখা যায়নি। এখন একটু সমস্যা হলেই একটি পক্ষ যেন তাদের মহাসড়কে নিয়ে যাচ্ছে, যা আভ্যন্তরীণভাবে সমাধান হওয়া যোগ্য তা না করে বড় ইস্যু সৃষ্টি করার লক্ষ্যে সড়ক অবরোধে যাচ্ছে। অনেকের ধারণা, বিগত সরকারের একটি সুবিধা ভোগী গোষ্ঠী পরিকল্পিতভাবে এই অস্থিরতায় ইন্ধন দিচ্ছে।
তৈরি পোশাক খাতের শ্রমিকদের নিয়ে কাজ করা সংগঠনগুলোর মধ্যে বিভেদ, প্রতিবেশী রাষ্ট্রের স্বার্থে কাজ করা বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের মতাদর্শের অনুসারী ও শ্রমিক নেতাদের মধ্যে অনৈক্যের কারণে শ্রমিক অসন্তোষ বন্ধ হচ্ছে না বলে তৈরি পোশাক কারখানার মালিক ও শ্রমিক নেতারা মনে করেন। একজন কারখানার মালিক বলেন, পোশাক খাতে ১০০টি সংগঠন আছে। এই সকল সংগঠনের বা ফেডারেশনের নেতাদের মাঝে কোনো জবাবদিহি নেই। অনেক সংগঠন সাইনবোর্ড সর্বস্ব হিসেবে আছে। শুধুমাত্র এদের অস্তিত্ব জাহির করার লক্ষ্যে মাঝে মাঝে সড়ক অবরোধ করে নিজেদের পরিচয় তুলে ধরতে চায়।
ব্যাংক খাতের চলমান সংকটে বিপাকে পড়ছেন বেশ কিছু কারখানার মালিক। মালিকদের ইচ্ছে থাকা স্বত্ত্বেও শুধু ব্যাংকে তারল্য সংকটের কারণে শ্রমিকদের বেতন দিতে পারছে না বেশ কয়েকটি কারখানা। শুধু তাই নয়, তারল্য সংকটের কারণে এলসি খুলতেও সমস্যা হচ্ছে। প্রতিনিয়ত এ ঘটনা ঘটছে। কিছু অর্থপাচারকারীর বিপুল পরিমাণ টাকা ব্যাংক থেকে সরিয়ে নেওয়ার কারণে এর খেসারত দিতে হচ্ছে তৈরি পোশাক মালিকদের। নগদ অর্থের প্রবাহ ঠিক থাকলে শ্রমিকদের বেতন পেতে সমস্যা হতো না। এ ক্ষেত্রে শ্রমিকরাও আন্দোলনে সুযোগ পেত না।
নতুন সরকার প্রায় চার মাস অতিক্রম করলেও গার্মেন্ট খাতের নিয়ন্ত্রণ রয়ে গেছে আগের সরকারের লোকজনের হাতে। বিজ্ঞজনের ধারণা, তারা শ্রমিক আন্দোলনের মাধ্যমে বর্তমান নোবেল বিজয়ী ড. মুহাম্মদ ইউনূস সরকারের ইমেজ নষ্ট করার জন্য এই খাতকে বেছে নিয়েছে। এ ক্ষেত্রে সরকারের বিভিন্ন ধরনের পদক্ষেপ থাকলেও বিশৃঙ্খলা সৃষ্টিকারীদের বিরুদ্ধে শক্ত হাতে আইন প্রয়োগ করতে দেখা যাচ্ছে না। মালিক পক্ষের ধারণা, আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর শিথিলতার সুযোগ নিচ্ছে বিশৃঙ্খলাকারীরা। এটা মানতে হবে, বিশৃঙ্খলাকারীদের চিহ্নিত করে আইনানুগ ব্যবস্থা নিতে পারিনি আইনপ্রয়োগকারী সংস্থাগুলো। তছাড়া বিগত সরকারে গঠিত ইন্ডাস্ট্রিয়াল পুলিশের ভূমিকাও রহস্যজনক।
সম্প্রতি শ্রম মন্ত্রণালয়ের সচিবালয়ে মালিক পক্ষ শ্রমিক নেতাদের নিয়ে একটি বৈঠকের আয়োজন করে শ্রম উপদেষ্টা বিগ্রেডিয়ার জেনারেল (অব.) সাখাওয়াত হোসেন বলেন, দেশের বিভিন্ন স্থানে চলমান শ্রমিক অসন্তোষের যৌক্তিক সমাধান করা হবে। শ্রমিকদের রাস্তা অবরোধ না করে নিজ নিজ কর্মস্থলে যোগদান করার আহবান জানিয়ে তিনি বলেন, আমাদের ওপর ভরসা রাখুন। আপনাদের কষ্ট অনুভব করছি। আপনাদের ন্যায্য পাওনা অবশ্যই পাবেন। তিনি সিদ্ধান্ত নিয়েছেন গাজীপুর, নারায়ণগঞ্জ, আশুলিয়া, সভারসহ কারখানা অধ্যুষিত এলাকাগুলোতে ক্লাস্টার ভিত্তিতে কমিটি গঠন করা হবে। ওই কমিটি মালিকপক্ষকে সার্বক্ষণিক মনিটরিং করবে। তারা বেতন ভাতা পরিশোধ করছে কিনা সরকার ঘোষিত নিম্নতর মজুরি বাস্তবায়িত হচ্ছে কিনা সেটি নিশ্চিত করবে। কেন শ্রমিক অসন্তোষ হচ্ছে তা অনুসন্ধান করবে। শ্রমিকদের ১৮ দফা বাস্তবায়ন কতটা হচ্ছে, সেটাও দেখা হবে।
কারখানা মালিকদের সঙ্গে আলাপে যা জানা গেছে, সাধারণত পোশাক খাতে যে কোনো সমস্যা দেখা দিলে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়, শ্রম মন্ত্রণালয়, তৈরি পোশাক কারখানার মালিক ও শ্রমিকদের মধ্যে যে সমন্বয় থাকা জরুরি ছিল বর্তমানে তা নেই। কয়েকজন ব্যবসায়ী নেতা জানান, বিগত সরকারের আমলে যে কোনো অরাজকতা ও সমস্যা দ্রুত সমাধান হলেও এখন হচ্ছে না বিভিন্ন দফতরের সমন্বয়ের অভাবে।
লেখক: সাবেক ব্যাংক কর্মকর্তা ও কলামিস্ট
বিভাগ : সম্পাদকীয়
মন্তব্য করুন
আরও পড়ুন
ঢাকায় আসছেন ভারতের পররাষ্ট্র সচিব বিক্রম মিশ্রী
ফ্যাসিস্ট সরকারের ৮ বছরের নিষেধাজ্ঞার পর অবশেষে মঞ্চে আসছে থিয়েট্রিক্যাল বাহাস ও কন্ঠনালীতে সূর্য
মিলেছে ‘হারিছ চৌধুরী’র ডিএনএ, রাষ্ট্রীয় মর্যাদায় দাফনের নির্দেশ
নাম পরিবর্তনের দাবি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের
গলায় ফাঁস দিয়ে বৃদ্ধের আত্মহত্যা
আইএসের নৃশংসতার বিচারে জাতিসংঘ ব্যর্থ : নাদিয়া মুরাদ
নোয়াখালীর সুবর্ণচরে ইসকন নিষিদ্ধের দাবিতে হেফাজতের মানববন্ধন
মানিকগঞ্জে হাঙ্গার প্রজেক্টের গণতন্ত্র অলিম্পিয়াড অনুষ্ঠিত
এবার ভারতের মালদহে বাংলাদেশিদের জন্য হোটেল ভাড়া বন্ধ ঘোষণা
কিশোরগঞ্জের হাওর-অর্থনীতি বেগবান করতে চলছে কয়েকশ কোটি টাকার প্রকল্প
প্লাস্টিক ব্যবহার রোধে সবাইকে এগিয়ে আসতে হবে: অতিরিক্ত সচিব ফাহমিদা খানম
দেশের ৬৯ কারাগারের ১৯টি ঝুঁকিপূর্ণ, ৭০ জঙ্গিসহ ৭০০ বন্দি এখনো পলাতক
পায়রার রাজস্ব আয় বাড়বে তিনগুণ, দেশের অর্থনীতিতে রাখবে বড় ভূমিকা
মমতা ব্যানার্জির মনে গভীর কট্টরপন্থি হিন্দুত্ববাদ : রিজভী
কঠিন সময় পার করছে বাংলাদেশ : প্রধান উপদেষ্টা
কুড়িগ্রামে সাবেক এমপি পুত্র সবুজ গ্রেফতার
ভারতে ৫.৩ মাত্রার শক্তিশালী ভূমিকম্প
অমৃতসরে স্বর্ণ মন্দিরে পাঞ্জাবের সাবেক উপমুখ্যমন্ত্রী সুখবীর সিং বাদালের ওপর গুলিবর্ষণ
খুলনায় সন্ত্রাসী হামলায় আহত বিএনপি নেতার মৃত্যু
বাড়তি মেদ কমাতে ‘খাওয়া কমানো’ কতটা কার্যকর