নির্বাচনের রোডম্যাপ নিয়ে নানা কথা
২১ ডিসেম্বর ২০২৪, ১২:০৩ এএম | আপডেট: ২১ ডিসেম্বর ২০২৪, ১২:০৩ এএম
প্রধান উপদেষ্টার বক্তব্যে ‘নির্বাচনী রোডম্যাপ’ নিয়ে আশাহত জানিয়ে বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বলেছেন, নির্বাচনী রোডম্যাপে সুনির্দিষ্ট কিছু বলেননি প্রধান উপদেষ্টা। এক্ষেত্রে আমরা হতাশ হয়েছি। সেই সাথে উপদেষ্টার প্রেস সচিব যে বক্তব্য দিয়েছেন, সেটা সাংঘর্ষিক। প্রধান উপদেষ্টা বলেছেন, ‘২৫ সালের শেষে অথবা ২৬-এর শুরুতে নির্বাচন হবে। আর প্রেস সচিব বলেছেন, ‘২৬-এর জুনে নির্বাচন হতে পারে’। আমরা বুঝতে পারছি না, কোনটি সঠিক। নির্বাচন বিষয়ে রোডম্যাপ কোনো যৌক্তিকতায়ই হয়নি।
জাতীয় সংসদ নির্বাচন কবে হবে, অবিরাম এ জিজ্ঞাসার জবাব আরেকটু খোলাসা করে দিয়েছেন প্রধান উপদেষ্টা। ২০২৫ সালের শেষ দিকে বা ২০২৬ সালের প্রথমার্ধে নির্বাচন হবে এটা বলে দিয়েছেন। মহান বিজয় দিবস উপলক্ষে জাতির উদ্দেশে দেওয়া ভাষণে প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস বলেছেন, ২০২৫ সালের শেষের দিকে নির্বাচন অনুষ্ঠান হয়তো সম্ভব হবে। এর সঙ্গে নির্বাচনব্যবস্থা সংস্কার কমিশনের সুপারিশের পরিপ্রেক্ষিতে এবং জাতীয় ঐকমত্যের ভিত্তিতে প্রত্যাশিত মাত্রার সংস্কার যোগ করলে আরো ছয় মাস অতিরিক্ত সময় লাগতে পারে। এ ধরনের বাক্যে ম্যাসেজ মোটামোটি পরিষ্কার। কিন্তু, রাজনৈতিক দলগুলো তাতে মনে হয় সন্তুষ্ট নয়। তার এ ধরনের কথার মধ্যে তবে-কিন্তু আঁচ করছে তারা। তাই তারা আরো স্পষ্টতা দাবি করছে। যার জেরে পরদিন সংবাদ সম্মেলন করে প্রধান উপদেষ্টার প্রেসসচিব শফিকুল আলম জানান, ২০২৬ সালের ৩০ জুনের মধ্যে আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচন হবে।
প্রেস সচিবের বক্তব্যে নির্বাচনের একটা খসড়া রোডম্যাপ মোটামোটি দেয়া হয়েছে ধরে নেয়া যায়। কিন্তু প্রশ্ন উঠেছে, তিনি এ তথ্য জানানোর কে? প্রধান উপদেষ্টাকে সবাই মিলে, দেশের মানুষ মিলে মনোনীত করেছেন। কিন্তু প্রেস সচিব তো সরকারি চাকরি করেন, সরকারের বেতন নেন, তিনি এ ক্ষমতা পেলেন কোথায়? এখানেই শেষ নয়, প্রেস সচিব প্রধান উপদেষ্টাকেও ক্রস করে ফেলেছেন বলেও ক্ষোভ জানানো হয়েছে।
বিএনপি নেতারা বলছেন, অন্তর্বর্তী সরকার নির্বাচন আয়োজন করতে চাইলে চার থেকে ছয় মাসের বেশি সময় লাগার কথা নয়। সিপিবির মতে, সরকার আন্তরিক হলে ২০২৫ সালের ডিসেম্বরের আগেই নির্বাচন সম্ভব। সুনির্দিষ্ট সময় উল্লেখ না করলেও নির্বাচনের জন্য দীর্ঘ সময় দিতে চায় না জামায়াত। ২০২৬ সালে নির্বাচন হলে আপত্তি নেই ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশের। পছন্দের সময় চায় জাতীয় পার্টি। সেই পছন্দের সময়টা কখন তা এখনই বলতে চায় না দলটি।
অবস্থাদৃষ্টে মনে হচ্ছে, নির্বাচন নিয়ে বেশ একটা জটিলতার সৃষ্টি হয়েছে। প্রধান উপদেষ্টা ড. ইউনূস নিজে অরাজনৈতিক বা রাজনীতির ঊর্ধ্বে। কিন্তু, তার যত কাজ রাজনীতিকদের সাথে। তাদের আয়ত্ব করতে, নিয়ন্ত্রণে নেয়ার চেষ্টায় যে তার অন্ত নেই। কিন্তু, কতোটা পারছেন তা গোপন থাকছে না। বিতাড়িত আওয়ামী লীগ তার স্পষ্ট প্রতিপক্ষ। বিএনপি-জামায়াতসহ ডান-বামের বাকিরাও একেবারে পক্ষ শক্তি নয়। বিপক্ষে না হলেও নির্মোহ সমর্থক নয়। যথাসময়ে, যৌক্তিক সময়ে, যথাশিঘ্র সংস্কার শেষ করে নির্বাচন, এ ধরনের কথায় তারা সন্তুষ্ট হতে পারছে না।
নির্বাচনের এ পথে অইনি জটিলতা কাটিয়ে সম্প্রতি আবারও তত্ত্বাবধায়ক সরকার পদ্ধতি ফিরে এসেছে। আগামী নির্বাচনটি তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে, মানে বর্তমান সরকারটিই তত্ত্বাবধায়ক সরকার হিসেবে কাজ করবে, তাও পরিষ্কার। আদালতের রায়ে অবৈধ ঘোষণা করে আংশিক বাতিল করা হয়েছে পঞ্চদশ সংশোধনী। এর মধ্য দিয়ে ফিরলো তত্ত্বাবধায়ক সরকার পদ্ধতি। ১৭ ডিসেম্বর দেয়া এ রায়ে আদালতের ভাষায় বলা হয়েছে, তত্ত্বাবধায়ক সরকার রাজনৈতিক ঐকমত্যের ভিত্তিতে হয়েছিল। যে কারণে এটি সংবিধানের মৌলিক ভিত্তি হয়ে গেছে। হাইকোর্ট তার পর্যবেক্ষণে বলেন, পঞ্চদশ সংশোধনীর মাধ্যমে সংবিধানের মৌলিক কাঠামোকে ধ্বংস করা হয়েছিল।
গেল কয়েকটি নির্বাচনের মতো তামাশার নির্বাচন আগামীতে হচ্ছে না, তা বলার অপেক্ষা রাখে না। বাংলাদেশে ২০০৯ সাল থেকে বিরোধী রাজনৈতিক দলগুলোর আন্দোলন যখন একে একে ব্যর্থ হতে থাকে এবং ২০২৪ সালের ‘আমি এবং ডামি’ নির্বাচন বানচাল করতে তারা ব্যর্থ হয় তখন প্রায় সকলেই ধরে নিয়েছিলেন যে, আওয়ামী ফ্যাসিস্ট সরকার ২০২৯ সাল পর্যন্ত ক্ষমতায় থাকবে।
বিরোধী রাজনৈতিক দলগুলোর ব্যর্থতার অংশীদার হতে চায়নি কেউ। সাধারণ জনগণও সকল আশা ভরসা ছেড়ে দিয়ে চরম হতাশার মধ্যে নিমজ্জিত হয়ে পড়ে। ২০২৪ সালের জানুয়ারিতে অনুষ্ঠিত জাতীয় সংসদ নির্বাচনের পর মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা যখন বাংলাদেশে আসেন তখন তারা বিরোধী কোনো রাজনৈতিক নেতাদের সঙ্গে কথা বলেননি, কথা বলেছেন সিভিল সোসাইটির নেতাদের সঙ্গে। রাজনৈতিক শূন্যতার পরিবেশে তখনই সংশ্লিষ্টরা বুঝতে পেরেছিলেন ভবিষ্যতে কী হতে যাচ্ছে। এমতাবস্থায়, হঠাৎ করেই ছাত্রদের নেতৃত্বে জুলাই-আগস্ট বিপ্লব যখন শেখ হাসিনার তক্ত-তাউস ভেঙ্গে চুরমার করে দেয় তখন সবকিছুই অনেকের কাছে স্বপ্নের মতো মনে হচ্ছিল। ঘটনা ঘটে যাওয়ার পর ছাত্রদের এই বিজয়ের দাবিদার হতে থাকেন অনেকেই। এটাই জাগতিক নিয়ম। ছাত্ররা তাদের বিজয় অন্য কাউকে হাইজ্যাক করতে দিতে চাইছে না। বিজয়ের কৃতিত্ব তাই আঁকড়ে ধরে রাখার জন্য প্রতিনিয়ত তারা পদক্ষেপ নিচ্ছে। মানে নতুন দল সংগঠিত করছেন।
এদিকে নির্বাচিত সরকারের অধীনে রাষ্ট্র সংস্কারের দাবি তোলায় রাজনৈতিক দলগুলোর অতীতের ভূমিকা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন পরিবেশ উপদেষ্টা সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান। তিনি বলেছেন, ‘আজকে তারা বলছে, সংস্কার তারাই সবচেয়ে ভালো করতে পারবে, এটাই তো গণতান্ত্রিক দেশের কথা। তাইলে তারা ৫৩ বছর কেন করেন নাই?’ কেন আজকে আমাদের দায়িত্ব নেওয়া লাগল, উড ইউ প্লিজ অ্যানসার?
প্রধান উপদেষ্টার এবারের ভাষণে স্পষ্ট যে, সরকার কেবল একটি নির্বাচন দিয়ে জনপ্রতিনিধিদের হাতে ক্ষমতা হস্তান্তর করে দায়িত্ব শেষ করতে চায় না; তারা জাতীয় ঐকমত্য প্রতিষ্ঠায় কমিশন করে রাজনৈতিক সংস্কারের প্রক্রিয়ায়ও শুরু করতে চায়। প্রধান উপদেষ্টার কথা দৃষ্টে নতুন নির্বাচন কমিশনের কাজ চলছে। সে অনুযায়ী নির্বাচন করতে নির্বাচন কমিশন প্রস্তুত বলে জানিয়েছেন সিইসি এ এম এম নাসির উদ্দীন। জানিয়েছেন, তার কমিশন দায়িত্ব নেওয়ার প্রথম দিন থেকেই নির্বাচনের প্রস্তুতিমূলক কাজ শুরু করেছে। সুন্দরভাবে নির্বাচনের যাবতীয় প্রস্তুতি নিয়ে এগোচ্ছেন তারা।
এ আয়োজনের মধ্যে বিএনপির কিছু ‘কিন্তু’ রয়েছে। বিএনপির সঙ্গে যুগপৎ আন্দোলনে থাকা দল ও জোটগুলোও বলেছে, প্রধান উপদেষ্টার এই বক্তব্যে রোডম্যাপ নয় শুধু কিছু ইঙ্গিত পাওয়া গেছে। অন্তর্বর্তী সরকার গঠনের চার মাস পার হওয়ার পর সরকারের শীর্ষ পর্যায় থেকে নির্বাচনের সময় নিয়ে বক্তব্য এলো কেন, এ প্রশ্নও তাদের। বামপন্থী দলগুলোও নির্বাচন নিয়ে প্রধান উপদেষ্টার বক্তব্যে পুরোপুরি সন্তুষ্ট হতে পারেনি। এই দলগুলো সংস্কার এবং নির্বাচনের দিনক্ষণ দিয়ে সুনির্দিষ্ট রোডম্যাপ চায়। তারা মনে করে, রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে আলোচনা করে ২০২৫ সালের মধ্যেই নির্বাচন অনুষ্ঠানের একটি রোডম্যাপ তৈরি করা সম্ভব। কোনো কোনো ইসলামি দলের প্রতিক্রিয়াতেও একই ধরনের অবস্থান প্রকাশ পেয়েছে। রোডম্যাপ প্রশ্নে দলগুলো এখন অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধানের সঙ্গে সংলাপ আশা করছে। এদিকে, কথা না ঘুরিয়ে সোজাসাপ্টা কথা বৈষম্যবিরোধী ছাত্রদের সংগঠন জাতীয় নাগরিক কমিটির। সমাবেশ ডেকে সে জানিয়ে দিয়েছে, শেখ হাসিনার বিচারের আগে যারা নির্বাচন চাইবে, তারা জাতীয় শত্রু। তাদের কথা পরিষ্কার, কিন্তু উদ্দেশ্য ঝাপসা। মহান বিজয় দিবসে রাজধানীতে বিজয় র্যালি করে জাতীয় নাগরিক কমিটির নেতারা বলেছেন, শেখ হাসিনা গত ১৬ বছরে বাংলাদেশের নাগরিকদের হয় দালাল বানিয়েছেন, নইলে দাস বানিয়েছেন। সেই শেখ হাসিনা ও আওয়ামী লীগের বিচার ছাড়া বাংলাদেশে কোনো নির্বাচন হতে দেয়া হবে না। যারাই বিচারের আগে কোনো নির্বাচনের পাঁয়তারা করবে, তাদের জাতীয় শত্রু হিসেবে ধরে নেওয়া হবে।
সমাবেশে জাতীয় নাগরিক কমিটির আহ্বায়ক নাসীরুদ্দীন পাটোয়ারী বলেন, ‘তারা বুলেট ক্রস করেছেন, আগামী দিনে ব্যালটের রেভল্যুশন এলে সেটাও মোকাবিলা করতে প্রস্তুত। তবে সেটা বিচারের আগে নয়। বিচার হবে, এরপর নির্বাচন।’ জাতীয় নাগরিক কমিটির মুখ্য সংগঠক আলোচিত সারজিস আলম আরো তেজি। তিনি বলেন, তাদেরকে নাগরিক হয়ে উঠতে দেয়া হয়নি। চব্বিশের গণঅভ্যুত্থানের পরে সুযোগ হয়েছে নাগরিক হয়ে ওঠার। তারা জুলাই-আগস্ট স্টাইলে কিছু নতুন স্লোগানও ছেড়েছেন। একাত্তর মরে না, চব্বিশ হারে না, ‘আবু সাঈদ মুগ্ধ, শেষ হয়নি যুদ্ধ’Ñ এসব স্লোগানের মাঝে আগামী দিনের রাজনীতি ও নির্বাচন বিষয় রয়েছে।
আবার তাদের পেছনে বর্তমান ক্ষমতাসীনদের সম্পৃক্ততার তথ্যও ঘুরছে। এমন কানাঘুষার মাঝেই রাষ্ট্রপতি মো. সাহাবুদ্দিন চুপ্পুর বঙ্গভবনে বিজয় দিবস উদযাপনের আমন্ত্রণ প্রত্যাখ্যান করেছেন তারা। বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের দপ্তর সেল থেকে সই করা সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়, মহান বিজয় দিবসের মতো জাতীয় গৌরবের দিন ফ্যাসিবাদের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট রাষ্ট্রপতির আমন্ত্রণে পালন করাকে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন গণঅভ্যুত্থানের অভিপ্রায়ের সঙ্গে অসঙ্গতিপূর্ণ মনে করে।
লেখক: সাংবাদিক ও কলামিস্ট।
[email protected]
বিভাগ : সম্পাদকীয়
মন্তব্য করুন
আরও পড়ুন
বিবর্ণ সিটির এবার চোটের ধাক্কা
ফুটবলারদের ইউরোপে খেলার সুযোগ করে দিতে চান হামজা
তারেক রহমান প্রতিহিংসার রাজনীতি করেন না - ডা.মাজহার
হাসান আরিফের প্রথম জানাজায় ড. ইউনূসসহ উপদেষ্টা পরিষদের সদস্যরা
খুনিদের বিচার ও সাদ পন্থীদের কার্যক্রম বাংলাদেশে নিষিদ্ধ করতে হবে
গোয়ালন্দে ৫ জানুয়ারির জনসভা সফল করতে বিএনপির কর্মী সভা অনুষ্ঠিত
রাষ্ট্রীয় পৃষ্ঠপোষকতায় রাজনৈতিক দল হলে সরকারের গ্রহণযোগ্যতা কমবে: রিজভী
সাংবাদিক নির্যাতনে ডিএমসিআরসির উদ্বেগ
বিশ্ব ইজতেমা ময়দানে মুসল্লিদের উপর হামলার প্রতিবাদে ফুলপুরে বিক্ষোভ
বেক্সিমকোসহ বিভিন্ন গার্মেন্টস বন্ধে কর্মহীন হাজারো মানুষ, রেমিট্যান্স হারাচ্ছে দেশ
ভ্রমণকারীদের সচেতন হতে হবে
হাসান আরিফের মৃত্যুতে প্রধান বিচারপতির শোক
বিশ্ব ইজতেমার ভবিষ্যৎ কী?
তাবলিগ একটিই থাকবে : সাদকে নিষিদ্ধ করতে হবে
ঈশ্বরদীতে বিএনপির কর্মীকে কুপিয়ে জখম : ৩৫ ঘরবাড়িতে আগুন
ঝিকরগাছায় অভিনব কায়দায় ৩ লাখ টাকা ছিনতাই, আটক ১
আশাশুনিতে আশ্রয়ণ প্রকল্পের ঘর দখল
লক্ষ্মীপুরে সাজাপ্রাপ্ত বৃদ্ধ কয়েদির মৃত্যু
শীতকাল আল্লাহ তায়ালার নিয়ামত
পানির-ভারসাম্যতত্ত্ব, আসলনকল নির্ধারণী যন্ত্রের আবিষ্কারক মুসলিম মনীষী