বিশ্ব ইজতেমার ভবিষ্যৎ কী?
২১ ডিসেম্বর ২০২৪, ১২:০৩ এএম | আপডেট: ২১ ডিসেম্বর ২০২৪, ১২:০৩ এএম
তুরাগ নদীর তীরে গত ১৭ ডিসেম্বর ভোরবেলা তাবলীগ জামাতের দুই গ্রুপের সমর্থকদের মধ্যে সংঘর্ষ হয়ে গেল। দীর্ঘদিন যাবত তাবলীগ জামাতের মধ্যে বিভেদ ও দ্বন্দ্ব চলে আসছিল। একপক্ষ আরেক পক্ষকে বাতিল ও নিজেরা হক হিসেবে মনে করা থেকে নানা বক্তব্যের জেরে এই দ্বন্দ্ব চরমে রূপ নিয়েছে বলে মনে করা হচ্ছে। এর সংগে যুক্ত হয়েছে সাম্প্রতিক রাজনৈতিক পট পরিবর্তনের ফলে উদ্ভূত নতুন কিছু অনুষঙ্গ। দেশের বর্তমান পরিবর্তিত আর্থ-সামাজিক ও রাজনৈতিক অবস্থার প্রেক্ষিতে প্রতিবেশী দেশের সংগে সম্পর্ক অনেকটা শিথিল থাকা অবস্থায় এবং সেই দেশের ধর্মীয় নেতার সমর্থনকারী হবার অজুহাতে এই ঘটনাটি একটি ব্যাপক জল্পনা-কল্পনার অবকাশ তৈরি করেছে।
গেল ১৭ ডিসেম্বর মঙ্গলবার দিবাগত রাত ৩টার দিকে ভারতীয় মাওলানা সাদ সাহেবের অনুসারীরা টঙ্গীর তুরাগ নদীর পশ্চিম তীর থেকে কামারপাড়া ব্রিজসহ বিভিন্ন রাস্তা ধরে ইজতেমা ময়দানে প্রবেশ করতে থাকেন। তখন ময়দানে বহু মুসুল্লি চটের শামিয়ানার নিচে ঘুমাচ্ছিলেন। এ সময় ময়দানের ভেতর থেকে বাংলাদেশি মাওলানা জোবায়েরপন্থিরা ইটপাটকেল নিক্ষেপ করেন। জবাবে সাদপন্থিরাও পাল্টা হামলা চালান। একপর্যায়ে সাদপন্থিরা ময়দানে প্রবেশ করলে উভয়পক্ষের মধ্যে ব্যাপক সংঘর্ষ শুরু হয়ে যায়। দুই গ্রুপের এই সংঘর্ষে চারজন নিহত ও ৫০ জন আহত হয়েছেন বলে জানিয়েছে বিভিন্ন গণমাধ্যম।
অন্তর্বর্তী সরকারের আইনশৃংখলা বাহিনী ও বিজিবি বিশ্ব ইজতেমা মাঠের নিয়ন্ত্রণ নিয়ে ১৮ ডিসেম্বর মাওলানা সাদ ও মাওলানা জোবায়েরপন্থিদের সঙ্গে বৈঠক করেছে এবং জোড় ইজতেমা বন্ধ করে সবাইকে মাঠ ছেড়ে চলে যেতে বলেছে। টঙ্গী ও আশেপাশের এলাকায় সভা, মিছিল, জমায়েত করা নিষিদ্ধ করে দিয়েছে। গভীর রাতে কেন এমন রক্তের খেলা হলো, এমন নির্মমতা প্রদর্শিত হলো তাতে বাংলাদেশসহ বিশ্বের মুসলমান ও শান্তিকামী মানুষ বিস্মিত ও চিন্তিত।
তাবলীগ জামাতকে বলা হয় সবচেয়ে বড় অরাজনৈতিক ধর্মীয় সংগঠন। সেখানে প্রতিবছর ইজতেমার সময় সব রাজনৈতিক মতাদর্শে বিশ্বাসী মুসলিমগণ যোগ দিয়ে থাকেন। এই তাবলীগ সম্মেলন মুসলমানদের দ্বিতীয় বৃহত্তম জমায়েত। ধর্মভিত্তিক রাজনীতির বাইরে তাবলীগের শিক্ষা ও আদর্শ প্রচারিত হওয়ায় এর একটি বৈশ্বিক পরিচিতি রয়েছে। প্রতিবছর বিশ্বের প্রতিটি কর্নার থেকে ৭০-৮০টি দেশের ধর্মপ্রাণ মুসলমান টঙ্গীর তীরে আসেন ইসলামের শান্তির বাণী শুনে নিজেকে সুশীতল করেন, সেই বাণী পুনরায় সারা বিশ্বের মানুষের কাছে পৌঁছে দেন। বিগত কয়েক দশকে ইসলামের দাওয়াত পৌঁছানোর মাধ্যমে তাবলীগের অনুসারীর সংখ্যা বহুগুণ বৃদ্ধি পেয়েছে। ইসলামের প্রতি সাধারণ মানুষের আগ্রহ বেড়েছে আরো অনেক বেশি।
তাবলীগ পরিচালিত হয় মুরুব্বীভিত্তিক একটি ধর্মীয় অনুশাসনের মাধ্যমে। যেখানে মুরুব্বির আদেশ, ইসলামের বয়ানকে বেশ শ্রদ্ধা ও ভালবাসার সাথে গ্রহণ করে কঠোর ধর্মীয় নিয়মানুবির্তিতার মাধ্যমে আত্মশুদ্ধি চালিয়ে মুসুল্লিরা নিজেকে সংশোধন করে নেন। বক্তিগত জীবনে ইসলামের গভীর চর্চার সাথে পরিবার ও সমাজ জীবনে এর ইতিবাচক প্রতিফলন ঘটতে দেখা যায়। এর আন্তর্জাতিক চরিত্রও বেশ প্রশংসনীয় হয়ে উঠেছে। সাথে এত বড় মুসলিম জমায়েতকে পরিচালনা করার সক্ষমতা ও সামর্থ্যের মাধ্যমে বাংলাদেশের মর্যাদাও বেড়েছে।
তবে দিন বদলেছে। ইসলামের নামে অসংখ্য দল, উপদল সৃষ্টি হয়েছে। অনেক জায়গায় কিছু কট্টর লোকেরা ইসলামের নামে নানা সংগঠন খুলে বসেছেন। এত কিছুর পরেও তাবলীগকে বিতর্কিত হতে দেখা যায়নি। কারণ, কেউ তাবলীগের বিরুদ্ধে খুনসুটি বা বিরুদ্ধাচারণ করে কথা বললেও সেখানে পাল্টা বা প্রতিবাদ না জানিয়ে বরং মুব্বিদের সাথে পরামর্শ করে অত্যন্ত আদবের সাথে বিষয়টির সমাধান করার ব্যাপারে জোর দেয়ার নিয়ম রয়েছে। এর উপর প্রকাশনাও খুব হাতেগোনা। তাই তাবলীগী বিষয় নিয়ে পারস্পরিক দ্বন্দ্ব-কলহ হবার নজির খুব কম।
কিন্তু কয়েক বছর আগে তাবলীগ জামাত হঠাৎ দু’ভাগে বিভক্ত হয়ে যায়। তাদের গোলমাল জটিল আকার ধারণ করলে রাষ্ট্র হস্তক্ষেপ করতে বাধ্য হয়। রাষ্ট্র দু’পক্ষের মুরুব্বীদের সঙ্গে আলোচনা করে দু’পক্ষকে আলাদা আলাদা সময়ে ইজতেমা করার নির্দেশনা দেয়। গেল কয় বছর ধরে দুটি ইজতেমা অনুষ্ঠিত হয়ে আসছিল।
বলা বাহুল্য, দিনে দিনে মানুষ খুব অস্থির ও অসহিষ্ণু হয়ে উঠেছে। করোনা পরবর্তী সময়ে এই অস্থিরতা সারা বিশ্বের মানুষের মধ্যে উত্তেজনা বাড়িয়ে তুলেছে। যুদ্ধ-বিগ্রহ ও ধর্মীয় আবরণে নানা সহিংস ঘটনার জন্ম হয়েছে।
তাবলীগ জামাত হঠাৎ দু’ভাগে ভাগ হয়ে যাবার পর থেকে পারস্পরিক বিদ্বেষ মেটানোর কোনো উপায় কেউ গ্রহণ করতে এগিয়ে আসেনি। তৎকালীন সরকারও না, বর্তমান সরকারও না। গত মাসে ঢাকার সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে মাওলানা জোবায়েরপন্থিদের বৃহৎ সমাবেশ থেকে বড় উত্তেজনা তৈরি হলে সেটা নিরসনে শুধু ছাত্র সমন্বয়কদের কয়েকজনকে পাঠানো হয়েছিল। কিন্তু সেটা স্থায়ী হয়নি। সরকার তাৎক্ষণিকভাবে প্রো-একটিভ হয়ে উঠলে এই সংকট এড়ানো যেত বলে মনে হয়। যার ফলস্বরূপ টঙ্গী ময়দানে হঠাৎ বড় সহিংসতা ও রক্তপাত হয়েছে বলে বিশ্লেষকগণ মনে করছেন।
এর সাথে প্রতিবেশী দেশের সাথে দূরত্ব তৈরির বিষয়টিকে খাটো করে দেখার উপায় নেই। কিছুদিন পূর্বে চট্টগ্রামে একজন আইনজীবীকে হত্যা করার কাজটিও ছিল ইসলামোফোবিয়ায় আক্রান্ত হয়ে ভিন্ন একটি ধর্মীয় গোষ্ঠীর ঘৃণ্য ঘটনা। এর আলামত ৫ আগস্টের পট পরিবর্তনের পর থেকে বেশ গভীরভাবে লক্ষণীয় হয়ে উঠেছিল। সেদিন কাকডাকা ভোরে তুরাগ মাঠে টুপি দাড়ি পরে কারা আক্রমণ ও প্রতিআক্রমণে মানুষ হত্যায় উন্মত্ত হয়ে উঠেছিল তা তদন্ত করে বের করা দরকার। এটা খুব কঠিন কাজ নয়। রাষ্ট্র এই কাজে সময় পায়নি বলে কোনো ধরনের এক্সকিউজ চাইবে সেটা এই ঘটনায় অন্তত মানায় না।
এই মুহূর্তে টঙ্গীর সহিংস ঘটনায় আসলে করণীয় কী? ইজতেমা কি তাহলে এবছর হবে না? যদিও হত্যা মামলা রুজু হওয়ায় এই ঘটনা একটি আইনী বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে তবুও এটাকে শক্ত হাতে সমাধান করতে তৎপরতা চালাতে হবে। কারণ, এই মর্মান্তিক ঘটনা শুধু আমাদের দেশে নয়, আন্তর্জাতিকভাবে ভুল বার্তা ছড়ানোর কাজ করছে। প্রতিবেশী দেশের অসংখ্য গণমাধ্যম এই সরকারের প্রতি অত্যন্ত রোষের বশবর্তী হয়ে শুরু থেকে ন্যক্কারজনক প্রচারণা চালাচ্ছে, বাংলাদেশের বিরুদ্ধে। প্রতিবেশীর সংগে দূরত্ব সৃষ্টির এই নাজুক সময়ে টঙ্গীর ঘটনার কাভারেজ শুধু ইসলামোফোবিয়া থেকেই নয় বরং পালিয়ে থাকা দেশিদের মাধ্যমে ঘৃণ্য রাজনৈতিক দাবাখেলায় মত্ত হবার উপাদান হিসেবে কাজে লাগানো হচ্ছে।
তাই তাবলীগ ইস্যুতে বিশ্ব মুসলিমের ঐক্য খুব জরুরি হয়ে দেখা দিয়েছে। ইসলামের নামে বিভেদ সৃষ্টি, মারামারি, রক্তপাত মুসলমানদের কাজ নয়। যারা তুরাগের ময়দানে কলহ করে এটাকে কারবালা ময়দানে পরিণত করেছেন তারা খুবই গর্হিত কাজ করেছেন। যারা রং দিয়ে, খোঁড়া অজুহাত নিয়ে দিনাতিপাত করছেন তারা বোকার স্বর্গে বাস করছেন। কেন তারা পরস্পরের বিরুদ্ধে গিয়ে শান্তির ধর্মপ্রচারের পথ থেকে বিচ্যুত হয়ে পড়ছেন তা বোধগম্য নয়।
ভিনদেশি গণমাধ্যমের অপপ্রচারের শিকার হয়ে জঙ্গিবাদের ক্রীড়নক হয়ে যাবেন, সেটাও বোধগম্য নয়। সেজন্য সকল তাবলীগি ভাইদের প্রতি আবেদন, তারা যেন সময় থাকতে সকল দ্বন্দ্ব-সংঘাত ভুলে আত্মশুদ্ধির পথে ফিরে এসে ইসলামের শান্তির বাণী প্রচারে মনোযোগী হন।
লেখক: রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজকর্ম বিভাগের প্রফেসর ও সামাজিক বিজ্ঞান অনুষদের সাবেক ডিন।
[email protected]
বিভাগ : সম্পাদকীয়
মন্তব্য করুন
আরও পড়ুন
বিবর্ণ সিটির এবার চোটের ধাক্কা
ফুটবলারদের ইউরোপে খেলার সুযোগ করে দিতে চান হামজা
তারেক রহমান প্রতিহিংসার রাজনীতি করেন না - ডা.মাজহার
হাসান আরিফের প্রথম জানাজায় ড. ইউনূসসহ উপদেষ্টা পরিষদের সদস্যরা
খুনিদের বিচার ও সাদ পন্থীদের কার্যক্রম বাংলাদেশে নিষিদ্ধ করতে হবে
গোয়ালন্দে ৫ জানুয়ারির জনসভা সফল করতে বিএনপির কর্মী সভা অনুষ্ঠিত
রাষ্ট্রীয় পৃষ্ঠপোষকতায় রাজনৈতিক দল হলে সরকারের গ্রহণযোগ্যতা কমবে: রিজভী
সাংবাদিক নির্যাতনে ডিএমসিআরসির উদ্বেগ
বিশ্ব ইজতেমা ময়দানে মুসল্লিদের উপর হামলার প্রতিবাদে ফুলপুরে বিক্ষোভ
বেক্সিমকোসহ বিভিন্ন গার্মেন্টস বন্ধে কর্মহীন হাজারো মানুষ, রেমিট্যান্স হারাচ্ছে দেশ
ভ্রমণকারীদের সচেতন হতে হবে
হাসান আরিফের মৃত্যুতে প্রধান বিচারপতির শোক
নির্বাচনের রোডম্যাপ নিয়ে নানা কথা
তাবলিগ একটিই থাকবে : সাদকে নিষিদ্ধ করতে হবে
ঈশ্বরদীতে বিএনপির কর্মীকে কুপিয়ে জখম : ৩৫ ঘরবাড়িতে আগুন
ঝিকরগাছায় অভিনব কায়দায় ৩ লাখ টাকা ছিনতাই, আটক ১
আশাশুনিতে আশ্রয়ণ প্রকল্পের ঘর দখল
লক্ষ্মীপুরে সাজাপ্রাপ্ত বৃদ্ধ কয়েদির মৃত্যু
শীতকাল আল্লাহ তায়ালার নিয়ামত
পানির-ভারসাম্যতত্ত্ব, আসলনকল নির্ধারণী যন্ত্রের আবিষ্কারক মুসলিম মনীষী