গণস্বার্থে সিদ্ধান্ত পুনর্বিবেচনা করতে হবে
১৩ জানুয়ারি ২০২৫, ১২:০৯ এএম | আপডেট: ১৩ জানুয়ারি ২০২৫, ১২:০৯ এএম
দেশের দরিদ্র ও স্বল্প আয়ের সাধারণ মানুষ দীর্ঘদিন ধরে কষ্টে আছে। পতিত স্বৈরাচারের আমলে বলা হয়েছে, সরকার ব্যবসায়ী বান্ধব। এর মানে, সরকার ব্যবসায়ীদের জন্য; মানুষের জন্য নয়। বাস্তবেও দেখা গেছে, সরকার যত সুযোগ, যত সুবিধা সব ব্যবসায়ীদের দিয়েছে। জনগণকে বঞ্চিত করেছে। তাদের পাশে দাঁড়ায়নি। নির্বিচারে দফায় দফায় পণ্য ও সেবায় শুল্ক-কর বাড়ানো হয়েছে। নিরূপায় হয়ে সেটাই মেনে নিতে হয়েছে সবাইকে। উচ্চ মূল্যস্ফীতিসহ জীবনযাত্রার ব্যয় অস্বাভাবিকভাবে বেড়েছে। আয়ের সঙ্গে ব্যয়ের সঙ্গতি না থাকায় সাধারণ মানুষকে খেয়ে না খেয়ে, অতি প্রয়োজনীয় পণ্য কম কিনে, শিক্ষা-চিকিৎসার মতো জরুরি ব্যয় কর্তন করে টিকে থাকতে হয়েছে। ওই সময়ে ‘মানুষের অর্থনীতি’ চরম বিপন্ন দশায় উপনীত হয়। অন্যদিকে বেপরোয়া দুর্নীতি, অপচয়, লুটপাট ও অবাধ অর্থপাচারে ‘দেশের অর্থনীতি’ও সম্পূর্ণ ফোকলা হয়ে যায়। স্বৈরাচারের পতন ও বিদায়ের পর উভয় ক্ষেত্রে অর্থনীতির আসল চিত্র বেরিয়ে আসছে। অন্তর্বর্তী সরকার সম্পূর্ণ ধসে যাওয়া অর্থনীতির প্রেক্ষাপটে দায়িত্ব নিয়েছে। সঙ্গতকারণেই অর্থনীতির পুনরুদ্ধারকে সরকার উচ্চ অগ্রাধিকার দিয়েছে। কিন্তু গত পাঁচ মাসে দু’ একটি ক্ষেত্র ছাড়া সকল ক্ষেত্রেই সাফল্য দেখাতে পারেনি। মূল্যস্ফীতি গত বহুদিন ধরে দুই সংখ্যার ওপর। এর কোনো পরিবর্তন ঘটেনি। বরং মূল্যস্ফীতি আরো বেড়েছে। দেশের অর্থনীতিও একই হালে রয়েছে। বিনিয়োগ নেই, উৎপাদন রফতানি নি¤œমুখী, বেকারের সংখ্যা ক্রমবর্ধমান। অনেক শিল্প-কারখানা বন্ধ হয়ে গেছে। এমতাবস্থায়, শিল্পে গ্যাসের দাম বাড়ানোর প্রস্তাব করা হয়েছে। পাঁয়তারা চলছে আবাসিকে দাম বাড়ানোর। এই সঙ্গে বিদ্যুৎ ও পানির দাম বাড়ানোরও প্রক্রিয়া চলছে। ইতোমধ্যে শতাধিক পণ্য ও সেবায় ভ্যাট ও সম্পুরক শুল্ক বাড়ানো হয়েছে। সরকার ১ জানুয়ারি ‘মূল্য সংযোজন কর ও সম্পূরক শুল্ক (সংশোধন) অধ্যাদেশ-২০২৫’ এবং ‘দ্য একসাইজ অ্যান্ড সল্ট (সংশোধন) ২০২৫’ নামে দু’টি অধ্যাদেশ জারি করেছে। এনবিআর সঙ্গে সঙ্গে তা বাস্তবায়নের নির্দেশনা দিয়েছে। সকলেরই জানা, এনবিআর রাজস্ব আদায়লক্ষ্য অর্জনে ব্যর্থ একটি প্রতিষ্ঠান। বছরের পর বছর তার এ ব্যর্থতা বহমান আছে। রাজস্ব আহরণে ব্যর্থ হলেও প্রতিষ্ঠানটি প্রস্তাব ও সুপারিশ দিয়ে ভ্যাট-শুল্ক বাড়ানোর ক্ষেত্রে ওস্তাদ বটে। আর্থিক দিক দিয়ে সরকার সংকটে আছে। তার আয় বাড়ানো দরকার। কিন্তু সাধারণ মানুষের ঘাড়ে ভ্যাট-শুল্কের বোঝা চাপিয়ে আয় বাড়ানো হবে, সেটা সমর্থনযোগ্য হতে পারে না। এ পদক্ষেপ গণবিরোধী বলে বর্ণিত হয়েছে।
বলা হয়েছে, আইএমএফ’র ঋণের শর্ত প্রতিপালনে সরকার এ পদক্ষেপ নিয়েছে। বিগত স্বৈরাচারী সরকার আইএমএফ’র ঋণ পেতে ন্যায়-অন্যায় শর্ত পরোয়া করেনি। বিষয়টি নিয়ে অন্তর্বর্তী সরকার আইএমএফ’র সঙ্গে কথা বলতে পারতো। বলেছে কিনা, আমাদের জানা নেই। বললে হয়তো ফলাফল ইতিবাচক হতে পারতো। সাধারণ মানুষে ওপর জুলুম হয়, এমন কাজ থেকে সরকার বাইরে থাকতে পারতো। প্রায় শতেক খানেক পণ্যে ভ্যাট বাড়ানো হয়েছে ৭ থেকে ১৫ শতাংশ হারে। এসব পণ্যের মধ্যে রয়েছে ওষুধ, এলপি গ্যাস, গুঁড়া দুধ, বিস্কিট, আচার, ফলমূল, সাবান-ডিটারজেন্ট, মিষ্টি ইত্যাদি। অন্যদিকে ইন্টারনেট, মোবাইল টকটাইমসহ অন্তত ৪২টি পণ্য ও সেবার সম্পূরক শুল্ক ৫০ শতাংশের বেশি বাড়ানো হয়েছে। ইতোমধ্যেই পণ্য ও সেবায় অতিরিক্ত ভ্যাট-শুল্ক আরোপের বিরূপ প্রতিক্রিয়া দেখা দিতে শুরু করেছে। পণ্য ও সেবা ক্রয়ে কমতির আলামত দৃশ্যমান হয়েছে। সরকারের তরফে জানানো হয়েছে, বর্ধিত ভ্যাট-শুল্ক সাধারণ মানুষের জীবনে প্রভাব ফেলবে না। অর্থনীতিবিদরা সরকারের এ অভিমত মানতে রাজি নন। তাদের মতে, ভ্যাট-শুল্কের এই বৃদ্ধি নিশ্চিতভাবেই মূল্যস্ফীতি আরো বাড়াবে। পণ্যগুলো চাল-আটার মত নিত্য প্রয়োজনীয় না হলেও নিত্য ব্যবহার্য পণ্য বটে। ভ্যাট বৃদ্ধিতে এসব পণ্যের মূল্য বৃদ্ধি হবে। পণ্যগুলো সাধারণ মানুষও কেনে এবং ব্যবহার করে। ইন্টারনেট, মোবাইল ফোন, সিম কার্ড ইত্যাদিও সাধারণ মানুষ সবাই ব্যবহার করে। এসব কিনতে তাদের ব্যয় বাড়বে। জীবনযাত্রার ব্যয় আরো স্ফীত হবে। সেটা তাদের জন্য দুর্বহ হবে। সরকারের কাজ জনগণের শান্তি ও স্বস্তি নিশ্চিত করা। তাদের কষ্ট-দুর্ভোগ বাড়ানো জনহিতৈষী কোনো সরকারের কাজ হতে পারে না। দুঃখজনকভাবে আমরা লক্ষ্য করছি, সরকারের অধিকাংশ উপদেষ্টার সঙ্গে সাধারণ মানুষের তেমন কোনো সম্পর্ক নেই। তাদের অনেকে এনজিওসম্পৃক্ত ও বয়সের ভারে নত। তাদের মধ্যে উদ্যম ও সৃজনশীলতা স্বভাবতই কম। তারা ক্ষমতা উপভোগ করছেন। কিন্তু গণকল্যাণে তা ব্যবহার করতে পারছেন না। এর মধ্যেই আমরা জেনেছি, টিসিবির মাধ্যমে কম দামে পণ্য বিক্রী বন্ধ করে দেয়া হয়েছে। লাখ লাখ গরীব, এমন কি মধ্যবিত্ত শ্রেণির মানুষও এর মাধ্যমে উপকৃত হতো। কোন বুদ্ধিতে এটা বন্ধ করে দেয়া হয়েছে?
ভ্যাট-শুল্ক বৃদ্ধি এবং খোলাবাজারে নিত্যপণ্যের বিক্রী বন্ধ করে দেয়াতে সরাসরি ক্ষতিগ্রস্ত হবে সাধারণ মানুষ, যাদের সংখ্যাই সবচেয়ে বেশি। অন্তর্বর্তী সরকার এই দুটি সিদ্ধান্ত ও পদক্ষেপ নিয়ে নির্মমতার পরিচয় দিয়েছে। অতীতে সাড়ে ১৫ বছর ধরে স্বৈরাচার একের পর এক গণবিরোধী সিদ্ধান্ত ও পদক্ষেপ নিয়েছে। গণঅভ্যুত্থানের মাধ্যমে প্রতিষ্ঠিত সরকারও যদি স্বৈর সরকারের মতো আচরণ করে তবে মানুষ যাবে কোথায়? এটা কারোই কাম্য হতে পারে না। গণমত এটাই যে, অবিলম্বে ভ্যাট-শুল্ক বাড়ানোর সিদ্ধান্ত প্রত্যাহার করা হোক এবং চালু করা হোক খোলাবাজারে পণ্য বিক্রী। অর্থনীতিবিদ ও ব্যবসায়ীদের অভিমত, সরকারের এ জাতীয় সিদ্ধান্ত ও পদক্ষেপে সামগ্রিক অর্থনীতির কোনো উপকার হবে না। অর্থনীতি চাঙ্গা হবে না; বরং তার শক্তি কমে যাবে। সরকারের উচিত হবে, বিনিয়োগ বাড়ানো, স্থাপিত শিল্প-কারখানা সুরক্ষাসহ উৎপাদন-রফতানি বৃদ্ধি এবং নতুন কর্মসংস্থান সৃষ্টি করা। রাজস্ব আয় বাড়ানোর জন্য সরকারের উচিত প্রত্যক্ষ কর আদায়ের ক্ষেত্রে জোর দেয়া এবং অপ্রত্যক্ষ করারোপ পরিহার করা। করের আওতা আরো বাড়ানো এবং কর আদায়ের ক্ষেত্রে দুর্নীতি নিরোধ করা। এসব পদক্ষেপ নিলে মানুষের অর্থনীতি যেমন ভালো থাকবে, তেমনি দেশের অর্থনীতিও গতিশীল ও ঋদ্ধ হবে। আমরা আশা করবো, গণস্বার্থে সরকার গৃহীত সিদ্ধান্ত পুনর্বিবেচনা করবে।
বিভাগ : সম্পাদকীয়
মন্তব্য করুন
আরও পড়ুন
৯ দফা বাস্তবায়নে পদক্ষেপ কতদূর?
মর্গের দুই লাশের দাবিদার দুই পরিবার,
আইনজীবীকে হত্যার হত্যাচেষ্টা: শেখ হাসিনা-জয়সহ ৯৩ জনের মামলা এজাহার হিসেবে গ্রহণের নির্দেশ
তথ্য থাকলেও সন্দেহজনক লেনদেনে দেরিতে ব্যবস্থা নিচ্ছে বিএফআইইউ!
সাবেক এমপি হেনরীর ৫৬ কোটি টাকার সম্পত্তি জব্দের নির্দেশ,
গ্যাসের দাম বাড়ানোর উদ্যোগে উৎকণ্ঠায় নারায়ণগঞ্জের ব্যবসায়ীরা
দেশে এইচএমপি ভাইরাস আক্রান্ত রোগী শনাক্ত
শাহজালাল বিমানবন্দরে বিমান বাহিনীর সদস্যদের অপসারণে আইনি নোটিশ
চকরিয়ায় পুলিশ-সন্ত্রাসীদের মধ্যে গোলাগুলি: বসতবাতিতে আগুন, ওয়ার্ড মেম্বারসহ আহত ২
স্বাধীন সামরিক বাহিনী সংস্কার কমিশন গঠনের প্রস্তাব
শেখ হাসিনার চোখ ছিল শুধু ঢাকা থেকে টুঙ্গীপাড়া পর্যন্ত : সারজিস
শেখ হাসিনা ভারতের সাথে বৈষম্যমৃলক চূক্তি করেছিলেন-মৌলভীবাজারে সারজিস আলম
ব্র্যাক ব্যাংকের টপ টেন রেমিটেন্স অ্যাওয়ার্ড জয় ২০২৪ সালে ১.৬ বিলিয়ন ডলার রেমিটেন্স সংগ্রহ
ওসি মুহিবুল্লাহকে বাঁচাতে স্বজনদের মানববন্ধন
পাটগ্রাম সীমান্তে বাংলাদেশিকে লক্ষ্য করে বিএসএফের গুলি, আহত ১
ওয়ান টাইম প্লাস্টিক বন্ধে ক্ষতিগ্রস্ত হবে ৬ হাজার প্রতিষ্ঠান: বিপিজিএমইএ
চলমান সংস্কার গতিশীল করতে হবে, যাতে কেউ প্রশ্ন তুলতে না পারে : মান্না
ফরিদপুরে পৃথক সড়ক দুর্ঘটনায় তিন দিনে মোট ১১ জন নিহত, আহত ৩৫
বিধ্বংসী শতকে লিটনের জবাব, ঝড়ো সেঞ্চুরি তানজিদেরও, বিপিএলে রেকর্ড
ঐক্যবদ্ধ থাকলে কোন ষড়যন্ত্রকারী বিএনপির ক্ষতি করতে পারবে না : আমিনুল হক