বই পড়ায় অনাগ্রহ বাড়ছে

Daily Inqilab আফতাব চৌধুরী

০৯ ফেব্রুয়ারি ২০২৫, ১২:০৫ এএম | আপডেট: ০৯ ফেব্রুয়ারি ২০২৫, ১২:০৫ এএম

বই পড়ার প্রয়োজনীয়তা সম্পর্কে জনৈক মনীষীর বক্তব্য হলো, ‘আমাদের শিক্ষিত সমাজের লোলুপ দৃষ্টি আজ অর্থের উপরেই পড়ে রয়েছে, সুতরাং সাহিত্য চর্চার সুফল সম্বন্ধে আমরা অনেকেই সন্দিহান। যারা হাজার খানা ল রিপোর্ট কিনেন, তারা একখানা কাব্যগ্রন্থও কিনতে প্রস্তুত নন, কেননা, তাতে ব্যবসার কোনও সুসার নেই।’

আমাদের স্কুল-কলেজের শিক্ষার পদ্ধতি সম্পর্কে বলতে গিয়ে প্রমথ চৌধুরী বলেন, ‘যেখানে ছেলে-মেয়েদের বিদ্যা গিলানো হয়, তারা তা জীর্ণ করতে পারুক আর নাই পারুক, এর ফলে ছেলেরা শারীরিক ও মানসিক মন্দাগ্নিতে জীর্ণ হয়ে কলেজ থেকে বেরিয়ে আসে। আমাদের সমাজে এমন অনেক মা আছেন, যারা শিশু সন্তানকে ক্রমান্বয়ে গরুর দুধ গেলানোটাই শিশুর স্বাস্থ্যরক্ষার ও বলবৃদ্ধির প্রধান উপায় মনে করেন। গোদুগ্ধ অবশ্য অতি উপাদেয় পদার্থ, কিন্তু তার উপকারিতা যে ভোক্তার জীর্ণ করার শক্তির উপর নির্ভর করে, এ জ্ঞান ওশ্রেণির মাতৃকুলের নেই। তাদের বিশ্বাস, ও বস্তু পেটে গেলেই উপকার হবে। কাজেই শিশু যদি তা গিলতে আপত্তি করে, তাহলে সে ব্যায়াড়া ছেলে, সে বিষয়ে আর বিন্দুমাত্র সন্দেহ থাকে না। অতএব, তখন তাকে ধরে বেঁধে জোরজবরদস্তি করে দুধ খাওয়ানোর ব্যবস্থা করা যায়। শেষটা সে যখন এ দুগ্ধপান ক্রিয়া হতে অব্যাহতি লাভ করবার জন্য মাথা নাড়তে, হাত-পা ছুঁড়তে শুরু করে, তখন স্নেহময়ী মাতা বলেন, আমার মাথা খাও, মরা মুখ দেখো ইত্যাদি। মাতার উদ্দেশ্যে যে খুব সাধু, সে বিষয়ে কোনও সন্দেহ নেই, কিন্তু এ বিষয়েও কোনও সন্দেহ নেই যে, উক্ত কথা বলার ফলে শুধু ছেলের যকৃতের মাথা খান। আমাদের স্কুল-কলেজের শিক্ষা-পদ্ধতিটাও ওই একই ধরনের।’

বর্তমানে বাড়িতে ওই পদ্ধতি আরও কঠোরভাবেই বলবৎ করা হয়েছে। কেননা, এ যুগের পিতা-মাতারা সন্তানদের পড়াশোনার ব্যাপারে আরও সিরিয়াস হয়েছেন। তাই এদের গল্পের বই পড়ার প্রশ্নই ওঠে না। ‘শকুন্তলা’য় বিদ্যাসাগর বলেছিলেন, ‘বুঝিলাম স্নেহ অতি ভীষণ বস্তু’। বস্তুত এই আপত্যস্নেহে বশীভূত মা-জননীরা কখনও কখনও ছোট ছোট সন্তান-সন্তুতিদের টিভির সম্মুখে বসতে দেন। এটা অবসর বিনোদনের মোক্ষম দাওয়াই তথা জোরে বলে বিদ্যা গেলার উপযুক্ত পুরস্কার বা বোনাস হিসাবেই তারা আদায় করে নিচ্ছে।

তাৎক্ষণিক আনন্দলাভের আশায় আজকাল যুব সমাজের গল্প-উপন্যাস পড়ার মোটেই অবকাশ নেই। রাত জেগে মোবাইল দেখে, টিভি দেখে তারা কেবল পশ্চিমা রীতির জীবনযাপন প্রণালী এবং যৌনতাতপ্ত ছবি দেখে চলেছে। কেউ জানে না, এর শেষ কোথায়, সমাপ্তি কোথায়? কারও কারও হাতে হয়ত বা কখনও কখনও দু’একটি একটি ম্যাগাজিন দেখা যায়। তবে আজকের দিনের প্রায় সবকটি ম্যাগাজিনের ভূমিকা খুবই ন্যাক্কারজনক এবং এগুলোরই কাটতি বেশি। যে কোনও ম্যাগাজিনের দোকানে দাঁড়ালে দেখা যায় সেখানে বেশিরভাগই কুরুচিপূর্ণ প্রচ্ছদযুক্ত ম্যাগাজিন ঝোলানো রয়েছে।

বাইরের প্রচ্ছদপট দেখে ভিতরের সারবত্তা সহজেই আঁচ করা যায়। মোট কথা ঘরে ঘরে টেবিলে টেবিলে সিনেমা, সিরিয়াল আর মোবাইলে দৌলতে নবীন প্রজম্মদের বই পড়ার প্রয়োজন আজ ফুরিয়ে গিয়েছে। যান্ত্রিক সভ্যতার উন্নয়নের সুবাদে আমাদের জীবন যাপনের পদ্ধতি এমন দ্রুত গতিতে পাল্টে যাচ্ছে, যা এর আগে শত বছরেও এরূপ দেখা যায়নি। আজ থেকে পঞ্চাশ-ষাট বছর আগে অর্থাৎ আমাদের বাল্য-কৈশরে বই পড়াই ছিল অবসর বিনোদনের একটা প্রধান অঙ্গ। খেলাধূলার মতো এটাও ছিল অন্যতম হবি বা শখ। সে সময়ে আমরাও ক্লাব গঠন করেছি, তবে এর প্রধান শর্ত ছিল নিদেন পক্ষে অন্তত শ’ দুয়েক বই ক্রয় করে তাতে পাঠাগার স্থাপন করা। আজকাল পাড়ায় পাড়ায়, গলিতে গলিতে অসংখ্য ক্লাব গঠিত হচ্ছে, তবে উপরোক্ত শর্তের লেশমাত্র চিহ্নও চোখে পড়ছে না।

তখনকার দিনে অভিভাবকরা আমাদের পড়াশোনার খুব একটা খবর না রাখলেও চলতো। কেননা বিদ্যালয়ের আদর্শ শিক্ষকের উপরই ছিল তাদের ষোল আনা ভরসা। তাদের সে ভরসা পুরো মাত্রায়ই ফলপ্রসূ হয়েছে। স্কুল, কলেজ জীবনে পড়ালেখার ফাঁকে ফাঁকে আমরা স্কুল ও কলেজ লাইব্রেরি থেকে নানা বই সংগ্রহ করেছি। এছাড়া জেলা গ্রন্থাগার এবং মহকুমা গ্রন্থাগারেও ছিল আমাদের নিত্য আড্ডা। আজও এসব পাঠাগার সরকারি পয়সার বিস্তর অপচয় করে এক পায়ে দাঁড়িয়ে আছে। কিন্তু পাঠকের অভাবে ওইসব গ্রন্থাগারের লক্ষ্মীছাড়া দৈনদশা বাস্তবিকই বেদনার সঞ্চার করে। কোথাও যেন প্রাণের পছন্দ নেই।

সেদিন আমাদের শিক্ষিত অথবা অর্ধশিক্ষিত প্রতিটি পরিবারের ঘরে ঘরে ভালো ভালো সাহিত্য ম্যাগাজিন শোভা পেত। আমরা নামীদামী, জ্ঞানীগুণী লেখক-লেখিকাদের গল্প উপন্যাস ধারাবাহিকভাবে নিয়মিত পাঠ করেছি। তবুও যেন আশা মিটেনি। তাই পরে বই আকারে প্রকাশিত হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে আমরা এগুলোকে ‘যেন তেন প্রকারে’ লুফে নিয়েছি। তাছাড়া ভৌগোলিক-ঐতিহাসিক-বৈজ্ঞানিক নানা গ্রন্থও সুযোগ পেলে আমরা পাঠ করেছি। এগুলো ব্যবহারিক জীবনে জ্ঞানের পরিধি বিস্তারে সহায়ক হয়েছে। সবচেয়ে বড় কথা সাহিত্যিক অঙ্গনে অবাধে বিচরণের ফলস্বরূপই তখনকার মানুষের নৈতিক মূল্যবোধের সঙ্গে এখনকার প্রজন্মদের মূল্যবোধে বিস্তর ফারাক দেখা দিয়েছে।

আজকের যুব সমাজ হতাশাগ্রস্ত, উদাসীন। তারা কেমন যেন মনমরা। বই পড়ার অভাবেই তাদের মন সবল, সচল সরাগ ও সমৃদ্ধ হওয়ার উপাই নেই। বড় হওয়ার পরিবর্তে দিনে দিনে তাদের মনের পরিধি আরও সংকীর্ণ হয়ে যাচ্ছে। মানবিকতা, মূল্যবোধ এসব দিনে দিনে হারিয়ে যাচ্ছে। ব্যবসার খাতিরে বিভিন্ন টিভি চ্যানেল ক্ষণিকের জন্য স্থ’ূল রুচির আমোদ-প্রমোদ উপহার দিচ্ছে সত্যি তবে এগুলো তাদের মনে স্থায়ী প্রশান্তির কোনও প্রলেপ সিঞ্চন করছে না। এখন তো আবার ইন্টারনেট-ওটিটির যুগ, সবকিছু একেবারে হাতের মুঠোয় চলে এসেছে। কিন্তু সেসব বিনোদন প্রকৃত অর্থে নবীন প্রজন্মকে বিশুদ্ধ মরুভূমির দিকে সবেগে ধাবিত করছে। বই পড়ার অভাবে প্রকৃতার্থে জ্ঞানের বর্তিকা ছাড়াও টিভি থেকে আয়ত্ব স্থূল রুচির ক্ষণস্থায়ী আবেগকে মূলধন করে নবপ্রজন্মরা ব্যবহারিক জীবনে পদার্পণ করছে। সেখানে ব্যথা, বেদনা ও নৈরাজ্যের হাহাকার ছাড়া ওদের জন্য আর কী-ই বা অপেক্ষা করতে পারে?

লেখক: সাংবাদিক ও কলামিস্ট।


বিভাগ : সম্পাদকীয়


মন্তব্য করুন

HTML Comment Box is loading comments...

এই বিভাগের আরও

মুসলিম শাসকরা কি ইহুদিদের দাসে পরিণত হয়েছেন?
হাসিনার পতনের পর বিএনপির আট মাস
ট্রান্সশিপমেন্ট বাতিল : বৈরিতার বহিঃপ্রকাশ
প্রতিবন্ধীবান্ধব অবকাঠামোর অপ্রতুলতা
ক্ষুদ্র ও মাঝারি খাতের বিকাশে জোর দিতে হবে
আরও
X

আরও পড়ুন

মতলব মুন্সীর হাট বাজারে আগুনে পুড়েছে ১৭ ব্যবসা প্রতিষ্ঠান

মতলব মুন্সীর হাট বাজারে আগুনে পুড়েছে ১৭ ব্যবসা প্রতিষ্ঠান

আর্টেমিস অ্যাকর্ডে যুক্ত হওয়ায় বাংলাদেশকে স্বাগত জানাল যুক্তরাষ্ট্র

আর্টেমিস অ্যাকর্ডে যুক্ত হওয়ায় বাংলাদেশকে স্বাগত জানাল যুক্তরাষ্ট্র

দেশের চার অঞ্চলে দুপুরের মধ্যেই ঝড়ের শঙ্কা, নদীবন্দরগুলোকে সতর্ক বার্তা

দেশের চার অঞ্চলে দুপুরের মধ্যেই ঝড়ের শঙ্কা, নদীবন্দরগুলোকে সতর্ক বার্তা

সাগরে ডাকাতি: ২ কোটি টাকার মালপত্র লুট, ২৫ ঘণ্টা পর ৬৮ জেলে উদ্ধার

সাগরে ডাকাতি: ২ কোটি টাকার মালপত্র লুট, ২৫ ঘণ্টা পর ৬৮ জেলে উদ্ধার

ইসরাইলি অবরোধে অপুষ্টিতে ভুগছে গাজার ৬০,০০০ শিশু : জাতিসংঘ

ইসরাইলি অবরোধে অপুষ্টিতে ভুগছে গাজার ৬০,০০০ শিশু : জাতিসংঘ

আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীদের গোপন ঢাকামুখী যাত্রা, গোয়েন্দা তথ্যে চাঞ্চল্য

আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীদের গোপন ঢাকামুখী যাত্রা, গোয়েন্দা তথ্যে চাঞ্চল্য

ঢাকায় তাপমাত্রা কমার আভাস, শীতল দিনে স্বস্তির সম্ভাবনা

ঢাকায় তাপমাত্রা কমার আভাস, শীতল দিনে স্বস্তির সম্ভাবনা

হঠাৎ বাংলাদেশের ট্রান্সশিপমেন্ট সুবিধা বাতিল, ভারতের উদ্দেশ্য কী ছিল?

হঠাৎ বাংলাদেশের ট্রান্সশিপমেন্ট সুবিধা বাতিল, ভারতের উদ্দেশ্য কী ছিল?

রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানের ৯ জিএমকে ডিএমডি পদে পদোন্নতি

রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানের ৯ জিএমকে ডিএমডি পদে পদোন্নতি

নোয়াখালীতে আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর স্থাপনের দাবিতে মন্ত্রণালয়ে চিঠি ডিসি'র

নোয়াখালীতে আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর স্থাপনের দাবিতে মন্ত্রণালয়ে চিঠি ডিসি'র

ইসরায়েলের বর্বরতার প্রতিবাদে রাজধানীতে মোটরসাইকেল র‌্যালি

ইসরায়েলের বর্বরতার প্রতিবাদে রাজধানীতে মোটরসাইকেল র‌্যালি

সৈয়দপুরে স্বেচ্ছাসেবক দলের নেতার বাড়ি থেকে বোমা সাদৃশ্য বস্তু উদ্ধার

সৈয়দপুরে স্বেচ্ছাসেবক দলের নেতার বাড়ি থেকে বোমা সাদৃশ্য বস্তু উদ্ধার

বিনিয়োগকারীদের চোখ আগামী নির্বাচিত সরকারের দিকে: খসরু

বিনিয়োগকারীদের চোখ আগামী নির্বাচিত সরকারের দিকে: খসরু

ভারতজুড়ে ওয়াকফ আইন নিয়ে তীব্র বিক্ষোভ ও আইনি লড়াই

ভারতজুড়ে ওয়াকফ আইন নিয়ে তীব্র বিক্ষোভ ও আইনি লড়াই

ভক্ত, দর্শনার্থীদের পদচারণায় মুখোরিত মোরেলগঞ্জের লক্ষীখালি বারুনী স্নানোৎসব ও ধর্মীয় মাতুয়া মেলা

ভক্ত, দর্শনার্থীদের পদচারণায় মুখোরিত মোরেলগঞ্জের লক্ষীখালি বারুনী স্নানোৎসব ও ধর্মীয় মাতুয়া মেলা

ইসরায়েলি অবরোধে ত্রাণহীন গাজায় মানবিক বিপর্যয়

ইসরায়েলি অবরোধে ত্রাণহীন গাজায় মানবিক বিপর্যয়

ড. ইউনূসের নেতৃত্ব বাংলাদেশের সমৃদ্ধি আনবে, প্রত্যাশা আমিরাত প্রেসিডেন্টের

ড. ইউনূসের নেতৃত্ব বাংলাদেশের সমৃদ্ধি আনবে, প্রত্যাশা আমিরাত প্রেসিডেন্টের

নদীতে গোসল করতে নেমে প্রাণ গেল দুই বোনের

নদীতে গোসল করতে নেমে প্রাণ গেল দুই বোনের

জীবিত অভিবাসীদের ‘মৃত’ ঘোষণা করে তাড়াচ্ছে ট্রাম্প প্রশাসন

জীবিত অভিবাসীদের ‘মৃত’ ঘোষণা করে তাড়াচ্ছে ট্রাম্প প্রশাসন

বঙ্গোপসাগরে ৪ ট্রলারে ডাকাতি, গুলিবিদ্ধসহ আহত ৮

বঙ্গোপসাগরে ৪ ট্রলারে ডাকাতি, গুলিবিদ্ধসহ আহত ৮