আর নয় বিভাজন ও সংঘাতের রাজনীতি

Daily Inqilab ইনকিলাব

২০ ফেব্রুয়ারি ২০২৫, ১২:০৫ এএম | আপডেট: ২০ ফেব্রুয়ারি ২০২৫, ১২:০৫ এএম

খুলনা বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ে(কুয়েট) ছাত্রদল, বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের মধ্যকার সংর্ঘষ নিয়ে সারাদেশে শিক্ষাঙ্গণে পারস্পরিক দোষারোপ ও কাঁদা ছোঁড়াছুড়ি চলছে। হাজারো ছাত্র-জনতার জীবন ও রক্তের বিনিময়ে অর্জিত নতুন বাংলাদেশে অভ্যুত্থানের অংশীদার ছাত্র সংগঠনগুলোর এমন বিপরীতমুখী অবস্থান ও সাংঘর্ষিক ভ’মিকা স্বৈরাচারের দোসরদের প্রত্যাবর্তন ও পুনর্বাসনের পথকেই সুগম করবে। এহেন বাস্তবতা মেনে নেয়া যায় না। শুধু কুয়েটেই নয়, দেশের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে লেজুড়বৃত্তির ছাত্র রাজনীতি বন্ধে এক ধরণের ঐকমত্য প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল। বিশেষত ক্ষমতার ছত্রছায়ায় ছাত্রলীগের ভয়ঙ্কর সন্ত্রাসী সংগঠনে পরিনত হওয়ার বাস্তবতায় আর কোনো ছাত্র সংগঠনকে অনুরূপ অবস্থায় ফিরে আসতে দিতে চায়না দেশের সাধারণ ছাত্র সমাজ। এ ক্ষেত্রে ছাত্র রাজনীতিতে নীতিগত ও গুণগত পরিবর্তন নিশ্চিত করা এখন সময়ের দাবি। কুয়েটে ছাত্রদলের ফরম বিক্রি এবং বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের প্রতিবাদী সমাবেশে কথিত ছাত্রদলের হামলায় বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষকসহ শতাধিক শিক্ষার্থীর আহত হওয়ার ঘটনাকে খাটো করে দেখার সুযোগ নেই। এই ঘটনার সুষ্ঠু, নিরপেক্ষ তদন্ত সাপেক্ষে দোষিদের বিরুদ্ধে কার্যকর প্রশাসনিক ও সাংগঠনিক ব্যবস্থা গ্রহণের মধ্য দিয়ে ফ্যাসিবাদ বিরোধী ছাত্রদের ঐক্য ফিরিয়ে আনতে হবে। ঘটনার নেপথ্যে ও প্রকাশ্যে যে বা যারাই থাকুক, দ্রুততম সময়ে তাদের বিরুদ্ধে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি নিশ্চিত করতে হবে। এ কথা স্পষ্ট যে, ফ্যাসিবাদী আওয়ামী বিরোধী আন্দোলন ও অভ্যুত্থানের শরিক ছাত্র সংগঠনগুলোর মধ্যে বিভেদ-বৈরীতা সৃষ্টি করা পতিত স্বৈরাচারের দোসরদের গোপন এজেন্ডা। এ থেকে তারাই সবচেয়ে বেশি লাভবান হতে পারে। দেশকে আর অতীতের ঘৃণ্য রাজনীতির দিকে নিয়ে যাওয়ার যে কোনো অপপ্রয়াস সম্মিলিতভাবে মোকাবেলা করতে হবে।

বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানের ডাকে সাড়া দিয়ে তিস্তার পানির ন্যায্য হিস্যার দাবিতে যখন উত্তরের জেলাগুলোর সমাবেশে জনতার ঢল নেমেছে, তখন কুয়েট ক্যাম্পাসে ছাত্রদলের পরিচয়ে বৈষম্যবিরোধী ছাত্রদের উপর ন্যক্কারজনক হামলার ঘটনা মানুষের নজরকে ভিন্নখাতে প্রবাহিত করেছে। এতে একদিকে ছাত্রদলের প্রতি সাধারণ শিক্ষার্থীদের একটি বিরূপ অবস্থান তৈরী হচ্ছে, গণঅভ্যুত্থানের অংশীদারদের মধ্যকার বিভেদ-বিভাজন ও সংঘাতের সুযোগে ঘাপটি মেরে থাকা ছাত্রলীগ ও পতিত স্বৈরাচারের দোসররা স্বমূর্তিতে ফিরে আসার সুযোগ নিতে পারে। এমনকি কুয়েট ক্যাম্পাসে সাংঘাত ও হামলায় যে সব বহিরাগত ছাত্রদল-যুবদল সদস্যের জড়িত থাকার অভিযোগ উঠেছে, তাদের সাথে মুখশধারি ও হেলমেটধারি ব্যক্তিদের উপস্থিতি বিগত স্বৈরাচারি আমলে ছাত্রলীগ-যুবলীগের হেলমেট বাহিনীর কথাই স্মরণ করিয়ে দিচ্ছে। ছাত্রদলের ছাত্রলীগের ভ’মিকায় অবতীর্ণ হওয়া কিংবা ছাত্রদলের সাথে মিশে ছাত্রলীগকর্মীদের নৃশংস হামলায় অংশগ্রহণ, যেটাই ঘটুক না কেন, দেশের সাধারণ মানুষ এবং ছাত্র-জনতা এটা স্বাভাবিকভাবে মেনে নেবে না। কুয়েট ক্যাম্পাসে এবং ক্যাম্পাসের বাইরে যারা মুখ ঢেকে হাতে লম্বা বগি, রামদা নিয়ে প্রতিপক্ষের উপর হামলা করেছে, তাদেরকে শনাক্ত বা চিহ্নিত করা খুব কঠিন কিছু নয়। অনেক ছবি এবং ভিডিও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ছড়িয়ে আছে। এর বাইরেও কুয়েট শিক্ষার্থীদের কাছে অনেক ছবি ও ভিডিও পাওয়া যাবে। সময়মত যথাযথ পদক্ষেপ নিতে না পারাসহ প্রশাসন ও আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর বিরুদ্ধে যে সব অভিযোগ উঠে এসেছে তারও জবাবদিহিতা নিশ্চিত করতে হবে।

দেশের গণতন্ত্রকামি মানুষ আর বিভেদ-বিভাজনের পুরনো রাজনৈতিক ধারায় ফিরে যেতে চায় না। বিগত স্বৈরাচার একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধ ও পরবর্তি রাজনৈতিক বন্দোবস্তকে সামনে রেখে জাতিকে অন্তহীনভাবে বিভাজিত করে যে বিপজ্জনক রাজনৈতিক ধারা চালু করেছিল, নতুন প্রজন্ম তা প্রত্যাখ্যান করে জাতীয় ঐক্যের অনন্য নজির সৃষ্টি করেছে। জাতীয় স্বার্থ ও জাতীয় ঐক্যের ভিত্তিতে সব পক্ষের শান্তিপূর্ণ সহাবস্থানের রাজনীতি নিশ্চিত করাই নতুন বাংলাদেশের প্রথম প্রত্যাশা। সেখানে নতুন করে একাত্তরকেন্দ্রিক বিভাজন সৃষ্টি কিংবা ছাত্রলীগের সুরে কোনো ক্যাম্পাসে ‘একটা-দুইটা শিবির ধর, ধইরা ধইরা জবাই কর’ ধরণের শ্লোগান গণঅভ্যুত্থানের মধ্য দিয়ে সৃষ্ট নতুন বাংলাদেশের জন্য একটি অশনি সংকেত। শিক্ষাঙ্গণে আবার লেজুড়বৃত্তির ছাত্র রাজনীতি, অস্ত্রের ঝনঝনানি, রক্তপাত-হানাহানির এই বাস্তবতা দেশের সাধারণ মানুষ মেনে নেবে না। এ ধরণের পরিস্থিতি যারা সৃষ্টি করবে তারা মানুষের কাছে প্রত্যাখ্যাত হবে। দেশের বৃহত্তম রাজনৈতিক দল ও ছাত্র সংগঠন হিসেবে বিএনপি ও ছাত্রদলের দায় অবশ্যই বেশি। বিএনপি ও ছাত্রদলের কিছু নেতার দায়িত্বহীন কথাবার্তা ও আচরণের ফলে পুরো দলের ভাবমর্যাদা ও অবস্থান ক্ষুন্ন হচ্ছে। গত ১৬ বছর ধরে প্রবল প্রতিকূল পরিস্থিতিতেও বিএনপি-জামায়াতের রাজনৈতিক ঐক্য অটুট ছিল। এ ক্ষেত্রে খালেদা জিয়া ও তারেক রহমানের দৃঢ় ভ’মিকা ছিল। নির্বাচনের সময়সীমা ও সংস্কার নিয়ে দলগুলোর মধ্যে কিছু মতবিরোধ থাকা স্বাভাবিক। এটাই গণতন্ত্রের সৌন্দর্য। ফ্যাসিবাদের বিরুদ্ধে, গুম-খুনের বিচারের প্রশ্নে গড়ে ওঠা জাতীয় ঐক্য রক্ষার কোনো বিকল্প নাই। অথচ কারো কারো কণ্ঠে ফ্যাসিবাদের ধ্বনি ও বিভেদ-বিসংবাদের আওয়াজ শোনা যাচ্ছে যা অনভিপ্রেত ও দু:খজনক। পতিত স্বৈরাচারের দোসররা সারাদেশে ওত পেতে আছে। দিল্লী থেকে নানা ধরণের উস্কানিমূলক তৎপরতা ও প্রপাগান্ডা চলছে। তারা ছাত্র-জনতার গণঅভ্যুত্থানের স্পিরিটকে ব্যর্থ করে দিতে চায়। রাজনৈতিক ঐক্যমত্য বিনষ্ট করে পরিস্থিতিকে সংঘাতের দিকে ঠেলে দেয়াই তাদের অন্যতম টার্গেট। বিএনপি-জামায়াতের মত রাজনৈতিক দলগুলো সে ফাঁদে পা দিলে তা দেশের জন্য বড় বিপর্যয় ডেকে আনতে পারে। কুয়েটে সংঘাত-সংঘর্ষের প্রভাব দেশের বিভিন্ন ক্যাম্পাসে পড়ছে। সব পক্ষের সর্বোচ্চ পর্যায়ের সঠিক নির্দেশনা, আলোচনা ও সমঝোতার মাধ্যমে মতভেদ ও বিভাজন দূর করার উদ্যোগ নিতে হবে। যারা অতীতের বিভাজন ও দুর্গন্ধযুক্ত রাজনীতিকে সামনে এনে জাতিকে আবারো বিভক্ত করতে চায় তারা গণতন্ত্রের পক্ষের শক্তি বলে বিবেচিত হবে না। তাদের বিরুদ্ধে দলীয়ভাবে ব্যবস্থা নিতে হবে। সব পক্ষের অংশগ্রহণ ও সহযোগিতা ছাড়া গুম-খুনের বিচার, সাংবিধানিক সংস্কার এবং শান্তিপূর্ণ ও অংশগ্রহণমূলক জাতীয় নির্বাচন নিশ্চিত করা সম্ভব নয়। মনে রাখতে হবে, রাজনৈতিক সংস্কার ও অবাধ নির্বাচনের মধ্য দিয়ে ক্ষমতার শান্তিপূর্ণ পালাবদল ও জনগণের অংশীদারিত্ব নিশ্চিত করাই ফ্যাসিবাদ বিরোধী গণঅভ্যুত্থানের মূল লক্ষ্য।


বিভাগ : সম্পাদকীয়


মন্তব্য করুন

HTML Comment Box is loading comments...

এই বিভাগের আরও

বই আত্মার মহৌষধ
পহেলা বৈশাখ শুধু একটি দিন নয়
সুযোগের সদ্ব্যবহার করতে হবে
শুভ নববর্ষ
আন্তঃধর্মীয় সংলাপের গুরুত্ব
আরও
X

আরও পড়ুন

নববর্ষ উদযাপনে মনোহরগঞ্জ উপজেলা বিএনপির আনন্দ শোভাযাত্রা

নববর্ষ উদযাপনে মনোহরগঞ্জ উপজেলা বিএনপির আনন্দ শোভাযাত্রা

মাজারের বার্ষিক ওরসের মেলায় অন্তঃসত্ত্বা স্ত্রীকে জবাই করে হত্যা করল স্বামী

মাজারের বার্ষিক ওরসের মেলায় অন্তঃসত্ত্বা স্ত্রীকে জবাই করে হত্যা করল স্বামী

কুমিল্লার রাজগঞ্জ বাজারে অগ্নিকাণ্ডে পৌনে দুই কোটি টাকার মালামাল ভস্মীভূত

কুমিল্লার রাজগঞ্জ বাজারে অগ্নিকাণ্ডে পৌনে দুই কোটি টাকার মালামাল ভস্মীভূত

সরকার নয়, আমরা একটি দেশ হিসেবে কাজ করছি: জ্বালানি উপদেষ্টা

সরকার নয়, আমরা একটি দেশ হিসেবে কাজ করছি: জ্বালানি উপদেষ্টা

মতলবে উপজেলা বিএনপির বর্ষবরণ আনন্দ শোভাযাত্রা

মতলবে উপজেলা বিএনপির বর্ষবরণ আনন্দ শোভাযাত্রা

ফিলিস্তিনবাসীদের শান্তি কামনায়   বিশেষ দোয়া মাহফিল

ফিলিস্তিনবাসীদের শান্তি কামনায়  বিশেষ দোয়া মাহফিল

বর্ণাঢ্য ‘ড্রোন শো’ দেখে মুগ্ধ লাখো মানুষ

বর্ণাঢ্য ‘ড্রোন শো’ দেখে মুগ্ধ লাখো মানুষ

নতুন বছরে সংস্কার ও নির্বাচন নিয়ে অনিশ্চয়তা দূর হোক  : মঞ্জু

নতুন বছরে সংস্কার ও নির্বাচন নিয়ে অনিশ্চয়তা দূর হোক : মঞ্জু

বুধবার ঢাকায় আসছেন যুক্তরাষ্ট্রের দুই উপসহকারী পররাষ্ট্রমন্ত্রী

বুধবার ঢাকায় আসছেন যুক্তরাষ্ট্রের দুই উপসহকারী পররাষ্ট্রমন্ত্রী

পুরোনো পদে ফিরলেন গাঙ্গুলি

পুরোনো পদে ফিরলেন গাঙ্গুলি

আসছে দক্ষিণ আফ্রিকা ইমার্জিং নারী ক্রিকেট দল

আসছে দক্ষিণ আফ্রিকা ইমার্জিং নারী ক্রিকেট দল

রূপায়ণ সিটিতে শতকন্ঠে বর্ষবরণ

রূপায়ণ সিটিতে শতকন্ঠে বর্ষবরণ

বর্ষবরণকে স্বাগত জানিয়ে গাজীপুরে জেলা বিএনপির শোভাযাত্রা

বর্ষবরণকে স্বাগত জানিয়ে গাজীপুরে জেলা বিএনপির শোভাযাত্রা

আমরা নতুন বাংলাদেশে প্রবেশ করেছি: ফারুকী

আমরা নতুন বাংলাদেশে প্রবেশ করেছি: ফারুকী

ভারতীয়দের হজ কোটা ৮০ শতাংশ কমাল সৌদি

ভারতীয়দের হজ কোটা ৮০ শতাংশ কমাল সৌদি

চীনা দূতাবাসের সৌজন্যে ঢাকার আকাশে ব্যতিক্রমী ড্রোন শো

চীনা দূতাবাসের সৌজন্যে ঢাকার আকাশে ব্যতিক্রমী ড্রোন শো

নাসিরনগর প্রশাসনের বর্ষবরণে উপস্থাপক ছাত্রলীগ কর্মী, সাংবাদিককে এসিল্যান্ড বললেন কিছু হবে না!

নাসিরনগর প্রশাসনের বর্ষবরণে উপস্থাপক ছাত্রলীগ কর্মী, সাংবাদিককে এসিল্যান্ড বললেন কিছু হবে না!

মালয়েশিয়ার সাবেক প্রধানমন্ত্রী আব্দুল্লাহ আহমাদ মারা গেছেন

মালয়েশিয়ার সাবেক প্রধানমন্ত্রী আব্দুল্লাহ আহমাদ মারা গেছেন

পহেলা বৈশাখ আমাদের সংস্কৃতি, ভালোবাসা আর আনন্দের  প্রতীক : সমাজকল্যাণ উপদেষ্টা

পহেলা বৈশাখ আমাদের সংস্কৃতি, ভালোবাসা আর আনন্দের প্রতীক : সমাজকল্যাণ উপদেষ্টা

নববর্ষে আইন শৃঙ্খলা সুরক্ষায়  প্রশংসনীয় ভূমিকায় র‍‍্যাব - ৯

নববর্ষে আইন শৃঙ্খলা সুরক্ষায়  প্রশংসনীয় ভূমিকায় র‍‍্যাব - ৯