ভাষাশহীদ ও আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস

Daily Inqilab ইনকিলাব

২১ ফেব্রুয়ারি ২০২৫, ১২:১৫ এএম | আপডেট: ২১ ফেব্রুয়ারি ২০২৫, ১২:১৫ এএম

আজ একুশে ফেব্রুয়ারি, মহান ভাষাশহীদ ও আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস। জাতি হিসেবে আমাদের আত্মপরিচয় ও স্বাতন্ত্রের দাবি ঊর্ধ্বে তুলে ধরার ঐতিহাসিক দিন। মাতৃভাষার সম্মান ও মর্যাদা রক্ষায় সালাম, বরকত, রফিক, জব্বারসহ জাগ্রত তারুণ্যের প্রতিনিধিরা ১৯৫২ সালের একুশে ফেব্রুয়ারিতে শাসকদের লেলিয়ে দেয়া পুলিশের গুলিতে আত্মোৎসর্গ করেছিলেন। তাদের সেই আত্মত্যাগের বিনিময়ে শাসকরা বাংলাকে রাষ্ট্রভাষার মর্যাদা দিতে বাধ্য হয়েছিল। অন্যদিকে, ভাষার জন্য জীবন দেয়ার বিরল ইতিহাস রচনার সুবাদে একুশে ফেব্রুয়ারি এখন আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস হিসেবে স্বীকৃতি লাভ করেছে। হাজার বছরের লালিত স্বকীয় বৈশিষ্ট্য ও আত্মমর্যাদার দাবিকে অগ্রাহ্য করার বিরুদ্ধে বায়ান্নতে রুখে দাঁড়ানোর শাণিত চেতনার পথ বেয়ে দেশের মানুষ পরবর্তী প্রতিটি রাজনৈতিক আন্দোলন-সংগ্রামকে সাফল্যের দ্বারপ্রান্তে এগিয়ে দিতে সক্ষম হয়েছে। বাষট্টির শিক্ষা আন্দোলন, ঊনসত্তরের গণঅভ্যুত্থান, সত্তরের নির্বাচন, স্বাধিকার সংগ্রাম এবং একাত্তরের স্বাধীনতাযুদ্ধের চেতনার মধ্যে মহান ভাষাশহীদদের আত্মদান এবং এ দেশের মানুষের গণতান্ত্রিক মূল্যবোধ ফল্গুধারার মতো প্রবাহমান ছিল। আজকের এইদিনে আমরা মহান ভাষাশহীদদের অমলিন স্মৃতির প্রতি গভীর শ্রদ্ধা জানাচ্ছি। তাদের রূহের মাগফিরাত কামনা করছি।

ব্রিটিশভারতে বাংলা ভাষাভাষীরা শুধু সংখ্যার দিক দিয়েই নয়, সাহিত্য-সংস্কৃতি, সমাজ ও রাষ্ট্রচিন্তার দিক দিয়েও অগ্রগণ্য ছিল। ব্রিটিশমুক্ত ভারতে লিংগুয়া ফ্রাংকা কী হবে, তা নিয়ে যখন প্রশ্ন ওঠে তখন উর্দু ও হিন্দির পাশে বাংলার দাবিও উঠে আসে। ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহ ওই দাবি পেশ করেন এবং বলেন, বাংলার লিংগুয়াফ্রাংকা হওয়ার যোগ্যতা অন্য দুই ভাষার চেয়ে কোনো অংশেই কম নয়। তখন ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহর এই অভিমত অনেকেরই পছন্দ হয়নি। তারা বাংলার পক্ষে দাঁড়াতে দ্বিধাপ্রকাশ করেছেন। কেউ কেউ বাংলার দাবি নাকচ করে দিয়েছেন। তাদের মধ্যে সে সময়ের প্রধান কবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর পর্যন্ত আছেন। তিনি হিন্দির পক্ষে রায় দেন। এখানে সংক্ষেপে স্মরণ করা যেতে পারে, বাংলা সর্বভারতীয় ভাষাসমূহের মধ্যে গুরুত্বপূর্ণ ও শক্তিশালী ভাষা হিসেবে গণ্য হলেও বাংলা ভাষাভাষীদের মধ্যকার একটি শ্রেণি বিভিন্ন সময়ে এ ভাষাকে যথাযথ মূল্য দিতে চায়নি। এই ভাষায় প্রথম সাহিত্যচর্চা করেছেন বৌদ্ধ সহজিয়া সাধকরা। শেষ পর্যন্ত তারা ব্রাহ্মণ্যবাদী শাসকের অত্যাচার-নির্যাতনে দেশছাড়া হয়েছেন। বাংলা সাহিত্যের আদি নিদর্শন চর্যাপদের পান্ডুলিপি পাওয়া গেছে নেপালের রাজদরবারে। ব্রাহ্মণ্যবাদীরা বাংলা ভাষায় ধর্মচর্চা ও ধর্মীয় গ্রন্থের অনুবাদ করতে দেয়নি। বলেছে, যারা এটা করবে, তারা রৌরব নরকে যাবে। মধ্যযুগেও বাংলাভাষা বিদ্বেষ লক্ষ্য করা গেছে। বিদ্বেষীদের উদ্দেশ্যে তাই কবি আবদুল হাকিমকে বলতে হয়েছে, ‘যে সবে বঙ্গে জন্মি হিংসে বঙ্গবাণী, সে সব কাহার জন্ম নির্ণয় ন জানি।’

উপমহাদেশ ও বাংলাভাগের পর পাকিস্তানের শাসকরা বাংলার মর্যাদা দিতে রাজি হয়নি। তাদের নারাজির প্রতিবাদেই সংগঠিত হয় ভাষা আন্দোলন। ভাষাশহীদরা বুকের রক্ত ঢেলে বাংলার মর্যাদা সুরক্ষা করেন। এটা ঐতিহাসিকভাবে সত্য, এ দেশের মানুষ ভাষাপরিচয়ে বাঙালি। ধর্মীয় পরিচয়ে অধিকাংশ মানুষ মুসলমান। এই দুই পরিচয়ের কোনোটিই পরিত্যাগযোগ্য নয়। এই দু’য়ের মেলবন্ধনেই গড়ে উঠেছে বাংলাদেশি জাতীয়তাবাদ। এই দুই পরিচয়ের একটি অস্বীকার করার অর্থ হলো, জাতীয় স্বাতন্ত্রকে অস্বীকার করা। বাংলাদেশের মানুষের জন্য এটা অতুল্য গৌরবের বিষয় যে, ২১ ফেব্রুয়ারি আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস হিসেবে আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত। ১৯৯৯ সালের ১৭ নভেম্বর ইউনেস্কোর সাধারণ সভায় ২১ ফেব্রুয়ারিকে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস ঘোষণা করা হয়। কিন্তু যে ভাষার মর্যাদার জন্য বায়ান্নর প্রজন্ম সর্বোচ্চ ত্যাগ স্বীকার করে দাবি আদায় করেছিল, তার ধারাবাহিকতা রক্ষিত হয়নি। এখনো প্রশাসন, আদালতসহ সর্বত্র বাংলাকে মাধ্যম হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করা সম্ভব হয়নি। স্বীকার করতে হবে, আমাদের শিক্ষা ব্যবস্থা, রাজনীতি এবং সামাজিক ব্যবস্থায় অবক্ষয় দেখা দিয়েছে। এর মূলে রয়েছে বিদেশি অপসংস্কৃতির আগ্রাসন, যা প্রতিষ্ঠিত ও নিশ্চিত করার জন্য পতিত স্বৈরাচার এমন কিছু নেই যা করেনি। বিশ্ব দরবারে বাংলাকে এবং বাংলাদেশকে সমৃদ্ধ ও উচ্চ মর্যাদার আসনে অধিষ্ঠিত করতে হলে বিদেশি আগ্রাসী সংস্কৃতির মূলোৎপাঠনের বিকল্প নেই।
গত ১৬ বছর একটি ফ্যাসিবাদী রাজনৈতিক শক্তির দ্বারা এ দেশের মানুষ কার্যত অবরুদ্ধ জীবন কাটিয়েছে। রাজনৈতিক-সাংস্কৃতিক অঙ্গন ছিল একচ্ছত্রভাবে ক্ষমতাসীনদের নিয়ন্ত্রণাধীন। তারা ভারতীয় অপসংস্কৃতিল অবাধ অনুপ্রবেশ ও চর্চা অবারিত করে দিলেও দেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষের ধর্মীয়-সাংস্কৃতিক আত্মপরিচয়ের ভিত্তিকে ধসিয়ে দিতেই সচেষ্ট ছিল। রাজনৈতিক দুর্বৃত্তায়ন ও দলীয়করণ সাংস্কৃতিক পরিমন্ডলকেও কলুষিত করে ফেলেছিল। একুশের প্রথম প্রহরে শহীদ মিনারে ফুল দেয়ার রেওয়াজ কিংবা স্বাধীনতা ও জাতীয় দিবসগুলোতে স্মৃতিসৌধে একটি রাজনৈতিক পক্ষের কর্তৃত্ববাদী আস্ফালন দেখা গেছে। বাংলা একাডেমি আয়োজিত একুশে বইমেলাকে এক ব্যক্তি ও পরিবারের বন্দনানির্ভর প্রকাশনায় সয়লাব করে ফেলা হলেও দেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষের তাহজিব-তামদ্দুনের পরিচয়বাহী জাতীয় সংস্কৃতিকে সেখানে প্রবেশের সুযোগই দেয়া হয়নি। একইভাবে বাংলা একাডেমি পুরষ্কার, একুশে পদক ও স্বাধীনতা পদকের মতো রাষ্ট্রীয় সম্মাননা থেকে প্রকৃত জ্ঞানী-গুণীদের বঞ্চিত করে দলবাজ, তেলবাজ লোকদের এসব পদকে ভূষিত করে রাষ্ট্রীয় পদক ও সম্মাননার মান-মর্যাদাকে ভূলুণ্ঠিত করা হয়েছে। ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থান জাতিকে সেই অবরুদ্ধ অবস্থা থেকে মুক্তি দিয়েছে। ফ্যাসিবাদী দল ও পতিত স্বৈরাচারের দোসরদের বাইরে পুরো জাতি এখন মুক্ত পরিবেশে মত প্রকাশ করতে পারছে। সেখানে কোনো বিশেষ রাজনৈতিক মতাদর্শের একচ্ছত্র কর্তৃত্ব ও নিয়ন্ত্রণ নেই। এ মুক্ত পরিবেশকে রক্ষা করতে হবে। বায়ান্নর ভাষা শহীদদের অম্লান ত্যাগের অনুপ্রেরণাকে ধারণ করেই চব্বিশের গণঅভ্যুত্থানের শহীদের রক্ত দিয়ে দেশকে ফ্যাসিবাদ মুক্ত করেছে। তাদের এই সুমহান ত্যাগের মর্যাদা রক্ষা এবং দেশের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্রকারী রাজনৈতিক-সাংস্কৃতিক অপশক্তির মোকাবেলায় জাতিকে ঐকবদ্ধ থাকতে হবে। সুস্থ ধারার সংস্কৃতি চর্চা, গণতন্ত্র, মানবাধিকার, অর্থনৈতিক মুক্তি, বৈষম্যহীন ও শোষণমুক্ত সমাজ প্রতিষ্ঠা এ আকাক্সক্ষার অন্তর্গত অপরিহার্য বিষয়। এমতাবস্থায়, ভাষা আন্দোলন ও স্বাধীনতা যুদ্ধ এবং চব্বিশের গণঅভ্যুত্থানের অবিনাশী চেতনাই আমাদের সঠিক পথ দেখাতে পারে।


বিভাগ : সম্পাদকীয়


মন্তব্য করুন

HTML Comment Box is loading comments...

এই বিভাগের আরও

বই আত্মার মহৌষধ
পহেলা বৈশাখ শুধু একটি দিন নয়
সুযোগের সদ্ব্যবহার করতে হবে
শুভ নববর্ষ
আন্তঃধর্মীয় সংলাপের গুরুত্ব
আরও
X

আরও পড়ুন

ভারতে আবাসিক ভবনে ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ড, যেভাবে নাটকীয়ভাবে বেঁচে গেল একটি পরিবার

ভারতে আবাসিক ভবনে ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ড, যেভাবে নাটকীয়ভাবে বেঁচে গেল একটি পরিবার

অবশেষে পরীক্ষায় অংশগ্রহণের সুযোগ পেলেন উখিয়ার ১৩ এসএসসি পরীক্ষার্থী

অবশেষে পরীক্ষায় অংশগ্রহণের সুযোগ পেলেন উখিয়ার ১৩ এসএসসি পরীক্ষার্থী

পবিপ্রবি শিক্ষার্থী পানিতে পড়ে আহত হওয়ার পরে চিকিৎসা অবহেলার মৃত্যুর অভিযোগ

পবিপ্রবি শিক্ষার্থী পানিতে পড়ে আহত হওয়ার পরে চিকিৎসা অবহেলার মৃত্যুর অভিযোগ

শেরপুর জেলা উপজেলায় নানা আয়োজনে বাংলা নববর্ষ উদযাপন

শেরপুর জেলা উপজেলায় নানা আয়োজনে বাংলা নববর্ষ উদযাপন

নববর্ষ উদযাপনে মনোহরগঞ্জ উপজেলা বিএনপির আনন্দ শোভাযাত্রা

নববর্ষ উদযাপনে মনোহরগঞ্জ উপজেলা বিএনপির আনন্দ শোভাযাত্রা

মাজারের বার্ষিক ওরসের মেলায় অন্তঃসত্ত্বা স্ত্রীকে জবাই করে হত্যা করল স্বামী

মাজারের বার্ষিক ওরসের মেলায় অন্তঃসত্ত্বা স্ত্রীকে জবাই করে হত্যা করল স্বামী

কুমিল্লার রাজগঞ্জ বাজারে অগ্নিকাণ্ডে পৌনে দুই কোটি টাকার মালামাল ভস্মীভূত

কুমিল্লার রাজগঞ্জ বাজারে অগ্নিকাণ্ডে পৌনে দুই কোটি টাকার মালামাল ভস্মীভূত

সরকার নয়, আমরা একটি দেশ হিসেবে কাজ করছি: জ্বালানি উপদেষ্টা

সরকার নয়, আমরা একটি দেশ হিসেবে কাজ করছি: জ্বালানি উপদেষ্টা

মতলবে উপজেলা বিএনপির বর্ষবরণ আনন্দ শোভাযাত্রা

মতলবে উপজেলা বিএনপির বর্ষবরণ আনন্দ শোভাযাত্রা

ফিলিস্তিনবাসীদের শান্তি কামনায়   বিশেষ দোয়া মাহফিল

ফিলিস্তিনবাসীদের শান্তি কামনায়  বিশেষ দোয়া মাহফিল

বর্ণাঢ্য ‘ড্রোন শো’ দেখে মুগ্ধ লাখো মানুষ

বর্ণাঢ্য ‘ড্রোন শো’ দেখে মুগ্ধ লাখো মানুষ

নতুন বছরে সংস্কার ও নির্বাচন নিয়ে অনিশ্চয়তা দূর হোক  : মঞ্জু

নতুন বছরে সংস্কার ও নির্বাচন নিয়ে অনিশ্চয়তা দূর হোক : মঞ্জু

বুধবার ঢাকায় আসছেন যুক্তরাষ্ট্রের দুই উপসহকারী পররাষ্ট্রমন্ত্রী

বুধবার ঢাকায় আসছেন যুক্তরাষ্ট্রের দুই উপসহকারী পররাষ্ট্রমন্ত্রী

পুরোনো পদে ফিরলেন গাঙ্গুলি

পুরোনো পদে ফিরলেন গাঙ্গুলি

আসছে দক্ষিণ আফ্রিকা ইমার্জিং নারী ক্রিকেট দল

আসছে দক্ষিণ আফ্রিকা ইমার্জিং নারী ক্রিকেট দল

রূপায়ণ সিটিতে শতকন্ঠে বর্ষবরণ

রূপায়ণ সিটিতে শতকন্ঠে বর্ষবরণ

বর্ষবরণকে স্বাগত জানিয়ে গাজীপুরে জেলা বিএনপির শোভাযাত্রা

বর্ষবরণকে স্বাগত জানিয়ে গাজীপুরে জেলা বিএনপির শোভাযাত্রা

আমরা নতুন বাংলাদেশে প্রবেশ করেছি: ফারুকী

আমরা নতুন বাংলাদেশে প্রবেশ করেছি: ফারুকী

ভারতীয়দের হজ কোটা ৮০ শতাংশ কমাল সৌদি

ভারতীয়দের হজ কোটা ৮০ শতাংশ কমাল সৌদি

চীনা দূতাবাসের সৌজন্যে ঢাকার আকাশে ব্যতিক্রমী ড্রোন শো

চীনা দূতাবাসের সৌজন্যে ঢাকার আকাশে ব্যতিক্রমী ড্রোন শো