ভারতে নতুন ওয়াকফ আইন, কী পরিবর্তন হতে যাচ্ছে?

Daily Inqilab ইনকিলাব ডেস্ক

০৭ এপ্রিল ২০২৫, ১২:২৭ পিএম | আপডেট: ০৭ এপ্রিল ২০২৫, ১২:৩৫ পিএম

ভারতের পার্লামেন্টে সদ্য পাস হওয়া ‘মুসলিম ওয়াকফ (সংশোধনী) আইন’ ঘিরে ভারতজুড়ে তুমুল বিতর্ক শুরু হয়েছে। ক্ষমতাসীন বিজেপি সরকারের দাবি, এই আইনের মাধ্যমে ওয়াকফ সম্পত্তির ব্যবস্থাপনায় স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতা আনা হবে। অন্যদিকে বিরোধী দল, মুসলিম নেতৃবৃন্দ এবং বিভিন্ন নাগরিক অধিকার সংগঠন একে সংখ্যালঘুদের উপর ‘সরকারি হস্তক্ষেপ’ ও ‘ধর্মীয় অধিকার খর্ব’ করার চেষ্টা বলে অভিহিত করছেন। শুধু ভারতেই নয়, প্রতিবেশী বাংলাদেশেও এই নতুন আইন নিয়ে উদ্বেগ ছড়িয়েছে এবং প্রতিবাদ জানিয়েছে একাধিক ইসলামপন্থী রাজনৈতিক দল ও সংগঠন।

 

এই নতুন আইনটি ২০২৫ সালের মার্চ মাসের শেষ সপ্তাহে ভারতের সংসদের উভয় কক্ষ – লোকসভা ও রাজ্যসভা – পাস করে। এরপর রাষ্ট্রপতি দ্রৌপদী মুর্মু রেকর্ড সময়ের মধ্যে তাতে সম্মতি প্রদান করেন, যার ফলে এটি আইনে পরিণত হয়। সরকার বলছে, ওয়াকফ সম্পত্তির ব্যবস্থাপনায় স্বচ্ছতা, আধুনিকীকরণ ও অব্যবস্থাপনা রোধ করাই এই আইনের মূল লক্ষ্য। অথচ বিরোধী রাজনৈতিক জোট 'ইন্ডিয়া', মুসলিম পার্সোনাল ল বোর্ড, এআইএমআইএম, কংগ্রেস, আরজেডি-সহ একাধিক পক্ষ মনে করছে, এটি মুসলিমদের ধর্মীয় ও দাতব্য সম্পত্তির উপর ‘সরকারি নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠার পথ’ প্রশস্ত করবে। ফলে সুপ্রিম কোর্টে ইতিমধ্যেই আইনটির বৈধতা চ্যালেঞ্জ করে চারটি পৃথক পিটিশন দাখিল হয়েছে।

 

ভারতে ‘ওয়াকফ’ শব্দটি এসেছে আরবি ‘ওয়াকাফা’ শব্দ থেকে, যার অর্থ ‘হাতবদল থামানো’। মুসলিম আইনে, কোনও ব্যক্তি যদি তার জমি, ভবন, অর্থ বা সম্পদ আল্লাহর নামে ধর্মীয় বা দাতব্য কাজে দান করেন, তাকে ‘ওয়াকফ সম্পত্তি’ বলা হয়। এগুলোর মধ্যে মসজিদ, মাদ্রাসা, কবরস্থান, এতিমখানা, আশ্রয়কেন্দ্র বা শুধু জমি—সবই থাকতে পারে। দানের উদ্দেশ্য ছাড়া এগুলোর ব্যবহারে কোনও পরিবর্তন আনা যায় না, এগুলো বিক্রি, হস্তান্তর বা ভোগদখলও নিষিদ্ধ। হিন্দু সমাজে যেমন ‘দেবোত্তর সম্পত্তি’ রয়েছে, ওয়াকফ মূলত তার মুসলিম সংস্করণ।

 

১৯৯৫ সালের ‘ওয়াকফ অ্যাক্ট’-এর মাধ্যমে ভারতজুড়ে ওয়াকফ সম্পত্তির ব্যবস্থাপনার জন্য রাজ্যভিত্তিক ওয়াকফ বোর্ড গঠন করা হয়েছিল। বোর্ডে মুসলিম বিধায়ক বা সাংসদ, রাজ্য সরকারের মনোনীত প্রতিনিধি, বার কাউন্সিলের সদস্য ও ওয়াকফ পরিচালনাকারী ব্যক্তিরা থাকতেন। কিন্তু দীর্ঘদিন ধরে এই বোর্ডগুলির স্বচ্ছতা, অদক্ষতা এবং দুর্নীতির অভিযোগ উঠে আসছিল। বিজেপি সরকারের দাবি, এই কারণেই ২০২৩ সালের আগস্টে তারা এই আইন সংশোধনের বিল আনেন। আইনটি যাচাই-বাছাইয়ের জন্য সংসদের একটি যৌথ কমিটিতে পাঠানো হয়, যারা ২০২৫ সালের ফেব্রুয়ারিতে বিলটি কিছু পরিবর্তনসহ অনুমোদন করে।

 

নতুন আইনে কয়েকটি বড় পরিবর্তন আনা হয়েছে যা বিতর্কের মূল কেন্দ্রবিন্দুতে। প্রথমত, ওয়াকফ সম্পত্তির সংজ্ঞা পুনর্নির্ধারণ করা হয়েছে। আগে শুধু মৌখিক ঘোষণার ভিত্তিতেও কোনও সম্পত্তিকে ওয়াকফ হিসেবে গ্রহণ করা হতো যদি মুসলিম সমাজ বহুদিন ধরে তা ব্যবহার করে আসতো। এখন থেকে কোনও সম্পত্তিকে ওয়াকফ বলে দাবি করতে হলে প্রমাণস্বরূপ বৈধ দলিল দেখাতে হবে। সরকারি খাস জমির ক্ষেত্রে সিদ্ধান্ত নেওয়ার ক্ষমতা থাকবে সরকারের হাতে, যা ওয়াকফ বোর্ডের ক্ষমতা হ্রাস করবে। দ্বিতীয়ত, ওয়াকফ বোর্ডে মুসলিম ছাড়া অন্য ধর্মাবলম্বীদেরও সদস্য হিসেবে অন্তর্ভুক্ত করার বিধান আনা হয়েছে। অনেকের মতে, এটি ওয়াকফ বোর্ডের ধর্মীয় স্বাতন্ত্র্যকে প্রশ্নের মুখে ফেলছে।

 

তৃতীয় বড় পরিবর্তন হলো ওয়াকফ বিষয়ক বিরোধ নিষ্পত্তির ক্ষেত্রে এখন যে কেউ আদালতে যেতে পারবেন। আগে ওয়াকফ ট্রাইব্যুনালের সিদ্ধান্তই ছিল চূড়ান্ত, এখন তা নয়। চতুর্থত, দেশের সব ওয়াকফ সম্পত্তির জন্য একটি কেন্দ্রীয় নিবন্ধন ব্যবস্থা চালু করা হবে। নতুন আইনের ছয় মাসের মধ্যে প্রতিটি ওয়াকফ সম্পত্তিকে ওই রেজিস্টারে নথিভুক্ত করতে হবে। নতুন সম্পত্তি যুক্ত করতে হলে বোর্ডে আবেদন করতে হবে এই নিবন্ধন ব্যবস্থার মাধ্যমেই। পঞ্চমত, সরকারের হস্তক্ষেপ এখন আরও বাড়ানো হয়েছে—ওয়াকফ সম্পত্তির সার্ভে বা তদন্তের সিদ্ধান্ত নিতে পারবে সরকার, যা আগে শুধুমাত্র ওয়াকফ বোর্ড করতে পারতো।

 

এই পরিবর্তনগুলোর ফলে ওয়াকফ বোর্ডগুলোর সিদ্ধান্তগ্রহণ ক্ষমতা ব্যাপকভাবে সীমিত হয়ে যাবে বলে বিরোধীদের আশঙ্কা। অল ইন্ডিয়া মজলিস-ই-ইত্তেহাদুল মুসলিমিন (এআইএমআইএম)-এর প্রধান আসাদউদ্দিন ওয়াইসি আইনটিকে “গণতান্ত্রিক ভাবে চাপিয়ে দেওয়া” পদক্ষেপ বলে অভিহিত করেছেন। তিনি অভিযোগ করেছেন, এই বিলের মাধ্যমে মুসলিমদের অধিকারের উপর সরাসরি হস্তক্ষেপ করা হচ্ছে এবং ওয়াকফ বোর্ডে অমুসলিমদের অন্তর্ভুক্ত করার মাধ্যমে ধর্মীয় স্বাধীনতা ক্ষুণ্ণ হচ্ছে। কংগ্রেস নেতা মল্লিকার্জুন খাড়্গে জানান, লোকসভায় বিলটির বিপক্ষে ২৩২টি ভোট পড়েছে, যা বিরোধিতার প্রকৃত চিত্র তুলে ধরে। অন্যদিকে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী একে ‘ওয়াটারশেড মোমেন্ট’ বলে উল্লেখ করে বলেছেন, "ওয়াকফ ব্যবস্থার স্বচ্ছতা ও নাগরিক অধিকার সুরক্ষিত করতেই এই আইন।"

 

ভারতের গণ্ডি পেরিয়ে বাংলাদেশেও এই আইনটি নিয়ে ব্যাপক প্রতিক্রিয়া দেখা গেছে। বিএনপি, জামায়াত-ই-ইসলামী, হেফাজতে ইসলাম এবং ইসলামী ছাত্র শিবিরসহ বহু ইসলামপন্থী দল এর নিন্দা জানিয়েছে। বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য সালাহউদ্দিন আহমেদ বলেছেন, "ভারতের ২০ কোটির বেশি মুসলমানের ধর্মীয় অধিকার এই আইনের মাধ্যমে খর্ব করা হয়েছে। এটি মুসলিম প্রতিষ্ঠানগুলোর পরিচালনায় জটিলতা সৃষ্টি করবে।" জামায়াত-সমর্থিত ইসলামী ছাত্র শিবিরও ঢাকায় মানববন্ধনের মাধ্যমে প্রতিবাদ জানিয়েছে। হেফাজতে ইসলাম এই আইনকে ‘ধর্মীয় দখলদারির সুযোগসন্ধানী পদক্ষেপ’ বলেও মন্তব্য করেছে।

 

হেফাজতে ইসলামের বিবৃতিতে ভারত সরকারের অতীত নীতির কথাও উল্লেখ করা হয়, যেমন তিন তালাক নিষিদ্ধকরণ, ধর্মান্তর বিরোধী আইন এবং গোমাংস বহনের অভিযোগে মুসলিমদের পিটিয়ে হত্যার ঘটনা। এসবের ধারাবাহিকতায় ওয়াকফ আইন সংশোধনকেও তারা হিন্দুত্ববাদী শাসনের একাংশ হিসেবে দেখছে। ইসলামী ছাত্র শিবির এক বিবৃতিতে জানিয়েছে, “ভারতে রেলওয়ে ও সেনাবাহিনীর পরে সবচেয়ে বেশি জমির মালিক ওয়াকফ বোর্ড। নতুন আইন সরকারকে এই সম্পদের উপর সর্বোচ্চ নিয়ন্ত্রণ দেবে, যা মুসলিম সমাজের প্রতি গভীর অবিচার।”

 

সব মিলিয়ে ওয়াকফ সম্পত্তি নিয়ে ভারতের এই নতুন আইন শুধু দেশের মধ্যেই নয়, পার্শ্ববর্তী রাষ্ট্রেও সংখ্যালঘু মুসলিমদের মধ্যে এক ধরনের অনিশ্চয়তা ও ক্ষোভ সৃষ্টি করেছে। একদিকে সরকার বলছে, এই আইন আধুনিকীকরণ ও স্বচ্ছতা আনবে, অন্যদিকে বিরোধীরা একে সংবিধানবিরোধী এবং মুসলিম স্বার্থ বিরোধী হিসেবে চিহ্নিত করছে। এখন দেখার বিষয়, সুপ্রিম কোর্টে এই আইনের বিরুদ্ধে দায়ের করা মামলাগুলোর রায় কী দাঁড়ায়, এবং সত্যিই এই আইনের প্রয়োগে সংখ্যালঘুদের ধর্মীয় অধিকার কতটা সুরক্ষিত থাকে।

 

একটি বহুধাবিভক্ত দেশের গণতন্ত্রে ধর্মীয় সম্পত্তির নিয়ন্ত্রণ নিয়ে আইন প্রণয়ন অত্যন্ত সংবেদনশীল বিষয়। তাই সরকার ও বিরোধী দুই পক্ষেরই দায়িত্ব হলো সংবিধানসম্মত পন্থায় এমন সমাধানে পৌঁছানো, যা সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের আত্মবিশ্বাস অক্ষুণ্ণ রাখে এবং একই সঙ্গে দুর্নীতিমুক্ত প্রশাসনের পথও সুগম করে। ধর্মীয় সম্পত্তি যেন কারও রাজনীতির হাতিয়ার না হয়ে ওঠে, সেটাই এখন সময়ের দাবি। তথ্যসূত্র : বিবিসি বাংলা

 


বিভাগ : আন্তর্জাতিক


মন্তব্য করুন

HTML Comment Box is loading comments...

এই বিভাগের আরও

গাজায় ইহুদী হামলায় ৬০ ফিলিস্তিনি শহীদ
জাতিসংঘের দুটি আঞ্চলিক সংস্থায় নির্বাচিত হলো বাংলাদেশ
পাকিস্তান-ভারতকে ‘সর্বোচ্চ সংযম’ দেখাতে বলল জাতিসংঘ
পহেলগামে সেনার অনুপস্থিতি নিয়ে যা বলছে ভারত সরকার
যুক্তরাষ্ট্রের ২০ কোটি ডলারের ড্রোন ভূপাতিত করল হুতিরা
আরও
X

আরও পড়ুন

পাবনায় চররে জমি দখল নিয়ে সংর্ঘষে গুলবিদ্ধি ৫

পাবনায় চররে জমি দখল নিয়ে সংর্ঘষে গুলবিদ্ধি ৫

আইএমএফের ঋণের কিস্তি নিয়ে আশাবাদী বাংলাদেশ

আইএমএফের ঋণের কিস্তি নিয়ে আশাবাদী বাংলাদেশ

মার্কিন উচ্চশিক্ষার চরম পতন

মার্কিন উচ্চশিক্ষার চরম পতন

পরিশুদ্ধ-পরিবর্তিত বিএনপিকে রাষ্ট্রীয় ক্ষমতায় আনতে হবে-সাহাদাত হোসেন সেলিম

পরিশুদ্ধ-পরিবর্তিত বিএনপিকে রাষ্ট্রীয় ক্ষমতায় আনতে হবে-সাহাদাত হোসেন সেলিম

গাজায় ইহুদী হামলায় ৬০ ফিলিস্তিনি শহীদ

গাজায় ইহুদী হামলায় ৬০ ফিলিস্তিনি শহীদ

জাতিসংঘের দুটি আঞ্চলিক সংস্থায় নির্বাচিত হলো বাংলাদেশ

জাতিসংঘের দুটি আঞ্চলিক সংস্থায় নির্বাচিত হলো বাংলাদেশ

রাজনৈতিক দল গঠন এখন ছেলেখেলা!

রাজনৈতিক দল গঠন এখন ছেলেখেলা!

সাভারে অজ্ঞাত নারীর অর্ধগলিত মরদেহ উদ্ধার

সাভারে অজ্ঞাত নারীর অর্ধগলিত মরদেহ উদ্ধার

নর্থ সাউথে ভর্তি পরীক্ষা দিলেন উপদেষ্টা আসিফ

নর্থ সাউথে ভর্তি পরীক্ষা দিলেন উপদেষ্টা আসিফ

কোরআনবিরোধী নারী সংস্কার প্রস্তাবনা দেশের জন্য হুমকি স্বরূপ

কোরআনবিরোধী নারী সংস্কার প্রস্তাবনা দেশের জন্য হুমকি স্বরূপ

পাকিস্তান-ভারতকে ‘সর্বোচ্চ সংযম’ দেখাতে বলল জাতিসংঘ

পাকিস্তান-ভারতকে ‘সর্বোচ্চ সংযম’ দেখাতে বলল জাতিসংঘ

‘সর্বাত্মক যুদ্ধের’ হুঁশিয়ারি পাকিস্তানের

‘সর্বাত্মক যুদ্ধের’ হুঁশিয়ারি পাকিস্তানের

নারী কমিশনের প্রস্তাবের বিরুদ্ধে সবাইকে রুখে দাঁড়াতে হবে

নারী কমিশনের প্রস্তাবের বিরুদ্ধে সবাইকে রুখে দাঁড়াতে হবে

তারেক রহমান ‘নিয়তির সন্তান’

তারেক রহমান ‘নিয়তির সন্তান’

অতিদারিদ্র্য বৃদ্ধির শঙ্কা

অতিদারিদ্র্য বৃদ্ধির শঙ্কা

২৪ ঘন্টায় গ্রেফতার ১০৭২ আ’লীগ ও সহযোগী সংগঠনের ৫ নেতা গ্রেফতার

২৪ ঘন্টায় গ্রেফতার ১০৭২ আ’লীগ ও সহযোগী সংগঠনের ৫ নেতা গ্রেফতার

পারভেজ হত্যা মামলায় প্রধান আসামি মেহেরাজ রিমান্ডে

পারভেজ হত্যা মামলায় প্রধান আসামি মেহেরাজ রিমান্ডে

আ.লীগের ধর্ম বিষয়ক উপকমিটির সদস্য সন্তোষ কুমার রিমান্ডে

আ.লীগের ধর্ম বিষয়ক উপকমিটির সদস্য সন্তোষ কুমার রিমান্ডে

চট্টগ্রামে পেট্রোল বোমায় দগ্ধ মহিলার মৃত্যু

চট্টগ্রামে পেট্রোল বোমায় দগ্ধ মহিলার মৃত্যু

রাজধানীর প্রধান সড়কে ব্যাটারি রিকশা বন্ধের দাবি মোটরসাইকেল চালকদের

রাজধানীর প্রধান সড়কে ব্যাটারি রিকশা বন্ধের দাবি মোটরসাইকেল চালকদের