ভারতের ভাষা যুদ্ধ: উত্তর-দক্ষিণ বিভাজনের জন্ম দিচ্ছে হিন্দি
১৪ এপ্রিল ২০২৫, ০৫:৫৬ পিএম | আপডেট: ১৪ এপ্রিল ২০২৫, ০৫:৫৬ পিএম

নয়া দিল্লি: ভারতের রাজ্যগুলিতে হিন্দি ভাষা চাপিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করছে—এমন অভিযোগ উঠেছে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির সরকারের বিরুদ্ধে। সম্প্রতি, মুম্বাইয়ের থানে শহরে মারাঠি ভাষা অন্তর্ভুক্ত করার দাবিতে ‘মহারাষ্ট্র নবনির্মাণ সেনা (এমএনএস)’-এর কর্মীদের বিক্ষোভের পর ডোম্বিভলিতে বর্তমানে নির্মাণাধীন মেট্রো স্টেশনের তথ্য ও দিকনির্দেশনাগুলিতে হিন্দির পরিবর্তে মারাঠি ভাষা প্রতিস্থাপন শুরু হয়েছে। সাইনবোর্ডগুলিতে মারাঠি ভাষা না থাকায় বিক্ষোভের সূত্রপাত হয়, কারণ সেগুলো কেবল হিন্দি ও ইংরেজিতে লেখা ছিল।
মোদির সরকার ভারতের দক্ষিণাঞ্চলীয় বৃহত্তম এবং সর্বাধিক জনবহুল রাজ্য তামিলনাড়ুর সাথেও ভাষাগত বিরোধে জড়িয়ে পড়েছে। রাজ্যটির রাজধানী চেন্নাই ও নয়াদিল্লির মধ্যে এই বিরোধ রাজপথে বিক্ষোভের রূপ নিয়েছে। কেন্দ্রীয় সরকারের বিরুদ্ধে তামিলনাড়ুর শিক্ষা তহবিল আটকে রাখার অভিযোগ উঠেছে।
যদিও ২০২০ সালের জাতীয় শিক্ষা নীতিতে হিন্দি অ-হিন্দিভাষী রাজ্যগুলোর জন্য ঐচ্ছিক তৃতীয় ভাষা হিসেবে অন্তর্ভুক্ত থাকলেও, কেন্দ্রীয় শিক্ষামন্ত্রী ধর্মেন্দ্র প্রধান ঘোষণা করেছেন যে, ‘সমগ্র শিক্ষা অভিযান’ প্রকল্পের আওতায় তামিলনাড়ুর প্রায় দুই হাজার কোটি রুপির শিক্ষা তহবিল আটকে রাখা হবে, যদি না রাজ্যটি জাতীয় শিক্ষা নীতির তিন-ভাষা ফর্মুলা বাস্তবায়ন করে।
তামিলনাড়ুর পক্ষ থেকে দাবি করা হয়েছে, মোদি সরকারের এই নীতির আড়ালে হিন্দি চাপিয়ে দেওয়ার গোপন অভিসন্ধি রয়েছে। ফেব্রুয়ারিতে এক রাষ্ট্রীয় অনুষ্ঠানে রাজ্যটির মুখ্যমন্ত্রী, ডিএমকে নেতা এম কে স্ট্যালিন হুঁশিয়ারি দিয়ে বলেন, ‘আমি মোদি সরকারকে সতর্ক করে দিচ্ছি—মৌমাছির চাকে ঢিল ছুঁড়বেন না। তামিলদের অনন্য লড়াইয়ের তেজ দেখার আকাঙ্ক্ষা করবেন না।’
দিল্লি বিশ্ববিদ্যালয়ের হিন্দি অধ্যাপক অপূর্বানন্দ বলেছেন, ‘কেন্দ্রীয় সরকার হিন্দি ভাষায় বিপুল বিনিয়োগ করছে, কিন্তু অন্য কোনও ভাষাকে তেমনভাবে গুরুত্ব দিচ্ছে না।’ তিনি উদাহরণ হিসেবে উল্লেখ করেন, মোদি সরকারের অধিকাংশ নতুন নীতি ও প্রকল্পের নাম হিন্দিতে। ২০২২ সালে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহ হিন্দিভাষা প্রচলিত নয় এমন উত্তর-পূর্বাঞ্চলের রাজ্যগুলোতে ২২ হাজার হিন্দি শিক্ষক নিয়োগের সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন।
তামিলনাড়ুর সাক্ষরতার হার ৮২ শতাংশের বেশি, যা জাতীয় গড় ৭৩ শতাংশের তুলনায় উল্লেখযোগ্যভাবে বেশি। এই রাজ্যটি শিক্ষা ও সাংস্কৃতিক সচেতনতার দিক দিয়ে দেশের মধ্যে অগ্রণী। এখানেই ভাষার লড়াই সবচেয়ে তীব্র, যেখানে ঐতিহ্যগতভাবে উত্তর ও পশ্চিম ভারতের তুলনায় মোদির বিজেপি এখনও রাজনৈতিকভাবে শক্তিশালী হয়নি।
ভাষাবিদ পেগি মোহন বলেন, ‘ভাষা একটি ক্ষমতার খেলা। এটি কেবল যোগাযোগের বিষয় নয়, এটি নিয়ন্ত্রণ আরোপের ক্ষমতার প্রতিফলন। আপনি এই ভাষা জানেন না—তাহলে আপনি আমার চেয়ে কম ক্ষমতাশালী। এটি হচ্ছে নিছক ভাষার বাইরে ক্ষমতার প্রকাশ।’
ভারতের ভাষাগত বিরোধের কেন্দ্রবিন্দুতে রয়েছে জাতীয় শিক্ষা নীতি, যা প্রথম চালু হয় ১৯৬৮ সালে। মূল নীতিতে তিন-ভাষা ফর্মুলা বাধ্যতামূলক করা হলেও, হিন্দিকে কেন্দ্রীয় সরকারি ভাষা হিসেবে চাপিয়ে দেওয়ার চেষ্টা তামিলনাড়ুর কাছে কখনও গ্রহণযোগ্য ছিল না। রাজ্যটি বরাবরই তাদের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে কেবল তামিল ও ইংরেজি ভাষায় শিক্ষা চালু রেখেছে।
তামিলনাড়ুতে হিন্দি বিরোধী প্রথম বড় আন্দোলন শুরু হয় ১৯৩৭ সালে, যখন ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক শাসনের অধীন কংগ্রেস-নেতৃত্বাধীন প্রাদেশিক সরকার শিক্ষায় হিন্দি বাধ্যতামূলক করে। দুই বছরেরও বেশি সময় ধরে চলা ওই আন্দোলনে ১২০০-র বেশি মানুষ গ্রেপ্তার হন। পরবর্তীতে ব্রিটিশরা সিদ্ধান্ত প্রত্যাহার করতে বাধ্য হয়। স্বাধীনতার পর ১৯৪৮ সালেও হিন্দি চাপানোর বিরুদ্ধে রাজ্যটিতে আন্দোলন অব্যাহত ছিল।
১৯৬৩ সালে ডিএমকের নেতা সিএন আন্নাদুরাই স্কুলে হিন্দি বাধ্যতামূলক করার প্রতিবাদে সংবিধানের একটি অনুচ্ছেদ পুড়িয়ে দেওয়ার অভিযোগে গ্রেপ্তার হন। ১৯৬৫ সালে হিন্দি বিরোধী আন্দোলনের প্রাক্কালে তিনি আবার গ্রেপ্তার হন, দুইজন তরুণ আত্মহুতি দেন, হিন্দি বই পুড়িয়ে দেওয়া হয়, এবং পুলিশের সঙ্গে আন্দোলনকারীদের সংঘর্ষ হয়। আজও সেই দিনটিকে তামিল রাজনীতিতে ‘শোক দিবস’ হিসেবে পালন করা হয়।
১৯৫৩ সালে প্রায় ৮ কোটি ১০ লাখ তেলেগুভাষী জনগণ ভাষার দাবি আদায়ের আন্দোলনের মাধ্যমে তামিলনাড়ু থেকে আলাদা হয়ে অন্ধ্র প্রদেশ রাজ্য গঠন করে। এর ধারাবাহিকতায়, ভারতের প্রায় সব রাজ্যে ভাষাগত ভিত্তিতে রাজ্য পুনর্গঠন করা হয়।
তবে তামিলনাড়ুর বাইরে অন্য অনেক রাজ্যও ১৯৬৮ সালের শিক্ষানীতির আওতায় হিন্দি বাধ্যতামূলক করার বিরোধিতা করেছে। অধ্যাপক অপূর্বানন্দ বলেন, ‘মোদি সরকার ভারতের বহুত্ববাদী চেতনার পরিবর্তে একক সাংস্কৃতিক পরিচয় তৈরি করতে চায়, যেখানে হিন্দিকে একটি রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক অস্ত্র হিসেবে ব্যবহার করা হচ্ছে।’সূত্র: দ্য টাইমস অব ইন্ডিয়া, আল জাজিরা
বিভাগ : আন্তর্জাতিক
মন্তব্য করুন
আরও পড়ুন

পাবনায় চররে জমি দখল নিয়ে সংর্ঘষে গুলবিদ্ধি ৫

আইএমএফের ঋণের কিস্তি নিয়ে আশাবাদী বাংলাদেশ

মার্কিন উচ্চশিক্ষার চরম পতন

পরিশুদ্ধ-পরিবর্তিত বিএনপিকে রাষ্ট্রীয় ক্ষমতায় আনতে হবে-সাহাদাত হোসেন সেলিম

গাজায় ইহুদী হামলায় ৬০ ফিলিস্তিনি শহীদ

জাতিসংঘের দুটি আঞ্চলিক সংস্থায় নির্বাচিত হলো বাংলাদেশ

রাজনৈতিক দল গঠন এখন ছেলেখেলা!

সাভারে অজ্ঞাত নারীর অর্ধগলিত মরদেহ উদ্ধার

নর্থ সাউথে ভর্তি পরীক্ষা দিলেন উপদেষ্টা আসিফ

কোরআনবিরোধী নারী সংস্কার প্রস্তাবনা দেশের জন্য হুমকি স্বরূপ

পাকিস্তান-ভারতকে ‘সর্বোচ্চ সংযম’ দেখাতে বলল জাতিসংঘ

‘সর্বাত্মক যুদ্ধের’ হুঁশিয়ারি পাকিস্তানের

নারী কমিশনের প্রস্তাবের বিরুদ্ধে সবাইকে রুখে দাঁড়াতে হবে

তারেক রহমান ‘নিয়তির সন্তান’

অতিদারিদ্র্য বৃদ্ধির শঙ্কা

২৪ ঘন্টায় গ্রেফতার ১০৭২ আ’লীগ ও সহযোগী সংগঠনের ৫ নেতা গ্রেফতার

পারভেজ হত্যা মামলায় প্রধান আসামি মেহেরাজ রিমান্ডে

আ.লীগের ধর্ম বিষয়ক উপকমিটির সদস্য সন্তোষ কুমার রিমান্ডে

চট্টগ্রামে পেট্রোল বোমায় দগ্ধ মহিলার মৃত্যু

রাজধানীর প্রধান সড়কে ব্যাটারি রিকশা বন্ধের দাবি মোটরসাইকেল চালকদের