প্রতিবেশী ও অধীনদের সঙ্গে সদাচরণ

Daily Inqilab মাওলানা আবুল কাসেম আল-আযহারী

১৪ আগস্ট ২০২৩, ১১:৪৩ পিএম | আপডেট: ১৫ আগস্ট ২০২৩, ১২:০৫ এএম

মানুষ জন্মগতভাবে সমাজবদ্ধ জীব। সমাজ ছাড়া মানুষ কখনো চলতে পারে না। সুখ-শান্তিময় একটি আদর্শ মানবসমাজ গড়ে তুলতে হলে পারস্পরিক হৃদ্যতা, সহানুভ‚তি ও সহযোগিতা একান্ত প্রয়োজন। আর তা সৃষ্টি হওয়ার জন্য প্রত্যেকের অন্যের হক ও অধিকারগুলোর ব্যাপারে সচেতন থাকা অপরিহার্য।

অনেক সময় দেখা যায় যে, সমাজে আত্মীয়-স্বজনের চেয়ে প্রতিবেশী অধিক কাজে লাগে। বিপদে-আপদে দুঃখ-দুর্দশায় প্রতিবেশীরাই প্রথমে এগিয়ে আসে। তাই প্রতিবেশীরা যেকোনো ধর্মের, যেকোনো বর্ণের এবং যেকোনো আদর্শের অনুসারীই হোক না কেন, ইসলাম আমাদেরকে সর্বাবস্থায় তাদের সাথে সদাচরণের নির্দেশ দিয়েছে। আল্লাহ তাআলা পবিত্র কুরআনে ইরশাদ করেন : নিকট প্রতিবেশী, দূর প্রতিবেশী এবং সঙ্গী-সাথীদের সাথে সদ্ব্যবহার করবে। (সূরা নিসা : ৩৬)।

প্রতিবেশীকে কষ্ট না দেওয়া ইমানের দাবি। রাসূলুল্লাহ (সা.) ইরশাদ করেন, ‘যে ব্যক্তি আল্লাহ ও পরকালের প্রতি বিশ্বাস রাখে সে যেন প্রতিবেশীকে কষ্ট না দেয়’। (সহিহ বুখারী)। অন্য হাদিসে বর্ণিত হয়েছে, একদা রাসূলুল্লাহ (সা.) ইরশাদ করেন, আল্লাহর কসম! সে ব্যক্তি ইমানদার নয়, আল্লাহর কসম! সে ব্যক্তি ইমানদার নয়, আল্লাহর কসম! সে ব্যক্তি ইমানদার নয়।’ প্রশ্ন করা হলোÑ হে আল্লাহর রাসূল! কে সেই ব্যক্তি? জবাবে রাসূলুল্লাহ (সা.) ইরশাদ করলেনÑ ‘যার প্রতিবেশী তার অনিষ্ট থেকে নিরাপদ নয়।’ (মিশকাত শরিফ)।

প্রতিবেশীর খোঁজ-খবর নেওয়া এবং তাদের কেউ অভুক্ত থাকলে তাদেরকে খাবার দেয়া ইমানী দায়িত্ব। এ সম্পর্কে তাকিদ করে হযরত রাসূলুল্লাহ (সা.) ইরশাদ করেন : ওই ব্যক্তি প্রকৃত মুমিন নয় যে তৃপ্তি সহকারে খাবার খায়, অথচ তার প্রতিবেশী তার পাশে ক্ষুধার্ত অবস্থায় পড়ে আছে। (মিশকাত শরীফ)।

পারস্পরিক মিল-মহব্বত সৃষ্টির লক্ষ্যে মাঝে মধ্যে প্রতিবেশীদেরকে হাদিয়া-তোহফা দেওয়ার জন্য রাসূলুল্লাহ (সা.) বিশেষ গুরুত্ব প্রদান করেছেন। এ মর্মে তিনি ইরশাদ করেনÑ ‘তোমরা একে-অপরকে হাদিয়া-তোহফা দাও, এতে পরস্পরের মাঝে মিল-মহব্বত সৃষ্টি হবে’। তিনি অন্যত্র ইরশাদ করেন, ‘তুমি যখন তরকারি রান্না করবে তখন তাতে পানি বাড়িয়ে দিবে এবং তোমার প্রতিবেশীকে তা থেকে হাদিয়া দিবে।’ (মুসলিম শরিফ)।
প্রতিবেশীর গুরুত্ব বুঝাতে গিয়ে এক হাদিসে রাসূলুল্লাহ (সা.) ইরশাদ করেন, ‘জিব্রীল আমাকে প্রতিবেশী সম্পর্কে এত বেশি গুরুত্ব দিচ্ছিলেন যে, আমার মনে হচ্ছিল, তাদেরকে পরিত্যক্ত সম্পত্তির ওয়ারিস বানিয়ে দেওয়া হবে। (সহিহ বুখারী)।

অবস্থার তারতম্যে প্রতিবেশীর হক বা অধিকারেরও তারতম্য ঘটে। কখনো প্রতিবেশীর হক আদায় করা ফরজ স্তরে পৌঁছে। যেমন ক্ষুধার্ত থাকলে আহার্য দান করা। আবার কখনো সুন্নত স্তরে থাকে। যেমন স্বাভাবিক অবস্থায় ভালো খাদ্যের ব্যবস্থা হলে তা থেকে প্রতিবেশীকে হাদিয়া দেওয়া। এ ছাড়াও অধিকার অনুসারে প্রতিবেশীদের মাঝে শ্রেণিভেদ সম্পর্কে রাসূলুল্লাহ (সা.) ইরশাদ করেন যে, প্রতিবেশী তিন প্রকার :

১. এক অধিকার বিশিষ্ট প্রতিবেশী। তারা হচ্ছে মুশরিক অর্থাৎ অমুসলিম প্রতিবেশী। তাদের অধিকার কেবল প্রতিবেশী হওয়ার ভিত্তিতে। ২. দুই অধিকার বিশিষ্ট প্রতিবেশী। তারা হচ্ছে মুসলিম প্রতিবেশী। তাদের অধিকার প্রতিষ্ঠিত হয় প্রতিবেশী হওয়া এবং মুসলিম হওয়া এই দুই ভিত্তিতে। ৩. তিন অধিকার বিশিষ্ট প্রতিবেশী। তারা হচ্ছে মুসলিম আত্মীয় প্রতিবেশী। তাদের অধিকার প্রতিবেশী হওয়া, মুসলিম হওয়া এবং আত্মীয় হওয়া এই তিন ভিত্তিতে। (তিরমিজি শরীফ)।

একজন ব্যক্তির আশেপাশে কতগুলো গৃহ পর্যন্ত তার প্রতিবেশী বলে গণ্য হবেÑ এ প্রসঙ্গে রাসূলুল্লাহ (সা.) বলেন, ‘শুনে রেখো! চল্লিশটি গৃহ পর্যন্ত প্রতিবেশী বলে গণ্য হবে।’ (তিরমিজি শরিফ)। ইসলাম প্রতিবেশীদের পাশাপাশি কাজে সাহায্যকারী, চাকর-চাকরানী ও অন্যান্য অধীনদের অধিকারের প্রতিও বিশেষ গুরুত্বারোপ করেছে এবং তাদের সঙ্গে সদাচরণ করার নির্দেশ দিয়েছে। রাসূলুল্লাহ (সা.) জীবনের শেষ মুহূর্তে ওসিয়তকালে ইরশাদ করেন : ‘তোমরা নামাজে যতœবান হও এবং অধীনদের ব্যাপারে আল্লাহকে ভয় কর।’

পৃথিবীর ভারসাম্য রক্ষার্থে মানুষকে বিভিন্ন শ্রেণি বা স্তরে সৃষ্টি করা হয়েছে এবং একজনকে অন্যজনের অধীন করা হয়েছে। তবে মনে রাখতে হবে যে, ইসলামী জীবন ব্যবস্থায় আল্লাহর নিকট মর্যাদার ভিত্তি টাকা-পয়সা, ধন-সম্পদ ও পদমর্যাদা ইত্যাদি নয়। বরং মর্যাদার ভিত্তি হচ্ছে তাকওয়া তথা আল্লাহভীতি, দ্বীনদারী ও পরহেযগারী। পবিত্র কুরআনে আল্লাহ তাআলা ইরশাদ করেন : নিশ্চয় আল্লাহর নিকট সে-ই সর্বাধিক মর্যাদাবান যে সর্বাধিক আল্লাহ ভীরু-পরহেযগার। (সূরা হুজুরাত : ১৩)।

তাই অধীন লোক ও কাজের সাহায্যকারীদের প্রহার করা, গালি দেওয়া, তুচ্ছ-তাচ্ছিল্য করা, বংশগত নীচুতার দরুণ লজ্জা দেয়া, অন্ন, বস্ত্র ও বাসস্থানের কষ্ট দেওয়া ইত্যাদি থেকে সকলকে দূরে থাকতে হবে। তাদের ভুলত্রæটি হলে তা ক্ষমাসুন্দর দৃষ্টিতে দেখতে হবে। নিজে যা খাবে এবং পরবে তাদেরকেও তা-ই খেতে পরতে দিবে।

 

 


বিভাগ : শান্তি ও সমৃদ্ধির পথ ইসলাম


মন্তব্য করুন

HTML Comment Box is loading comments...

এই বিভাগের আরও

ভালো কাজে দেরি করা উচিত নয়-২
ভালো কাজে দেরি করা উচিত নয়-১
জালেমের সামনে সত্য প্রকাশে নির্ভীক ছিলেন যারা
জালেমের সহযোগী-সমর্থকও জালেম
আল কুরআনে মানব হত্যার শাস্তি-২
আরও

আরও পড়ুন

মুক্তিযুদ্ধের সঠিক ইতিহাস তুলে ধরতে হবে : তারেক রহমান

মুক্তিযুদ্ধের সঠিক ইতিহাস তুলে ধরতে হবে : তারেক রহমান

ঋণখেলাপিরা যাতে মনোনয়ন না পায় চেষ্টা করবো : মির্জা ফখরুল

ঋণখেলাপিরা যাতে মনোনয়ন না পায় চেষ্টা করবো : মির্জা ফখরুল

অর্থনৈতিক বৈষম্য দূর না হলে রাজনৈতিক সংস্কার টেকসই হবে না : বিপ্লবী ওয়ার্কার্স পার্টি

অর্থনৈতিক বৈষম্য দূর না হলে রাজনৈতিক সংস্কার টেকসই হবে না : বিপ্লবী ওয়ার্কার্স পার্টি

টিসিবি’র এক কোটি ফ্যামিলি কার্ডধারীর মধ্যে ৩৭ লাখই ভুয়া: বাণিজ্য উপদেষ্টা

টিসিবি’র এক কোটি ফ্যামিলি কার্ডধারীর মধ্যে ৩৭ লাখই ভুয়া: বাণিজ্য উপদেষ্টা

ভোজ্যতেলের সরবরাহ নিশ্চিতে কারখানা পরিদর্শন ভোক্তা অধিকারের

ভোজ্যতেলের সরবরাহ নিশ্চিতে কারখানা পরিদর্শন ভোক্তা অধিকারের

গণপরিবহনে শৃঙ্খলায় কাউন্টার স্থাপনের পরিকল্পনা

গণপরিবহনে শৃঙ্খলায় কাউন্টার স্থাপনের পরিকল্পনা

রাজধানীর তিন পার্কে ভেন্ডারের চুক্তি : শর্ত ভঙ্গের তদন্তে ডিএনসিসি

রাজধানীর তিন পার্কে ভেন্ডারের চুক্তি : শর্ত ভঙ্গের তদন্তে ডিএনসিসি

বাবা-মায়ের পুরোনো বাড়িতে যাই : শফিকুল আলম

বাবা-মায়ের পুরোনো বাড়িতে যাই : শফিকুল আলম

জুলাই গণঅভ্যুত্থানে আহতদের চিকিৎসায় ১৫০ কোটি টাকা অনুদান

জুলাই গণঅভ্যুত্থানে আহতদের চিকিৎসায় ১৫০ কোটি টাকা অনুদান

২০২৪ সালে ৩১০ শিক্ষার্থীর আত্মহত্যা

২০২৪ সালে ৩১০ শিক্ষার্থীর আত্মহত্যা

ভারতীয় ৭২ গণমাধ্যমে বাংলাদেশ নিয়ে অপতথ্য প্রচার

ভারতীয় ৭২ গণমাধ্যমে বাংলাদেশ নিয়ে অপতথ্য প্রচার

লেবানন থেকে দেশে ফিরলেন আরো ৪৭

লেবানন থেকে দেশে ফিরলেন আরো ৪৭

প্লাটফর্ম বিষয়ক প্রশিক্ষণ অনুষ্ঠিত

প্লাটফর্ম বিষয়ক প্রশিক্ষণ অনুষ্ঠিত

শক্তিশালী অর্থনীতি ও গর্বিত জাতি গড়তে শহীদ জিয়ার দর্শন ধারণ করতে হবে : আমির খসরু

শক্তিশালী অর্থনীতি ও গর্বিত জাতি গড়তে শহীদ জিয়ার দর্শন ধারণ করতে হবে : আমির খসরু

কী আছে তৌফিকার লকারে?

কী আছে তৌফিকার লকারে?

ঘটনার তিনদিন পর থানায় মামলা

ঘটনার তিনদিন পর থানায় মামলা

অনিয়ম ঢাকতে তড়িঘড়ি করে নির্বাচনের পাঁয়তারা

অনিয়ম ঢাকতে তড়িঘড়ি করে নির্বাচনের পাঁয়তারা

শেবাচিম হাসপাতালের মেডিসিন বিভাগের দুরবস্থা

শেবাচিম হাসপাতালের মেডিসিন বিভাগের দুরবস্থা

৯৬টি সিএনজি ভাঙ্গাড়ি হিসাবে সাড়ে ১১ লাখ টাকায় বিক্রি

৯৬টি সিএনজি ভাঙ্গাড়ি হিসাবে সাড়ে ১১ লাখ টাকায় বিক্রি

৩১ দফা জনগণের কাছে পৌঁছে দিতে রূপগঞ্জে বিএনপির সমাবেশ

৩১ দফা জনগণের কাছে পৌঁছে দিতে রূপগঞ্জে বিএনপির সমাবেশ