ঢাকা   সোমবার, ২৫ নভেম্বর ২০২৪ | ১১ অগ্রহায়ণ ১৪৩১

ফিলিস্তিন মুক্ত করতে বিশ্ব মুসলিমকে শক্ত অবস্থান নিতে হবে

Daily Inqilab ডা. মুহাম্মাদ মাহতাব হোসাইন মাজেদ

২৫ নভেম্বর ২০২৩, ১২:০৪ এএম | আপডেট: ২৫ নভেম্বর ২০২৩, ১২:০৪ এএম

(গত দিনের পর) দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধোত্তর সুপার পাওয়ার তথা পরাশক্তি হিসেবে পৃথিবীতে আবির্ভাব ঘটে দুটি রাষ্ট্রের। একটি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, অন্যটি রাশিয়া। আন্তর্জাতিক রাজনীতির ইতিহাসে তাদের মধ্যেকার দ্বন্দ্বকে বলা হয় ‘স্নায়ুযুদ্ধ বা ঠাণ্ডা যুদ্ধ’। ফলে গোটা পৃথিবীটা দুই শিবিরে ভাগ হয়ে যায়। এজন্য আমরা দেখতে পাই, রাশিয়া ফিলিস্তিনকে সমর্থন দেয়, অন্যদিকে আমেরিকা ইসরাইলকে সমর্থন দেয়। একটা কথা খুব জোরেসোরে মনে রাখা দরকার, রাশিয়া-আমেরিকা কোনো স্বার্থ বা লাভ ছাড়া কোনো দেশ বা যুদ্ধকে সমর্থনকে করে না এবং তাদের সমর্থনই সমস্যার ক্ষত দীর্ঘ থেকে দীর্ঘতর হতে থাকে। তাদের সমর্থন অনেকটা কাটা গায়ে নুনের ছিটা দেয়ার মতো। যে রাশিয়া ইসরাইলের পক্ষে দ্বিজাতিতত্ত্বের সমর্থন করেছিল সে রাশিয়া পরবর্তী সময় মজলুম ফিলিস্তিনকে সমর্থন করার পেছনে স্বার্থ ও রহস্য থাকাটা অস্বাভাবিক কিছু নয়। মূল কারণ হলো আন্তর্জাতিক মিডিয়াগুলোকে রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ থেকে মুখ ফিরিয়ে নিয়ে ফিলিস্তিন-ইসরাইলের দিকে তাক করা। (বলে রাখা উচিত, সোভিয়েত ইউনিয়নের সময় ইউক্রেন বর্তমান রাশিয়ার অন্তর্ভুক্ত ছিল।)

১৯৯১ সালে ইউক্রেন স্বাধীনতা ঘোষণা করে। ইউক্রেন হলো পূর্ব ইউরোপের রাষ্ট্র। আমেরিকা-ব্রিটিন কর্তৃক নিয়ন্ত্রিত ন্যাটো জোট চায় পূর্ব ইউরোপে তাদের আধিপত্য ও শক্তির বলয় বিস্তার করতে। তাই ২০০৮ সাল থেকেই ইউক্রেনকে ন্যাটোর জোটে যোগ করার আশ্বাস দিয়ে আসছে। ইউক্রেনের বর্তমান প্রেসিডেন্ট ভদিমির জেলেনেস্কি ন্যাটোতে যোগ দিতে তোড়জোড় চালাচ্ছে। যদি ইউক্রেন ন্যাটোতে যোগ দেয় তাহলে রাশিয়ার শক্তি অনেকটা কমে আসবে। এজন্যই মূলত রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ। এদিকে আবার চীন ফিলিস্তিনিদের প্রতি ইতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গি রাখলেও ভারত আবার ইসরাইলের দিকে ইতিবাচক। অথচ চীনের জিনজিয়াং প্রদেশের ১০ লাখ উইঘুর নারী-পুরুষকে ‘চরিত্রশোধনাগার’ নাম দিয়ে নির্মমভাবে দিনের পর দিন অত্যাচার করছে। আসলে রাজনৈতিক, ভৌগোলিক এবং অর্থনৈতিক স্বার্থ ছাড়া কেউ কাউকে সমর্থন দেয় না।
এভাবে যদি পরাশক্তিগুলো দুইটি শিবিরে ভাগ হয়ে একটা সমস্যাকে দুইটি ভাগে ভাগ করে ফেলে তাহলে সে সমস্যা আজীবনেও সমাধান হবে না। সমস্যা লেগেই থাকবে।আর গাজায় কাজের সংকট, খাদ্য সংকট নিত্যদিনের। কিন্তু মাদকের সংকট নেই। ইসরায়েল গাজায় হরেক রকমের মাদক প্রবেশের সুযোগ তৈরি করে দেয়। উদ্দেশ্য ফিলিস্তিনিদের মাদকাসক্ত করে গড়ে তোলা। মিশরের সঙ্গে দক্ষিণ গাজার সীমান্ত রাফাহ এখন বন্ধ। এই সীমান্ত খোলার আলোচনা চলছে। হাজারো ফিলিস্তিনি রাফাহ সীমান্তে জড়ো হয়েছে। এ কথা সত্য যে হামাস ইসরায়েলের ভেতরে ঢুকে নির্মমতা চালিয়েছে। প্রশ্ন এসেছে—হামাস কেন ইসরায়েলে আক্রমণ করল? কারণ হতে পারে দুটি।

প্রথমত, যেসব দেশের অবস্থান ফিলিস্তিনিদের পক্ষে ও ইসরায়েলের বিপক্ষে ছিল, তারাও ক্রমান্বয়ে ইসরায়েলের সঙ্গে বন্ধুত্ব বা সম্পর্ক স্বাভাবিক করছে। বিশেষ করে আরব বিশ্ব, সৌদি আরব যার নেতৃত্বে। ফিলিস্তিনিরা বা হামাস মনে করছে, তাদের স্বার্থ এখন আর কেউ দেখছে না। হামাস ইসরায়েলে হামলা করে বুঝিয়ে দিলো যে, ফিলিস্তিনিদের বাদ দিয়ে কোনো শান্তি প্রক্রিয়া এগিয়ে নেওয়া সম্ভব না। দ্বিতীয়ত, ইসরায়েল প্রতিদিনই একটু একটু করে ফিলিস্তিনিদের জায়গা দখল করে ইহুদি বসতি স্থাপন করছে। ফিলিস্তিনিদের নিপীড়ন করছে, হত্যা করছে। ইসরায়েল সরকার তার নাগরিকদের নিশ্চয়তা দিয়েছিল যে, যা কিছুই ঘটুক না কেন, তারা নিরাপদ। হামাস আক্রমণ করে বোঝাতে চাইল ইসরায়েলি জনগণও নিরাপদ নয়।

হামাসের আক্রমণ নিয়ে ব্যাখ্যা বা বিশ্লেষণ চলছে। সেই ব্যাখ্যা বা বিশ্লেষণের প্রায় সবই পক্ষপাতদুষ্ট। পৃথিবীর সামরিক ও অর্থনৈতিকভাবে শক্তিশালী রাষ্ট্রগুলো পক্ষপাতমূলক আচরণ করছে, একই রকম আচরণ করছে তাদের গণমাধ্যমও। ইসরায়েলি বর্বরতাকে জাস্টিফাই করে, তারা শুধু সামনে আনছে হামাসের নির্মমতা। ইসরায়েলের সর্বাত্মক অবরোধে গাজায় পানি নেই, জ্বালানি নেই, ওষুধ নেই। কমপক্ষে ১৫টি হাসপাতাল বোমা ফেলে ধ্বংস করে দিয়েছে ইসরায়েল। শিশুখাদ্য তো বটেই, সামগ্রিকভাবেই খাদ্য সংকট দেখা দিয়েছে গাজায়। বোমাবর্ষণ চলছে। নৌ ও স্থল আক্রমণ আরও তীব্র করার ঘোষণা দিয়ে উত্তরাঞ্চলের গাজাবাসীকে এলাকা ছাড়ার নির্দেশ জারি করেছে ইসরায়েল।

সবাই জানে গাজার উত্তরের ফিলিস্তিনিদের দক্ষিণে চলে যাওয়ার বিষয়টি অবাস্তব, অসম্ভব। এমনিতেই গাজা ঘনবসতিপূর্ণ। উত্তরের ১০-১২ লাখ গাজাবাসীর ঠাঁই হবে না দক্ষিণে। ইসরায়েল মূলত দুটি কারণে উত্তর গাজার ফিলিস্তিনিদের সরে যেতে বলেছে। এর মাধ্যমে বেসামরিক ফিলিস্তিনি হত্যার বিষয়টি তারা জায়েজ করতে চায়। বলবে, আগেই তো সরে যেতে বলেছিলাম। সরে না যাওয়ায় তারা মারা গেছে। আর দ্বিতীয় বা প্রধান কারণ, গাজার উত্তর অংশে ইসরায়েল দখল প্রতিষ্ঠা করতে চায়। গাজার উত্তর অংশে ফিলিস্তিনিদের আর কখনো আসতে দেবে না ইসরায়েল।

পরিশেষে বলতে চাই, বর্তমান পৃথিবীতে চলমান এই ছোট ছোট যুদ্ধক্ষেত্রগুলোই আগামীর পৃথিবীতে ভয়াবহ এক সমস্যা সৃষ্টি করবে, যার বিস্ফোরণের মধ্য দিয়ে পৃথিবীকে হয়তো তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধ নামে আরেকটা নরকীয় হত্যাযজ্ঞ প্রত্যক্ষ করতে হবে। ইউক্রেন-রাশিয়ার যুদ্ধ এক্ষুণি থামানো দরকার। ফিলিস্তিন-ইসরাইলকে শুধু সমর্থন নয়, তাদের নিজ নিজ অধিকার বুঝিয়ে দেয়া দরকার। মনে রাখতে হবে, ইসরাইল পারমাণবিক ক্ষমতাধর রাষ্ট্র। ইসরাইলকে এখন সম্পূর্ণ উৎখাত করে সমস্যা সমাধান করা কোনোভাবেই সম্ভব নয়। শুরুতে ৪৩ শতাংশ ভূমি দিয়ে ফিলিস্তিনকে যে ভূমিখণ্ড দেয়া হয়েছিল সে ফিলিস্তিনকে ৪৩ শতাংশ ভূমিতেই স্বাধীন ফিলিস্তিন হিসেবে ঘোষণা দেয়া হোক। তাদের আরও ভাবা উচিত, সমাজ এক অখণ্ড জিনিস।

অনেকগুলো উপাদান নিয়ে সমাজ গঠিত হয়। পৃথিবীর এক কোণের কোনো সমাজে বিপ্লব হলে পৃথিবীর অন্য প্রান্তে এসে ধাক্কা সে যুদ্ধের হাওয়া লাগে। ফলে নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসপত্রের দাম বাড়ে। পুরো পৃথিবীতে অস্থিতিশীল পরিস্থিতি বিরাজ করে। জাতিসংঘের এখনই উচিত স্বাধীন ফিলিস্তিনকে জাতিসংঘের সদস্যপদ দেয়া। এই ক্ষেত্রে জাতিসংঘকে আরও শক্ত হস্তে দমন করতে হবে, অনেকটা কঠোর হতে হবে। পৃথিবীর মানুষ রাশিয়া-আমেরিকার ক্ষমতার দ্বন্দ্বে, রাজনৈতিক স্বার্থে রক্তারক্তি খেলা আর পুনরায় দেখতে চায় না। এই রক্তারক্তি খেলা বন্ধ হোক। নির্বিচারে মানুষ হত্যা বন্ধ হোক।

 


বিভাগ : ইসলামী জীবন


মন্তব্য করুন

HTML Comment Box is loading comments...

এই বিভাগের আরও

দৈনন্দিন জীবনে ইসলাম
মসজিদে পরে এসে ঘাড় ডিঙিয়ে সামনের কাতারে যাওয়া জায়েজ নেই
দুনিয়া ও আখেরাতের জন্য সুন্দর জীবন এবং কৃতজ্ঞতাবোধ
যুগে যুগে জুলুম ও জালিমের পরিণতি
সালাম ইসলামী সম্ভাষণ রীতির এক উৎকৃষ্ট উদাহরণ
আরও

আরও পড়ুন

গুমের দায়ে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর ২২ সদস্য চাকরিচ্যুত

গুমের দায়ে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর ২২ সদস্য চাকরিচ্যুত

কুরস্ক অঞ্চলের ৪০ ভাগ খোয়ানোর স্বীকারোক্তি ইউক্রেনের

কুরস্ক অঞ্চলের ৪০ ভাগ খোয়ানোর স্বীকারোক্তি ইউক্রেনের

মুক্ত বাণিজ্য চুক্তি নিয়ে বাংলাদেশ চীনের সাথে কাজ করতে আগ্রহী: বাণিজ্য উপদেষ্টা

মুক্ত বাণিজ্য চুক্তি নিয়ে বাংলাদেশ চীনের সাথে কাজ করতে আগ্রহী: বাণিজ্য উপদেষ্টা

হাজীদের সর্বোত্তম স্বার্থ রক্ষায় সরকার প্রতিশ্রুতিবদ্ধ ধর্ম উপদেষ্টা ড. খালিদ হোসেন

হাজীদের সর্বোত্তম স্বার্থ রক্ষায় সরকার প্রতিশ্রুতিবদ্ধ ধর্ম উপদেষ্টা ড. খালিদ হোসেন

শরীয়তপুরে যুবদল, স্বেচ্ছাসেবক দল ও ছাত্রদলের যৌথ কর্মী সভা

শরীয়তপুরে যুবদল, স্বেচ্ছাসেবক দল ও ছাত্রদলের যৌথ কর্মী সভা

মানিকগঞ্জে সড়ক দুর্ঘটনায় সিকিউরিটি গার্ড নিহত

মানিকগঞ্জে সড়ক দুর্ঘটনায় সিকিউরিটি গার্ড নিহত

পাকিস্তানকে উড়িয়ে দিল জিম্বাবুয়ে

পাকিস্তানকে উড়িয়ে দিল জিম্বাবুয়ে

১৫ দিন রিমান্ড শেষে কারাগারে আব্দুর রাজ্জাক

১৫ দিন রিমান্ড শেষে কারাগারে আব্দুর রাজ্জাক

লক্ষ্মীপুরে ১২০ টাকায় পুলিশে চাকরি পেলেন ৫০ জন

লক্ষ্মীপুরে ১২০ টাকায় পুলিশে চাকরি পেলেন ৫০ জন

নির্বাচিত সরকারই দেশকে পুনর্গঠন করতে পারে : তারেক রহমান

নির্বাচিত সরকারই দেশকে পুনর্গঠন করতে পারে : তারেক রহমান

বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন জেলা কমিটিতে অচেনা ৭ জন

বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন জেলা কমিটিতে অচেনা ৭ জন

মৌলভীবাজারে কৃষি ও প্রযুক্তি মেলা শুরু

মৌলভীবাজারে কৃষি ও প্রযুক্তি মেলা শুরু

দ্রব্যমূল্য নিয়ন্ত্রণের মডেল উদ্ভাবন

দ্রব্যমূল্য নিয়ন্ত্রণের মডেল উদ্ভাবন

ব্রহ্মপুত্রে অবৈধ ড্রেজার বসিয়ে চলছে বালু ব্যবসা

ব্রহ্মপুত্রে অবৈধ ড্রেজার বসিয়ে চলছে বালু ব্যবসা

বাঘায় কৃষি শ্রমিককে গলা কেটে হত্যা

বাঘায় কৃষি শ্রমিককে গলা কেটে হত্যা

কেশবপুরে অবৈধ ইটভাটা বন্ধে বিভিন্ন দফতরে অভিযোগ

কেশবপুরে অবৈধ ইটভাটা বন্ধে বিভিন্ন দফতরে অভিযোগ

হামলার শিকার হয়েও মুখ খুলতে পারছে না বোয়ালমারীর বহু পরিবার

হামলার শিকার হয়েও মুখ খুলতে পারছে না বোয়ালমারীর বহু পরিবার

ইসলামী আন্দোলনের গণসমাবেশে আ.লীগ নিষিদ্ধের দাবি

ইসলামী আন্দোলনের গণসমাবেশে আ.লীগ নিষিদ্ধের দাবি

বিপিএলের প্রথম দিনই মাঠে নামছে বসুন্ধরা-মোহামেডান

বিপিএলের প্রথম দিনই মাঠে নামছে বসুন্ধরা-মোহামেডান

সাগরে মিলছে না আশানুরূপ ইলিশ হতাশায় মীরসরাইয়ের জেলেরা

সাগরে মিলছে না আশানুরূপ ইলিশ হতাশায় মীরসরাইয়ের জেলেরা