কুরআনের মাসে হোক কুরআনপ্রীতি
১৫ মার্চ ২০২৫, ১২:২২ এএম | আপডেট: ১৫ মার্চ ২০২৫, ১২:২২ এএম

আল্লাহ তায়ালা রমযানকে যেসব বিশেষণে বিশেষায়িত করেছেন, তার মধ্যে অন্যতম হলো: রমযান মাস কুরআনের মাস। এ মাসে নাযিল হয়েছে বিশ্বমানবের হেদায়েত ও কল্যাণের একমাত্র বাণী, কালামুল্লাহ-কুরআন মাজীদ। তাই এ মাসের সাথে কুরআনের সম্পর্ক ওতপ্রোতভাবে জড়িত। আল্লাহ তায়া’লা রমজানের পরিচয় পবিত্র কুরআনে এভাবে দিয়েছেন : রমযান মাসই হল সে মাস, যাতে নাযিল করা হয়েছে কোরআন, যা মানুষের জন্য হেদায়েত এবং সত্যপথ যাত্রীদের জন্য সুষ্পষ্ট পথ নির্দেশ আর ন্যায় ও অন্যায়ের মাঝে পার্থক্য বিধানকারী। (আল বাকারা : ১৮৫)। রমযান এলেই মুমিন হৃদয় কুরআন প্রীতির এক অনুপমেয় মহক ছড়িয়ে পড়ে, কুরআনের সাথে এক অকৃত্রিম স্বর্গীয় সখ্যতা গড়ে উঠে। কুরআন তিলাওয়াতে, কুরআনের তাফসীর শ্রবণে সজীবতা ফিরে পায় তাঁর ঈমানী চেতনা। তারাবীহ, তাহাজ্জুদে কুরআনের এক প্রানবন্ত মূর্চনায় আন্দোলিত হয় তার দেহমন।
স্বয়ং রাসূলে কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম, যাঁর ওপর পবিত্র কুরআন নাযিল হয়েছে, মাহে রমযানের আগমন ঘটলে তাঁর স্বাভাবিক জীবনাচারে পরিবর্তন ঘটত। বেশি বেশি কুরআন তিলাওয়াত করতেন। রমযানের প্রতি রাতে জিবরাঈল আ. অবতরণ করতেন। একজন আরেকজনকে কুরআন তিলাওয়াত করে শুনাতেন। দ্বীপ্যমান সে অবস্থার বর্ণনা দিয়েছেন হযরত ইবনে আব্বাস রা.। তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ছিলেন সর্বশ্রেষ্ঠ দাতা। রমযানে তিনি আরো বেশী দানশীল হতেন, যখন জিবরাঈল (আলাইহিস সালাম) তাঁর সাথে সাক্ষাত করতেন। আর রমযানের প্রতি রাতেই জিবরাঈল (আলাইহিস সালাম) তাঁর সাথে সাক্ষাত করতেন এবং তাঁরা পরস্পর কুরআন তিলাওয়াত করে শোনাতেন। নিশ্চয়ই রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম রহমতের বাতাস থেকেও অধিক দানশীল ছিলেন। (সহীহ বুখারী : ৬)।
রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের সাহাবীদের অবস্থাও এর ভিন্ন ছিল না। রমযান এলে তাঁরা তাদের তিলাওয়াতের পরিমাণ বাড়িয়ে দিতেন। বছরের অন্যান্য সময় যত দিনে কুরআন খতম করতেন, রমযানে তার চেয়ে কম সময়ে কুরআন খতম করতেন। পাশাপাশি তারাবীহ এবং তাহাজ্জুদে অত্যন্ত গুরুত্বের সাথে কুরআন তিলাওয়াতের আমল জারি রাখতেন। সালাফে সালেহীন এবং আইম্মায়ে মুজতাহিদীনের জীবনীতেও এমনটাই চোখে পড়ে। মাহে রমযানে তারা সকলেই কুরআন তিলাওয়াতের প্রতি বিশেষ গুরুত্বারোপ করতেন। নমুনাস্বরূপ আমরা এখানে সালাফের জীবনী থেকে তিলাওয়াতের সেই জ্যোতির্ময় ধারাবাহিকতার কিছু চিত্র তুলে ধরা হলো।
রমযান মাস এলেই ইমাম আবু হানীফা রাহ. কুরআন তিলাওয়াতের জন্য সম্পূর্ণ ফারেগ হয়ে যেতেন। স্বাভাবিক সময়ে তিনি প্রতিদিন এক খতম তিলাওয়াত করতেন। রমযানে প্রতিদিন দুই খতম তিলাওয়াত করতেন। এভাবে ঈদুল ফিতরের রাত ও দিনসহ মাহে রমযানে সর্বমোট ৬২ বার কুরআন খতম করতেন। যখন রমযানের শেষ দশক শুরু হত, তখন তাঁর সাথে কথাবার্তা বলার সুযোগ খুব কমই হত। (দ্র. আখবারু আবী হানীফা, পৃ. ৫৫, ৫৭; তারীখে বাগদাদ, খ. ১৩, পৃ. ৩৫৫)। ইমাম মালেক রাহ. রমযান মাসে হাদীসের দরস প্রদান থেকে এবং আহলে ইলমের সাথে দেখা-সাক্ষাৎ থেকে বিরত থাকতেন। কুরআন তিলাওয়াতে মগ্ন থাকতেন। (দ্র. লাতাইফুল মাআরিফ, ইবনে রজব হাম্বলী, পৃষ্ঠা ১৭১)।
তিনি প্রতি মাসে ৩০ বার কুরআন কারীম খতম করতেন। মাহে রমযানে ৬০ বার কুরআন খতম করতেন। দিনে এক খতম, রাতে এক খতম। তিনি যে শুধু তিলাওয়াত করে যেতেন, এমনটি নয়; বরং কখনো কখনো এমন হত, তিনি কিয়ামুল লাইলে দাঁড়িয়েছেন। তখন এমন একটি আয়াত সামনে এল, যেটা ফিকহের কোনো অধ্যায় সম্পর্কিত। তিনি সালাম ফিরিয়ে বাতি জ্বালাতেন এবং সেটা নোট করে রাখতেন। এরপর আবার বাতি নিভিয়ে নামাযে দাঁড়িয়ে যেতেন। দেখা যেত, এক রাতেই কয়েকবার এমনটি ঘটত। (দ্র. আদাবুশ শাফেয়ী ওয়া মানাকিবুহু, ইবনে আবি হাতেম, পৃ. ৭৪; মানাকিবুশ শাফেয়ী, বাইহাকী, খ. ১, পৃ. ২৪৪, ২৭৯)।
মাহে রমযানে তিনি বিভিন্নভাবে কুরআন খতম করতেন। রমযানের প্রথম রাতের সূচনা হলে, তাঁর শাগরিদরা তাঁর কাছে এসে জড়ো হত। তিনি তাদেরকে নিয়ে সালাত আদায় করতেন। প্রতি রাকাতে ২০ আয়াত করে তিলাওয়াত করতেন। এভাবে একটি খতম পূর্ণ হত। আবার সাহরীর সময় তিনি কুরআনের অর্ধেক বা এক-তৃতীয়াংশ পরিমাণ তিলাওয়াত করতেন। এভাবে সাহরীর সময় প্রতি তিন রাতে একটি খতম হত। এছাড়াও দিনের বেলায় প্রতিদিন একবার কুরআন খতম করতেন। ইফতারের সময় সেই খতম সমাপ্ত হত। তিনি বলতেন, প্রত্যেক খতমের সময়টা হচ্ছে দুআ কবুল হওয়ার সময়। (দ্র. শুআবুল ঈমান, বাইহাকী, খ. ২, পৃ. ৪১৬)। কুরআন তিলাওয়াতের জ্যোতির্ময় এই ধারাবাহিকতা এখানেই শেষ নয়! বরং পরবর্তী ওলামায়ে কেরাম, মুমিন মুসলমানদের মাঝেও এই ধারাবাহিকতা বিদ্যমান ছিল। এমনকি হিন্দুস্তানের নিকট অতীতের উলামায়ে কেরামের এর জীবনীতেও সচরাচর এমনটাই চোখে পড়ে। তাবলীগ জামাতের প্রতিষ্ঠাতা মাওলানা ইলিয়াস রাহ.-এর আম্মাজান। তিনি হাফেযা ছিলেন। রমাযানের বাইরে তাঁর নিয়মিত আমল ছিল, দৈনিক এক মঞ্জিল তিলাওয়াত করা। আর রমযানে তার দৈনিক আমল ছিল চল্লিশ পারা তিলাওয়াত করা। অর্থাৎ এক খতম করেও আরো দশ পারা তিলাওয়াত করতেন। এ তিলাওয়াতের পাশাপাশি কয়েকশ করে বিভিন্ন তাসবীহ আদায় করতেন। যা প্রায় সতের হাজারের কাছাকাছি হয়ে যেত। (আকাবির কা রমযান, যাকারিয়া রাহ., পৃষ্ঠা ৬৩)। কুরআন তিলাওয়াত নিছক পাঠ নয়। বরং এটি একটি স্বতন্ত্র ইবাদত। কুরআন সুন্নাহে বিভিন্ন ভাবে তার ফযিলত বর্ণিত হয়েছে। হযরত আবু হুরায়রা রা. থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন...আর যারা আল্লাহর ঘরে একত্র হয়ে আল্লাহর কিতাব তিলাওয়াত করে এবং পারস্পরিক কুরআনের চর্চা করে, তাদের প্রতি ‘সাকীনা’ তথা এক প্রকার বিশেষ প্রশান্তি বর্ষিত হয়, রহমত তাদেরকে আচ্ছাদিত করে নেয় এবং আল্লাহ তাঁর কাছের ফিরিশতাদের মাঝে তাদের আলোচনা করেন। (সহীহ মুসলিম, হাদীস ২৬৯৯)।
হযরত আবদুল্লাহ ইবনে মাসউদ রা. বলেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেন-যে ব্যক্তি কুরআনের একটি হরফ পড়ল তার জন্য রয়েছে একটি নেকী। আর একটি নেকী দশ নেকী সমতুল্য। নবীজী বলেন, আমি বলছি না যে, আলিফ লাম মীম- একটি হরফ। বরং আলিফ একটি হরফ, লাম একটি হরফ এবং মীম একটি হরফ। (জামে তিরমিযী, হাদীস ২৯১০)। উল্লেখ্য : রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম দৃষ্টান্ত স্বরূপ আলিফ লাম মিম উল্লেখ করেছেন, আর এগুলো এমন শব্দ যার অর্থ আল্লাহ তায়ালা ছাড়া আর কেউ জানে না। বুঝা গেল কেউ যদি অর্থ না বুঝেও তিলাওয়াত করে, তার জন্য রয়েছে অনেক সাওয়াব, অনেক ফায়দা। আর কেউ যদি বুঝে বুঝে, উপলব্ধি করে তিলাওয়াত করে, তাহলে তার কত সাওয়াব হবে সেটা আল্লাহ তায়ালাই জানেন।
অপর এক হাদিসে হযরত আয়েশা সিদ্দীকা রা. বলেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেছেন- যারা উত্তমরূপে কুরআন পড়বে তারা থাকবে অনুগত সম্মানিত ফিরিশতাদের সাথে। আর যে কুরআন পড়তে গিয়ে আটকে আটকে যায় এবং কষ্ট হয়, তার জন্য রয়েছে দ্বিগুণ সওয়াব। (সহীহ মুসলিম, হাদীস ৭৯৮)। নবীজীর এ হাদীসটি একদিকে যেভাবে তিলাওয়াতে পারদর্শী ব্যক্তিদের জন্য সুসংবাদ প্রদানকারী তেমনি কুরআন পড়তে যাদের কষ্ট হয়, মুখে আটকে আটকে যায়, তাদের জন্যও এ বাণী আশা সঞ্চারক এবং উৎসাহব্যঞ্জক। বস্তুত পবিত্র মাহে রমযান কুরআন মাজীদের সাথে একজন মুমিনের সম্পর্ক দৃঢ় থেকে দৃঢ়তর করা, এবং কুরআনের নূরে দেহমন স্নাত করার এক মোক্ষম সময়।
আল্লাহ তাআলা কুরআনের সাথে মুমিনের সম্পর্কের চিত্রায়ণ করেছেন অত্যন্ত চমৎকার ভঙ্গিমায় : মুমিন তো তারাই, (যাদের সামনে) আল্লাহকে স্মরণ করা হলে তাদের হৃদয় ভীত হয়, যখন তাদের সামনে তাঁর আয়াতসমূহ তিলাওয়াত করা হয় তখন তা তাদের ঈমানের উন্নতি সাধন করে এবং তারা তাদের প্রতিপালকের উপর ভরসা করে। (সূরা আনফাল : ০২)। তাই আমাদের উচিত কুরআনের মাসে কুরআনের সাথে এক অভেদ্য সূতীরেখা গড়ে তোলা। এবং বছরব্যাপী এই সেতুবন্ধন অটুট ও অক্ষুন্ন রাখা। আল্লাহ তায়ালা আমাদেরকে কুরআন প্রীতি দান করুন এবং রমজানের বরকত থেকে পরিপূর্ণভাবে উপকৃত হওয়ার তাওফিক দান করুন। আমিন
বিভাগ : ইসলামী জীবন
মন্তব্য করুন
আরও পড়ুন

কালো সোনায় রঙিন স্বপ্ন পঞ্চগড়ের কৃষক মানিকের

নোয়াখালীতে আইন মন্ত্রণালয় কর্মচারীর কাছে যুবদলনেতার ১ লাখ টাকা চাঁদা দাবি

‘শেখ পরিবারের কি এক্টাবস্থা!’

নেইমার ছিটকে গেলেন আবারও

ফ্যাক্ট চেকিংয়ের পরিবর্তে আসছে ‘কমিউনিটি নোটস’

ভূরুঙ্গামারী সীমান্তে ভারতীয় অস্ত্রের চালান আটক ভারত থেকে বাংলাদেশ পাচারের চেষ্টা

হাসিনাকে ফেরাতে জাহাঙ্গীরের ষড়যন্ত্র, অডিও ভাইরাল

মানবতাবিরোধী অপরাধে আইসিসি-তে দুতার্তের বিচার, ভিডিও কনফারেন্সে শুনানি

ডাকাতের কবলে তরমুজের ট্রলার, আহত ৮

বাউফলে উত্ত্যক্তের শিকার স্কুলছাত্রীর চিরকুট লিখে আত্মহত্যা

সিরাজদিখানে অজ্ঞাত গাড়ির ধাক্কায় অটোরিকশা খাদে, প্রাণ গেল কৃষকের

খুলনায় জাতীয় ভিটামিন ‘এ’ প্লাস ক্যাম্পেইনের উদ্বোধন

মামলা দেয়ার কথা বলে টাকা চাইবার কারবার করবেন না : ব্যারিস্টার মাহবুব উদ্দিন খোকন

আফগানিস্তান, পাকিস্তান, ভুটানসহ ৪৩টি দেশে ভ্রমণ নিষেধাজ্ঞা দিতে যাচ্ছে ট্রাম্প

ঈদগাঁওতে সন্ত্রাসীদের গুলিতে নিহত-১, আহত-৫

বিভিন্ন দাবিতে শাহবাগে অবস্থান নিয়েছে ‘ইনকিলাব মঞ্চ’

গাজায় ইসরায়েলি হামলায় আহত সাংবাদিক আলা হাশিমের মৃত্যু

ঝিকরগাছায় সংখ্যালঘু গৃহবধূকে ধর্ষণচেষ্টার অভিযোগে গ্রেপ্তার ১

গুলশানে ইউএন হাউজ উদ্বোধন করলেন জাতিসংঘ মহাসচিব

বাবা খ্রিস্টান, মা হিন্দু তবু কেন মুসলিম পদবী ব্যবহার করেন দিয়া!