রবীন্দ্রনাথের ছোটগল্প এবং কাব্য ভাবনা
১১ মে ২০২৩, ০৮:০৯ পিএম | আপডেট: ১২ মে ২০২৩, ১২:০২ এএম
বাংলা সাহিত্যের প্রসঙ্গ আসলেই যে নামটি সর্বাগ্রে মনের মুকুরে ভেসে উঠে তিনি আর কেউ নন, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর। যাকে বাংলা ভাষার সর্বশ্রেষ্ঠ কবি-কথাসাহিত্যিক বললেও অত্যুক্তি হবে না। যিনি গুরুদেব, কবিগুরু, বিশ্বকবি ইত্যাদি অভিধায় ভূষিত। ৫২টি কাব্যগ্রন্থ, ৩৮টি নাটক, ১৩টি উপন্যাস ও ৩৬টি প্রবন্ধ, ৯৪টি ছোটগল্প, এবং অসংখ্য গানই তার আধিপত্য এবং শেষ্ঠত্বের প্রমাণ। সাহিত্যের এহেন শাখা নেই, যেখানে তাঁর গৌরব দীপ্ত পদাচারনা নেই। রবীন্দ্র কাব্য, গল্প, উপন্যাস, গান, নাটক, এখনো সব শ্রেণির পাঠককে মায়াজালে জড়িয়ে রাখে।
এবার কবির কাব্যের বিস্তৃত এবং বহুমুখী:
প্রতিভার কিছুটা রস আস্বাদন করা যাক।শুরু করছি নবজাতক’ কাব্যগ্রন্থ দিয়ে। এই গ্রন্থের ভুমিকায় তিনি লিখেছেন — ‘আমার কাব্যের ঋতু পরিবর্তন ঘটেছে বারেবারে। প্রায়ই সেটা ঘটে নিজের অলক্ষ্যে। কালে কালে যেমন ফুল ফসল বদল হয়ে থাকে তেমন। তখন মৌমাছির মধু জোগান নতুন পথ নেয়।..কাব্যে এই যে হাওয়া বদল থেকে সৃষ্টি বদল এতো নিতান্তই স্বাভাবিক, তবে এটা ঘটতে থাকে অন্যমনে। সৃষ্টি সুখের উল্লাসে। কবির এ সম্বন্ধে তেমন একটা খেয়াল থাকে না’। যাই হোক কাব্যে ঋতুবদল শব্দটি নি:সন্দেহে একটি অভিজাত প্রয়োগ।
কাব্যের এই ঋতু-বদলের প্রেক্ষিতে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের কাব্যগুলিকে বিশ্লেষণ করলে দেখা যায়, গদ্য এবং ছন্দ—উভয় ক্ষেত্রেই সমানতালে স্বচ্ছন্দ বিচরণ করেছেন তিনি। তাঁর সাহিত্যসৃষ্টির প্রথম পর্বের রচনাগুলোর মধ্যে রয়েছে ‘বনফুল‘(১২৮২-৮৩), কবি কাহিনী,ভগ্নহৃদয় ‘ভানুসিংহের পদাবলী› (১২৮৪-১২৯০), ‘বাল্মীকি প্রতিভা (গীতিনাট্য) প্রভৃতি।
এরপর তিনি স্বতন্ত্র ধারার বিচ্ছুরণ ঘটান। স্বকীয়তায় ক্রমশ উজ্জ্বল থেকে উজ্জ্বলতর হয়ে উঠেন। যে সব কাব্যে তিনি নিজেকে নিজেই ছাড়িয়ে যান, তাদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো, ‘সন্ধ্যাসঙ্গীত‘(১২৮৮), ‘প্রভাতসংগীত›(১২৯০), ছবি ও গান (১২৯০), ‘কড়ি ও কোমল› (১২৯৩) ইত্যাদি। প্রভাত সংগীত রচনার সময় প্রকৃতির বিশালতা এবং মানব জীবনের নানাবিধ বৈচিত্র্যের সঙ্গে কবির আত্মিক যোগসূত্র স্থাপিত হয়। তখন কবির হৃদয়ের ভাবাবেগের দোলাচল বা অস্পষ্টতা কেটে যায়। কাব্যের ভাব, ভাষা ও ছন্দ, উপমা, অলংকার ক্রমশ বিকশিত হয়। তখন কবি কাব্য জগতের চারাগাছ থেকে একপ্রকা- মহীরুহ। কবির এইসব কাব্যের ভাবনা পরবর্তীতে তাঁর প্রেমের গল্প সমূহে প্রতিভাত হয়। প্রভাত সংগীতের পরবর্তী কাব্য ‘ছবি ও গানে’র পর রবীন্দ্রনাথের চতুর্দশপদী কবিতা সমৃদ্ধ ‘কড়ি কোমল (১২৯৩) প্রকাশিত হলে, তাতে তাঁর প্রকৃতিপ্রেম, স্বদেশপ্রেম, বিশ্বমানবতা ও বিশ্বপ্রকৃতির প্রভাব ও প্রকাশ লক্ষ করা যায়। অত:পর ‘মানসী (১২৯৭) ও ‘সোনার তরী (১৩০০) কাব্যগ্রন্থ দুটিতে মূলত: রবীন্দ্র কাব্যের পরিণত ভাবধারার বিস্ফোরণ ঘটে। এই সময় ছন্দ ও ভাষার আড়ষ্টতা থেকে মুক্তি, সৌন্দর্য ব্যাকুলতা ও নিসর্গ চেতনাময় রোমান্টিক কল্পনার বিস্তারে তাঁর কাব্য প্রতিভার যথার্থ উন্মেষ ঘটে। ‘চিত্রা’(১৩০২) গ্রন্থে মানবতাবোধ, সৌন্দর্য সীমা ও অসীমে পরিব্যাপ্তিতে দেখার মনোভাব, কর্মচঞ্চল জীবনের আহ্বানে সংগ্রামের জন্য প্রস্তুতির চেতনা, দুঃখবরণ ও আত্মবিসর্জনের উপলক্ষ লক্ষ করা গেছে।
‘চিত্রা’র পরবর্তীকালে ‘চৈতালি (১৩০২) কাব্যগ্রন্থে প্রাচীন ভারতের ধ্যানগম্ভীর, শান্ত আদর্শে কবি উদ্বুদ্ধ। এছাড়া এই কাব্যে সুখ-দুঃখ, মহত্ত্ব, কর্তব্য নিষ্ঠার পরিচয় পাওয়া যায়। ‘কল্পনা‘(১৩০৭) কাব্যেও লক্ষণীয় সেই অতীত স্মৃতিরই অনুধ্যান দেখা যায়। এখানে অতীতমুখী কবিমন প্রাচীন ভারতের সৌন্দর্য স্মৃতিতে বিভোর। প্রায় একই সময়ে রচিত তাঁর অন্য কাব্যগ্রন্থগুলি হলো ‘কথা ও কাহিনী’ ও ‘ক্ষণিকা’। পৌরাণিক, ঐতিহাসিক, লৌকিক আখ্যায়িকা থেকে গৃহীত বিষয় নিয়ে লেখা কবিতা ও নাট্যকবিতা স্থান পেয়েছে ‘কথা ও কাহিনী’ ও ‘ক্ষণিকা’য়। সমাজ ও স্বভাবধর্মের ওপর মানুষ্য ধর্মের বিজয় ঘোষণার পাশাপাশি ত্যাগ যে কত মোহময় হতে পারে, তা এই কবিতাগুলিতে প্রকাশিত হয়েছে। ‘কণিকা’ কাব্যগ্রন্থে কবির আবেগ উচ্ছলতা সংযত হয়ে সাধারণ জীবনের চারপাশের ভাব থেকে রূপক বেছে নিয়ে নীতি নির্ভর, দার্শনিকতা প্রধান অজস্র কবিতা রচিত হয়েছে। ‘ক্ষণিকা’র কবিতাগুলি গীতি কবিতার অসামান্য নিদর্শন। একইভাবে ‘নৈবেদ্য’ কাব্যগ্রন্থে ঈশ্বরের প্রতি কবির শান্ত, সমাহিত, ঐকান্তিক অনুরাগের ছবি ফুটে উঠেছে। সেই সাথে জীবনের চরম সত্য অনুধাবনে কবির ব্যাকুলতা গভীরভাবে লক্ষ করা গেছে। এছাড়া কবি পতœীর তিরোধানের প্রেক্ষাপটে লেখা ‘স্মরণ (১৩০৯) কাব্যে মৃত্যুরহস্য সম্পর্কিত বেশ কিছু কবিতা স্থান পেয়েছে। তাছাড়া কবির শিশুসুলভ খেয়ালি মনের ও চমতকার উপলব্ধির প্রকাশ ঘটেছে ‘শিশু (১৩১০) কাব্যগ্রন্থে। পরবর্তীতে গানের সংকলন ‘গীতাঞ্জলি’, ‘গীতিমাল্য’ ও ‘গীতালি’তে, অসীমের প্রতি কবির গভীর অনুরাগ দেখতে পাওয়া যায়।
এবার আসা যাক, রবীন্দ্রনাথের ছোটগল্প প্রসঙ্গে। একথা অনস্বীকার্য যে, রবীন্দ্রনাথ বাংলা ছোটগল্পের প্রথম সার্থক রূপকার। ‘সাধনা’ পত্রিকার মাধ্যমে তার গল্পের শুরু। তবে বাংলা ছোটগল্প যে পাশ্চাত্য গল্পের কাছে ঋণী, এমন কি রবীন্দ্রনাথ নিজেও এডগার অ্যালান পো-র মতোন বিদেশি সাহিত্যিকের সাহায্য গ্রহণ করেছিলেন, এ তথ্য আজ প্রমাণিত। প্রসঙ্গত প্রভাতকুমার মুখোপাধ্যায়ের একটি উক্তি স্মরণযোগ্য। তিনি ছোটগল্পে রবীন্দ্রনাথের অসাধারণ কৃতিত্বের কথা স্মরণ করার পাশাপাশি লিখেছেন, “উপন্যাসের মত, ছোটগল্প জিনিসটাকেও আমরা পশ্চিম হইতে বঙ্গসাহিত্যে আমদানি করিয়াছি।
আমাদের রবীন্দনাথ ঠাকুরের ছোটগল্পের সংখ্যা ৯৪ টি। ১৮৭৭ সালে মাত্র ষোলো বছর বয়সে ভিখারিণীগ্ধ গল্পটি রচনার মাধ্যমে তাঁর গল্প লেখার হাতে-খড়ি। পরবর্তীকালে লেখক কর্তৃক পরিত্যক্ত এই গল্পটি প্রকাশিত হয়েছিল ভারতী পত্রিকার শ্রাবণ-ভাদ্র ১২৮৪ সংখ্যায়। এরপর সাত বছর রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর কোনও গল্প রচনা করেননি। ১৮৮৪ সালে তেইশ বছর বয়সে তিনি রচনা করেন ঘাটের কথাগ্ধ ও রাজপথের কথাগ্ধ গল্প দু’টি এবং তার পরের বছর রচনা করেন মুকুটগ্ধ। তবে অনেকেই মনে করেন, ১৮৯১ সালে তিরিশ বছর বয়সে রবীন্দ্রনাথের যথার্থ ছোটগল্প রচনার সূত্রপাত ঘটে।
পরবর্তীকালে ভারতী ছাড়াও নবজীবন, বালক, হিতবাদী, সাধনা, সখা ও সাথী, প্রদীপ, বঙ্গদর্শন, প্রবাসী, বঙ্গভাষা, সবুজপত্র, ছোট গল্প, আনন্দবাজার পত্রিকা, শনিবারের চিঠি, বিশ্বভারতী পত্রিকা ও ঋতুপত্র পত্রিকায় তাঁর অন্যান্য ছোটোগল্পগুলি প্রকাশিত হয়। গ্রন্থাকারে গল্পগুলি সংকলিত হয়েছিল ছোটগল্প, বিচিত্র গল্প (১ম ও ২য় ভাগ), কথা-চতুষ্টয়, গল্প-দশক, গল্প-গুচ্ছ (১ম খ- ও ২য় খ-), কর্মফল, হিতবাদীর উপহার: রবীন্দ্র গ্রন্থাবলী, গল্পগুচ্ছ (১ম-৫ম ভাগ), আটটি গল্প, গল্প চারিটি, গল্পসপ্তক, পয়লা নম্বর, লিপিকা, গল্পগুচ্ছ (১ম-৪র্থ খ-, বিশ্বভারতী গ্রন্থালয় প্রকাশিত), সহজপাঠ, সে, তিন সঙ্গী ও গল্পসল্প গ্রন্থে। বিশ্বভারতী প্রকাশিত রবীন্দ্র রচনাবলী-র ৭ম, ৮ম, ৯ম, ১০ম, ১১শ, ১২শ, ১৩শ ও ১৪শ খ-ে (সুলভ সংস্করণ) গল্পগুচ্ছ-এর অন্তর্ভুক্ত গল্পগুলি সংকলিত হয়েছে। এছাড়া রবীন্দ্রনাথ শরৎকুমারী দেবী, চারুচন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায়, প্রভাতকুমার মুখোপাধ্যায়, বলাইচাঁদ মুখোপাধ্যায় (বনফুল) প্রমুখ কথাসাহিত্যিককে কয়েকটি গল্পের কাহিনি-সারাংশ লিখে দিয়েছিলেন এবং নিজ কন্যা মাধুরীলতা দেবীর লেখা একটি গল্প সংশোধন করে দেন। এছাড়া রবীন্দ্রনাথ তাঁর কয়েকটি গল্পের নাট্যরূপও দিয়েছিলেন।
রবীন্দ্রনাথের ছোটগল্প দুটি পর্বে বিভক্ত। প্রথম পর্বের গল্পগুলিতে পদ্মা তীরবর্তী উত্তরবঙ্গের গ্রামীণ জীবনই প্রধানত প্রতিফলিত হয়েছে। সমকালীন জটিল নাগরিক পরিবেশ থেকে এই পটভূমির পার্থক্য অত্যন্ত স্পষ্ট। দ্বিতীয় পর্বের ছোটগল্প মূলত সবুজপত্রে প্রকাশিত গল্প। এগুলোর ভাব, বিষয় ও রূপকল্পে সম্পূর্ণ নতুনত্ব লক্ষণীয়। তবে তাঁর ছোটগল্পের আসল পালাবদলের শুরু ষষ্ঠনীড় রচনার কাল থেকে। তার উত্তরবঙ্গের জীবন অভিজ্ঞতা নির্ভর গল্প ৫৯টি আর নতুন জীবনবোধে সিদ্ধ গল্প ২৩টি। যেগুলো পরবর্তীতে গল্পগুচ্ছে স্থান পেয়েছে। অবশ্য এরপরেও তিনি গল্প লিখেছেন, তবে সেগুলিতে রবীন্দ্রমানসের প্রতিফলন ততটা নেই। তবুও বাংলা ছোটোগল্পে রবীন্দ্রনাথ নিঃসন্দেহে পথিকৃৎ।
সর্বোপরি, সাহিত্যের যে কোনো শাখার নাম নিলেই চেতনে অথবা অবচেতনে যে নামটি চলে আসবেই... তিনিই আমাদের রবি ঠাকুর। যাকে ছাড়া বাংলা সাহিত্যের বিকাশ এবং সমৃদ্ধি প্রায় অসম্ভব ছিল। তাই আমি গভীরভাবে বিশ্বাস করি,রবীন্দ্রনাথকে নিয়ে আরও বেশি গবেষণা হওয়া দরকার। কারণ তাকে নিয়ে যত বেশি গবেষণা হবে বাংলা সাহিত্য তত বেশি সমৃদ্ধ হবে।
বিভাগ : সাহিত্য
মন্তব্য করুন
আরও পড়ুন
বাংলাদেশের বিপক্ষে যে একাদশ দিয়ে মাঠে নামছে ওয়েস্ট ইন্ডিজ
কিশোরগঞ্জের আওয়ামী লীগ নেতা আনোয়ার কামালসহ তিনজন গ্রেফতার
প্রেসিডেন্টের সঙ্গে তিন বাহিনীর প্রধানের সাক্ষাৎ
বেইজিং সংস্কৃতি ও পর্যটন ব্যুরো ও আটাবের মধ্যে চুক্তি স্বাক্ষরিত
উইন্ডিজের বিপক্ষে মাঠে নামছে বাংলাদেশ
গাজায় যুদ্ধবিরতি ছাড়া বন্দী বিনিময় হবে না : হামাস
শান্তিরক্ষা মিশন মোতায়েন করতে চায় জাতিসংঘ হাইতিতে
চকরিয়ার বিএনপি নেতা আবু তাহের চৌধুরীর মৃত্যুতে সালাহউদ্দিন আহমদ ও হাসিনা আহমদের শোক
পুতিন পারমাণবিক অস্ত্র ব্যবহার করতে দ্বিধা করবেন না : সার্বিয়া
ক্লাইমেট অর্থায়ন ইস্যুতে দেশগুলোর মধ্যে দ্বন্দ্ব
লালমোহনে দুই গ্রুপের সংঘর্ষে আহত যুবদল নেতা চিকিৎসাধীন অবস্থায় মৃত্যু
ট্রাম্পের অ্যাটর্নির বিরুদ্ধে তদন্ত প্রতিবেদন আটকে গেল
‘ফিলিস্তিনের পর ইরান, সউদী ও তুরস্ক হবে পরবর্তী টার্গেট’
প্রতি বছর ৩ লাখ নথিবিহীন অভিবাসীকে বৈধতা দানের ঘোষণা স্পেনের
প্রেম-ভালোবাসা নিয়ে সবচেয়ে অসুখী দেশ জাপান-কোরিয়া
মুসলিম চিকিৎসক
শীর্ষে দিল্লি
সৈয়দ মোসাদ্দেক বিল্লাহ আল মাদানীকে জমিয়াতুল মোদার্রেসীন ও দারুননাজাত মাদরাসা’র সংবর্ধনা
ইসলামিক ফাউন্ডেশন এর বোর্ড অব গভর্নর সৈয়দ মোসাদ্দেক বিল্লাহ আল মাদানীকে জমিয়াতুল মোদার্রেসীন ও দারুননাজাত মাদরাসা’র সম্বর্ধনা
বাংলাদেশ, নেপাল ও ভুটানের মধ্যে আঞ্চলিক সহযোগিতার আহ্বান