বাংলা নববর্ষ এবং মুসলিম হিজরী সনের যোগসূত্র
১১ এপ্রিল ২০২৫, ১২:০৮ এএম | আপডেট: ১১ এপ্রিল ২০২৫, ১২:০৮ এএম

বাংলা নববর্ষ মূলতঃ বাংলা ভাষাভাষীদের নিজস্ব ঐতিহ্য। ধর্ম বর্ণ নির্বিশেষে সব মানুষের জাতীয় উৎসবের নাম বাংলা নববর্ষ। ইতিহাস থেকে জানা যায় যে, বাঙ্গালীদের যে বঙ্গ-অঞ্চল সেই অঞ্চলের সরকারি খাজনা আদায়ের সুবিধার জন্যই মোঘল সম্রাট আকবর-এর সময় বাংলা সন বা বঙ্গাব্দ প্রবর্তন করা হয়। কোন না কোন ঘটনার প্রেক্ষিতেই প্রচলিত প্রত্যেকটি সন গণনার শুরু হয়। যেমন- যীশু খৃষ্টের জন্মদিন থেকে গণনা শুরু হয় খৃস্টাব্দ, মুসলমানদের নবী হযরত মুহাম্মদ (সাঃ) এর হিজরতের দিন থেকে গণনা শুরু হয় হিজরী সন, খৃস্টপূর্ব ৭৫ অব্দে ভারতে শক সাম্রাজ্য প্রতিষ্ঠালগ্ন থেকে গণনা শুরু হয় শকাব্দ ইত্যাদি। তবে বাংলা সনের গণনা মোঘল সম্রাট আকবরের দিল্লীর সিংহাসনে আরোহন করার দিন থেকে শুরু হলেও, নির্মোহ সত্য এই যে মুসলমানদের হিজরী সনই হলো বঙ্গাব্দের মূল ভিত্তি। যদিও অনেক মুসলমান অজ্ঞতার কারণে বাংলা নববর্ষকে বিজাতীয় সংস্কৃতি বলে নির্লিপ্ত থাকেন তবুও ইতিহাস সাক্ষী দেয় যে বাংলা নববর্ষ মুসলিম ঐতিহ্যের এক উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত। হিজরী সন বা মোহাম্মাদী সন থেকেই যে বঙ্গাব্দের প্রচলন তা-ই বহমান প্রবন্ধের মূল প্রতিপাদ্য। মহানবী হযরত মুহাম্মদ (সাঃ) এর তিরোধানের পর ইসলামের দ্বিতীয় খলীফা হযরত উমর (রাঃ)-এর সময়কালে হযরত আলী (রাঃ) এর প্রস্তাবে মহানবী (সাঃ) এর হিজরতের দিন থেকে হিজরী সন গণনা শুরু হয়। সেটা ছিল ৬২২ খ্রীস্টাব্দের ১৬ জুলাই। এখানে উল্লেখ্য যে ‘সন’ এবং ‘তারিখ’ দু’টিই আরবী শব্দ। ‘সন’ অর্থ বর্ষ বা বর্ষপঞ্জি এবং ‘‘তারিখ’’ অর্থ দিন বা দিবস। বাংলা সনের ইতিহাস বড়ই ঘটনাবহুল। ৬০০ হিজরীতে ইখতিয়ার উদ্দিন মুহাম্মদ বিন বখতিয়ার খিলজি বঙ্গ বিজয় করেন। তখন থেকেই এই বঙ্গ দেশে হিজরী সন গণনার প্রচলন হয়। প্রায় ৩৬৩ বছর এই আরবী সন গণনা চলে এই বাংলা বিহার উড়িষ্যায়। তৎকালীন সম্রাটদের নিয়মানুযায়ী বছরের শুরুতেই প্রজাদের নিকট থেকে খাজনা বা রাজস্ব আদায় করা হত। আর সেটা ছিল হিজরী সনের প্রথম মাস মহররম। আরবী সনের ভিত্তি হলো চন্দ্র উদয়, অর্থাৎ চন্দ্র উদয়ের সাথে সাথেই হিজরী সন বা চন্দ্রবর্ষের যাত্রা শুরু হয় এবং চন্দ্রবর্ষকে বারোটি চন্দ্রমাসে ভাগ করা হয়। এক্ষেত্রে একটা সমস্যা হলো যে চন্দ্রবর্ষ প্রতিবছরে ১১ দিন করে অগ্রগামী হয় । অর্থাৎ এগারো দিন আগেই বছর শুরু হয়। ফলে চন্দ্রবর্ষ হয় ৩৫৪ দিনে; যার ফলে আরবী বছর শুরু হলেও অর্থাৎ মহররম মাস শুরু হলেও তখন দেখা যেত ফসল কাটার সময় হতো না। যার কারণে কৃষি প্রধান এই বঙ্গ দেশের মানুষ খাজনা দিতে ব্যর্থ হতো। ফলে খাজনা আদায় এবং সরকারি হিসাব সংরক্ষণের ক্ষেত্রে গুরুতর সমস্যা দেখা দিত। এই সমস্যা সমাধানের জন্য ফসল কাটার সময়কে বিবেচনা করে একটি সৌরবর্ষ প্রবর্তন করা হয় মোঘল সম্রাট আকবরের সময়। এই বর্ষ শুরু হতো সূর্যোদয়ের সাথে সাথে, এবং এর নাম দেয়া হলো তখন ফসলী সন। এ কাজটি করা হলো মোঘল সাম্রাজ্যের একজন প্রভাবশালী সম্রাট আকবরের সময় যাকে ইতিহাসবেত্তাগণ আকবর দ্যা গ্রেট বলে অভিহিত করেন এবং তিনি ছিলেন একজন মুসলমান সম্রাট। সম্রাট আকবর ছিলেন একজন মুর্খ ব্যক্তি এবং তার নয় সদস্য বিশিষ্ট একটি উপদেষ্টা পরিষদ ছিল যাদেরকে ইতিহাসবেত্তাগণ নবরতœ বলে অভিহিত করেন। তাঁদের মধ্যে আমির ফতেহ উল্লাহ সিরাজি নামে একজন মুসলিম জ্যোতির্বিদ ছিলেন, তাঁর উপরই সন জনিত জটিলতা এড়ানো এবং ফসলী সন প্রবর্তনের দায়িত্ব দেন মুসলিম বীর চেঙ্গিসখান এবং তৈমুর লং এর বংশধর বাদশাহ বাবরের নাতি আর সম্রাট হুমায়ুনের ছেলে আকবর দ্যা গ্রেট। কাজ শুরু করেন আমীর ফতেহ্ উল্লাহ্ সিরাজী। সম্রাট আকবরের নির্দেশে ৯৯৮ হিজরী মোতাবেক ১৫৮৫ খৃস্টাব্দে ফসলী সনের প্রবর্তন করেন তিনি। যেহেতু বঙ্গ অঞ্চলের জন্যই এই ফসলী সনের প্রবর্তন, সেহেতু পরবর্তীতে এর নাম দেয়া হয় বঙ্গাব্দ বা বাংলা সন। আর এই বঙ্গাব্দের গণনা শুরু হয় সম্রাট আকবরের সিংহাসনে আরোহনের বছরকে বেজ বা ভিত্তি ধরে। সেটা ছিল ৯৬৩ হিজরী মোতাবেক ১৫৫৬ সালে (১৪ ফেব্রুয়ারি)। অর্থাৎ জন্ম গ্রহণের দিনই বাংলা সন বা বঙ্গাব্দের বয়স ছিল ৯৬৩ বছর। ১,২,৩ এমনিভাবে হিসাব শুরু হয়নি। হিজরী সন যে দিন থেকে গণনা শুরু হয়, সেই দিনই মূলতঃ বাংলা সনের জন্ম তারিখ। সেমতে গ্রেগরিয়ান সৌরবর্ষ বা খৃস্টীয় বর্ষ ও বাংলা সনের মধ্যে তৎকালীন সময়ে পার্থক্য দাঁড়ায় (১৫৫৬ - ৯৬৩) = ৫৯৩ বছর। সেই হিসাব মতে খৃস্টীয় সন বা ঈসায়ী সন হতে ৫৯৩ বছর পেছনে চলছে বাংলা সন। তাহলে ২০২৫ সালে বাংলা সনের বয়স হয় (২০২৫ - ৫৯৩) = ১৪৩২ বঙ্গাব্দ এবং তাই হলো বর্তমান অবস্থা। সে ক্ষেত্রে আরবী সন বা হিজরী সনও ১৪৩২ হওয়ার কথা ছিল।
কিন্তু পূর্বেই বলা হয়েছে যে চন্দ্রবর্ষ সৌরবর্ষ হতে প্রতিবছর ১১ দিন অগ্রগামী (যেহেতু চন্দ্রবর্ষ হয় ৩৫৪ দিনে আর সৌরবর্ষ হয় ৩৬৫ দিনে) সে কারণে ১৪৩২ বাংলা সনে অর্থাৎ (১৪৩২ - ৯৬৩ = ) ৪৬৯ বছর পরে এসে বাংলা সন এবং হিজরী সনের মধ্যে পার্থক্য দেখা দেয়ার কথা (৪৬৯*১১) দিন = ৫১৫৯ দিন বা (৫১৫৯স্ট৩৫৪) বছর = ১৪.৫৭ বছর বছর। অর্থাৎ হিজরী সন বাংলা সন হতে অগ্রগামী হওয়ার কথা ১৪.৫৭ বছর। সে ক্ষেত্রে বাংলা সন যখন ১৪৩২, তখন হিজরী সন হওয়ার কথা (১৪৩২ + ১৪.৫৭)= ১৪৪৬.৫৭ বছর। সত্যি সত্যি ১৪৩২ সনের যখন পহেলা বৈশাখ তখন হিজরী সন হলো ১৪৪৬ হিজরীর শাওয়াল মাসের ১৫ তারিখ। উপরোক্ত আলোচনার প্রেক্ষিতে এ কথা দিবালোকের মত পরিষ্কার হয়ে যায় যে - বাংলা সন বলতে যা বুঝায় তা মূলত হিজরী সন বা মুহাম্মাদী সন। সম্রাট আকবরের সময় রাষ্ট্রীয় প্রয়োজনে জনগণের সুবিধার্থে হিজরী চন্দ্রবর্ষকে সুকৌশলে সৌরবর্ষে রূপান্তর করা হয়েছে মাত্র। সুতরাং হিজরী সনের জন্য কারও মনে যদি এতটুকু অনুভূতি থাকে, বাংলা সনের জন্যও তার মনে সমান বা তার চেয়ে বেশী অনুভূতি থাকা বিশেষভাবে প্রয়োজন। আর বাংলা ভাষাভাষী মুসলমানদের জন্য বাংলা সন তো রীতিমতো গর্বের বিষয় যে বাংলা সনের নামে তারা যে সন পেয়েছে তা তাদের শুধু জাতীয় সনই নয় হিজরী সনেরই নামান্তর । এক দিকে বাংলা সন যেমন জাতীয় দিক থেকেও গুরুত্বপূর্ণ ঠিক ধর্মীয় দিক থেকেও তেমনই গুরুত্বপূর্ণ। অতএব, বাঙালী অমুসলিমেরা যদি বাংলা সনকে নিয়ে একবার হাসে, মুসলমানদের দশবার হাসা উচিত, অমুসলিমেরা যদি একবার একটা অনুষ্ঠান আয়োজন করে মুসলমানের তাহলে দশবার অনুষ্ঠানের আয়োজন করা উচিত। এক্ষেত্রে একটা কথা না বললেই নয় যে অমুসলিমেরা যদি মুসলমানদের বর্ষ নিয়ে বিশেষ কোন আয়োজন করে তাতে তো কোন ক্ষতি নেই। বরং তা অহংকারের বিষয় যে অমুসলিমরাও মুসলমানদের বিশেষ কোন তিথি-পর্বের প্রতি আকৃষ্ট হয়ে তা পালন করছে। তবে হ্যাঁ, এ কথা ঠিক যে মুসলিমদের আচার আচরণ, কৃষ্টি কালচার, উৎসব ইত্যাদি অমুসলিমদের থেকে আলাদা হবে। উভয় জাতি বা জাতিসমূহের প্রকাশভঙ্গিও ভিন্ন ভিন্ন হবে; তা তো হবারই কথা। এ ব্যপারে একটা প্রশ্ন উঠতে পারে যে, বর্তমান সময়ে যেভাবে বর্ষ বরণ করা হচ্ছে তা কি সুস্থ কোন ধারার মানুষের পদ্ধতি কি না? যদি বিবেক বলে যে না, তাহলে একথা স্বীকার করতে দ্বিধা থাকা উচিত নয় যে এখন যে বিকৃত সাংস্কৃতিক ধারা বিদ্যমান তার জন্যে মুসলিমরাও (সত্যিকার ধর্মীয় অনুভূতি সম্পন্ন মুসলিম) কম দায়ী নয়। কেননা তারা নিজের আনন্দ উৎসবকে নিজের বলে জানে না, জানলেও তা পালন করার জন্য সুস্থ কোন ধারার প্রবর্তন করতে পারেনি বা পারছে না। ফলে তাদের নিজস্ব সংস্কৃতি এখন বিকৃত এবং বিকৃতিটাই এখন আসল রূপ ধারণ করতে চলেছে। আর সেই সময়ে ভোঁতা মুসলিম সমাজ ঘরে বসে নাক সিঁটকাচ্ছে। উদাহরণটা ঠিক ঐ গেরোস্থের মত যিনি বুঝতে পারলেন যে তার ঘরে চোর ঢুকেছে অথচ উনি চুপটি মেরে বিছানায় শুয়ে ঘুমোবার ভান করছেন। পরে ফজরের সময় উঠে মসজিদে গিয়ে নামাজ পড়ে মুসল্লিবৃন্দকে (যারা এমনিতেই ধার্মিক এবং নামাজী তাদেরকে) উদ্দেশ্য করে বয়ান করে শুনাতে লাগলেন যে, রাতের বেলা তার ঘরে চোর ঢুকেছিল। কিন্তু তিনি কোন বাধা দেননি, কিংবা চোর যদি প্রকৃত অভাবী হয় তবুও তাকে একমুঠো খাবারও দেননি। বরং চোর যেহেতু চুরি করার মত হারাম কাজ করছে তাই তিনি বাধাও দেননি এবং নিজের সম্পদ রক্ষা করার ব্যপারেও কোন পদক্ষেপ নেননি। ফলে যা হবার তাই হবে। পরিশেষে যে কথা বলতে চাই তাহলো যে, বাংলা সন যেহেতু মুসলিম ঐতিহ্যের হিজরী সনের উপর ভিক্তি করে উদ্ভাবিত হয়েছে, সেহেতু প্রকৃত মুসলমানদেরকেই দায়িত্ব নিতে হবে নিজের সংস্কৃতিকে সুস্থ ধারায় টিকে রাখার জন্য। কেননা সংস্কৃতি হলো নদীর স্রোতের মত । এক দিকে স্থবির হয়ে গেলে কিংবা গতিপথে বাঁধ দিলে আরেক দিকে প্রবাহিত হবে।
বিভাগ : সাহিত্য
মন্তব্য করুন
আরও পড়ুন

পাবনায় চররে জমি দখল নিয়ে সংর্ঘষে গুলবিদ্ধি ৫

আইএমএফের ঋণের কিস্তি নিয়ে আশাবাদী বাংলাদেশ

মার্কিন উচ্চশিক্ষার চরম পতন

পরিশুদ্ধ-পরিবর্তিত বিএনপিকে রাষ্ট্রীয় ক্ষমতায় আনতে হবে-সাহাদাত হোসেন সেলিম

গাজায় ইহুদী হামলায় ৬০ ফিলিস্তিনি শহীদ

জাতিসংঘের দুটি আঞ্চলিক সংস্থায় নির্বাচিত হলো বাংলাদেশ

রাজনৈতিক দল গঠন এখন ছেলেখেলা!

সাভারে অজ্ঞাত নারীর অর্ধগলিত মরদেহ উদ্ধার

নর্থ সাউথে ভর্তি পরীক্ষা দিলেন উপদেষ্টা আসিফ

কোরআনবিরোধী নারী সংস্কার প্রস্তাবনা দেশের জন্য হুমকি স্বরূপ

পাকিস্তান-ভারতকে ‘সর্বোচ্চ সংযম’ দেখাতে বলল জাতিসংঘ

‘সর্বাত্মক যুদ্ধের’ হুঁশিয়ারি পাকিস্তানের

নারী কমিশনের প্রস্তাবের বিরুদ্ধে সবাইকে রুখে দাঁড়াতে হবে

তারেক রহমান ‘নিয়তির সন্তান’

অতিদারিদ্র্য বৃদ্ধির শঙ্কা

২৪ ঘন্টায় গ্রেফতার ১০৭২ আ’লীগ ও সহযোগী সংগঠনের ৫ নেতা গ্রেফতার

পারভেজ হত্যা মামলায় প্রধান আসামি মেহেরাজ রিমান্ডে

আ.লীগের ধর্ম বিষয়ক উপকমিটির সদস্য সন্তোষ কুমার রিমান্ডে

চট্টগ্রামে পেট্রোল বোমায় দগ্ধ মহিলার মৃত্যু

রাজধানীর প্রধান সড়কে ব্যাটারি রিকশা বন্ধের দাবি মোটরসাইকেল চালকদের