ঢাকা   শুক্রবার, ২২ নভেম্বর ২০২৪ | ৮ অগ্রহায়ণ ১৪৩১

পল ভ্যালেরি ও তার কাব্যসাহিত্য

Daily Inqilab রেশম লতা

২২ ডিসেম্বর ২০২৩, ১২:১৬ এএম | আপডেট: ২২ ডিসেম্বর ২০২৩, ১২:১৬ এএম

বিংশ শতাব্দীর অন্যতম প্রধান ফরাসি সাহিত্যিক পল ভ্যালেরি। তার পুরো নাম অ্যামব্রোইজ পল টুসাইন্ট জুলস ভ্যালেরি(৩০ অক্টোবর, ১৮৭১) সালে সেতে, ফ্রান্সে জন্মগ্রহণ করেন। তার মা একজন জেনোইজ ইস্ট্রিয়া বংশদ্ভূত এবং  বাবা কর্সিকান। মন্টপেলারে শৈশব অতিবাহিত করার পর ১৮৮৯ সালে তিনি আইন নিয়ে পড়াশোনা করার জন্য প্যারিসে বসবাস শুরু করেন। বিশ্ববিদ্যালয়ে থাকাকালীন তিনি সাহিত্য জগতের কিছু গুরুত্বপূর্ণ চরিত্রের সাথে পরিচিত হন। তারমধ্যে  পিয়েরে লুই, স্টিফেন মালার্মে এবং আন্দ্রে গিড ছিলেন। এই সময়ে তিনি একটি প্রতীকী ম্যাগাজিনের পাতায় তার কিছু কবিতা প্রকাশ করেছিলেন । মূলত এডগার অ্যালান পোয়ের এবং মালার্মের কবিতা তাকে বেশি প্রভাবিত করে কবিতা লেখার জন্য। তিনি আজন্ম একজন কবি। পল ভ্যালেরির মতে, কবিতা কখনো সম্পূর্ণ লেখা যায় না এটা অসমাপ্ত অবস্থায় পরিত্যাক্ত হয়। তাই তিনি বার বার কবিতার কাছে ফিরে এসেছিলেন। তার কাব্যচর্চার অন্যতম প্রধান অনুপ্রেরণা হচ্ছে প্রতীকবাদী আন্দোলন। তাঁর বিখ্যাত কবিতার বই ঔঁহব ঢ়ধৎয়ঁব (১৯১৭) এবং ঈযধৎসবং (১৯২২)। ভ্যালেরির ‘সম্মোহন’ বইয়ে বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য কবিতা সাগরতীরে সমাধিক্ষেত্র যা বিশ শতকের ফরাসি সাহিত্যের অন্যতম প্রধান কাজ বলে বিবেচিত হয়। এৎধাবুধৎফ নু ঃযব ংবধ (সাগরতীরে সমাধিক্ষেত্র) যেখানে তার হৃদয়ের যন্ত্রণার মন্থন পরিস্ফুট হয়েছে। শিল্পী চিত্তের আশা-হতাশা, ঘৃণা-ভালোবাসা আর অনন্য এক আত্মিক সৃজনীচেতনার স্ফূরণ ঘটেছে ‘আর তুমি, বিশাল আত্মা হেতোমার স্বপ্ন কি রক্ত-মাংসের শরীরে অস্তিত্বশীল তার বর্ণবিভাসহ? এখনও কি স্বপ্ন দেখো তুমি?বাষ্পীভূত তুমি এখনও কি গান করো? সবকিছু হারিয়ে যায়! আর আমার অবস্থা এখন সছিদ্রযেন হাওয়া ও তরলের চলাচল উপযোগী; নির্দোষ জীবনস্ফূর্তিও হয়েছে বিলীন!’বহুমুখী প্রতিভার অধিকারী পল ভ্যালেরি একাধারে  কবি, গাণিতিক এবং দার্শনিক। বৈজ্ঞানিক মানসিকতা ও যুক্তিবাদ তার লেখক চরিত্রের অন্যতম বিশেষত্ব।১৮৯৪ সালে তিনি প্যারিসের ওয়ার অফিসে সম্পাদক হিসেবে চাকরি পান। ১৮৯৫-১৮৯৬ এর মধ্যে, তিনি লিওনার্দো দা ভিঞ্চির পদ্ধতি এবং অ্যান ইভনিং উইথ সিগনেটর টেস্টে লিখেছেন। যেখানে তিনি তার দার্শনিক পদ্ধতিতে মনোনিবেশ করার চেষ্টা করেন এবং কার্টেশিয়ান দর্শনের প্রতি তার প্রবণতা প্রকাশ পায়।একথা অস্বীকার্য যে তার কাব্যজীবন আবার শুরু হয়েছিল আন্দ্রে গাইডের মধ্যস্থতার মাধ্যমে। সে তাকে গ্যালিমার্ড প্রকাশনা সংস্থার সাথে লে জিউন পার্ক সংকলন প্রকাশের অনুমতি দিয়েছিল। তারই ফলস্বরূপ ১৯২৫ সালে ফ্রান্স একাডেমিতে তার নির্বাচন এবং একজন ফরাসি বিজ্ঞানীর সর্বোচ্চ স্বীকৃতি লাভ করেন।    এমনকি ১৯৩৬ সালে বিশ্ব মেলা আয়োজনে সভাপতির ভূমিকায় আসন ছিলেন।  ফ্রান্সের কলেজে বিশেষ করে ভ্যালেরির নামে জন্য কাব্য বিভাগ তৈরি করা হয়েছিল। গড়হংরবঁৎ ঞবংঃব নামক গ্রন্থে ভ্যালেরির তীক্ষ্ম ইন্দ্রিয়ানুভূতি আর নৈর্ব্যক্তিক বিশ্বদর্শন ফুটে উঠেছে। তার কবিতাগুলো সাহিত্যরস সমৃদ্ধ আর জ্ঞানের আধার। তার ঞযব ঝুষঢ়য কবিতায় ডুব দিলে পাঠক মনে অদৃশ্য ছবির কল্পনা ভেসে উঠে। অস্তিত্ব-অনস্তিত্ব, বাস্তব-অবাস্তবের এক প্রগাঢ় ইন্দ্রিয়ানুভূতি কাজ করে‘আমাকে দেখাও যায়নি চেনাও যায়নি আমি এক আকর্ষণের নাম অস্তিত্বশীল ও অস্তিত্বহীন, বাতাসের সঙ্গে চলে আসি!জানা যায়নি আমাকে দেখাও যায়নি, প্রতিভাময়ী না হঠাৎ হয়ে ওঠা? আমার তো কাজ শেষ চলে আসি কদাচিৎআমার বিষয়ে পড়েনি কেউ, বোঝেওনি!বড় মানুষের নিয়তি, বড় ভ্রান্তিতে ভোগা! দেখা যায় আমার সম্বন্ধে জানাও যায়নি কিছু শেমিজের নিচে স্তন খোলা থাকার সময়টা চমৎকার!’রিল্কে এবং এলিয়টের পাশাপাশি তিনি ঊনবিংশ শতাব্দীর ঐতিহ্য এবং বিংশ শতাব্দীর অভিনবত্বের মধ্যে সেতু হিসেবে দাঁড়িয়েছেন। ফরাসি ভাষার সবচেয়ে সুন্দর এবং বিংশ শতাব্দীর সবচেয়ে প্রভাবশালী গদ্য কবিতা ‘দ্য এঞ্জেল’ এটা তার নোটবুকে সংরক্ষিত ছিল। নোটবুকগুলির গদ্য এবং পদ্য ভ্যালেরিকে একজন চিন্তাবিদ লেখক হিসাবে কনফিগার করে নতুন শতাব্দীতে যা ফিউচারিজম এবং দাদার সাথে গতি বাড়িয়ে দেয়। ভ্যালেরির কবিসত্ত্বা নিওক্লাসিক্যাল পরিপূর্ণতার কাছাকাছি সেইসাথে তিনি বুঝতে পেরেছিলেন যে কীভাবে অধরা পরিপূর্ণতা সর্বদা থাকবে। মার্ক স্ক্রগিন্স পল ভ্যালেরি সম্বন্ধে যথার্থই বলেছেন, ‘ভ্যালেরির সেরা লেখার সৌন্দর্য এবং শক্তি অনস্বীকার্য, এবং মানুষের দ্বিধাগুলি তার কাজের ঠিকানা- মৃত্যু, মূর্ততা, পরিপূর্ণতার আকাঙ্খা-আমাদের মধ্যে থেকে যায়।তাঁর কবিতা দার্শনিক ইন্দ্রিয়জ সজ্ঞা ও প্রজ্ঞায় আসক্ত। জীবনাসক্তি ও মৃত্যু, প্রাকৃতিক জীবন, পরাবাস্তবতা, অধিবাস্তবতা পরিলক্ষিত। তিনি ধৈর্যশীল, চিন্তাশীল এবং প্রায়ই কল্পনাপ্রবণ। শিল্পকলা নিয়েও তার গভীরতাসন্ধের সৃজনী অব্যাহত ছিল। ১৯০০ সালে তিনি জিনিন জোবিলার্ডকে বিয়ে করেন এবং তাদের তিনটি সন্তান হয়। ২০ জুলাই ১৯৪৫ সালে ৭৩ বছর বয়সে মারা যান। তাকে তার নিজ শহরে একটি সমুদ্রের পাশে কবরস্থানে সমাহিত করা হয় যেখানে চিরঘুমে শায়িত ফরাসিয়ান বিখ্যাত কবিতার এই মহানায়ক। নিচে তার দুটি কবিতার অনুবাদ
কৌশলী ইঙ্গিতওহ বাঁক যা সর্পিল গোপন মিথ্যার মতো।শ্লথতা নয় তা কি কোমলতম শিল্প ?আমি জানি কোথায় যাচ্ছি, তোমাকে সেখানে নিয়ে যাবো,আমার কালো অভিসন্ধিগুলো তোমার ক্ষতি করবে না, যদিও মেয়েটি হাসে ঝলমলে গর্বে,অতো স্বাধীনতা মাথা খারাপ করে দ্যায় ! ওহ বাঁক যা সর্পিল গোপন মিথ্যার মতো,আমি তোমায় অপেক্ষা করাবো কোমলতম শব্দের খাতিরে।
হারিয়ে যাওয়া মদএকদিন আমি সমুদ্রে ছুঁড়ে ফেলে দিলুমমনে নেই কেমন আকাশের তলায় শূন্যতায় উৎসর্গ করার মতন,দামি মদের যতোটা বাকি ছিল তার পুরোটাকে তোমার ক্ষতির নির্দেশ দিয়েছিল, হে সুরাসার ?স্বর্গ কি আমার হাতকে প্ররোচিত করেছিল ?হয়তো আমার হৃদয়ের আচ্ছন্নতা,রক্তের স্বপ্ন দেখে, মদ ফেলেছিল ?কিছুক্ষণের জন্য গোলাপি উদ্গীরণ হয়েছিলধোঁয়ার, আর তারপর সমুদ্র হয়ে উঠলস্বচ্ছ, যেমন আগে থেকে ছিলমদ হারিয়ে গেল -- ঢেউগুলো মাতাল !আমি দেখতে পেলাম অস্বাভাবিক আকৃতিরাতিক্ত বাতাসে লাফিয়ে উঠছে--


বিভাগ : সাহিত্য


মন্তব্য করুন

HTML Comment Box is loading comments...

এই বিভাগের আরও

আখতারুজ্জামান ইলিয়াসের গল্প
গণ-অভ্যুত্থান ২০২৪ : সাহিত্য সংস্কৃতি ভাবনা
প্রার্থনার মূল কাজ সংযোগ স্থাপন
গ্রাফিতি বাংলাদেশ
তোমাকে
আরও

আরও পড়ুন

মাইলফলকের টেস্ট স্মরণীয় করে রাখতে চান মিরাজ

মাইলফলকের টেস্ট স্মরণীয় করে রাখতে চান মিরাজ

আজারবাইজানে কপ-২৯ সম্মেলনে ঠাকুরগাঁওয়ের ইএসডিওর সাইড ইভেন্ট অনুষ্ঠিত

আজারবাইজানে কপ-২৯ সম্মেলনে ঠাকুরগাঁওয়ের ইএসডিওর সাইড ইভেন্ট অনুষ্ঠিত

বেতন পেয়ে অবরোধ প্রত্যাহার করল বেক্সিমকোর শ্রমিকেরা

বেতন পেয়ে অবরোধ প্রত্যাহার করল বেক্সিমকোর শ্রমিকেরা

লেবাননে ইসরায়েলি বিমান হামলায় নিহত ৪৭

লেবাননে ইসরায়েলি বিমান হামলায় নিহত ৪৭

ট্রাম্প প্রশাসনের জন্য মনোনীত দুই সদস্যের বিরুদ্ধে যৌন কেলেঙ্কারির অভিযোগ

ট্রাম্প প্রশাসনের জন্য মনোনীত দুই সদস্যের বিরুদ্ধে যৌন কেলেঙ্কারির অভিযোগ

ট্রাম্প ব্যবসায়ী, আমরাও একজন ব্যবসায়ী পার্টনার চাই : টাইম ম্যাগাজিনকে ড. ইউনূস

ট্রাম্প ব্যবসায়ী, আমরাও একজন ব্যবসায়ী পার্টনার চাই : টাইম ম্যাগাজিনকে ড. ইউনূস

আদানির দুর্নীতি : এবার ভারতেই বির্তকের মুখে মোদি সরকার

আদানির দুর্নীতি : এবার ভারতেই বির্তকের মুখে মোদি সরকার

প্রেসিডেন্টর সঙ্গে তিন বাহিনী প্রধানের সৌজন্য সাক্ষাৎ

প্রেসিডেন্টর সঙ্গে তিন বাহিনী প্রধানের সৌজন্য সাক্ষাৎ

নিজ্জর হত্যায় মোদীর সংশ্লিষ্টতার দাবি কানাডার সংবাদমাধ্যমের ,‘হাস্যকর’ দাবি ভারতের

নিজ্জর হত্যায় মোদীর সংশ্লিষ্টতার দাবি কানাডার সংবাদমাধ্যমের ,‘হাস্যকর’ দাবি ভারতের

পাকিস্তানে যাত্রীবাহী গাড়িতে গুলি, নিহত ৪২

পাকিস্তানে যাত্রীবাহী গাড়িতে গুলি, নিহত ৪২

এক সপ্তাহে রিজার্ভ বাড়ল ৬ কোটি ১০ লাখ ডলার

এক সপ্তাহে রিজার্ভ বাড়ল ৬ কোটি ১০ লাখ ডলার

ইউক্রেন যুদ্ধ বৈশ্বিক সংঘাতে পরিণত হচ্ছে : পুতিন

ইউক্রেন যুদ্ধ বৈশ্বিক সংঘাতে পরিণত হচ্ছে : পুতিন

মুরগি-সবজিতে কিছুটা স্বস্তি, আলু এখনো চড়া

মুরগি-সবজিতে কিছুটা স্বস্তি, আলু এখনো চড়া

নেতানিয়াহুর বিরুদ্ধে গ্রেফতারি পরোয়ানা, যা বলল যুক্তরাষ্ট্র

নেতানিয়াহুর বিরুদ্ধে গ্রেফতারি পরোয়ানা, যা বলল যুক্তরাষ্ট্র

মার্কিন শ্রম প্রতিনিধি দল ঢাকা আসছে আজ

মার্কিন শ্রম প্রতিনিধি দল ঢাকা আসছে আজ

পার্থে শুরুতেই চাপে ভারত

পার্থে শুরুতেই চাপে ভারত

বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের ১৮ সদস্যবিশিষ্ট কেন্দ্রীয় কমিটি ঘোষণা

বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের ১৮ সদস্যবিশিষ্ট কেন্দ্রীয় কমিটি ঘোষণা

সেনাকুঞ্জে খালেদা জিয়ার সঙ্গে জামায়াত আমীরের কুশল বিনিময়

সেনাকুঞ্জে খালেদা জিয়ার সঙ্গে জামায়াত আমীরের কুশল বিনিময়

সিঙ্গেল সিটের দাবিতে গভীর রাতেও হলের বাইরে ছাত্রীরা

সিঙ্গেল সিটের দাবিতে গভীর রাতেও হলের বাইরে ছাত্রীরা

ইসরাইলি হামলায় গাজায় নিহতের সংখ্যা ৪৪ হাজার অতিক্রম করলো

ইসরাইলি হামলায় গাজায় নিহতের সংখ্যা ৪৪ হাজার অতিক্রম করলো