ঢাকা   শুক্রবার, ২২ নভেম্বর ২০২৪ | ৮ অগ্রহায়ণ ১৪৩১
সান্দ্র পাঠে সৈয়দ মুজতবা আলীর

পণ্ডিতমশাই

Daily Inqilab হোসইন  আজিজ

২৯ ডিসেম্বর ২০২৩, ১২:১০ এএম | আপডেট: ২৯ ডিসেম্বর ২০২৩, ১২:১০ এএম

  ষোল বছর বয়সী এক কিশোর বিদ্যার্জনের তুমুল ইচ্ছা নিয়ে গমন করলেন রবীন্দ্রনাথের শান্তিনিকেতনে। আলাপকালে সুরসিক রবীন্দ্রনাথ কিশোরটিকে রস করে বললেন ‘তোমার মুখ থেকে তো কমলালেবুর গন্ধ আসছে’। হ্যাঁ, কমলালেবুর অঞ্চল সিলেটের সেই কিশোরটির নাম সৈয়দ মুজতবা আলী।সৈয়দ মুজতবা আলী আজীবন কমলালেবুর সুগন্ধ আর সুমিষ্ট রস বিলিয়ে গেছেন তাঁর প্রতিটি লেখায়। যদিও তিনি বহুভাষাবিদ, গল্পকার, ঔপন্যাসিক ও অনুবাদক তবে তাঁকে বলা হয়ে থাকে ‘রম্যরচয়িতা’। রম্য করে তিনি লিখে গেছেন মানুষের জীবনের সুখ-দুঃখ, হাসি-কান্না, আনন্দ-বেদনার মর্মকথা। বোহেমিয়ান জীবনযাপনে অভ্যস্ত সৈয়দ মুজতবা আলী জানতেন বহু ভাষা, ঘুরেছেন বহু দেশ, দেখেছেন বিভিন্ন দেশের মানুষের চালচলন, আচার-আচরণ এবং তার বেশিভাগ সরস উপস্থাপনে ফুটিয়ে তুলেছেন তাঁর লেখনীর জাদুময় ভাষায়।স্কুলজীবনে পাঠ্যবইয়ে সৈয়দ মুজতবা আলীর দু’টি গল্প পাঠের সৌভাগ্য হয়েছিল আমার। গল্প দু’টি হলো, ‘প-িত মশাই’ ও ‘রসগোল্লা’ লেখা দু’টি আমার কিশোর মনকে যারপরনাই আলোড়িত করেছিল। আমার পনের বছর বয়সে তাঁর ‘দেশে বিদেশে’ ও ‘চাচা কাহিনী’ বই দু’টিও পড়া হয়ে গিয়েছিল।সৈয়দ মুজতবা আলী রসাত্মক করে যেমন লিখতে পারতেন কোনো আনন্দের গল্প, ঠিক তেমন রসাত্মক করে লিখতে পারতেন কোনো যন্ত্রণার গল্প। এখানেই তাঁর স্বকীয়তার পরিচয় পাওয়া যায়। যেমন লিখেছেন তাঁর ‘প-িত মশাই’ গল্পে সুবিধাবঞ্চিত এক স্কুল শিক্ষকের কথা।সংস্কৃত ভাষায় প-িত বলতে বিশেষ জ্ঞানের অধিকারী  জ্ঞানী, শিক্ষিত বা বিদ্বান ব্যক্তি”কে বোঝায়। কিন্তু তখনকারদিনে বাংলার শিক্ষককেই প-িত বলা হতো। শিক্ষকদের মধ্যে ‘প-িতরাই ছিলেন সর্বাধিক অবহেলিত। ‘প-িত মশাই’ গল্পে এর প্রমাণ পাওয়া যায়। সৈয়দ মুজতবা আলীর ভাষায় লাট সাহেব ততক্ষন হেডমাস্টারের সাথে প-িত শব্দের মূল নিয়ে ইংরেজীতে আলোচনা জুড়ে দিয়েছেন। হেডমাস্টার কি বলেছিলেন জানিনে তবে রবীন্দ্রনাথ নাকি প-িতদের বিদ্রুপ করে বলেছেন যার সবকিছু প- হয়ে গিয়েছে সেই নাকি প-িত।‘প-িত মশাই’ গল্পে আমরা তৎকালীন হিন্দু সমাজের ধর্মীয় গোঁড়ামির একটা প্রকট চিত্র দেখতে পাই। মুজতবা আলীর ভাষায় ‘”শাস্ত্রে সেলাই করা কাপড় পরা বারন বলে প-িতমশাই পাঞ্জাবি শার্ট পরেন না, কিন্তু লাটসাহেব আসছেন খালি গায়ে ইস্কুলে আসা চলবে না তাই গেঞ্জি পরে এসেছেন। গেঞ্জি বোনা জিনিষ, সেলাই করা কাপড়ের পাপ থেকে প-িত মশাই এই কৌশলে নিষ্কৃতি পেয়েছেন’।আমাদের অনাদৃত প-িত শ্রেণি উর্ধতন কারো কাছ থেকে সামান্য সম্মান বা একটি ধন্যবাদ পেলে কিপরিমান খুশি হতেন, তার প্রমাণ পাওয়া যায় ‘প-িত মশাই’ গল্পের নি¤েœাক্ত বর্ণনায়। মুজতবা আলী লিখেছেন ‘হ্যালো পানডিট’ বলে সাহেব হাত মিলালেন। রাজসম্মান পেয়ে প-িতমশাইয়ের সব যন্ত্রণা লাঘব হলো। বারবার ঝুকে সাহেবকে সেলাম করলেন এই অনাদৃত প-িত শ্রেণী সামান্যতম গতানুগতিক সম্মান পেয়েও যে কি রকম বিগলিত হতেন তা তাদের সে সময়কার চেহারা না দেখলে বিশ্বাস করার উপায় নেই”। এই গল্পের অন্যত্র মুজতবা আলী লিখেছেন লাট সাহেব চলে গেলেন। যাবার পূর্বে পন্ডিত মশাইয়ের দিকে একখানা মোলায়েম নড করাতে তিনি গর্বে চৌচির হয়ে ফেটে যাবার উপক্রম। আনন্দের আতিশয্যে নতুন গেঞ্জির চুলকানির কথা পর্যন্ত ভুলে গিয়েছেন। মুজতবা আলী ছিলেন একজন জাত লেখক। তাঁর যাদুকরী প্রকাশভঙ্গী, রসাত্মক বর্ণনা পাঠককে আটকে রাখে মন্ত্রমুগ্ধের মতো। বিষয় উপস্থাপনের প্রয়োজনে চারপাশ থেকে খড়কুটো কুড়িয়ে এনেও জুড়ে দিতেন রচনায়, যা হয়ে উঠতো প্রাসঙ্গিক এবং মনকাড়া। নিরস করুণ বিষয়কে যাদুকরী ভাষায় করে তুলতেন মর্মগ্রাহী এবং মর্মন্তুদ। প-িত মশাই জীবনে সেলাই করা কাপড় পরেননি। লাট সাহেবের আগমন উপলক্ষে সেলাইবিহীন গেঞ্জি পরে প-িত মশাইয়ের যে অবস্থার মোকাবিলা করেছিলেন, সৈয়দ মুজতবা আলী তার সরস বর্ণনা দিয়েছেন ‘আধ মিনিট যেতে না যেতেই দেখি প-িত মশাই মুখ বিকৃত করে  গেঞ্জির ভিতর হাত চালান করে পাগলের মত এখানে ওখানে খ্যাঁস খ্যাঁস করে খামচান। একে তো জীবনভর উত্তমাঙ্গে কিছু পরেননি, তার উপর গেঞ্জি, সেও আবার নতুন কোরা গেঞ্জি’।‘প-িত মশাই’  গল্পের কঠিন কথাটি মুজতবা আলী তাঁর সুকৌশলী বর্ণনায় গল্পের শেষাংশে এসে বলেছেন। যা পাঠে পাঠকমাত্রই এক বেদনাময় মুগ্ধতায় আচ্ছন্ন হবেন। স্কুল পরিদর্শনে আসা লাট সাহেবের সফরসঙ্গীদের মধ্যে একটি তিন পা ওয়ালা কুকুরও ছিল। প-িত মশাই জানতে পেরেছেন কুকুরটির পেছনে লাট সাহেবের মাসিক খরচ পঁচাত্তর টাকা। প-িত মশাইয়ের মাসিক বেতন সাকুল্যে পঁচিশ টাকা। কুকুরটির সাথে মনেমনে নিজের তুলনা করে প-িত মশাই নিজেকে তুচ্ছাতিতুচ্ছ ভেবে মর্মাহত হয়েছেন। তিনদিনের ছুটির পর ক্লাসে এসে তাঁর সেই মনোকষ্টের প্রকাশ করেছেন সুকৌশলে ছাত্রদের সাথে কথোপকথনের মাধ্যমে। সেসময়কার অবহেলিত প-িতসমাজের আর্থিক অবস্থার চিত্র ফুটে উঠেছে ‘প-িত মশাই’ গল্পের নিচোক্ত অংশটুকুতে।তারপর প-িতমশাই ফের অনেকক্ষণ চুপ থাকার পর আপন মনে আস্তে আস্তে বললেন, আমি, ব্রাহ্মণী, বৃদ্ধা মাতা, তিন কণ্যা, বিধবা পিসি, দাসী মোট আটজনা। তারপর হঠাৎ কথা ঘুরিয়ে ফেলে আমাকে জিজ্ঞেস করলেন, ‘মদনমোহন কি রকম আঁক শেখায় রে’? মদনমোহন বাবু আমাদের অংকের মাস্টার-প-িত মশাইয়ের ছাত্র। বললুম ভালোই পড়ান।প-িত মশাই বললেন বেশ বেশ। তবে শোন – লাট সাহেব তার কুকুরের পিছনে মাসে খরচ করেন পচাত্তর টাকা। এইবার দেখি তুই কি রকম অংক শিখেছিস। বল তো দেখি যদি একটা কুকুরের পিছনে মাসে পচাত্তর টাকা খরচ হয়, আর সেই কুকুরের তিনটি ঠ্যাং হয় তবে প্রতি ঠ্যাং এর জন্য কত খরচ হয়?আমি ভয় করেছিলুম প-িতমশাই খুব মারাত্মক রকমের অংক কষতে দিবেন। আরাম বোধ করে তাড়াতাড়ি বললুম, আজ্ঞে পঁচিশ টাকা। প-িত মশাই বললেন সাধু সাধু।তারপর বললেন আমি, ব্রাহ্মণী, বৃদ্ধা মাতা, তিন কণ্যা, বিধবা পিসি, দাসী মোট আটজনা, আমাদের সকলের জীবনধারণের জন্য আমি মাসে পাই পঁচিশ টাকা। এখন বল তো দেখি এই ব্রাহ্মণ পরিবার লাট সাহেবের কুকুরের কটা ঠ্যাঙের সমান? আমি হতবাক।‘বল না’।আমি মাথা নিচু করে বসে রইলাম। শুধু আমি না, সমস্ত ক্লাস নিস্তব্ধ।প-িতমশাই হুংকার দিয়ে বললেন ‘উত্তর দে’।মুর্খের মত একবার প-িতমশাইয়ের মুখের দিকে মিটমিটিয়ে তাকিয়েছিলুম। দেখি সে মুখে লজ্জা, তিক্ততা, ঘৃণায় বিকৃত হয়ে গিয়েছে।ক্লাসের সবাই বুঝতে পেরেছে, প-িতমশাই আত্ম অবমাননার কি নির্মম পরিহাস সর্বাঙ্গে মাখছেন আমাদের সাক্ষী রেখে।‘প-িত মশাই’ গল্পে আমরা তৎকালের প-িত সমাজের আর্থিক দৈন্যতার একটি খন্ড চিত্র দেখতে পাই। সৈয়দ মুজতবা আলীর রসাত্মক ভাষা মাধুর্য একটি করুণ বিষয়কে ব্যাঙ্গরসাত্মক করে আমাদের মর্মমূলকে নাড়িয়ে দিয়ে যায়। যার রেশ পাঠক হৃদয়ে আমৃত্যু থেকে যেতে বাধ্য, যদি সে পাঠক সহৃদয় বোদ্ধা পাঠক হন।


বিভাগ : সাহিত্য


মন্তব্য করুন

HTML Comment Box is loading comments...

এই বিভাগের আরও

আখতারুজ্জামান ইলিয়াসের গল্প
গণ-অভ্যুত্থান ২০২৪ : সাহিত্য সংস্কৃতি ভাবনা
প্রার্থনার মূল কাজ সংযোগ স্থাপন
গ্রাফিতি বাংলাদেশ
তোমাকে
আরও

আরও পড়ুন

২৪ নভেম্বরের ‘পিটিআই’র বিক্ষোভ নিয়ে বুশরা বিবির বার্তা ও সরকারের প্রতিক্রিয়া

২৪ নভেম্বরের ‘পিটিআই’র বিক্ষোভ নিয়ে বুশরা বিবির বার্তা ও সরকারের প্রতিক্রিয়া

লাঞ্চের আগেই ৪ উইকেট নেই ভারতের

লাঞ্চের আগেই ৪ উইকেট নেই ভারতের

মাইলফলকের টেস্ট স্মরণীয় করে রাখতে চান মিরাজ

মাইলফলকের টেস্ট স্মরণীয় করে রাখতে চান মিরাজ

আজারবাইজানে কপ-২৯ সম্মেলনে ঠাকুরগাঁওয়ের ইএসডিওর সাইড ইভেন্ট অনুষ্ঠিত

আজারবাইজানে কপ-২৯ সম্মেলনে ঠাকুরগাঁওয়ের ইএসডিওর সাইড ইভেন্ট অনুষ্ঠিত

বেতন পেয়ে অবরোধ প্রত্যাহার করল বেক্সিমকোর শ্রমিকেরা

বেতন পেয়ে অবরোধ প্রত্যাহার করল বেক্সিমকোর শ্রমিকেরা

লেবাননে ইসরায়েলি বিমান হামলায় নিহত ৪৭

লেবাননে ইসরায়েলি বিমান হামলায় নিহত ৪৭

ট্রাম্প প্রশাসনের জন্য মনোনীত দুই সদস্যের বিরুদ্ধে যৌন কেলেঙ্কারির অভিযোগ

ট্রাম্প প্রশাসনের জন্য মনোনীত দুই সদস্যের বিরুদ্ধে যৌন কেলেঙ্কারির অভিযোগ

ট্রাম্প ব্যবসায়ী, আমরাও একজন ব্যবসায়ী পার্টনার চাই : টাইম ম্যাগাজিনকে ড. ইউনূস

ট্রাম্প ব্যবসায়ী, আমরাও একজন ব্যবসায়ী পার্টনার চাই : টাইম ম্যাগাজিনকে ড. ইউনূস

আদানির দুর্নীতি : এবার ভারতেই বির্তকের মুখে মোদি সরকার

আদানির দুর্নীতি : এবার ভারতেই বির্তকের মুখে মোদি সরকার

প্রেসিডেন্টর সঙ্গে তিন বাহিনী প্রধানের সৌজন্য সাক্ষাৎ

প্রেসিডেন্টর সঙ্গে তিন বাহিনী প্রধানের সৌজন্য সাক্ষাৎ

নিজ্জর হত্যায় মোদীর সংশ্লিষ্টতার দাবি কানাডার সংবাদমাধ্যমের ,‘হাস্যকর’ দাবি ভারতের

নিজ্জর হত্যায় মোদীর সংশ্লিষ্টতার দাবি কানাডার সংবাদমাধ্যমের ,‘হাস্যকর’ দাবি ভারতের

পাকিস্তানে যাত্রীবাহী গাড়িতে গুলি, নিহত ৪২

পাকিস্তানে যাত্রীবাহী গাড়িতে গুলি, নিহত ৪২

এক সপ্তাহে রিজার্ভ বাড়ল ৬ কোটি ১০ লাখ ডলার

এক সপ্তাহে রিজার্ভ বাড়ল ৬ কোটি ১০ লাখ ডলার

ইউক্রেন যুদ্ধ বৈশ্বিক সংঘাতে পরিণত হচ্ছে : পুতিন

ইউক্রেন যুদ্ধ বৈশ্বিক সংঘাতে পরিণত হচ্ছে : পুতিন

মুরগি-সবজিতে কিছুটা স্বস্তি, আলু এখনো চড়া

মুরগি-সবজিতে কিছুটা স্বস্তি, আলু এখনো চড়া

নেতানিয়াহুর বিরুদ্ধে গ্রেফতারি পরোয়ানা, যা বলল যুক্তরাষ্ট্র

নেতানিয়াহুর বিরুদ্ধে গ্রেফতারি পরোয়ানা, যা বলল যুক্তরাষ্ট্র

মার্কিন শ্রম প্রতিনিধি দল ঢাকা আসছে আজ

মার্কিন শ্রম প্রতিনিধি দল ঢাকা আসছে আজ

পার্থে শুরুতেই চাপে ভারত

পার্থে শুরুতেই চাপে ভারত

বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের ১৮ সদস্যবিশিষ্ট কেন্দ্রীয় কমিটি ঘোষণা

বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের ১৮ সদস্যবিশিষ্ট কেন্দ্রীয় কমিটি ঘোষণা

সেনাকুঞ্জে খালেদা জিয়ার সঙ্গে জামায়াত আমীরের কুশল বিনিময়

সেনাকুঞ্জে খালেদা জিয়ার সঙ্গে জামায়াত আমীরের কুশল বিনিময়