বাংলা কাব্যে বৈশাখ
১৯ এপ্রিল ২০২৪, ১২:১০ এএম | আপডেট: ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ১২:১০ এএম
সুপ্রাচীনকাল থেকে দেশে দেশে নববর্ষ উদযাপনের যে ঐতিহ্য গড়ে উঠেছে তার সঙ্গে সঙ্গতি রেখেই বাংলা নববর্ষ উদযাপন করা এখন জাতীয় চেতনার লক্ষ্মণ বলে বিবেচিত হচ্ছে। কৃষকের বীজ বপন,চারা রোপন, ফসল কাটা এমন কি খাজনা আদায়ের সুবিধার জন্য ১৫৫৬ খ্রিষ্টাব্দের ১০ই মার্চ, ৯৯২ হিজরিতে বাংলা সন গণনা শুরু হয়। তবে এই গণনা পদ্ধতি কার্যকর করা হয় সম্রাট আকবরের সিংহাসন আরোহণের সময় (৫ই নভেম্বর, ১৫৫৬) থেকে। প্রথমে এই সনের নাম ছিল ফসলি সন, পরে বঙ্গাব্দ” বা বাংলা বর্ষ নামে পরিচিত হয়।বাংলা বছরের প্রথম মাস হিসাবে বৈশাখকে ধরা হয়,তাই পহেলা বৈশাখ নিয়ে বাংলার গ্রামে গঞ্জে নানা উৎসব পালন করা হয়। গ্রামাঞ্চলে বসে বৈশাখীমেলা, আর মেলাকে কেন্দ্র করে আয়োজন করা হয় কত রং ঢংয়ের অনুষ্ঠান। বৈশাখী উৎসব এখন জাতি ধর্ম নির্বিশেষে বাঙালির জাতীয় উৎসবে পরিণত হয়েছে। বাঙালি কবি সাহিত্যিকরা ও বাদ যাবেন কেন। চৈত্রের কাঠ-ফাঁটা খরার পর বৃষ্টিস্নাত বৈশাখ যেমন কৃষকের মাঠে আশির্বাদ হয়ে আসে, তেমনি কালবৈশাখী ঝড় আসে অনেকের জীবনে দুঃখ- দুর্দশা হয়ে।কবিরা তাঁদের কাব্যে বৈশাখকে নিয়ে সুখ-দুঃখ, ব্যথা-বেদনা অনুভূতি দিয়ে উপলব্ধি করে লিখেছেন কত গান, কবিতা। বাংলা সাহিত্যে বৈশাখের কবিতা কোনো বাঙালি কবি লেখেন না তা পাওয়া বিরল। এ পরিসরে সবগুলো উত্থাপন করা সম্ভব না হলেও কিছুটা তুলে ধরার চেষ্টা করছি।
পহেলা বৈশাখ যখন ঘটা করে পালন করা শুরু হয়নি তারও আগে বৈশাখ নিয়ে এ অঞ্চলের মানুষের মধ্যে শিহরণ লক্ষ্য করা যায়। প্রাচীন যুগে কৃষক বা গৃহস্থ ঘরের মঙ্গল অমঙ্গল নিয়ে খনা (আসল নাম লীলাবতী) বছরের বিভিন্ন সময় ও প্রকৃতির অবস্থা লক্ষ্য করে কি হতে পারে তা নিয়ে যে কাব্য রচনা করেছিলেন তাই বাঙালি সমাজে খনার বচন নামে বহুল পরিচিত। (আনু. অষ্টম-দ্বাদশ শতাব্দী সময়কাল এর মধ্যে খনার জন্মকাল হিসেবে ধরে নেয়া হয়।)শুদ্ধ জীবন যাপন রীতি নিয়ে রচিত হয় খনার ছড়া।এখানে বৈশাখকে নিয়ে খনার কয়েকটি কাব্যাংশ উপস্থাপন করা হয়েছে।
১. বৈশাখের প্রথম জলে,আশুধান দ্বিগুণ ফলে।
২. চৈত্র বৈশাখে লাগাইয়া ঝাল,সুখে কাটে বর্ষাকাল।
৩. মাঘের মাটি হীরের কাঠি ফাল্গুনের মাটি সোনা, চৈতের মাটি যেমন তেমন বৈশাখের মাটি নোনা।
৪. চৈতের ধূলি,বৈশাখের পেঁকি ধান হয় ঢেঁকি ঢেঁকি।
৫. চৈত্রে দিয়া মাটি,বৈশাখে কর পরিপাটি।
মধ্যযুগের কবি মুকুন্দরাম চক্রবর্তী (১৫৪০-১৬০০ খ্রিস্টাব্দ) তাঁর ‘চন্ডিমঙ্গল’ কাব্যে কালকেতু ও ফুল্লরার দাম্পত্য জীবনের সুখ-দুঃখকে কবি বৈশাখের দাবদাহ আর প্রাকৃতিক বিক্ষুব্ধতার সাথে তুলনা করেছেন।এহেন রুক্ষ প্রকৃতির মাঝে বাড়ি বাড়ি মাংস বিক্রেতা ফুল্লরার জীবনে কী বিরূপ প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি হয়েছিল,কাব্যে তা তুলে ধরা হয়েছে :
‘বৈশাখে অনলসম বসন্তের খরা।/
তরুতল নাহি মোর করিকে পসরা/
পায় পোড়ে খরতর রবির কিরণ।/শিরে দিতে নাহি আঁটে খুঞ্চার বসন/
নিযুক্ত করিল বিধি সবার কাপড়।/
অভাগী ফুল্লরা পরে হরিণের দুড়/পদ পোড়ে খরতর রবির কিরণ।/ শিরে দিতে নাহি আঁটে অঙ্গের বসন/
বৈশাখ হৈল আগো মোর বড় বিষ।/
মাংস নাহি খায় সর্ব্ব লোকে নিরামিষ’
মাইকেল মধুসূদন দত্ত (১৮২৪-১৮৭৩ খ্রি.) প্রকৃতির ঋতু চক্রের সাথে জীবনের সাদৃশ্য খুঁজেছেন এভাবে—
‘ভূতরূপে সিন্ধুজনে গড়ায়ে পড়িল
বৎসর কালের ঢেউ, ঢেউর গমনে
নিত্যগামী রথ চক্র নীরবে ঘুরিল
আবার আয়ুর পথে হৃদয় কাননে
কত শত আশা লতা শুকায়ে মরিল
হায়রে কব তা কারে, কবিতা কেমনে
কি সাহসে আবার তা রোপিব যতনে
সে বীজ, যে বীজ ভূতে বিভল হইল।’
বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের জন্ম(১৮৬১-১৯৪১ খ্রিস্টাব্দ) বৈশাখ মাসে।বৈশাখকে নিয়ে কবি অসংখ্য গান,কবিতা রচনা করেছেন।
কবির বৈশাখী গান ও কবিতার দিকে তাকালে মনে হবে তিনি বৈশাখী কবি।বৈশাখকে অভিবাদন জানিয়ে যে গান লিখেছেন সেটা বৈশাখী অনুষ্ঠানে না গাইলে যেন অসম্পূর্ণই থেকে যায়।বৈশাখকে বরণ করতে কবির কণ্ঠে –
‘এসো হে বৈশাখ, এসো এসো/তাপস নিঃশ্বাস বায়ে/মুমূর্ষুরে দাও উড়ায়ে/
বৎসরের আবর্জনা দূর হয়ে যাক যাক যাক/এসো এসো...’/
কল্পনা কাব্যের ‘বৈশাখ’ কবিতায় রবীন্দ্রনাথে রুদ্র,রুক্ষ বৈশাখ হিসেবে তুলে ধরেছেন,
‘হৈ ভৈরব, হে রুদ্র বৈশাখ,/
ধুলায় ধূসর রুক্ষ উড্ডীন পিঙ্গল জটাজাল,/তপঃক্লিষ্ট তপ্ত তনু, মুখে তুলি বিষাণ ভয়াল/কারে দাও ডাক-/
হে ভৈরব, হে রুদ্র বৈশাখ?’/
এ ছাড়াও রবীন্দ্রনাথের সেই বিখ্যাত কবিতা যা আমরা অনেকেই ছোট বেলায় মুখস্থ করেছি তা আজও গড়গড় করে বলতে পারি –
‘আমাদের ছোট নদী চলে বাঁকে বাঁকে/বৈশাখ মাসে তার হাঁটু জল থাকে/পার হয়ে যায় গোরু/পার হয় গাড়ি/দুই ধার উঁচু তার/ ঢালু তার পাড়ি।’
বিদ্রোহী কবি কাজী নজরুল ইসলাম (১৮৯৯-১৯৭৬ খ্রিস্টাব্দ) পুরাতনকে ছুঁড়ে ফেলে নতুনের জয়গান করতে বলেছেন--‘ঐ নূতনের কেতন ওড়ে কালবৈশাখীর ঝড়/তোরা সব জয়ধ্বনি কর/তোরা সব জয়ধ্বনি কর/ধ্বংস দেখে ভয় কেন তোর/প্রলয় নূতন সৃজন বেদন/আসছে নবীন জীবন ধারা অসুন্দরে করতে ছেদন/তাই যে এমন কেশে-বেশে মধুর হেসে/ভেঙে আবার গড়তে জানে সে চির সুন্দর।’/
আবার ‘কালবৈশাখী কবিতায় বলেছেন, ‘বারেবারে যথা কালবৈশাখী ব্যর্থ হল রে পুব-হাওয়ায়/দধীচি-হাড়ের বজ্র-বহ্নি বারেবারে যথা নিভিয়া যায়/কে পাগল সেথা যাস হাঁকি/বৈশাখী কালবৈশাখী!
আরেকটি গানে নজরুল তাঁর প্রেয়সীর বিরহে মগ্ন হয়ে বলেন, বৈশাখী ঝড়ের রাতে চমকিয়া উঠি জেগে/বুঝি অশান্ত মম আসিলে ঝড়ের বেগে/ ঝড় চলে যায় কেঁদে ঢালিয়া শ্রাবণ ধারা/ সে কি তুমি? সে কি তুমি?
মুসলিম রেনেসাঁর কবি ফররুখ আহমদ (১৯১৯-১৯৭৪ খ্রি.)
‘বৈশাখী’ কবিতায় চৈত্রের খরায় মাঠভরা নিষ্প্রাণ খড়কুটো উড়িয়ে নিয়ে যায় বৈশাখী ঘূর্ণিঝড়ে অর্থাৎ সকল অশুভের পরিসমাপ্তি ঘটুক ইস্রাফিলের শিংগার আওয়াজে যেরূপ প্রলয় ঘটে, সেরূপ বৈশাখী তান্ডবলীলার মাঝে। কবি লিখেছেন :
“বৈশাখের মরা মাঠ পড়ে থাকে নিস্পন্দ যখন নিষ্প্রাণ,/যখন ঘাস বিবর্ণ,নিস্প্রভ ময়দান,/যোজন যোজন পথ ধূলি-রুক্ষ, প্রান্তর, বিরান;/শুকনো খড়কুটো নিয়ে ঘূর্ণী ওঠে মৃত্যুর মতন;/সে আসে তখনি। তখনি তো ঘিরে ফেলে উপবন,/বন চোখের পলকে, মুছে ফেলে ঘুমন্ত নিখিল/সে আসে বিপুল বেগে। কণ্ঠে তার সুরে ইস্রাফিল/বজ্রস্বরে কথা কয়, জানে না সে গম্ভীর বন্ধন।/
কবি তার ‘বৈশাখের কালো ঘোড়া’ কবিতায় বৈশাখকে মহা শক্তির আধার হিসাবে উল্লেখ করে বলেছেন,
‘বৈশাখের কালো ঘোড়া উঠে এলো। বন্দর, শহর/পার হয়ে সেই ঘোড়া যাবে দূর কোকাফ মুলুকে,/অথবা চলার তালে ছুটে যাবে কেবলি সম্মুখে/প্রচ- আঘাতে পায়ে পিষে যাবে অরণ্য,/
পল্লীকবি জসীমউদ্দীনের (১৯০৩-১৯৭৬খ্রি.) ভাষায় বৈশাখের রুক্ষতা প্রকাশ করতে লিখেছেন,‘চৈত্র গেল ভীষণ খরায়, বোশেখ রোদে ফাটে,/এক ফোঁট জল মেঘ চোঁয়ায়ে নামলো না গাঁ’র বাটে।’/
নাগরিক কবি শামসুর রাহমান (১৯২৯-২০০৬ খ্রি.) বৈশাখকে দেখেছেন বস্তিবাসীদের দুঃখ- দুর্দশার প্রতীকরূপে কবির ভাষায়--
‘রাত্রি ফুরালে জ্বলে ওঠে দিন/
বাঘের থাবায় মরছে হরিণ/
কাল বোশেখের তা-বে কাঁপে পড়ো পড়ো চাল/শূন্য ভাঁড়ারে বাড়ন্ত চাল ইচ্ছে তার ইচ্ছে।’/
কবি আল মাহমুদ (১১ জুলাই ১৯৩৬-১৫ ফেব্রুয়ারি ২০১৯)‘বোশেখ মাসে এ কোন খরা’ কবিতায় বলেছেন,
‘ঋতুর রাজা বোশেখ এসো,/খোলো স্রোতের মুখ/
তৃষ্ণাকাতর হাজার বুকে/লাগুক পানির সুখ।’/
বৈশাখ যেমন আসে আনন্দের পসরা নিয়ে প্রকৃতির জীর্ণতাকে ধুয়ে-মুছে সাফ করতে, তেমনি জাতীয় জীবনের সংকীর্ণতা পায়ে মুছে মানবিক মূল্যবোধে উদ্দীপ্ত হতে হবে। বিজাতীয় অপসংস্কৃতি দূর করে জাতীয় জীবনে স্বকীয় চেতনা বিকাশে তৎপর হতে হবে। কবির ভাষায়: বন্ধু হও,শত্রু হও,যেখানে যে কেহ রও,/ক্ষমা করো আজিকার মত/ পুরাতন বছরের সাথে/পুরাতন অপরাধ যত।
বিভাগ : সাহিত্য
মন্তব্য করুন
আরও পড়ুন
নাটকীয় শেষ দশ মিনিটে দুই গোল শোধ করে বার্সাকে রুখে দিল সেল্তা
বিবর্ণ সিটিকে ইতিহাদেই বিধ্বস্ত করলো টটেনহ্যাম
নটিংহ্যামকে হারিয়ে চার ম্যাচের জয়খরা কাটালো আর্সেনাল
স্বতন্ত্র ইবতেদায়ী মাদরাসা জাতীয়করণের দাবী অত্যন্ত যৌক্তিক
পাঠ্যবই ছাপায় অনিয়মে আনন্দ প্রিন্টার্সকে সতর্কতা
দক্ষিণ লেবাননে ৬ চিকিৎসাকর্মী নিহত
জনগণের সাথে জনসংযোগ বাড়াতে হবে
আমরা যুদ্ধে বিশ্বাসী না কেউ গায়ে পড়লে জবাবের প্রস্তুতি রাখতে হবে: পররাষ্ট্র উপদেষ্টা
বাফুফের নতুন সভাপতি তাবিথের কাছে ২৭ রেফারির চিঠি
ফের বাড়লো সোনার দাম, ভরি ১ লাখ ৪২ হাজার টাকা
বাংলাদেশে খেলা নিয়ে অনিশ্চিয়তায় হামজা!
বঙ্গবন্ধু স্টেডিয়ামেই হবে অনূর্ধ্ব-২০ নারী সাফের খেলা
সিলেটে মাজিদের ফিফটি
অ্যাম্বাসেডর কাপ উশুতে সেনাবাহিনী চ্যাম্পিয়ন
মাদক শুধু ব্যক্তিকে নয় পরিবারকেও ধ্বংস করে
সাধারণ মানুষের পেটে লাথি মেরে আ.লীগ নিজেদের ভাগ্য গড়েছে : এমরান সালেহ প্রিন্স
ধর্মদ্রোহী সরকারের সময় কোনো ধর্মই নিরাপদ ছিল না
দৌলতখানে শীতকালীন সবজি পরিচর্যায় ব্যস্ত কৃষক
সুন্দরগঞ্জে ছয় পা বিশিষ্ট বাছুরের জন্ম
বৈষম্যের শিকার কুমিল্লার ১৫ হাজার এতিম শিশু