ফাগুনের তিনদিন
২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১২:১১ এএম | আপডেট: ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১২:১১ এএম
কর্মচঞ্চল রাজধানী শহর-ঢাকার ছেলে শাফিন। শৈশবের চাঞ্চল্য থেকে কৈশোরের চাপল্য পর্যন্ত সময় পার করেছে শহরের ধুলোবালি, যানজট আর কংক্রিটের আকাশছোঁয়ার প্রতিযোগিতা দেখে। শাফিনের পূর্বপুরুষ প্রদত্ত নিবাস পঞ্চগড় জেলার আটোয়ারী উপজেলায়। তবে তার জন্মের কিছুদিন পরেই বাবা-মায়ের সঙ্গে ঢাকায় এসে পাড়ি জমায় সে। মায়ের অফিস আর বাবার ব্যবসায়ের ব্যস্ততায় কখনো গ্রামে যাওয়া হয়নি তার। সুতরাং, শহরের উল্লেখযোগ্য ঐতিহাসিক স্থানগুলো দর্শন করলেও গ্রামীণ রহস্যময় সৌন্দর্য তার কাছে চিরদিন-ই অপরিচিত ছিল। তাই, এবারের ফাল্গুনের মাঝামাঝিতে প্রাণাধিক সুহৃদ আলিফের গ্রামের বাড়িতে গেলো বসন্তের ছুটি কাটাতে।
বরিশাল জেলার দ্বীপ উপজেলা নামে খ্যাত মেহেন্দিগঞ্জের একটি গ্রাম ‘চর মাধব রায়’। গ্রামের মধ্যস্থলে রঙিল দোচালা টিনের ঘর তাদের। স্থলপথে বাস, মোটরভ্যান আর নদীপথে নৌকাযোগে যখন তারা গ্রামে পৌঁছলো তখন ঘড়ির কাঁটা রাত দশটা অতিক্রম করেছে। সামনের ঘরে তাদের শোয়ার ব্যবস্থা করা হলো। সারাদিনের ভ্রমণক্লান্তিতে অসাড় শরীর নিদ্রাচ্ছন্ন হয়ে পড়লো মুহূর্তের মধ্যেই।
প্রত্যুষে শাফিনের ঘুম ভাঙলো সম্পূর্ণ অজ্ঞাতপূর্ব এক অভিজ্ঞতার মধ্য দিয়ে। ভোরের ক্ষীণ আলোয় খুপরির উপর দাঁড়িয়ে ডোরাকাটা পালকাবৃত ঝুঁটিওয়ালা একটি মোরগ অবিরাম ডেকেই চলেছে। কৌতূহলপরবশ হয়ে জানালা দিয়ে তাকিয়ে দেখলো সে। আলিফ ইতোমধ্যে উঠে গিয়েছে। সে-ও উঠে হাত-মুখ ধুয়ে দুজনে একত্রে মসজিদে গেলো। বয়োবৃদ্ধ ইমামের ভাঙাচোরা কণ্ঠের তেলাওয়াতে নামাজ শেষ করে বাইরে আসলো তারা। ভোরের আলোয় চারিদিক স্পষ্ট হয়ে গিয়েছে ততক্ষণে। বাজারে লোকসমাগম বাড়তে শুরু করেছে। স্থায়ী ব্যবসায়ীরা দোকানের ঝাঁপ-কপাট তুলছে, অস্থায়ীরা বস্তার তৈরি চাটাইয়ে বিক্রেয় দ্রব্যাদির উপর পানি ছিটিয়ে বেহুঁশ পণ্যগুলো হুঁশে আনছে, ক্রেতারা থলি হাতে এধার-ওধার খাঁটি বস্তুটির সন্ধান করছে। ক্রেতা-বিক্রেতার সুউচ্চ কোলাহল থামলো বেলা নয়টার দিকে। অত্যন্ত দ্রুততার সঙ্গেই যেনো বেচাকেনা শেষ হলো। শাফিনের কৌতূহল নিবৃত্ত করতে আলিফ বলল, গ্রামের জেলে-চাষি হোক আর ব্যবসায়ী-খরিদ্দার, সবই এরা। যারা এতক্ষণ উচ্চ কলরবে পণ্য বিক্রি করছিল আর যারা বিস্তর দরাদরি করে তা কিনছিল, সকলে এক্ষণে লাঙল-কোদাল নিয়ে মাঠে নামবে চাষবাস করতে। চাষাবাদই এদের জীবিকার্জনের প্রধান মাধ্যম। ‘শাফিন ভাবতে লাগলো, গ্রামীণ জীবন অত্যন্ত বিস্ময়করই বটে!’
উনিশ শতকের অন্যতম প্রবল খরস্রোতা নদী ‘কালাবদরের’ একাংশ গ্রামের পূর্বপ্রান্তে প্রবাহিত। ফাল্গুনে এসকল নদীবিধৌত অঞ্চলে খাল-বিলের পানি বাড়তে শুরু করে। নদী-খালের বর্ধিঞ্চু জলতরঙ্গে বসন্তের দ্বিপ্রহরে ছোট ছেলেমেয়েদের সাঁতার কাটার দৃশ্য বেশ উপভোগ্য। তীরসংলগ্ন উঁচু গাছের মগডাল থেকে লাফিয়ে পড়া, কাদা ছোঁড়াছুড়ি করা কিংবা পানির নিচে ডুব দিয়ে লুকোচুরি খেলা। গৃহকর্ত্রীকে লাঠিসোঁটা হাতে না দেখা পর্যন্ত এদের দুরন্তপনা অবাধে চলতে থাকে।
বিকেলে দুজনে গ্রাম ঘুরতে বের হলো । গ্রামের আঁকাবাঁকা সরু মাটির পথ। পথের একধারে সারি সারি গাছ। মেহগনি, রেইনট্রি, চাম্বল, গাব আর সুপারি গাছই চোখে পড়ে বেশি। গাছে গাছে নতুন সবুজ কিশলয় মৃদুমন্দ বাতাসে দুলছে। শাখে শাখে শত-সহস্র বসন্তপোকা সমস্বরে ঝিঁ-ঝি শব্দে কলরব করছে। পথের অন্যধারে তরঙ্গোচ্ছ্বসিত জলনালি সর্পিল গতিতে বয়ে চলেছে। প্রবল স্রোতে পাড় ধ্বসে গিয়ে কোথাও রাস্তার কিয়দংশ অবশিষ্ট আছে আবার কোথাও একনলা বাঁশের সাঁকো পার করতে হচ্ছে। অনভিজ্ঞ-আনাড়ি শাফিনের পক্ষে এই সাঁকোটুকু পাড় হওয়া ডিঙিনৌকা নিয়ে সমুদ্র পাড়ি দেওয়ার মতোই রোমাঞ্চকর। অপরাহ্ণের আকাশ স্বচ্ছ-পরিষ্কার, বর্ষার মেঘলা ভাব নেই তাতে; বৃষ্টির ঝঞ্ঝাটও নেই। গ্রামবাংলার কাঁচা মাটির রাস্তা, বৃষ্টি হলে হাটু সমান কাদা ডিঙিয়ে পথ চলতে হয়। অদূরে ছেলেমেয়েরা মাঠে খেলাধুলা করছে। কুতকুত, কানামাছি, বৌচি, এক্কা-দোক্কা, গোল্লাছুট ইত্যাদি কতো ধরনের খেলা। মাঠান্তে প্রকা- অশ্বত্থ গাছের আড়ালে সূর্য হারিয়ে যাওয়া পর্যন্ত দাড়িয়ে দেখলো দু’জনে।
পরদিন অপরাহ্নে নদী ভ্রমণে বের হলো তারা। পরিচিত এক জেলের কাছ থেকে ডিঙিনৌকা চেয়ে নিলো আলিফ। বসন্তের সূচনালগ্নে উত্তাল-অস্থির নদীর শান্ত-স্থির ভাব। কোথাও চওড়া, কোথাও সরু, কোথাও প্রাচীন দুর্গ দেয়ালের মতো পাড় খাড়া, কোথাও স্থলের সঙ্গে প্রায় সমতল। পাড় ঘেঁষে এঁকেবেঁকে নৌকা চলতে লাগলো। নদীর বুকে জীবনের সঞ্চালন; ছেলেমেয়েরা নদীতটে খেলাধুলা করছে, বধূরা কলসি কাঁকে জল তুলছে, জেলেরা নাইলনের সুতায় জাল বুনছে। মাছরাঙা, বক-ডাহুক শিকারের জন্য ওত পেতে আছে। ডিঙিনৌকা, খেয়ানৌকা, ট্রলার, লঞ্চ থেকে থেকে আসছে-যাচ্ছে। নদীর মাঝে ছোট ছোট চর, পালে-পালে মহিষ বিচরণ করছে সেখানে। শ’খানেক মহিষ প্রতিদিন নদীর এতটা অংশ সাঁতরে চরে গিয়ে ঘাস খেয়ে সন্ধে হলে আবার ফিরে আসে! অদ্ভুত কা- বটে!
সন্ধ্যাপূর্ব আকাশে পুঞ্জিভূত কালো মেঘ ঘনিয়ে এলো। বাতাসের বেগ বাড়তে শুরু করলো। শাফিন জানালায় দাঁড়িয়ে গৃহিণীদের কর্মক্ষিপ্রতা লক্ষ্য করতে লাগলো। বস্তুত, তার মনঃসংযোগ কথার দিকে নিবদ্ধ। গ্রাম্য মানুষের মুখে আঞ্চলিক শব্দ মকরন্দ অপেক্ষা অধিক শ্রুতিসুখকর। ‘আইল্লাডি’, ‘আইতœা’, ‘বাইশ্যা’, আরো কতো দুরূহ শব্দ সে শুনেছে যার মানে সে জানেনা। বোধহয় অভিধানবেত্তাগণও জানেন না। গতকাল যখন মাঠে দাঁড়িয়ে কৃষকদের হালচাষ দেখছিল তখন কেউ একজন বলল, “এই দুহাইররা রৌদে কোলার মইদ্দে খাড়াইয়া রইছো ক্যা মনু?” বিস্মৃত হওয়ার শঙ্কায় নোটপ্যাডে টুকে রেখেছিল। আলিফকে জিজ্ঞাসা করে এসব দুর্বোধ্য শব্দের অর্থোদ্ধার করতে হবে। প্রকৃতির চরিত্র পাল্টে গিয়েছে এতক্ষণে। ঝিরঝির বৃষ্টি মুহূর্তের মধ্যে মুষলধারে বইতে শুরু করেছে। প্রবল হাওয়া এসে বৃষ্টির ফোঁটাকে বিক্ষিপ্ত করে দিচ্ছে। বড় বড় গাছ উপড়ে পড়ার উপক্রম হয়েছে। সন্ধ্যার অন্ধকার বিদ্যুতের প্রবল ঝলকানিতে রৌদ্রস্নাত মধ্যাহ্নের মতো হয়ে যাচ্ছে। প্রকট বজ্রনাদে অন্তরিক্ষ ছিন্নভিন্ন হয়ে যাবে এক্ষুণি। শাফিন ভয়ে-আতঙ্কে কানে আঙুল দিলো, চোখের পাতা বন্ধ করে নিলো। এ দৃশ্য উপভোগ্য নয়। প্রকৃতির কি বীভৎস রূপ! এরূপ অবস্থা সম্পর্কেই সৃষ্টিকর্তা সতর্ক করে বলেন, “যেমন আকাশের বর্ষণমুখর মেঘ, যাতে আছে গাঢ় অন্ধকার, বজ্রধ্বনি ও বিদ্যুৎ চমক, বজ্রধ্বনিতে মৃত্যু ভয়ে তারা নিজেদের কানে আঙ্গুল ঢুকিয়ে দেয়।”
প্রভাতের গ্রাম পূর্বের মতো ছিলো না। স্থানে স্থানে মাটি ভেজা, সর্বত্র গাছের ভাঙাডাল আর কাঁচাপাতা ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে। সুপারি গাছ একটার উপর আরেকটা উপুড় হয়ে পথ আটকে রেখেছে। মেহগনি আর চাম্বল অধোমুখী হয়ে মাটির সঙ্গে ৩০, ৪৫, ৬০ ডিগ্রি কোণ উৎপন্ন করেছে। হাঁটতে হাঁটতে গ্রামান্তে গহিন অরণ্যে প্রবেশ করলো তারা। ঘন-বৃহৎ বন, দিনের বেলাতেও জায়গাটা কেমন অন্ধকার। কঙ্গোলিয়ান রেইন ফরেস্ট, আমাজন, সুন্দরবনের মতো কতো দুর্গম স্থানে রোমাঞ্চকর অভিযানের কথা পড়েছে শাফিন। শত-সহস্র প্রজাতির গাছগাছালি আর পশুপাখির অভয়ারণ্যে দাঁড়িয়ে তার অন্তর্জগতে শিহরণের সৃষ্টি হলো। এরকম অদ্ভুত বন-জঙ্গলের দৃশ্য সে কখনো দেখেনি। বন্যপ্রকৃতি এখানে আত্মহারা, লীলাময়ী, আপনার সৌন্দর্যে ও নিবিড় প্রাচুর্যে আপনি মুগ্ধ। সূর্য মাথার উপর চড়াও হতেই ফিরতে হলো তাদের। আজকেই তারা ঢাকার উদ্দেশ্যে রওয়ানা হবে। আসরের পরে ঘাট থেকে লঞ্চ ছেড়ে যায়। অন্তত, ঘন্টাখানেক আগে বাড়ি থেকে বের হওয়া চাই।
রাত তখন প্রায় দুটো। আলিফ ঘুমাতে গেলো কিছুক্ষণ আগেই। লঞ্চের বারান্দায় কেবিনের সামনের চেয়ারে বসে আছে শাফিন। পূর্ণিমার জ্যোৎস্নাময়ী আলোতে নদীর পানি ঝিলমিল করছে। আকাশে- কালপুরুষ, সপ্তর্ষি, বৃশ্চিক, ক্যাসিওপিয়া মিটমিট করে জ্বলছে। তীরের দিকে তাকালে মনে হয় জলের সীমার মাটির তীরভূমিও বুঝি লঘু গতিতে চলছে পেছনে। আকাশের রঙিন-ভাসমান মেঘ, ভাঙ্গন-ধরা তীরে শুভ্র কাশ ও শ্যামল তনু, নদীবুকের নগণ্য কচুরিপানা উপেক্ষা করে ভেসে চলছে তারা---গন্তব্য বহুদূর।
বিভাগ : সাহিত্য
মন্তব্য করুন
আরও পড়ুন
নাটকীয় শেষ দশ মিনিটে দুই গোল শোধ করে বার্সাকে রুখে দিল সেল্তা
বিবর্ণ সিটিকে ইতিহাদেই বিধ্বস্ত করলো টটেনহ্যাম
নটিংহ্যামকে হারিয়ে চার ম্যাচের জয়খরা কাটালো আর্সেনাল
স্বতন্ত্র ইবতেদায়ী মাদরাসা জাতীয়করণের দাবী অত্যন্ত যৌক্তিক
পাঠ্যবই ছাপায় অনিয়মে আনন্দ প্রিন্টার্সকে সতর্কতা
দক্ষিণ লেবাননে ৬ চিকিৎসাকর্মী নিহত
জনগণের সাথে জনসংযোগ বাড়াতে হবে
আমরা যুদ্ধে বিশ্বাসী না কেউ গায়ে পড়লে জবাবের প্রস্তুতি রাখতে হবে: পররাষ্ট্র উপদেষ্টা
বাফুফের নতুন সভাপতি তাবিথের কাছে ২৭ রেফারির চিঠি
ফের বাড়লো সোনার দাম, ভরি ১ লাখ ৪২ হাজার টাকা
বাংলাদেশে খেলা নিয়ে অনিশ্চিয়তায় হামজা!
বঙ্গবন্ধু স্টেডিয়ামেই হবে অনূর্ধ্ব-২০ নারী সাফের খেলা
সিলেটে মাজিদের ফিফটি
অ্যাম্বাসেডর কাপ উশুতে সেনাবাহিনী চ্যাম্পিয়ন
মাদক শুধু ব্যক্তিকে নয় পরিবারকেও ধ্বংস করে
সাধারণ মানুষের পেটে লাথি মেরে আ.লীগ নিজেদের ভাগ্য গড়েছে : এমরান সালেহ প্রিন্স
ধর্মদ্রোহী সরকারের সময় কোনো ধর্মই নিরাপদ ছিল না
দৌলতখানে শীতকালীন সবজি পরিচর্যায় ব্যস্ত কৃষক
সুন্দরগঞ্জে ছয় পা বিশিষ্ট বাছুরের জন্ম
বৈষম্যের শিকার কুমিল্লার ১৫ হাজার এতিম শিশু